কত যে সফরি স্নান! নদী, সমুদ্র। গঙ্গার আদুল থেকে বাহারি ঘাট। সাগরসঙ্গম। কত স্নান, সাঁতারের স্মৃতি! স্নানযোগ্য যদি হয়, আঁকুপাঁকু প্রাণ— স্নান স্নান। কত যে স্নান— অবগাহন!
বাড়ি-লাগোয়া তার ঘাট। ছোট্ট গোল তীরভূমি। ঝুঁকে-পড়া বাঁশ, ডালপালা-মেলা আম জাম লিচু কাঁঠাল তেঁতুল শিরীষ। কেবল পাটুকু মাটিতে ঠেকিয়ে পুরো শরীর ঝুঁকিয়ে-রাখা দুই পাতিলেবুর গাছ। জেঠিমাদের তেঁতুলডালে অগুনতি নতমস্তক আদুড় বাদুড়। শাখে শাখে পাখপাখালি। তার বুকে-পেটে জলে গাছের ডালে ডাঙায় মাছরাঙা বক ডাহুক ভোঁদড় জলদাঁড়াশ গোসাপ। খাবার কি না— পায়ে মাছেদের পরখের সুড়সুড়ি! ডোবা-জলে বৃষ্টির গান, বাদন জলতরঙ্গ থেকে ঝাঁঝর।
তোর কাছে আমার আজন্মের অবগাহন। ফুটি ফুটি স্মৃতির অতল! একজন, দুজন— ভরাঘাট। আমি আসার আগের, আমি আসার পরের। সর্ষের তেলের ঝাঁজে চোখে জল, আঁজলা আঁজলা জল— স্নান স্নান। বাবার কড়া হাত, তস্য কড়া তেল!
ওপারে অর্ধচন্দ্র ঢলঢল মুক্ত কলমির দাম। কানায় কানায় বর্ষায় মৃত্তিকার মায়ামুক্ত খুঁটি-বন্দি ঘাটের কাঠ বলে, মন চলো যাই ভ্রমণে...। তেমন এক ইচ্ছেকালে পাশের বাঁশবাগানে পায়খানা সেরে ক্ষুদ্র এক নর। বেলা দ্বিপ্রহর। অন্যদিনের মতো খোঁটা ধরে ধীরে ধীরে পা রাখা খেজুর কাঠের সে গোড়ের উপর। শৌচকর্ম সারবে সে। সেই ক্ষুদেটির সঙ্গে সে গোড়ে একটু মজা করতে চাইল বোধহয়। নিজের অক্ষের চারিদিকে ঘুরল এদিক-ওদিক। টালমাটাল সে ক্ষুদের পদস্খলন, খোঁটা থেকে খসে যায় ক্ষুদ্র দুর্বল হস্ত! মুহূর্তে জল তাকে পুরোপুরি নিজ আয়ত্তে পেয়ে মেতে ওঠে ক্রীড়ায়! অসম সেই ক্রীড়ায় হারতে থাকলে, কেবল শরীরের বাহির নয়, ভিতরটিও দখল করতে চায় সে জল! মুখগহ্বর থেকে প্রবেশে উদর-অধিকার! অনতিবিলম্বে সে-পুষ্করিণীর বৃহৎ কাতলার ন্যায় খাবি খাওয়া দ্বিপদ-দ্বিহস্ত সঞ্চালনরত অসহায় ক্ষুদ্র সে নরের! আর সেদিনই ব্যতিক্রমী সে ঘটনা! বরাবরের পুবের সদর ছেড়ে পশ্চিমের খিড়কি দিয়ে সে ক্ষুদেদের বাড়িতে আসা তার জ্যাঠামশাইয়ের। তাই সম্ভব আজ ব্যক্তিগত গদ্য এই!
কবে যে তোর ঘাটে কৌতুহলী অবতরণ! কবে যে হাঁটু, গলা থেকে ডুব-ডুব অবগাহন স্নান! হাতে খড়ি সাঁতারে। সাঁতার, সাঁতার পাগলপারা। জলকেলি। স্বচ্ছ জল ঘোলা, কৃষ্ণ শরীর শ্বেতাভ। আঙুলের ডগায় ভাঁজ। কঞ্চি হাতে শাসানি, দুদ্দাড় ছুট এদিক-সেদিক!
বছরের কখন যে কী রূপ তোর! বর্ষায় কানায়-কানায় তো গ্রীষ্মে কোমর-সমান পাওয়াই দায়! রৌদ্ররোষ থেকে বাঁচাতে মাচার ছায়া দেওয়া মাছেদের! কানায়-কানায় স্নানে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে কেউ, আমরা ডুব দিই মাটি তুলে আনার! ঝুঁকি দিয়ে দিয়ে ডুবে, মাথা নামিয়ে মাটি হাতে নেওয়া পর্যন্ত দমের অন্তিম প্রায়! তারপরও তো থাকে ওঠা— হাতের মাটি ধুয়ে-যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে! প্রমাণ দাখিল করতে হবে তো! আর বোধহয় ওঠা হল না! কতদূর এখনও! এই ডোবাই বোধহয় শেষ ডোবা! আর সামান্য পরেই মরে যাওয়া! কোনও প্রকারে মাথাটা জলের উপরে উঠলে নবজন্ম যেন! বৃষ্টিতে কম ময়লা-মল ধুয়ে পড়ত নাকি তোর জলে! গঙ্গাতেও পড়ে, তবে সে স্রোতস্বিনী অবাধ রোদ-বাতাসে। দু-এক দিন কী ঘোলা! ঘেন্না-ঘেন্না! সে দু-এক দিন হয়তো বড়্ পুকুর বা অন্য পুকুরে স্নান। আবার থিতানো স্থির জল, আবার স্বচ্ছতা। বিশেষত শরৎ ও হেমন্তে। কাকচক্ষু!
খাবার শেষে প্রায়দিনই অন্তত একটু ভাত-হাতে পুকুরে। মুখ ধুইতে যাওয়া আমাদের ভাইবোনেদের। শেষ-বর্ষা বা পুরো শরৎ ও খানিক হেমন্তে স্পষ্টতর তারা। মায়েরও হয়তো বাসনপত্রের সঙ্গে ঝড়তি-পড়তির অতিরিক্ত বাড়তি একটু ভাত। জলের শব্দ বা বাসনপত্রের আওয়াজে মুহূর্তে তাদের এসে জড়ো হওয়া ঘাটে! স্বচ্ছ জলে তাদের এদিক-ওদিক চক্কর আর তণ্ডুল গ্রহণ। চুনো থেকে 'রাঘব বোয়াল'। তার মধ্যে আকারে একটু ছোট-বড় দশাসই দুই রুই! দূরে থেকে ক্রমশ কাছে দুটি করে ভাত আমাদের। কতটা কাছে আনা যায় দুটিকে! আসতে আসতে ঠিক একটু দূরত্ব! প্রায় হাতে-করে ভাত খাওয়ানো! কাছে কাছে... ধরতে যাও, পাক খেয়ে চিকন শরীরে ছন্দ দুলিয়ে খানিক দূর। কতবার যে কাটা আমাদের পুঁটুলে বা কৈলে ছিপ, কিংবা কড় কেটে যাওয়ার ভয়ে ছিপ ছেড়ে দেওয়া আমাদের! কম রাগ ধরত নাকি! রাগে সেবার বাড়ি থেকে লাঠি নিয়ে, জলের মধ্যে দিলাম তো চালিয়ে! খানিক আঁশ গেল খসে! সাদা ক্ষত নিয়ে আসে, কী যে মনখারাপ তখন! বড়রাও দেখে, জেনে, খানিক বকুনি। ধরা কি পড়েনি একেবারেই! মজবুত ছিপ বা জালে একাধিকবার। আবার ছেড়ে দেওয়া, পোষা মাছ কি ধরা যায়!
কী করুণ মুখ বাবার! বাড়িতে ঢুকেই, ভেঙে-পড়া গলা, তার বড়দা মাছ পায়নি! ভোরবেলা মাছ আনতে গিয়েছিল লোক হাটে, না পেয়ে ফিরে এসেছে! এত বড় কাজ— এ-পুকুরের মাছ না হলে মানসম্মান বাঁচানোর আর উপায় থাকে না! সহসা শোকগ্রস্ত যেন বাড়ি! ছেঁচা হয় না পুকুর, কত দিনের সব মাছ! সব উঠে যাবে! আলাপ-আলোচনা বাড়িতে, সায় দিতেই হল বাবাকে! ঘরে-বাইরে এত মান্যগণ্য একজন মানুষ! পাড়ার অভিভাবক প্রায়! অফিস কাছারি থেকে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এত মানুষ নিমন্ত্রিত! অসহায় জ্ঞাতি জ্যাঠামশাইয়ের ওই করুণ মুখে তার উপর শেষ ভরসা রাখা!
ঝার দেকবুনি পতেঘাটে/তার দেকবুনি জলের ঘাটে! এ-বাড়ি থেকে জ্ঞাতি-গোষ্ঠী কত যে নতুন বউ তোর সঙ্গে পরিচিত হল, নিল আপন করে! কত গল্প তাদের বাপের বাড়ির! তাদের ছেলেমেয়েরা আপনজনের হাত ধরে নামতে নামতে একদিন নিজেরাই মাতোয়ারা তোর বুকে! এ-পাড়ার আজন্মের মেয়ে কোথাকার না বউ হয়ে, এসে গল্প কত শ্বশুরবাড়ির! কেবল কি আর সুখের সেসব, থাকে না কি দুখের! খুন্তি-চামচ ঘটি-বাটি থেকে নথ-পাশা হারিয়ে যাওয়া। হারিয়ে যাওয়া নতুন জামাইয়ের আংটি! খুঁজে পাওয়াও কোনও কোনওটি। জল-সওয়া থেকে নতুন জামাইয়ের মাছ ধরা। তোর জলে প্রতি পয়লা বৈশাখ আর মাঘে গবাদির স্নান। মন ঝদি হয় চ্যাঙ্গা/ডুব দিলি হয় গঙ্গা। তা কি কেবলই নরের বেলা, গরু-ছাগল-মুরগির বেলা নয়! বছরের আর যখন যা হয় হোক, এই দু-দিন বলতে গেলে মানুষ এবং তার প্রধান কোনও কোনও পোষ্য— সবার বেলা। তোর তীরে কার্তিক-সাঁঝের প্রদীপ। তোর জলে ভাসা নিজ-হাতে-গাঁথা কলার মান্দাসে! শাঁখ বাজিয়ে তোর জলে ডুবিয়ে রেখে আসা ঘটবারি পূজার ঘট। ভোর-না-হতে আমাদের ছোটা তার দখলে! পৌষ সংক্রান্তিতে প্রথম পিঠে দেওয়া তোর জলে। কেউ প্রয়াত হলে তোর জলছোঁয়া কাকবলির ভাত, তোর ঘাটে ঘাট।
এখনও এ অবগাহন কোথায় নিয়ে যায়! কত ঘাটে অবগাহন, তবু তোর কাছে কত কী যে গচ্ছিত আছে! কত কত স্নান তস্য তস্য পিতা পিতামহীর! সে জল তো নয়, তবু কি হারায় তা। স্মৃতিজল কেবা আটকায়! আর কোন সমুদ্র নদীর ঘাটে আঘাটায় স্মৃতিজল এমন উথলায়! এমন করে কাছে টানে, আয়-আয়, যে ক'দিন আছিস, যে ক'বার পারিস— অবগাহন করে নে! শরীর-শাস্ত্রজ্ঞরা যে-কোনো দিন গণ্ডি টেনে দেবে। যে-কোনো সময় পঞ্চভূত মিশিয়ে নেবে নিজেদের মধ্যে। তার আগে যেটুকু সুযোগ আছে ডুব দে— অবগাহন করে নে।
তোর কথা সব ফুরোবার তো নয়, আপাতত ক্ষান্ত দিতে হয়!
=========================
অরবিন্দ পুরকাইত
গ্রাম ও ডাক — গোকর্ণী,
থানা — মগরাহাট,
জেলা — দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।