প্রবীর বারিক
গত চারদিন হল সোনালীর পেটের অবস্থা ভালো নেই।দিনে ৮- ১০ বার পাতলা পায়খানা হচ্ছে তার।মুখে কোন খাবার তুলছে না।জোর করে খোয়াতে গেলে বমি করে সব বের করে দেয়।আড়াই বছরের টুকটুকে সোনালী কেমন নিস্তেজ হয়ে বসে থাকে।" মা মা মাম খাবো" বলে কাঁদতে থাকে।
রুদ্রানী মেয়ের এই অবস্থা দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনা।কখনও মুড়ির বাটি,সুজির থালা,ডালিয়ার প্লেট, চিড়ে ভাজা,মুসলি,খিচুড়ি, সাদাভাত - সব রকমের খাবার খাওয়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে।কিন্তু পণ্ডশ্রম,কোন খাবারই মুখে তুলে না মেয়ে।
রাগও হয় সেইসঙ্গে দুঃখও গ্রাস করে রুদ্রাণীর মাতৃবাৎসল্যে।
বর্ষার মরশুম শুরু হয়েছে।বাড়ি বাড়ি আমাশয় যেন সাধারণ রোগে পরিণত হয়েছে। দু ' দিনেই মেয়েটি কেমন রোগা,কালশিটে হয়ে গেছে। ছটফটে স্বভাবের মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা মেয়েটিকে চেনাই যায় না।
পলাশ মঙ্গলবার বাড়ি এসেছে। অ্যাজমার সমস্যাটি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ডাস্ট অ্যালার্জিও প্রকট হয়ে ওঠে।অফিস গিয়েছিল বাসে চেপে।স্বাস প্রশ্বাসে বুকে ব্যাথা উঠতেই রোটা ইনহেলার কম্বিহেল ও ফুটিকাসন মুখে নাকে টান দেয়।ভারী করে রাখা বুকটা হালকা হল।ডাক্তারবাবুর পরামর্শ - " বিশ্রাম নিন"।
পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাবে এই ঘটনা ঘটে থাকে।এক সপ্তাহের জন্য ছুটি নেয় পলাশ।বাড়িতে বেড রেস্টে থাকে।সাথে দুধ,শসা,চিংড়ি ইত্যাদি অ্যালার্জি উদ্দীপক খাবারগুলো থেকে দূরে থাকে।অনেকটা সুস্থতার পথে পলাশ।
এদিকে রূদ্রাণী মেয়ে সোনালীর চিন্তায় পাগলির মতো হয়ে উঠেছে।জোর করে ওষুধ খোয়ানোর চেষ্টা করে।' বাবা গো ও বাবা " বলে কেঁদে ওঠে সোনালী।
" সোনা মা আমার,এসো কোলে এসো" - বলতেই মায়ের কোল থেকে ঝাঁপ মেরে পলাশের কোলে এসে কাঁধে মাথা গুঁজে কাঁদতে থাকে।সারা সপ্তাহ পিতৃস্নেহ পায়না মেয়েটি।সপ্তাহে দু একদিন বাবা বাড়ি আসলে মেয়েটি স্বর্গসম সুখে ভেসে বেড়ায়।পিতার সাথে হামাগুড়ি খেলা করে।পুতুল ভেবে পিতাকে খাইয়ে ,স্নান করিয়ে দেয়।না খেতে চাইলে পিতাকে শাসন করে। মোট কথা মা যেমনভাবে সোনালীকে খাওয়ায়,বকুনি দেয় ঠিক সেই ঘটনাবলীর প্রতিফলন ফুটে ওঠে ছোট্ট মেয়েটির মধ্যে।
একদিন ঠাম্মার কোলে যাওয়ার জন্য কেঁদে কেঁদে গড়াগড়ি দিতে থাকে - " ও ঠাম্মা কোলে নাও"।
মঞ্জু নাতনির করুণ স্বরে কান্নার রোল শুনতে পেয়ে দৌড়ে আসে - " আয় বুনু আয়, হন্টুর দোকান যাব চল।কাঠি চকলেট খাবি?"
কথাটা বলা শেষ হতে না হতেই রুদ্রানী রুম থেকে বেরিয়ে ছোঁ মেরে সোনালীকে মঞ্জুর কোল থেকে ছিনিয়ে নেয়।সোনালী যারপরনাই উচ্চস্বরে কান্না জুড়ে দেয়।
ঘরের কোণেতে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে লাগলো সে।
" দম আটকে যাবে যে,তাকে কোলে নাও"
" দূর হয়ে যা তুই।আমার বাচ্চা আমি বুঝে নেব।বেশি জ্ঞান দিতে হবে না। কথায় বলে না মায়ের থেকে মাদির দরদ বেশি। এতো দরদ তো তার খাওয়ানো,ওষুধ দেওয়া,সব দায়িত্ব নাওনি কেন?যদি নাই পারবে মাঝে নাক গলাতে কেউ আসবে না" জ্যান্ত মাছ ডাঙায় লাফানোর মত ঝনঝন করে লাফিয়ে ওঠে রুদ্রানী।
" দেখ পলাশ দেখ,এসব কি বলছে,আমি কি কুকুর বিড়াল?"বৌমার অমানবিক উগ্রস্বভাবে মঞ্জুর সরলমনা হৃদয়টি দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গেল।অতীতের ব্যথা বেদনাময় কঠোর সংগ্রামের কথা মনে পড়ে গেল।
ভোর তিনটে থেকে ওঠে মুড়ির চাল খোলা হাঁড়িতে নুন দিয়ে নাড়া,মুড়ি ভাজা - মধ্যিখানে দুর্বলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়া,বর্ষায় কাঠের জ্বালানিতে ফুঁকা দিতে দিতে ধোঁয়ায় রান্না করা - সারা বছরে একটাও নতুন শাড়ি না পাওয়া,একান্নবর্তী গৃহস্থের সংগ্রাহী অশ্রুভেজানী দিনরাতের কাহিনী স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে চোখের পাতা ভিজে গেল।
রুদ্রানী তখন সিজার পেশেন্ট।হাঁটতে চলতে পরে না।হাসপাতাল থেকে বাড়িতে বিশ্রামে থাকে রুদ্রানী ও সদ্যজাত কন্যা সোনালী।কাটাঘায়ে প্রভিডন আয়োডিন মলম লাগানো,গরম জলে ড্রেসিং করা,সোনালীর জামা কাপড় কাচা,রুদ্রানীর জন্য হালকা জিরাজলের সহজপাচ্য খাবার রান্না করা - সবই নিজ মাতার মতো পালন করে মঞ্জু।রুদ্রনী হয়তো সেসব ভুলে গেছে।বিপদের সময় সাপও বাপ বাপ করে।আর বিপদ কেটে গেলে শেয়ালও সিংহ হয়ে ওঠে।
খিটখিটে মেজাজটা রুদ্রানীর ছিল না। হাসিখুশিতে সবার সাথে মিলেমিশে থাকাই শ্রেয় মনে করত সে।
শাশুরির কটূক্তি " গরীব বাড়ির মেয়ে দেখতে পেত না কিছু,এখন সব হাতের কাছে পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। অলুক্ষণে কোথাকার!বাপ মা কি শিক্ষা দিয়েছে?"
রুদ্রানী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।স্নান সেরে তুলসী মঞ্চে জল ঢেলে অন্ন গ্রহণ করবে।সেই সময় পলাশ মাকে বোঝায় " ঝগড়া করে কি হবে? তর্ক করে কি কেউ কখনও নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে?"
সেই মুহূর্তে রুদ্রানীর আগমন। শাশুড়ীর ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে দাম্ভিক রূপে বলে , " তুই কে?তুই আমার কেউ না।আমার সম্পর্কে কিছু বলবি না।না হলে...."
" না হলে কি করবি? মারবি?"
এই কথাকাটাকাটির মাঝে দুজন দুজনের দিকে তীব্র গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।পলাশ রুদ্রাণীকে আটকায়,দুইহাতে ধরে রাখে,সেই অবস্থায় চেয়ার ছুঁড়ে মারে মঞ্জুর দিকে। চকোসের কৌটোও মঞ্জুর দিকে তাক করে মারে।খাবার দাবার জিনিসপত্র সব মুড়ি মুরকির মতো হয়ে গেলো।
পলাশ না পারে মা কে সামলাতে,না পারে স্ত্রীকে।দুজনকেই সমান প্রয়োজন জীবনে।শ্বাশুড়ি বৌমার ঝগড়া প্রত্যেক বাড়িতেই লাগে থাকে। রুদ্রনী মঞ্জুর মধ্যেও হত। আজ সমস্ত সীমা অতিক্রম করলো।
দুজনকে দুদিকে সরিয়ে কোনমতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থামাতে সক্ষম হল পলাশ।মা বউয়ের অহিনকুল সম্পর্ক কি করে ঠিক হবে মনে মনে সমাধান সূত্র খুঁজতে থাকে সে।জন্মদাত্রী মা যে শতকষ্ট বুকে সহ্য করে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে।তাই মাকে ফেলতে পারে না।বিবেকে বাধে তার।আবার অগ্নিকে সাক্ষী রেখে ধর্মপত্নীর স্থান দিয়েছে রুদ্রানীকে।নিজের বাবা মা আত্মীয় স্বজন ছেড়ে স্বামীর ঘর এসেছে সুখের সংসার গড়ে তোলার জন্য। গালে হাত দিয়ে দার্শনিকের মতো ভাবতে শুরু করে পলাশ - জীবনে কার গুরুত্ব বেশি?
================================