জয়শ্রী ব্যানার্জি
তামিলনাড়ুর বিখ্যাত হিন্দু চোল রাজবংশের কথা আমরা সবাই জানি । সেই চোল রাজ বংশের এক বীর রাজার কথা যিনি খুব অল্প কিছু বছরের জন্যই পৃথিবীতে এসেছিলেন কিন্তু তিনি সেই সময়ের মধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে গেছিলেন। চোল রাজ বংশে তাঁকে স্মরণ করা হয় প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতি শীল শাসক হিসাবে। তিনি চোল রাজ রাজাদিত্য বা গণাদিত্য । মানুষের কাছে তিনি ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন তাই গণাদিত্য উপাধি তে ভূষিত হন।এবং মানুষের কাছে অধিক জনপ্রিয় তিনি এই নামে ছিলেন ।
রাজাদিত্য চোল ছিলেন প্রথম পরন্তক চোল এবং চেরা বা কেরল রাজকুমারী কোকিজানের পুত্র । জন্ম ৯২৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে । তাঁর জীবনে মায়ের প্রভাব গভীর ছিল ।
অল্প বয়স থেকেই তিনি পড়াশোনার সাথে সাথে অস্ত্র বিদ্যার চর্চা শুরু করেন ।
এবং ক্রমশঃ পরবর্তী কালে অসি চালনাতে অসম্ভব পারদর্শী হয়ে ওঠেন। সাথে তাঁর সঙ্গীত ও কবিতার প্রতি বেশ অনুরাগ লক্ষ্য করা যায় ।
তিনি ছিলেন ভীষণ বীর যোদ্ধা। রাজার চারপাশ ছিল সব সময় ষড়যন্ত্রে ভরা। সেদিকে ছিল তাঁর সতর্ক দৃষ্টি । সাম্রাজ্যের উন্নতি ও সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখতে তিনি সচেষ্ট থাকতেন ।গুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের পরামর্শ নিতেন ।শুনতেন এবং নিজের বুদ্ধিতে সেগুলো বিচার করতেন ।
পরন্তক চোল তিরুমুনাপদীতে তার পুত্র রাজাদিত্যের অধীনে একটি সেনাবাহিনী স্থায়ীভাবে রেখেছিলেন যাতে বানার এবং বৈদুম্বার আক্রমণ প্রতিহত করা যায়। যখন কোন যুদ্ধ হয়নি, তখন রাজাদিত্য তার সেনাবাহিনীর জনশক্তিকে বীর নারায়ণ হ্রদ নির্মাণে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি হ্রদের তীরে বীর নারায়ণ পেরুমল নামে ভগবান বিষ্ণুর একটি মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন।
হিংসাত্মক যুদ্ধ এবং আক্রমণের ইতিহাসে, রঙিন সাইডশো সবসময় বিদ্যমান। 949 খ্রিস্টাব্দের থাক্কোলামের যুদ্ধ এর একটি উদাহরণ। এই যুদ্ধে, রাষ্ট্রকূটরা ক্রমবর্ধমান চোলদের পরাজিত করেছিল। চোলের যুবরাজ রাজাদিত্যকে হত্যা করা হয়। জানা যায় এই যুদ্ধে তাঁর দলের এক গুরুত্ব পূর্ণ যোদ্ধা বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিলেন । যার পরিণতি তে চোল দের পরাজয় ও চোল রাজ রাজাদিত্যের হত্যা হয় ।
চেন্নাইয়ের তিরুভোত্তিউরের থিয়াগরাজস্বামী মন্দিরে একটি পাথরের শিলালিপি চোল যোদ্ধা বল্লভ ওরফে ভেলাঙ্গুমারনের গল্প বলে, যিনি আরাককোনাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে থাক্কোলামের যুদ্ধে তার অনুপস্থিতির জন্য একজন তপস্বী হয়েছিলেন। যদিও তিনি আসলে একজন বিশ্বাসঘাতক ছিলেন কিনা তা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে। রাজাদিত্য চোল সৈন্যদের কমান্ড করার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ও পরিচিত ছিলেন । তিনি তাঁর জীবন দশায় দুটি বড়ো যুদ্ধ সহ মাঝারি ছোটো অনেক যুদ্ধেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি চেরা ও পান্ড্য দের বিরুদ্ধে চোল সেনাবাহিনী কে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান ।
এহেন রাজা মশাই ও মাঝে মাঝেই তাঁর পাগলা মন কে সঙ্গে নিয়ে দুর অচিনপুরের উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে দিতেন । সেই নিরুদ্দেশে র কথা খুব ঘনিষ্ঠ ছাড়া আর কেউ জানতেন না ।
অসি ছেড়ে মাঝে মাঝেই তিনি কলম ও ধরতেন । তাঁর কবিতা প্রেমের কথা তৎকালীন নথি, শিলালিপি থেকে উঠে আসে ।
রাজাদিত্য চোল সাহিত্য ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । তিনি সংগীত ও কবিতার বেশ কিছু কাজ পরিচালনা করেন ।তিনি ছিলেন সেই সময় তামিলনাড়ুর প্রসিদ্ধ কবি সুন্দরের বন্ধু । কবি সুন্দর হিন্দু বৈষ্ণব ছিলেন এবং তিনি রাজাদিত্য কে নিয়ে বেশ কিছু কবিতা লিখে যান ।
তামিলনাড়ুর মৌরি গ্রামে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে চোল রাজ রাজাদিত্য সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য ঐতিহাসিক দের হাতে আসে । এ ছাড়া যুদ্ধ সংক্রান্ত ঘটনাগুলির চোল সংস্করণটি রাজারাজা প্রথমের রাজ হিজ রাইডেন হিজ গ্রান্ট (1006 খ্রিস্টাব্দ) এবং রাজেন্দ্র চোলের তিরুভারঙ্গদু হিজ প্লেট (1018 খ্রিস্টাব্দ) এ পাওয়া যায়। থাক্কোলামের যুদ্ধের একটি বিবরণ, যা চোল সংস্করণ থেকে কিছু বিশদ বিবরণে পৃথক, আতাকুরু শিলালিপিতে পাওয়া যায়, যা পশ্চিম গঙ্গার তৃতীয় কৃষ্ণ এবং তার রাজকুমার দ্বিতীয় বুটুগা (কৃষ্ণ তৃতীয়ের যুবক অধস্তন) দ্বারা প্রকাশিত। গঙ্গা রাজা মারসিংহের শ্রাবণ (৯৬৩-৯৭৫ খ্রি.) তাঁর বেলগোলা নথিতেও তাঁর পূর্বসূরি বুটুগা দ্বিতীয়ের বিরুদ্ধে চেরা রাজার বিজয়ের কথা উল্লেখ রয়েছে। কেরালার চোল সেনাপতি বীরান কুমারনের শিলালিপিতেও এই যুদ্ধের একটি পরোক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায়।
৯৪৮/৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে চোল ও রাষ্ট্রকুট দের মধ্যে সংঘটিত থাক্কলামের যুদ্ধে চোল দের হয়ে নেতৃত্বে ছিলেন রাজাদিত্য ও রাষ্ট্রকুট দের হয়ে ছিলেন তৃতীয় কৃষ্ণ । এই যুদ্ধে গণাদিত্য বা রাজাদিত্য র অকাল মৃত্যু চোল সাম্রাজ্যের কাছে একটি বড়ো ধাক্কা ছিল এবং এর পতনের তারিখ একটু একটু করে এগোতে থাকে ।
আর এই ভাবেই একজন বছর কুড়ি র মহান যোদ্ধা ও রাজা ইতিহাসের পাতায় নাম তুলে জ্যোতিষ্ক এর মতো হটাৎ কোথাও বিলীন হয়ে গেছেন ..! এখন কার অনেকে হয়তো তাঁকে ভুলে গেছেন বা জানেন না সেই ভাবে ,কিন্তু তিনি ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাননি। তাঁর কীর্তিতে তিনি থেকে গেছেন আজও। শুধু খুঁজে নিতে জানতে হয় ।
==================================
তথ্য সূত্র - চোল রাজবংশের ইতিহাস ।
পাল্লারোড, পূর্ব বর্ধমান।