প্রবন্ধ ।। সাইমন লিস্ট - ব্যাবিলনে অগ্নিদাহ ।। রণেশ রায়
সাইমন লিস্ট
ব্যাবিলনে অগ্নিদাহ
মুখবন্ধ
ক্লাইভ লয়েড
বইটা যখন আমি পড়ি কত না বিস্মৃত অতীত আমার স্মৃতিতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে l স্থান কাল পাত্র সবিশেষে টুকরো টুকরো আলাপচারিতা মনে পড়ে যায় যা গাঁথা থাকে আমার স্মৃতিতে l মাঠের সাজঘর, বিমান বন্দরের অপেক্ষাগার, হোটেলের বারান্দার বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া দৃশ্যগুলো বিস্মৃতির অতল থেকে ভেসে আসে স্মৃতির দৃশ্য পটে l আজ মনে পড়ে যায় সেসবই l পাকিস্থানের গিরিপথ, কিছুটা কম বিপজ্জনক নটিং হাম থেকে সোয়ানসির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সেই বাস যাত্রা। গোয়েল গার্নারের মিষ্টি গভীর হাসি, আলভিন কালিচরণের মনমাতান চুটকিগুলো যেন কানে শুনি।আবার আমি দেখি ভিভের চোখের সেই প্রত্যয়ী দৃষ্টি যা বলে আজ দিনটা আমারই। এক চমকে দেসমন হেনসের দুষ্টুমিভরা চোখের ইশারা আমি পাই যা বলে দেয় কোথাও পৃথিবীর কোন এক কোণে কোন এক মজার খেলা চলছে নিশ্চয়।
বড় বড় খেলার ছোট্ট ছোট্ট টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলোও আমার মনের দৃষ্টিতে ফিরে আসে। মেলবর্নের টেষ্টে আমি গার্ড নিয়ে অপেক্ষায়।ডেনিস লিলি যেন দৌড়ে আসে, এই বুঝি এক ভয়ানক বিপত্তি ! এক্ষুনি আগুন ঝরবে। আগুন বৃষ্টির সে তাপ আমি অনুভব করি। আমার মনে পড়ে ওভালে ব্যাটিং এর অপর প্রান্তে ব্যাট হাতে একটু ঝুঁকে আমি দাঁড়িয়ে। এক উন্মাদ কলগুঞ্জন সমুদ্র পথে বহুদূরে এক প্রান্তর থেকে ভেসে আসে যার ঘ্রাণ আমি পাই। এ কলগুঞ্জন কেবল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমর্থকরাই বহুদূর নিজের দেশে বসে সৃষ্টি করতে পারে।এ যেন মধুবন থেকে ভেসে আসা লক্ষ ভ্রমরের ভ্রমর গুঞ্জন। ছোট্ট একটা মুহূর্ত যা আমাকে গর্বে ভরিয়ে দেয়।এ ধরনের সমর্থনে আমরা আমাদের সবটা কেন উজাড় করে দিতে পারব না !
আমি আমার ডেস্ক এ বসে যখন লিখি তখন অনুভব করি খেলা শেষে সাজঘরে আমি বেঞ্চে শুয়ে,আমার ঘামে ভেজা জামা আমার ঘাড় জাপটে ধরে আছে।খেলার জীবনের দশটা মরশুমের আবেগ ঘন মুহূর্ত গুলি আমাকে চমকিত করে আমি উচ্ছসিত হয়ে উঠি----- টেষ্ট জয়, সিরিজ জিতে নেওয়া, বিশ্বকাপ জয়। অবশ্যই আমার ক্রিকেট জীবনের আরেকটা দিক আছে যা আমি অস্বীকার করতে পারিনা---- ব্যর্থতা হতাশা।বেঞ্চে বসে শুয়ে থাকাকালে সেসবও আমাকে আবিষ্ট করে। ব্যাবিলনে অগ্নি দাহ ( Fire in Babilon) বইটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের নেতৃত্ব আমাকে কত সুযোগ করে দিয়েছে ------ কত অনুভূতি, কী আবেগ জড়িত তার সাথে।
আমার চল্লিশ বছরের ইতিবৃত্তকে দুটি কথায় তুলে ধরা চলে----- আনন্দ আর আশা। আনন্দের উৎসরণ খেলার মাঠে বিশিষ্ট খেলোয়াড়দের সঙ্গ পাওয়া আর তাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে। আর আশা বেঁচে থাকে আজকের থেকে কালকের দিনটা উজ্জ্বলতর হবে, আরও নক্ষত্র উঠে আসবে, আরও সব কাজ এখনও সম্পূর্ণ করা হয় নি এইসব ভাবনার মধ্যে।
আন্তর্জাতিক স্তরে ১৯৭৪ সালে বেঙ্গালোরে টেষ্টে নেতৃত্বের ভূমিকায় অভিষেক থেকে ১৯৮৫ সালে সিডনিতে আমার খেলা শেষ টেস্ট পর্যন্ত আমি আরও ৪৫ জন ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়ের সান্নিধ্যে খেলার সুযোগ পেয়েছি। আর্থুর ব্যারেট রঙ্গী নিনান এর মত আমি টেষ্টে বেশ কয়েকবার নেতৃত্ব দিয়েছি। প্রতিটি পদক্ষেপে একই পথের পথিক ভিভিয়ান রিচারড মাইকেল হোল্ডিং প্রমুখ।সে কম বেশি যতদিনের জন্যই হোক আমরা সবাই মনে রাখার মত কিছু অর্জন করেছি।সে দশকের কথা ভোলার নয়।খুব ধৈর্য সহকারে যে ভিত গেড়ে তুলেছি তার ওপর সাফল্যের সৌধ গড়ে উঠেছে। জয় এনে দিয়েছি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। আমাদের দেশ সন্মান আদায় করে খ্যাতির চূড়ায় উঠতে পেরেছে। আপাত দৃষ্টিতে হয়ত বিষয়গুলো অতি সাধারণ, সেরকম কছুই না। কিন্ত আমাদের পূর্ব সুরীদের ওপর চেপে বসেছিল যে তিক্ত অভিজ্ঞতা, যে কঠিন পরীক্ষার সামনে তাদের পড়তে হত, তাদের প্রতিদিনের জীবনে যে দুর্ভোগের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল সেগুলোর বিচারে আমাদের দেশের দেশের বাইরে প্রতিটি মানুষের কাছে ক্রিকেটে জয় লাভের মুল্য কতখানি তা অভাবনীয়।শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদার স্বাদ আমরা পেয়েছি।আমাদের জনতা ব্যক্তিগত ও যৌথ কৃতিত্বের স্বীকৃতি শেষ পর্যন্ত পেয়েছে ক্রিকেটের দৌলতে। দেশে ও পৃথিবীর মাটিতে জায়গা করে নিয়েছে। কেউ সেটা আর অস্বীকার করতে পারে না। আমরা এমন একটা জনগোষ্ঠী কোন ব্যাপারে যারা একটা পার্থক্য গড়ে তুলে দিতে পারে। সি এল জেমস যেমন বলেন আমরা একটা যৌথবদ্ধ জাতি হয়ে উঠেছি।
Fire in Bailon বইটা আমার বিশেষ পছন্দের কারণ বইটা কিভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের একটা নিজস্ব ধারা গড়ে উঠেছে তার ব্যখ্যা দিয়েছে। বইটার শেষে লেখক লিখেছেন যে আমার বা ভিভের নেতৃত্বে জাতীয় এই দলটির ধূমকেতুর মত হঠাৎ উদয় হয় নি যে সে হঠাৎ মিলিয়ে যাবে । সে গড়ে উঠেছে একটা উত্তরাধিকার সূত্র ধরে যার বিকাশের একটা ঐতিহ্য আছে। তিনি সঠিক বলেছেন। আমরা একটা কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে এখানে পৌঁছেছি যেটা চলতে থাকবে। আমাদের নিজের প্রশাসনের সঙ্গে নিজেদের লড়তে হয়েছে উত্তরসূরীদের ঐতিহ্য ধরে। আমরা সেই সব আভ্যন্তরীণ শত্রুদের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই করেছি যারা ক্যারিব্যাগন মহিলা পুরুষদের কিছুই দেবার নেই বলে ক্রিকেটের নিয়ম ভেঙে তাদের প্রতিভাকে ভোঁতা করে রাখার চেষ্টা করত। সব রকম প্রতিবন্ধকতা দূর করে খেলোয়াড়দের এগিয়ে যেতে হয়েছে। ব্যাপারটা খুবই কঠিন ছিল। প্রকাশিত অনেক সাক্ষাৎকারের কথা আমরা জানলেও অনেক সাক্ষাতকারে এমন ব্যক্তিগত বিষয় আছে যা প্রকাশ পায় নি। আমি জানতাম অনেক আশা নিরাশা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে উত্তরসূরীদের পথ ধরে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।আমার খেলোয়াড় জীবনে আমি আমাদের ক্রিকেট পরিবার গাছের ছায়ার শীতলতা অনুভব করেছি।আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের ক্রিকেট পরিবারের গাছের শিকড় অন্যান্য ক্রিকেট জাতিদের তুলনায় গভীরে প্রথিত এবং শক্তিশালী। আমি জানি রোহণ কানাই বা গ্যারি সোবার্স ফ্রাঙ্ক ওরালের কাছে শিখেছে। ওরাল ও জর্জ হেদলি ও লেরি কনস্টান এর কাছ থেকে অনেক গুণ পেয়েছে। আমার ঘাড়ে যখন নেতৃত্বের দায়িত্ব এসেছে আমিও সেই উত্তরাধিকার ধরে এগিয়েছি যা আমার শক্তির উৎস ছিল। আমার আশা যে আজকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল সে শক্তির উত্তরাধিকার অর্জন করবে।যে দলের কথা বইটাতে বলা হয়েছে তার খেলোয়াড়রা পূর্বসূরীর থেকে অন্য নতুন এক সৌভাগ্যের ভাগীদার হবে। এখন shaat বছর হয়ে গেল । খেলোয়াড় দলের নেতা ক্রিকেট বোর্ডের ম্যানেজার নির্বাচক হিসেবে আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আমি এগিয়ে যাওয়ার পথে যা করণীয় তা করতে পিছুপা হব না। জানি বর্তমানে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে কিছুটা ভাঁটার টান কিন্তু আমরা সবসময় আশাবাদী। আমি আশাবাদী হয়ে উঠি যখন এই বইতে লেখা একশ বছরের আগের ব্যাক্তিত্ব কিংকবদন্টি চার্লস অলিভারের কথা পড়ি। একশো বছর আগের তিনি ছিলেন এক প্রবাদ পুরুষ যিনি কোথায় পৌঁছবেন না জেনেই অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন।ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট এর এক পথ প্রদর্শক। স্বপ্ন আর দৃঢ়তায় ভরপুর এক ব্যক্তিত্ব।আমি জানি আজকের ক্যারিবিয়ান এ রকম কিছু তরুণ আছে। তাদের সুরক্ষা দিতে হবে উৎসাহিত করতে হবে।
এই বইটি একটি চমৎকার বই সন্দেহ নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে এর থেকে ভালো বই আর লেখা হবে কী না সন্দেহ আছে। ক্যারিবিয়ান জনতার কাছে ক্রিকেট যে কী তা নিয়ে লেখা লেখকদের পাওয়া আমাদের কাছে আশীর্বাদ----- সি আই আর জেমস, মাইকেল ম্যানলি,হিলারি বেকলস, টনি কজিয়ার, টনি বেককা প্রমুখ। জানি এই লেখকরা লন্ডনবাসি, জর্জটাউন এর নন।সে দিক দিয়ে Fire in Babylon এক নতুন ঐতিহ্যের স্রষ্টা।
=====================