রিভিউ ।। ছড়াগ্রন্থ: ছড়ায় গাঁথা মালা ।। গোবিন্দ মোদক
রিভিউ - শিশু-কিশোর ছড়াগ্রন্থ:
ছড়ায় গাঁথা মালা
(ছড়াকার: রঞ্জিত বিশ্বাস)
পাঠ প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক
পেশায় শিক্ষক এবং নেশায় ছড়াকার-কবি রঞ্জিত বিশ্বাসের প্রথম ছড়াগ্রন্থ 'পাপ মাপার মশলা' পাঠকমহলে বিশেষভাবে সাড়া জাগিয়েছিল ছন্দের জাদুতে। সেই জাদু আরও নন্দিত এবং বন্দিত হয়ে, আরও ছন্দময় হয়ে গেঁথেছে 'ছড়ায় গাঁথা মালা' যেখানে নানা স্বাদের ষাটখানি ছড়া পাঠককে নির্ভেজাল আনন্দ দেবে বলে সদাপ্রস্তুত। ছড়াগুলির অধিকাংশই ব্যঙ্গাত্মক ছড়া যেগুলিতে তিনি অসামান্য মুন্সিয়ানায় নিজস্ব রচনাশৈলীতে আলতো করে ছন্দের বল ঠেলে দিয়েছেন পাঠকের কোর্টে যা পাঠককে যেমন ভাবাবে, আনন্দদান করবে, নির্মল হাস্যরসের খোরাক যোগাবে; তেমনই তা সূক্ষ শ্লেষ হয়ে বিদ্ধ করবে পাঠক হৃদয়। যেহেতু তিনি পেশায় শিক্ষক, সেইহেতু বহুক্ষেত্রেই শিশু-মনস্তত্বকে সঠিকভাবে অনুমান করে রচনা করেছেন মজাদার বাস্তবধর্মী স্বরবৃত্তীয় ছড়া যা তাদের মনে স্থায়ী রেখাপাত করবে। এছাড়া পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে কখনও বা সেগুলির প্রতি ব্যঙ্গের তর্জনী সংকেত তুলে ধরে, আবার কখনও বা সেই অনিয়ম-বেনিয়মকে উপজীব্য করে তিনি সমাজকে শ্লেষের বাণে বিদ্ধ করেছেন।
ছড়াকার রঞ্জিত বিশ্বাসের ছড়ার সবচেয়ে বড়ো গুণ হলো রচনাশৈলীর সরলতা এবং সরসতা; সহজ-সরল নির্ভেজাল হাস্যরসাশ্রয়ী ছড়াগুলো নির্মেদ, নির্ভার; কোথাও অকারণ পাণ্ডিত্য দেখাবার প্রয়াস নেই, নেই অযথা উপদেশদানের সুপ্ত বাসনা; বরং ফুরফুরে ছড়াগুলো যেন আপনমনেই ছন্দের খই ফুটিয়ে পাঠককে এক অনির্বচনীয় আনন্দ দান করে নিজেই মোহিত হতে চায় সৃষ্টির অনাবিল আনন্দে। যখন এই গতিময় যুগে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে হাসির অবকাশ ও উপকরণ, তখন এই ছড়াগুলির নির্ভেজাল কৌতুক যে একরাশ ব্যস্ততার মধ্যেও কিছুটা রিলিফ এনে দেবে একথা বলবার অপেক্ষা রাখে না। আর এইখানেই এই ছড়াগুলির সার্থকতা।
কবি-ছড়াকার রঞ্জিত বিশ্বাসের স্বরবৃত্তীয় ছড়াগুলি অসামান্য রিদিমিক তাল ও লয়ের বিন্যাসে যে কতোখানি প্রাঞ্জল ও প্রাণবন্ত তা নিচের নমুনাওলিতে সম্যক বোঝা যাবে —
১)
কোকিল বলে কাক-সঙ্গীত/হয় এতোটাই সুরে,
বাচ্চা-বুড়ো শুনতে গেলেই / মারে পাথর ছুঁড়ে!!
(কাকের বিখ্যাত সঙ্গীত)
২)
সিটে বসে উনি বললেন/ নিত্যযাত্রী আমরা,
সবাই জানে বুকিং করা/ আমাদের এই কামরা!!
(ঠাট্টার পাত্র)
৩)
কঙ্কাল দিলো ঘাড় মটকে/গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে,
বিপিনবাবুর স্পন্ডেলাইটিস/হান্ড্রেড পার্সেন্ট গেল সেরে!
(সেরে গেল স্পন্ডেলাইটিস)
8)
দাদু করলো ডাকাত ঘায়েল/জামার বোতাম ছুঁড়ে,
এ খবরে বিশ্বাসের ঢেউ/বইলো জগৎ জুড়ে। (বোতাম)
৫)
একটা স্থানে আমিই গায়ক/সেটা হলো টয়লেট,
নিজের গানে যাই যে ডুবে/তাইতো এতো হয় লেট!
(টয়লেট)
এইরকম অজস্র মজারু, সরস, নির্ভেজাল মজাদার মুচমুচে ছড়া ছড়িয়ে আছে বইটির পাতায় পাতায়, আশ্চর্য সুন্দর সেই সব ছড়াগুলির নামও চমৎকার —
গানের গুঁতো, কুকুরের হাসি, গরুর রচনা, নো অ্যানসার, পেটুক, মশা মারার কয়েল আবিষ্কার, প্রোটনের দুঃখ, খাওয়ার শো, দাদুর লুঙ্গি, উৎসাহ, রাঁধুনি, পড়া দরকার, মেন্টাল প্রবলেম, শ্বশুরবাড়ির ভোজ, মুগ্ধ করলো মগধরাজ, মেসোর চরণধূলি, চাকদায় চলে এসো, খাদ্যের গুণ, গানের বিচার, ছড়া যুদ্ধ, তরকারি কথা, পুরোনো সেই দাঁতের কথা, দাদুর বয়স, ওসির কী হয়েছে ইত্যাদি। তবে যে ছড়াকার —
"পেঁয়াজ বললো আদা/আমি তো তোর দাদা!
এই কথাটা কোন মতেই / বুঝলি নারে গাধা?"
— এমনটা লেখেন, তখন তাঁর খুশির সুনামি, মুখের বদলে নাকে, দৌড় প্রতিযোগিতা, আমার ভয়ে এরকম দু'একটি ছড়া পড়ে মনে হয় ছড়াগুলিতে আরও মনোযোগী হবার দরকার ছিলো। আর 'ঘোড়ার বিপদ' ছড়াটির নাম 'গাধার বিপদ' হলেই সুপ্রযুক্ত হতো।
সবশেষে 'ছড়াযুদ্ধ' নামক সেরা ছড়া থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে যা এককথায় অসাধারণ —
ছড়া যুদ্ধে শের শা জিতে/অনেক দিলো থ্যাঙ্ক,
স্মৃতিরক্ষায় গড়লো শেষে / রাস্তা গ্রান্ড ট্রাঙ্ক!!
এমন ছড়াকারের পরবর্তী ছড়াগ্রন্থের অপেক্ষায় থাকাই যায়।
প্রকাশক: আনন্দকানন
মূল্য : ১৩৫ টাকা
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৪৮
__________________________
গোবিন্দ মোদক।
সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ, ডাকসূচক - 741103