তারাদের কথা ।। বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্রঃ যতীন্দ্রনাথ বাগচি।। পাভেল আমান।
0
ডিসেম্বর ০১, ২০২৪
যতীন্দ্রনাথ বাগচি
পাভেল আমান
'বাঁশ বাগান মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক–বলা কাজলা দিদি কই?' হারিয়ে যাওয়া বোনটিকে ফিরে পাওয়ার হৃদয় নিংড়ানো গভীর আকুতি আজও দাগ কেটে আছে অগণিত পাঠকের মননে। একটি সার্থক কবিতাই যে কবিকে সাহিত্যের আসনে স্থায়ীভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম– কাজলা দিদি কবিতাটি এর অন্যতম প্রমাণ। এই কবিতাটি বিখ্যাত করেছিল কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে। তৎকালীন রবীন্দ্রত্তোর যুগের এক অন্যতম কবিত্ব সত্তার অধিকারী যতীন্দ্রমোহন বাগচী। আপন প্রতিভা সৃজন চেতনায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি এক চির পরিচিত নাম। যতীন্দ্রমোহন বাগচী ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭ নভেম্বর পশ্চিমবাংলার নদীয়া জেলার জমশেরপুরের বিখ্যাত বাগচী জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা হরিমোহন বাগচী এবং মা গিরিশমোহিনী দেবী। বাগচী পরিবার ছিল তখনকার একটি মুক্তচিন্তার পাঠশালা। যতীন্দ্রমোহন বাগচী প্রতাপশালী জমিদার পরিবারের সন্তান হলেও সাধারণের সাথে মিশেই তিনি শৈশব পার করেছেন। শৈশব-কৈশোর থেকেই তিনি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন সাধারণ জীবন-যাপনের প্রতি। যতীন্দ্রমোহন বাগচীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার জ্যাঠামশায়ের কাছে। জ্যাঠামশায়ের কাছে পাঠ্যপুস্তক নয়, তিনি পড়েন মহাভারত, কৃত্তিবাসের সপ্তকাণ্ড ও রামায়ণ। জ্যাঠামশায়ও নিবিড়ভাবে শুনতেন যতীন্দ্র মোহন বাগচীর এই পড়া। তার প্রথম একাডেমিক জীবন শুরু বহরমপুরের খাগড়াতে মিশনারী স্কুলে। শৈশবেই তিনি তীক্ষ্ণ মেধার পরিচয় দিয়ে শিক্ষকদের বিস্মিত করে ফেলেন। পরে তিনি ভর্তি হন কলকাতা হেয়ার স্কুলে। প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এফ. এ ও বি.এ পাস করেন। শিক্ষাজীবন শেষে নদীয়াস্থ জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এসবে তার মন বসল না। তিনি চলে যান কলকাতায়। সেখানে তিনি পুরোপুরি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তার শৈশব জীবনের লেখা তখনকার আলো ও উৎসাহ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হত।১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি মানসী, বঙ্গদর্শন, সাহিত্য, ভারতী, প্রবাসী, সাধনা, সবুজপত্র, মর্মবাণী, পূর্বাচল, যমুনা ইত্যাদি পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে তিনি লিখেছেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ পূর্বাচল পত্রিকার মালিক এবং সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। তাকে রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনা করে হয়।কবিতা তো ইতিহাস নয়, দর্শনও নয়। কবিতা হলো হৃদয়ের ভাব, একইসঙ্গে অন্তরের ছবিও এবং যতীন্দ্রমোহন সেখানে সার্থক।বাংলা কাব্যে একক নাটকীয় সংলাপ প্রয়োগেও সার্থক এই কবি মূলত কলাবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগ করতেন, চিত্রকল্প সৃষ্টি ও চরিত্রের যথার্থ উপস্থাপনায় এই ছন্দ উপযুক্ত। এই ছন্দের মাধ্যমেই কাজ্লাদিদি বা অন্ধ বধূর মতো চরিত্র রসোত্তীর্ণ হয়েছে, আবার কর্ণ বা দুর্যোধনের মতো চরিত্রও। 'কর্ণ', 'দুর্যোধন', 'ভীম', 'অশোক'-এর মতো কবিতায় পৌরাণিক যুগের বিশ্লেষণ পাওয়া যায়, তেমনই 'রাধা', 'মথুরার রাজা' ইত্যাদি কবিতায় বৈষ্ণব যুগের বর্ণনা ও চরিত্রও বিশ্লেষিত হয়েছে।মাটির সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান ছিল অবিচ্ছেদ্য, প্রকৃতিপ্রীতির কারণেই তাঁর কলমে ফুটে ওঠে যথাযথ নিসর্গবর্ণনা। আবার জীবনের অধিকাংশ সময় শহরে থাকার জন্য তাঁর ভাষা পরিশীলিত ও মার্জিত। জন্মের প্রায় দেড়শো বছর পরেও যে কবির কবিতা বা গান আমাদের মুখে মুখে ফেরে, বিস্মৃতি বা অনালোচনার আঁধার তাঁর প্রাপ্য নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "যে বাক্য তোমাকে খর্ব করতে চায়, তোমার বাণীর পরমায়ু তার চেয়ে বেশী।" অনেক দিনের পড়ে যাওয়া ধুলোটুকু সরিয়ে অপরিচয়ের ব্যবধানটুকু দূর করার প্রচেষ্টা দরকার আজ।যতীন্দ্রমোহন বাগচীর অজস্র কবিতা সঙ্কলিত হয়নি, তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনাও হয়নি সে ভাবে। অথচ তাঁর কবিতার ভাষা আজও আমাদের সমগ্র চেতনাকে মন্থন করে। পরিশেষে যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিতা ও জীবন দর্শন নিয়ে আরো বেশি আলোচনা ও চর্চা হোক বাঙালি পাঠকের দরবারে।
=====================
রচনা- পাভেল আমান- হরিহরপাড়া -মুর্শিদাবাদ