যম রাজ্যে নতুন নিয়ম
মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়
কিরে লম্বা লম্বা পা ঝুলিয়ে কি ভাবছিস? আমিতো ভাই এপারে চলে আসার পর চিন্তাভাবনা করা একদম ছেড়ে দিয়েছি। কেন ভাবতে যাবো বল। পাত্র'দা বলল, "গজু, তোর এলাকায় বলে দে কোনরকমে নিজের বাপের দেওয়া নামটা পরীক্ষার খাতায় লিখে দিতে পারলেই মাস ফুরালে কড়কড়ে কুড়ি হাজার পকেটে। আর বাকিটা পার্টি ফান্ডের চাঁদা, দেশসেবার কাজে উৎসর্গ করার জন্যে। অবশ্য শুরুতে দুই, পকেট বুঝে আড়াই-তিন। কিন্তু তার থেকে এক নয়া পয়সাও কোনভাবেই বেশী নয়। আরে আমাদের তো একটা নীতি আছে নাকি? পার্টির ইমেজের সাথে কোন সমঝোতা নেই। আগের গুলোর তো লাজ লজ্জা বলে কিছু ছিলনা শুধু লুটপাট আর ফতুয়া গায়ে চাপিয়ে বড় বড় ভাষণ।"
কিন্তু সবকিছু বাটি,ঘটি,জমিজমা বেঁচে সেই শুধু আমারা কজনাইতো অবশেষে গলায় দড়ি দিয়ে এখানে আসতে বাধ্য হলুম।
"আরে তোমরা দুজনে কড়িকাঠে ঝুলে,আর আমিতো ধার দেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে শেষে একবোতল ফলিডল খেয়ে-", গর্জে উঠল পেঁচো।মানে মর্তের পঞ্চানন গড়করি। মুর্শিদাবাদের ডোমজুর এলাকার শেখ আতারই সরলাবালা প্রাথমিক স্কুলের গ্রুপ ডি পাঁচুগোপাল গড়করির পাঁচ সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ।মেয়ে মেয়ে করে চার চারটিই পরে বংশের সলতে বলতে এই একটিই ছিল।প্রাথমিক স্কুলের চাকরির পরীক্ষায় আট কাঠা বাস্তু জমি জলের দরে বেঁচে সর্বসাকুল্যে চার লাখ টাকা। তার থেকে আড়াই লাখ পঞ্চায়েত প্রধানের ছেলে মিজানুর কে দিলাম চাকরি পাইয়ে দেবে এই আশ্বাসে। বাপে বারবার পইপই করে বারণ করলে।এমনকি এও বললে যে," আরতো বছর তিনেক চাকরি আছে।বাকি দুবছর আরো করে নিয়ে এক বছর বাকি থাকতে ইচ্ছা করে এক্সপ্রেস ট্রেনের তলায় শুয়ে পরবো। সরকারের কাছে এক্সিডেন্টাল কেসে মৃত্যু দেখালেই আমার পোষ্টে চাকরিটা পেয়ে যাবি। বয়স তো কম হলোনা। বাপ কাকার দেওয়া হিসাব মতো গত বছরেই সত্তর পার হয়ে গেছে। আমাদের সময় তো জন্মের সার্টিফিকেটের বালাইও ছিলনা।তাহলে বাহাত্তর বছর বেঁচে থাকার পর আর কি দরকার। তার জায়গায় যদি ছেলে আরও পয়ত্রিশ বছর সরকারি চাকরি করতে পারে তাহলে এর থেকে লোভনীয় সুযোগ আর দ্বিতীয় কিইবা হতে পারে।"
ঐযে গীতায় বলা আছে না গুরুজনের কথা সর্বদা মেনে চলবে। আজকে বাপের কথা শুনলে আমার জায়গায় তোদের পাশে আমার বাপ বসে উল্টো পা ঝোলাতো।
আরে থামতো।কি হতে পারতো আর কি হয়েছে এসব আবোলতাবোল সাত সতেরো ভেবে হাড়ে দূব্বো গজিয়ে লাভ নেই।বরং মর্তের কথা ছেড়ে এখানকার মতো করে এখন থেকে ভাবতে হবে।ঐ ব্যাটা জন্মের বুড়ো চিত্যগুপ্তটা হাড়বজ্জাদ। একটু হাত পা দুটো টিপে দিলে দেখবি কড়াই এর তেলটা কম গরম থাকে।
কি করে বুঝলি?
আরে প্রথম দুদিন নরমাল তেলেই ভাজছিল।কিন্তু আজকে সকালে একটু মোটা গলায় বলেছিলাম," কি দাদু তোমার কি রিটায়ারমেন্ট বলে কিছু নেই?" একটু ইয়ার্কিই করেছিলাম।ভেবেছিলাম বয়সে তো আমি ওঁর তস্য নাতির থেকেও ছোট তাই হয়তো কিছু মনে করবে না।কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওর ঐ জাবদা খাতায় কিসব হিজিবিজি কাটল আর বললো পাপের বোঝা নাকি আধ মণ বেড়ে গেছে।ব্যাস পাশের বড় কড়াইটার মধ্যে আরও আধা ঘন্টা বেশি ভেজে তুললো।আত্মাটাকে পুরো বেগুনের ভর্তা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ব্যাটা আমাকেও চেনেনা। ওর ঐ খাতায় গড়মিল করিয়ে দিয়ে যম' কাকু কে দিয়ে যদি না বুড়োকে কেস খাইয়াছি তো আমার নামও গজানন বিশ্বাস নয়।
বাপরে তোর ঐ কুম্ভকর্ণটাকে কাকু বলে ভাবতে ভালো লাগে। কৈলাসে শিবের যাঁড়টাকেও ওর থেকে বেশী সুন্দর দেখতে।
আরে নাড়ু, আস্তে বল যমের চেলাগুলো সবসময় কান খাঁড়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।কিছু একটা বেফাঁস শুনে নিলেই বুড়ো টিকটিকিটাও কাছে খবর পৌঁছে যাবে আর বৃদ্ধ মরা পোকা খুঁটে খাওয়া টিকটিকিটা সঙ্গে সঙ্গে শাস্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে।
তুই গত পরশু লক্ষ্য করেছিলি? আরে ঐ যে ফর্সা করে বাপের বয়সি আত্মাটা,একটু জিজ্ঞেস করেছিল যে কিসের অপরাধে তাকে আজ অতিরিক্ত এক ঘন্টা কড়া রোদে লোহার উঠোনে ফেলে সেঁকা হচ্ছে? ব্যাস ওমনি সময় আরো দুই ঘন্টা বাড়িয়ে দেওয়া হলো।
ঠিক বলেছিস। সেই জন্যেই ভাবছিলাম এরকম ফর্সা একটা আত্মা হঠাৎ করে এতো কালো হয়ে গেল কিভাবে!! এখন তোর কথা শুনে সব জলের মতো পরিস্কার।নাঃ, গজা একদম ঠিক বলেছে।একটা কিছু না করলেই নয়।বড্ড বাড় বেড়েছে এগুলোর।একটু টাইট না দিলে দিনকে দিন বাড়তেই থাকবে।এর থেকে আমাদের মর্ত্যলোকেই অনেক ভালো ছিল রে।যা ইচ্ছা করো কুছ পরোয়া নেই।শুধু দু-চারটে পলিটিকাল দাদার সুনজরে থাকতে হবে, ব্যাস লে ফুর্তি চেটেপুটে।
তোর ঐ পলিটিকাল দাদাদের কথা আর বলিস নাতো।ঐ গিরগিটি গুলোর জন্যেই তো আজ আমাদের এই অবস্থা।ওদের স্বপ্ন দেখানো ফাঁদে পা না দিলে আজ এই দিন দেখতে হতো?কত তেলেভাজা খেয়েছি মর্তে থাকতে।তখন কি দুঃস্বপ্নেও ভেবেছি যে মরার পরে যমালয়ে এসে নিজেদেরকেই তেলেভাজা হতে হবে?
আচ্ছা এখানে এই যন্ত্রণা আর কতদিন সহ্য করতে হবে বলতো? আমরা কি আর মর্তে কখনওই ফিরতে পারবোনা?
কি করে ফিরবি, নিজের পাপের মাত্রাটা কখনো একবার মেপে দেখেছিস।মর্তলোকে থাকতে সব এক একটা রাজা ছিলি নিজের এলাকায়।ছোট, বড় বুড়ি, ছুড়ি কাউকে রেহাই দিতেছিস? এখন দেখ সেইসব অগুনতি পাপের বোঝা থেকে কবে মুক্তি পাওয়া যায়।
আদৌ পাওয়া যাবে তো??
কি করে বলবো।একমাত্র ঐ বুড়ো সজনে ডাঁটা-টাই বলতে পারতো।কিন্তু জিজ্ঞেস করার তো জো নেই।সোজা তেলের উষ্ণতা বাড়িয়ে দেবে।তবে আমিও ওকে ছাড়বোনা।এখান থেকে যাওয়ার আগে এমন কলকাঠি নাড়বো যে ব্যাটাকে লজ্জার মাথা খেয়ে বাধ্য হয়ে রিটায়ার করতে হবে। ওঃ, সেদিনটা যা মজা হবেনা মাইরি। ভেবেই তো উল্টো পায়ে ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু না এখন নাচবো না, আগে ব্যাটাকে উচিত শিক্ষা দিই তারপরে নাচ কাকে বলে দেখবি। ঐ ব্যাটা আঙ্কেলটাকেও টাকের ওপরে কষে চারটে গাট্টা মারতে হবে। মর্ত্যে এতো বয়স্ক লোক রয়েছে যারা খাবার না পেয়ে, রোগে ভুগে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেড়াচ্ছে। সদা সর্বদা নিজের মৃত্যু কামনা করছে, সেগুলোকে খুঁজে পায়না?? তা না, আমাদের মতো সদ্য কুড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটে ওঠা শক্ত সমর্থ উঠতি জোয়ান ছেলেগুলোকে তুলে নিয়ে চলে এলি? এই নাকি তোর বিচার? একটু খেলছিলাম,তা খেলতে দেনা ভাই। তাতে তোর বাপের কি??
আরে গুরু, একটা কথাতো ঠিক বলেছিস। আচ্ছা এই কালো ধুমসো মোষটার বাবাটা কে বলতো??
কি করে বলবো বল, যমের বাবার নাম কোনো শাস্ত্রেই তো কোথাও উল্লেখ আছে বলে জানা নেই।
কে আবার হবে, ঐ পরমপিতা ব্রহ্মাই হবে।কিন্তু ব্রহ্মাতো আমাদেরকেও সৃষ্টি করেছেন। আর সেই সুত্রে সেক্ষেত্রে সম্পর্কে তো আমরা যম'দার আপন ভাই।
বেড়ে বলেছিস তো। আগে তো এটা মাথায় আসেনি। যম'দাকে এই জায়গায় একটু সুরসুরি দিয়ে দেখতে হবে। যদি কাজে লেগে যায় তো দেখ চিত্য টিকটিকি তোর চাকরিটা কিভাবে খাই।প্রচুর ভেজেছিস তেলে। এইবার তোকে কিভাবে ছাঁকা তেলে ভাজবো দেখ।
অবশ্য গুরু মুখরোচক হবেনা, যা দড়ি পাকানো চেহারা। শাঁস বলে তো কিছু নেই শরীরে। জলঢোড়ার শরীরেও এর থেকে বেশি খাদ্যবস্তু থাকে।
যা বলেছিস। যম'দাকে দেখতো আশেপাশে দেখা যায় কিনা। একবার দেখা পেলেই সম্পর্কটাকে একটু বেশি করে মাখন মাখিয়ে মুখের সামনে একদম প্লেটে সাজিয়ে বেড়ে দিতে হবে। যতো শুকবে ততো জাল গোটানো শুরু। আর একবার যদি সম্পর্কটাকে ওর ঐ ভোঁতা মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তো লে ছক্কা। পুরো মহারাজ। এক পা এগিয়ে এসে বা-হাতে ফুলটস বানিয়ে নিয়ে সোজা লং-অনের উপর দিয়ে মাঠের বাইরে, বল রূপী ঐ শুটকি কাঠ ঠোকরা,চিত্য। প্রচুর ঠুকরেছিস গত দুদিনে।এইবার বদলা কাকে বলে দেখবি।
এই তোরা তিনজনে এখানে কি করছিস রে। তোদের বিরুদ্ধে নালিশ আছে, তোরা তিনজনে নাকি সারাক্ষণ গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে বেড়াস। কিসের এতো শলা পরামর্শ তোদের??
আরে এ যে মেঘ না চাইতেই জল। ওঃ, আমাদের কি ভাগ্য। স্বয়ং আমাদের পরম শ্রদ্ধেও বড় ভাই আমাদের সামনে দাড়িয়ে। শিগগির প্রণাম কর সবাই দাদার রাতুল চরণে।
এই কি মতলব রে তোদের?? আমি আবার কবে থেকে তোদের দাদা হলাম?? এই শোন,কোনও রকম পেয়াজি নয় কিন্তু। একদম আলকাতরায় আস্ত ভেজে পচা পুকুরে চোবাবো। আমার কোনো ভাই-টাই নেই। একটাই শুধু বোন আছে, যমুনা। কিন্তু দুনিয়ার যতো নোংরা আবর্জনা ফেলে আমার বোনটার তোরা মর্তবাসী যা হাল করেছিস, মাঝেমধ্যে মনে হয় তোদের সবকটাকে একসাথে গরম তেলে পেয়াজি ভেজে কুড়মুড় করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি।ভাইফোঁটায় প্রতিবার ফোঁটা দিতে আসে, পাশে দুর্গন্ধে বসা যায়না। কিছু বলাও যায়না, শত হলেও আপন বাপের পেটের দিদি বলে কথা।নিজের বলতে তো ঐ একজনই আছে না।
কে বললো যম'দা,আছে তো। তোমার এই, যেটা বললে, বাপের পেটের তিন ভাই।
আবার মতলব?? এবার কিন্তু রাগে ব্রহ্মতালুতে আগুন ধরে যাবে বলে দিচ্ছি।
আরে যম'দা, খামোকাই উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছ। একটু শান্ত হও, সব বুঝিয়ে বলছি। দেখো যেটা সত্যি সেটাতো জোড় করে অস্বীকার করা যাবেনা না? সবটা ধৈর্য ধরে একটু শান্ত হয়ে শোনো। সব তোমার কাছে জলের মতো পরিস্কার হয়ে যাবে। তুমিই বলো পরমপিতা ব্রহ্মা তোমার কে হয়, বাবা? কারণ তিনি তোমাকে তৈরি করেছেন। এবার তাহলে তুমি বলো, আমাদের এই তিনজনকে সৃষ্টি করেছেন কে? ভেরি সিম্পল, স্বয়ং ব্রহ্মা। তাহলে তুমি আমাদের তিনজনের কে হলে? ভেরি ভেরি সিম্পল, বড় ভাই। একদম রামায়নের সেই জগত বিখ্যাত চার ভাই, তুমি শ্রী রাম, আর আমরা, আমি গজা,পেঁচো আর নাড়ু-তোমার পরম আদরের তিন ছোটো ভাই, লক্ষণ,ভরত আর শত্রুঘ্ন।
আমি শ্রী রাম!!বলছিস?? ব্যাপারটা তো আগে ভেবে দেখা হয়নি কখনো। হুঃ, কথাটার মধ্যে একটা, ইয়ে তোদের ভাষায় কি যেন বলে না বেশ...,
আরে রাম'দা, ইয়ে মানে যম'দা ওটাকে বলে লজিক।
হ্যা হ্যা, ঐ ঐ,লজিক। আর এইমাত্র কি একটা নামে যেন ডাকলি বেশ, হ্যা হ্যা স্পষ্ট শুনেছি রাম'দা। এই এটা কিন্তু একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কোথায় রাম'দা আর কোথায় আমি-, মৃত্যুলোকের অধিপতি যম।
কি যে বলো বড়'দা, 'রাম', নামটা কোথা থেকে এসেছে একবার একটু স্মরণ করে দেখো। দস্যু রত্নাকর প্রথমে 'মরা' দিয়ে শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে মরা'ই উল্টে হয়ে গেলো রাম। আর তুমিতো মৃত আত্নাদেরই সামলাও। তার মানে যে যম সেই রাম, ভেরি সিম্পল।
তাহলে আজ থেকে নিজেকে 'রাম' বলে ভাবতে পারি বলছিস? পুরুষোত্তম রাম,ওঃ, ভাবতেই কেমন যেন একটা রোমাঞ্চ হচ্ছে। ঐ ব্যাটা 'গুপ্ত', কোনদিনও এটা আমাকে বোঝালো না। সারাদিন শুধু তেলেভাজা নিয়েই ব্যস্ত!!
আরে যম'দা, তুমি ঐ লোকটার সাথে এতদিন একসাথে আছো কি করে? আজকে ঐ লোকটার জন্যেই মর্ত্যলোকে তোমার যত বদনাম। যমলোক শুনলেই লোকে ভয়ে সিঁটকে যায়। অথচ দেখো দেবলোকে সারাক্ষণ নাচ গান হৈ-হুল্লোর আর শুধুই মজা। আরে ওদের মতো তুমিও তো একজন প্রথম সারির দেবতা। মা দূর্গাকে মহিষাসুর কে বধ করতে যুদ্ধে পাঠানোর সময় তুমি দিয়েছো কালদন্ড। অথচ মর্তবাসীর কাছে তোমার প্রতি কোন শ্রদ্ধাই নেই। সেখানে পাড়ায় পাড়ায় দেখো বাকি সব দেবতাদের পুজো হচ্ছে ধুমধাম করে।ঐ একটা লোক,চিত্যগুপ্ত তোমার ইমেজটাকে গুপ্ত রেখে একেবারে তেলেভাজা বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তুমি ওকে এতকাল ধরে সহ্য করছো কি করে, আমার তো মাথাতেই ঢুকছে না।
আমাদেরও ঠিক তাই। যম'দা ঐ লোকটাকে এবার একটু পাল্টে অন্য কাউকে কিছুদিনের জন্যে দায়িত্ব দিয়ে দেখো। আমরা নিশ্চিত তুমিই হবে আগামী দিনে স্বর্গের অধিপতি।
বলছিস সেক্ষেত্রে একটা সুযোগ আছে?আরে তোরা তো একদম আমার মনের বহুদিনের সুপ্ত ইচ্ছাটাই ধরে ফেলেছিস দেখছি।
আরে যম'দা, কোথায় তোমার এইরকম তাগড়া উঁচু লম্বা শরীর, আর কোথায় দেবরাজ ইন্দ্র। তুমি সারাদিন কাজ করে দম নেওয়ার সময় পাচ্ছোনা। প্রতিমুহূর্তে হাজার খানেক করে বিভিন্ন পাপি তাপি আত্মা এসে মরাকান্না জুড়ে দিচ্ছে আর দেবলোকে দেখো কোন কাজই নেই। শুধুই আয়েস আর আরাম। নাচ, গান আর দেদার ফুর্তি। অথচ ওদেরই দেখো মর্তলোকে জয় জয়কার। ওদের উদ্দেশ্যেই সবাই পুজো দিচ্ছে, বিভিন্ন দামী দামী ভেট চড়াচ্ছে আর ওদের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্যে সারাক্ষণ কাকুতি মিনতি করে যাচ্ছে।আর সবটাই করছে শুধুমাত্র তোমার হাত থেকে বা বলতে পারো নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে।
একদম ঠিক বলেছিস। তোরা তিনজনে আজ এত যুগ বাদে আমার চোখ খুলে দিয়েছিস। ঐ 'গুপ্তর' জন্যেই আজ আমার এই দুর্দশা। কিন্তু ওর জায়গায় দায়িত্ব দেবো কাকে। বাকি সবকটাই তো এক একটা গন্ড মূর্খ। খাতায় যে পাপের হিসেব লিখে রাখবে সেটাও তো ওগুলোকে দিয়ে হবেনা। খুবই চিন্তায় পরে গেলাম রে। আবার ঐ গুপ্তটাকে না সরালেও নয়। আমার সুনামটাকে পুরো তেলেভাজা বানিয়ে ছেড়েছে।
বড়'দা যদি কিছু মনে না করো, তাহলে ছোট মুখে বড় কথা, আমরা তোমার সেবা করার সুযোগ পাবো কবে দাদা। এই ভাইগুলোকে একবার দায়িত্ব দিয়ে দেখো, তোমাকে যদি দেবলোকের দেবরাজ না বানিয়ে দিয়েছি তো আমাদের তুমি গরম তেলে বাকি জীবনটা চুবিয়ে রেখো।
ওরে না রে, তোরা আজ আমার পুরো চোখ খুলে দিয়েছিস। এতদিন আমি পুরো অন্ধ ছিলাম, আর সেটা ঐ গুপ্তর জন্যে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমি স্বর্গের রাজ সিংহাসনে বসে আছি আর মর্ত্যে সমস্ত পাড়ায় পাড়ায় শুধু আমার পুজোপাঠ চলছে।
আর বড়'দা চারদিকে শুধু ধ্বণিত হচ্ছে, "জয়, মহারাজ যমরাজের জয়"।
ওরে আমার ভাই আমার বুকে আয় তোরা। এতদিন কোথায় ছিলি রে?
ওরে বাবা কি বোটকা গন্ধ!! জন্মানোর পর থেকে মনে হয় আজ অবধি স্নান করেনি। আর বলে কিনা আমরা ওর দিদিকে নোংরা করেছি। দিদির গায়ে দুর্গন্ধ।
আর গায়ের লোমগুলো যেন খাড়া খাড়া সজারুর কাটা। বুকে বিঁধে যাওয়ার জোগাড় রে গজা।
ওরে চুপ কর তোরা। স্বপ্নের ঘোরে রয়েছে তাই শুনতে পাচ্ছেনা। শুনতে পেলে আর রক্ষা নেই। কত বিচিত্র তেলে যে কত বিচিত্রভাবে ভাজবে সেটা বোঝার চেষ্টা কর।
ওঃ, তোদের বুকে জড়িয়ে ধরে যেন শরীরে আলাদা করে শক্তি খুঁজে পাচ্ছি। তাহলে তোরা এখন থেকেই কাজে লেগে পর। তবে দেখিস, তোরা কিন্তু কথা দিয়েছিস আমাকে স্বর্গের অধিপতি বানিয়ে দিবি। কাজের ফাঁকে ওটাও মাথায় রাখিস। ওদিকে গুপ্তটার কি ব্যবস্থা করা যায় বলতো?
আরে বড়'দা, ওটা আমাদের উপরে ছেড়ে দাও। তবে বড়'দা, ওর একটা ছোটখাট শাস্তি পাওয়া খুব দরকার।আজকে তুমি সুনাম পাওনি শুধুমাত্র ওর বিকৃত বুদ্ধির জন্য।
সেটাতো বুঝতে পারছি। তবে বয়সের কথা ভেবে য়াই করিসনা কেন একটু ভেবে চিন্তে করিস। মেরে ফেলিসনা আবার। এই যমলোকে আজ পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
ঠিক আছে বড়'দা, আমরা দেখে নিচ্ছি পুরো ব্যাপারটা। তুমি একদম নিশ্চিন্তে তোমার স্বর্গের রাস্তাটা প্রশস্ত করো।
এইবার দেখ কাকে বলে মজা। এই ব্যাটা মামদো, এদিকে আয়। এখানকার নিয়ম কানুনে কিছু রদবদল হয়েছে জানিসতো? এখন থেকে আমরা এই তিনজন যা যা বলবো সেটাই হবে এখানকার আইন। ঐ বুড়ো টিকটিকি চিত্য ব্যাটাকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে আয়। বহুত ভেজেছে, এবার কে কাকে ভাজবে সেটা ও টের পাবে।
ছোটে ওস্তাদ স্যার, ওটাকে কি কান ধরে হিরহির করে টেনে নিয়ে আসবো? আমারও প্রচুর ক্ষোভ জমে আছে ওর উপর।
যেভাবে খুশি নিয়ে আয়, তবে দেখিস যেন চোট আঘাত না লাগে।যম'দাকে কথা দিয়েছি, শিক্ষাটাই শুধু দেবো, কোনরকম আঘাত নয়।
ঠিক আছে ছোটে ওস্তাদ স্যার। আমি এখুনি যেখান থেকে পারি ওকে ধরে নিয়ে আসছি। ব্যাটা মনে হয় কোথাও গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। তবে ও ভালো মতই জানে এখানে কোনো লুকানোর জায়গা নেই। পালিয়ে যাবে কোথায়।
এই ছাড় বলছি, ছাড় আমাকে। আরে কি হলো কানটা কি খুলে নিবি নাকি?
খুলে নেওয়াই উচিত।তুমি আমার সাথে যা ব্যবহার করেছ আমি জীবনে ভুলবো না। তুমি আমার জায়গায় ব্রহ্মদৈত্যকে মাতব্বর বানিয়ে দিলে। আর আমার কোনও প্রমোশন হলোনা। সেই আসার পর থেকে তিন যুগ ধরে শুধু তেলেভাজাই ভেজে চলেছি। এখানে কাজ বলতে তো শুধুই বড় বড় লোহার কড়াইতে গরম তেলে চুবিয়ে ভাজো আর তোলো। আত্মা গুলোর যন্ত্রণায় ছটফটানির চোটে ছিটকানো গরম তেলে প্রতিদিন হাড়ে অগুনতি ফোসকা পড়ে আর যন্ত্রণায় ছটফট করি।এবার দেখো, ছোটে ওস্তাদ স্যার তোমার কি হাল করে।
নিয়ে এসেছিস? বেশ করেছিস। কিরে টিকটিকি চিত্য, ভালোবেসে দাদু ডেকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম আর তার বদলে আরো আধ ঘন্টা গরম তেলে ভেজে তুলে ছিলি, মনে পরে?এবার তোর ঘুণে ধরা হাড়ে কি চাষ করি দেখ।মামদোওওওও....।
বলুন ছোটে ওস্তাদ।
এটাকে তেলে ভেজে তেল নষ্ট করে লাভ নেই।তেলের প্রচুর দাম তার থেকে একটা বিনে পয়সার শাস্তি খুঁজে বার করতে হবে। হ্যা, একটা মোক্ষম পাওয়া গেছে। এটাকে কান ধরে উঠবোস করা যতক্ষণ না তোর ঘুম পায়।
এই, এটা কিন্তু ঘোর অন্যায় হচ্ছে। মামদো কবে আবার ঘুমিয়েছে? ওর তো কোটরে চোখই নেই, ঘুম আসবে কোথা থেকে?
এই বুড়ো থামবি? তুই যখন শাস্তি দিতিস ভেবে দেখতিস? মামদো, কোনও সহানুভূতি নয় তুই শুরু করে দে। বেশি চেল্লালে মুখে একটা তেলেভাজা গুঁজে দিবি।
দাড়া, কোথা থেকে উড়ে এসে ঐ গবেট-টার মাথা ভেজে আমার জায়গায় জুড়ে বসেছিস। আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো। আমি ত্রিদেবের সাথে দেখা করবো।
সেগুড়ে বালি। আগে কান থেকে হাত সরিয়ে তো দেখা। মামদো, কান থেকে হাত সরালেই গরম তেলে হাত দুটো কড়া করে ভেজে দিবি,বুড়োর হাড়ে বহুত তেল জমেছে।সব তেল নিংড়ে বের করে নেবো।শোন মামদো মিনিটে একশ কুড়িবার করে উঠবস করাবি। একচুলও যেন এদিক ওদিক না হয়। আর তোর প্রমোশনের ব্যাপারটা নিয়ে শিঘ্রই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবো।
এখন আগের সেই অবৈজ্ঞানিক বস্তা পঁচা নিয়ম আর মর্তবাসীর জন্যে নেই। এখন মানুষের গড় আয়ু পচাঁত্তর। যা কিছু মৃত্যু,অপমৃত্যু সব পচাঁত্তরের পরে। সমস্ত মর্তবাসী স্বাভাবিক ভাবেই খুব খুশি। কোনো বাবা-মা,কেই আর সন্তানের মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছেনা। সবাই এখন পাড়ায় পাড়ায় প্রতি শনিবারে শনিদেবের বদলে যমদেবের ধুমধাম করে পুজো করে।সমস্যা দেখা দিয়েছে দেবলোকে। ইন্দ্রের সভায় আর নাচ গান হয়না। ভিড়ভাট্টা নেই। যমলোকে নিত্য রম্ভা, মেনকা, উর্বশী'দের আনাগোনা।।
-----×××-----
ঠিকানাঃ
MRINAL BANDYOPADHYAY,
KAMPA PURBAPARA,
VILL. AND P.O. KAMPA,
DIST. 24 PGS (NORTH),