ভূতে মারে ঢিল
প্রবোধ কুমার মৃধা
দেবনাথ বাড়ির কর্তা -গিন্নি জয়দেব ট্রাভেলসের লাক্সারি বাসে পাড়ি দিলেন গয়াধামে। গয়াধাম উপলক্ষে, তিন সপ্তাহের ট্যুর, ঘুরবেন প্রায় সমগ্ৰ উত্তর ভারত।
সচ্ছল পরিবার। চাঁদের হাট বসিয়েছেন মুকুল দেবনাথ।চার ছেলে, দুই মেয়ে।সকলেই বিবাহিত। ছেলে -বৌ, নাতি-নাতনি-- বাড়িঘর সরগরম।
তে-রাত পার হল না। বাড়িতে উপসর্গ আরম্ভ হয়ে গেল। সন্ধে হলেই বাইরে থেকে টুপ-টাপ ঢিল পড়তে থাকে বাড়ির মধ্যে,চলে প্রায় সারারাত।
গল্পটা তল্লাটে জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে বিলম্ব হল না। শুরু হল কৌতুহলী আমজনতার আসা-যাওয়া। তবে দিনের ভাগে সব স্বাভাবিক, রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢিল পড়া শুরু হয়। কখনো অল্প ব্যবধানে আবার কখনো দীর্ঘক্ষণ পরে পরে।
মজা দেখতে দূরের মানুষজন দিনের বেলা এসে একবার ঘুরে যায়, জেনে যায়। তাদের মুখে পল্লবিত হয়ে সেই গল্প বনস্পতির আকার নেয়।আসল ঘটনা লোকের মুখে মুখে ছড়াতে ছড়াতে বেমালুম ভৌতিক হয়ে পড়ে।
দেবনাথ বাড়ির বৌ-ঝি থেকে শুরু করে বড়োরা কেউ রাতে দু-চোখের পাতা এক করতে পারে না। দিনের ভাগে বাইরের কাজকর্ম সব মিটিয়ে ফেলে।সন্ধে হলে কেউ আর বাড়ির বাইরে পা রাখে না। সদর দরজা বন্ধ করে দেয়।
নিজের চোখে পরখ করার কৌতুহল নিয়ে পাড়ার বা গ্ৰামের অনেকে দু-পাঁচজন দু-পাঁচজন মিলে দলবদ্ধ হয়ে দেবনাথ বাড়িতে রাতে পৌঁছায় চক্ষু -কর্ণের বিবাদ অঞ্জনের নিমিত্ত।
দৈবাৎ কার ও কপালে ভৌতিক ঢিল পড়া চাক্ষুষ করে চর্ম চোখের তৃপ্তি সাধন ঘটত, অধিকাংশের তা ঘটত না। তবে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে প্রবেশ করলে সবাই কেমন যেন এক প্রকার অজানা আতঙ্কে সংক্রমিত হয়ে পড়ত। চোর -ডাকাত বা হিংস্র জীবজন্তুর ভয় নয়, আতঙ্কটা ছিল কেবলমাত্র ভূতের।
গতরাতে ঢিল পড়া প্রত্যক্ষ করতে আগত একজন কার গায়ে নাকি ভূতুড়ে ঢিল লেগেছিল।ভোর রাত থেকে সে নাকি জ্বরে পড়েছে,ভুল বকছে। এমনি কত রকমের নতুন নতুন গল্প -গাথার কল্প কাহিনি মুখে মুখে নিত্য সৃষ্টি হয়ে চলেছে।
কয়েক জন সংশয়ী ছোকরা ব্যাপারটির উৎস অনুসন্ধান করতে গোপনে রাতের আঁধারে বাইরে গা ঢাকা দিয়ে দু-রাত অপেক্ষা করে থাকল। তাদের সন্দেহ মতো বাইরে থেকে কাউকে বাড়ির মধ্যে ঢিল ছুঁড়তে দেখল না -- অথচ ঢিল পড়ল।
দশচক্রে ভগবান নাকি ভূত হয়। কথাটা ক্ষেত্র বিশেষে বোধহয় সত্যি। দেবনাথ বাড়ির নতুন প্রজন্মের দু-একজন যারা কলেজ-ইউনিভারসিটির শিক্ষা পেয়ে ভূতের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী হয়ে ওঠার অনুশীলন করছিল , তারা ও বর্তমান পরিস্থিতিতে এতটাই নার্ভাস হয়ে পড়েছে যে, অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন পাড়া-প্রতিবেশির পরামর্শ মতো গুনিন, ওঝা,গনৎকার ইত্যাদির সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
শিক্ষাটা তাদের সংস্কারকে অতিক্রম করতে পারে নি। মনের ভাবনা আর বাস্তবের ঘটনা -- দুয়ের মধ্যে মিলের অভাব লক্ষ্য করে তাদের অর্জিত বিশ্বাসে চিড় ধরল।
একদিকে পুরুত এসে বাস্তুর শান্তি- স্বস্ত্যয়ন উপলক্ষে মহা জাঁকজমক সহকারে পুজোপাঠ আরম্ভ করলেন।অপর দিকে গুনিন,গণৎকার সবাই কোমর বেঁধে নিজেদের কেরামতি প্রদর্শনের নিমিত্ত কসরত শুরু করে দিলেন।
দেবনাথ পরিবারে সে যেন এক মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে চলল, অথচ কর্তা মশাই এসবের বিন্দু -বিসর্গ জানতে পারলেন না।
রাত নামলেই পাড়ায় একটা ভৌতিক আতঙ্কের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। ঢিল পড়া প্রত্যক্ষ করেছে কয়েক জন মাত্র।অধিকাংশজনে ভীত হয়েছে গল্প শুনে।
ভয় বা দুঃসংবাদ এমনি করে সংক্রমণের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যে ঘটনা চোখে দেখল না, শুধুমাত্র শুনে এমনভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করছে যে, মনে হবে সে প্রত্যক্ষদর্শী।
পুরোহিত এবং গণৎকারের গণনার মধ্যে সামঞ্জস্য পাওয়া গেল অনেকটা। তাঁদের উভয়ের অভিমত হল যে,উত্তর পুরুষ কর্তৃক পিন্ড প্রাপ্তি ঘটলে পূর্ব পুরুষদের প্রেতাত্মা মুক্তি পেয়ে অনন্ত ধামের অধিবাসী হয়। তবে এই অনন্ত ধামের অধিবাসী হওয়ার জন্য কেউ লালায়িত নয়।তারা সবাই আপন জনদের সান্নিধ্যে প্রেত জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায়।
অতএব এতদিন যে সমস্ত বিদেহী স্থূল আত্ম প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়ে বাস্তু সংলগ্ন গাছে -পালায় বাস করত, বহুদিন পর স্থানচ্যূত হবার আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে উপদ্রব শুরু করেছে। প্রতিবাদ স্বরূপ সেই সমস্ত অশরীরী আত্মারা এরূপ অভিনব কৌশল অবলম্বন করেছে। ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক কিছু ববস্থা নিতে পারত ,কারণ সে শক্তি তাদের ছিল। যেহেতু তারা একসময় বংশের বংশধর ছিল,সে কারণে ধ্বংসাত্মক পন্থা গ্ৰহণ না করে নিছক প্রতীকী প্রতিবাদের আশ্রয় নিয়েছে।
তাঁদের আরো সংযোজন --- কয়েক দিন পর যখন গয়াধামে পিন্ড দান ক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যাবে, তারপর থেকে উপদ্রব বন্ধ হয়ে যাবে।কারণ, তখন সমস্ত প্রেতাত্মা এখান থেকে চির দিনের মতো বিদায় নেবে।
যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে ভূত বিশেষজ্ঞদের এমন ভৌতিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সাধারণ মানুষের মনে ধরাটাই স্বাভাবিক।
আর কাকতালীয় ভাবে ঘটল ও তাই। পাঁচ থেকে ছ' দিনের মাথায় ঢিল পড়া বন্ধ হবে গেল। আপাতত স্বস্তি মিলল বটে,ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় মন শঙ্কিত হয়ে রইল।
তবে না,গণক মশাই গ্যারান্টি দিয়েছেন এই মর্মে যে, দ্বিতীয়বার এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।
যুক্তিবাদীরা সন্দেহ প্রকাশ করে বলল---- ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে।ব্যাপারটা নিছক তাই। হয়তো মজা দেখতে কেউ বা কারা প্রথম দিন একটা ঢিল ছুঁড়েছিল বাড়ির মধ্যে। সেই ঘটনা তিল থেকে তালের আকার ধারণ করল আর কত কান্ডই না ঘটে গেল!
নবীনরা যাই বলুক,তারা অনভিজ্ঞ। আপামর প্রবীনদের , পুরোহিত এবং গণৎকারের উপর ভক্তি-বিশ্বাস নতুন করে বহুগুণ বৃদ্ধি পেল।
সপ্তা তিনেক পরে উত্তর ভারত ভ্রমণ শেষে দেবনাথ দম্পতি গৃহে ফিরলেন। তাঁদের গৃহত্যাগের পরপর গৃহে ঘটে যাওয়া তোলপাড় করা ঘটনার বিবরণ অবগত হয়ে বিস্মিত হলেন বটে, কিন্তু অবিশ্বাস করলেন না। পুরোহিত এবং গণক মশাইয়ের সিদ্ধান্তকে সকৃতজ্ঞ চিত্তে মান্যতা দিলেন।
===========================