মাধব ও মালতি
সমীরণ সরকার
ওই দুই পাঠান বন্ধুর নাম ছিল কামাল খান ও কাশেম খান । তারা বয়সে যুবক। দীর্ঘদেহী ও বলিষ্ঠ শারীরিক গঠনের অধিকারী। উপরন্তু অসিচালনায় অসাধারণ দক্ষতা ছিল তাদের। তারা যে কোত্থেকে রাজপুরে এসেছিল সেই ব্যাপারে সম্যক অনুসন্ধান না করেই বর্গীদের হাত থেকে নিজের রাজ্যকে বাঁচানোর জন্য রাজা হরি সিংহ নিজের সৈন্যবাহিনীতে তাদের গ্রহণ করেন।
দুই বন্ধুর লড়াইয়ের কৌশল ও শৌর্যে বর্গীরা বিতাড়িত হল। ওই দুই বন্ধুর বীরত্বে বিস্মিত হলেন রাজা হরি সিংহ। শুধু তাই নয়, কামাল ও কাশেমের বাকচাতুর্য ও স্ততি বাক্যেও মুগ্ধ ছিলেন তিনি। তাই যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরে রাজা হরি সিংহ কাশেম খানকে সেনাপতির পদে নিযুক্ত করেন। কালাম খান হল রাজার প্রধান অমাত্য ও ব্যক্তিগত দেহরক্ষী।
রাজা হরি সিংহ নিঃসন্তান ছিলেন। বংশ রক্ষার জন্য পরপর তিনবার বিবাহ করেন তিনি। বড় রানী কমলা ছিলেন এক সামন্ত রাজপরিবারের কন্যা। তার রূপে স্নিগ্ধতা ছিল । রাজ্যের ছোট-বড় যে কোন প্রজার যেকোনো সমস্যায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন তিনি। তিনি দানশীলা এবং ধর্মপরায়ণ ছিলেন । কিন্তু বিয়ের দশ বছর পরেও তার কোন সন্তান না হওয়ায় তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে তার দূরসম্পর্কীয় এক বোন কল্যাণীর সঙ্গে রাজা হরি সিংহের আবার বিয়ের ব্যবস্থা করলেন তিনি । কিন্তু মেজোরানী কল্যাণী ও বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে সন্তানসম্ভবা না হওয়ায় রাজা হরি সিংহ তৃতীয়বার বিবাহ করেছিলেন।
ছোট রানী মাধবী অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন বলে এক দরিদ্র পরিবারের কন্যা হওয়া সত্ত্বেও তাকে রাজা হরি সিংহ বিবাহ করেছিলেন শুধু বংশ রক্ষার তাগিদে। কিন্তু বিয়ের তিন বছর পরেও ছোটরাণী সন্তান-সম্ভবা হলেন না। কিন্তু তিনি খুব সুচতুর মহিলা ছিলেন। তিনি তাই তার রূপের ফাঁদে রাজা হরি সিংহ কে বশীভূত করে রেখেছিলেন।
বড় রানী কমলা পুজো পাঠ দান ধ্যান ইত্যাদি নিয়ে সময় কাটাতেন। মেজোরানী কল্যাণী খুব সংসারী ছিলেন। তিনি তাই দাস-দাসী পরিবৃত হয়ে গৃহ কাজের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। এই সুযোগে ছোট রানী মাধবী রাজার অনুমতি আদায় করে নিজের ভাই মদন সিংহ এবং পিতার তরফের দুরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজনকে রাজকার্যে নিযুক্ত করেছিলেন।
মদন সিংহ ছিল শিয়ালের মতো ধূর্ত এবং লোভী । দরিদ্র পরিবারের সন্তান মদন রাজা হরি সিংহের প্রাসাদে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করে এবং রাজ সুখ উপভোগ করে দিনে দিনে আরো লোভী হয়ে ওঠে।সে তার দিদি ছোট রানী মাধবীর সাহায্যে সমস্ত রাজকর্মচারী এবং রাজ্যের মাথা মাথা ব্যক্তিদের বশীভূত করে।
কাশেম এবং কালাম রাজপদ লাভ করার পর কিছুকাল রাজ্যের উন্নতি সাধনে সর্বান্তকরণে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তারা মদন সিংহের কুপরামর্শে আরো ক্ষমতা লাভ করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে।
রাজার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হওয়ার সুবাদে রাজ অন্তঃপুরে কালাম খানের প্রবেশাধিকার ছিল অবারিত। কালাম খানের পুরুষোচিত দেহসৌষ্ঠবে আকৃষ্ট হন রানী মাধবী। ওদিকে রানী মাধবীর অসাধারণ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হল কালাম খান। শুরু হলো ষড়যন্ত্রের আরেক নতুন অধ্যায়।
মদন সিংহের সাহায্যে রাজবৈদ্যকে প্রচুর উৎকোচ দিয়ে বশীভূত করে লতাগুল্মের সাহায্যে প্রস্তুত ভেষজ বিষ ধীরে ধীরে প্রয়োগ করা শুরু হলো রাজা হরি সিংহের উপরে। রানী মাধবী তার প্রিয় দাসী চঞ্চলা এবং রাজার রন্ধনশালার প্রধান পাচক দুর্লভ কে উৎকোচ দিয়ে এবং প্রাণনাশের ভয় দেখিয়ে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে বাধ্য করলো। ধীরে ধীরে রাজা হরি সিংহ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দেশ-বিদেশের অনেক বৈদ্য এসেও রাজাকে সুস্থ করতে পারল না। অতি কষ্টে তখন তিনি চলাফেরা করতে পারতেন। সেই অবস্থা তেও তিনি এক অমাবস্যার রাতে দেবী কালিকার পূজা করার জন্য একা নৌকা চালিয়ে কালি সায়রের সেই কালী মন্দিরে দেবী পূজার জন্য গেলেন। প্রায় সারা রাত কেটে গেল কিন্তু রাজা ফিরে এলেন না।
পরদিন ব্রাহ্ম-মুহূর্তে হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের শব্দ শুনতে পেল রাজপুরের অধিবাসীরা। সেইসঙ্গে শুনতে পেল প্রচুর জলোচ্ছাসের শব্দ । কালি সায়রের দিক থেকে ভেসে আসছিল শব্দ। প্রজারা ছুটতে ছুটতে কালি সায়রের পারে গিয়ে উপস্থিত হল। তারা সবিস্ময়ে দেখল ,দেবী কালিকার মন্দিরের চূড়া টি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে ।কালি সায়রের বুকে তখন ও প্রচুর জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে। যেন কোন অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে সুবিশাল জলাশয় কালি সায়রের জল উথাল পাথাল করছে।
ততক্ষণে কালি সায়রের পারে উপস্থিত হয়েছেন বড় রানী ও মেজোরানী । বড় রানী দেখলেন ,নৌকাটা বাধা আছে ঘাটে, মন্দিরে নয়। তবে কি রাজা পূজা শেষ করে ফিরে এসেছেন পারে? কিন্তু কোথায় তিনি? মাঝির সাহায্যে নৌকা করে মন্দিরে গেলেন বড় রানী। মন্দিরে ঢুকে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। মন্দিরের ভিতরে বেদী ফাঁকা । কোন দেবী মূর্তি নেই সেখানে। এমনকি মন্দিরের ভিতরে রাজা হরি সিংহে র চিহ্ন মাত্র নেই।
ডাকা হল জেলেদের। আনা হলো আরো নৌকা।
জেলেরা সারাদিন তোলপাড় করলো কালি সায়রের জল। কিন্তু না রাজা, না দেবী মূর্তি--- কারুর কোন হদিশ পাওয়া গেল না।
কিন্তু জলের ভিতর পাওয়া গেল রাজা হরি সিংহের পোশাক। বড় রানী কমলার নির্দেশে রাজবাড়ীর শশান ঘাটে রাজার পোশাক সাজানো হলো চিতার উপর। সেই চিতার উপরেই সহমরণে গেলেন বড় রানী কমলা। মেজোরানী কল্যাণী চলে গেলেন কাশীতে।
রাজপুরের রাজসিংহাসনে বসলেন ছোট রানী মাধবী। কালাম খান হল রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যের সমস্ত প্রশাসনিক ক্ষম ন্যস্ত হয় পাঠান কালাম খানের হাতে। মদন সিংহকে একটা ছোট তালুকের দায়িত্ব দিয়ে দূরে পাঠানো হলো।
ভাগ্যের কী অদ্ভুত পরিহাস !
রানী মাধবী যখন রাজপুরের সিংহাসনে গ্রহণ করলেন ,সেইসময় তিনি ছিলেন গর্ভবতী। রাজা হরি সিংহের সন্তান তখন তার গর্ভে ।
যথাসময়ে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন রানী মাধবী। রাজপুত্রের মুখ দেখে রানী মাধবীর মনে বিশাল পরিবর্তন আসে। তাঁর কৃতকর্মের জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হন তিনি।
এদিকে রাজা হরি সিংহের উত্তরাধিকারীকে ভূমিষ্ঠ হতে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে কালাম খান। রাজকুমার কে হত্যা করার ভয় দেখিয়ে রানী মাধবীকে তার সমস্ত অন্যায় নির্দেশ মানতে বাধ্য করে সে।
ওদিকে কালাম খান কে রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতা কায়েম করতে দেখে এবং সুন্দরী রানী মাধবীর সঙ্গে প্রণয়লীলায় লিপ্ত হতে দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে সেনাপতি কাশেম খান।
একদিন অপরাহ্ন কালে রাজ উদ্যানে রানী মাধবীর তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও কালাম খান যখন তাকে গোপনে সাক্ষাৎ করতে বাধ্য করে নিজের লালসা চরিতার্থ করার জন্য ,সেই সময় সেনাপতি কাশেম অতর্কিত আক্রমণ করে হত্যা করে কালামকে। ভীত রানী মাধবী নিজের পুত্র সন্তানকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে রাজপুর ত্যাগ করেন। এরপরে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কাশেম খান রাজপুরের সিংহাসনে আরোহন করে। মুর্শিদাবাদের নবাব তখন মুর্শিদকুলি খান। মুর্শিদকুলি খান কে প্রচুর উপঢৌকন এবং বাৎসরিক মোটা কর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নবাবী সনদ লাভ করে কাশেম খান।
কালি সায়রের জলে স্নান করতে এসে মাঝে মাঝেই রাজপুরের পুরনো ইতিহাস স্মরণ করে মাধব। এই কাহিনী সে শুনেছিল যশোদা মিষ্টান্ন ভান্ডারের বর্তমান মালিক নবীন সরকারের মা পদ্মাবতী দেবীর মুখে। পুরোটা অবশ্য পদ্মাবতী দেবী তাকে বলেননি। কিছুটা বলেছিলেন,বাকীটা পরে জেনেছিল সে । এই পদ্মাবতী দেবীর জন্যই তো রাজপুরে আসা মাধবের। সে তো আজও জানে না কোথায় তার বাড়ি আর কে তার মা-বাবা।
==============================
(চলবে)