বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। প্রতিবাদী ।। আবদুস সালাম

 

 

প্রতিবাদী

 আবদুস সালাম

 সবিতা রানী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রাঁধুনী দের কোন না কোন অজুহাতে প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকে। ওদের ঝগড়ার মাত্রা কখনো কখনো এমন তীব্র আকার ধারণ করে যে আলু পেঁয়াজ ছোঁড়া থেকে শুরু করে খুন্তি, বটি, কাঠের টুকরো, ঘুঁসি (ঘুঁটে)ছোঁড়াছুঁড়ি সবই হয় ।অল্পস্বল্প যখম যে হয়না এমন নয়তরকারি কাটা যেই শেষ হয়ে যায়, ক্ষণিক পরে দেখা যায় সবাই  চুপচাপ।

 রান্নাবান্না  থেকে আরম্ভ করে  ছেলেদের মধ্যে   খাবার সুষ্ঠুভাবে বিলি-বন্টন ,হাড়ি- হোন্ডা  ধোয়া সবই হয় সময় মতো। রান্না শেষে সবাই খুশি মনে বিদায় ও হয়।এ এক আজব  কাণ্ড । কিছুতেই হিসেবে মেলানো যায় না ‌। কেন যে এরা ঝগড়া করে, আর কেমন করেই  বা এরা মিলে যায় ভাবতে অবাক লাগে।

 বিশাল বড়ো গ্রাম ।  গ্রামে একটাই স্কুল বলে ছাত্র সংখ্যা ও অনেক প্রায় সাড়ে চারশোর উপর । গ্রামটি নিম্নবর্গ ও  সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বলে গ্রামে দলাদলির পরিমাণ খুব বেশি ।  নিয়োগ হয়েছে চার জন রাধুনী। এদের ভিতর    সিডিউল কাস্টের তিন জন আর একজন বিধবা মুসলমান বুড়ি। নেতাদের মদতে হরেন  তার স্ত্রীর বদলে কাজ করতে আসে।

 রাধাকান্ত বাবু এই বিদ্যালয়েরই প্রধান শিক্ষক ।মারি মাছ না  ছুঁই পানি   গোছের তার হাবভাব।

  নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ভালো মানুষ সেজে এর কথা ওকে, ওর কথা ওকে বলে বেড়ান । পরিবেশ যাতে স্বচ্ছ না হয় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া তার  বরাবরের অভ্যাস।সিডিউল কাস্টের তিন জন আর একজন বিধবা মুসলমান বুড়ি। নেতাদের মদতে হরেন  তার স্ত্রীর বদলে কাজ করতে আসে।

 ক্লাসে আছি, এমন সময় হট্টগোল এলো কানে । স্বভাবতই  উৎসুক কান চলে যায় ওই দিকে।, আরে হট্টগোল যে আমারই  ছাদের নিচেই,  যেখানে সদ্য তৈরি হয়েছে কিচেন ঘর। ‍ বাইরে এসে দেখি আমাদের রাঁধুনি  সাবিয়ার মা প্রাণপণ  চেঁচাচ্ছে -

" জ্বলি গ্যালো রে, পুড়ি গ্যালো রে। ল্যাড়ের ব্যাটা হামাকে ওরা পোড়েঁয় মারলে  রে   আল্লাহ তুমি বিচ্যার করিও রে  ।"

 বাইরে এসে দেখি, রাধাকান্ত বাবু দাঁড়িয়ে আছে। সব দেখেশুনেও নিশ্চুপ । এত বড় একটা ঘটনার নিরব সাক্ষী সে ।কেবল হরেন  সর্দারের ভয়ে  তটস্থ সে  ।অবশ্যই এর আগে ভি ই সি কমিটির  হেনস্থার হাত থেকে রক্ষা করেছিল  হরেন সর্দার। তারই প্রতিদান স্বরূপ বিন্দুবৎ উচ্চবাচ্চ্য না করে হরনের  সমস্ত অপরাধ আড়াল করার জন্য বলে বসলেন " আমি কিছুই দেখিনি "---

 অথচ তার চোখের সামনে এতো বড়ো একটা মর্মান্তিক ঘটনাটা ঘটে গেলো ।

 অন্য দিকে কোলাহলের রেশ ধরে প্যারাটিচার  মসিউর মাস্টার  ছুটে এসেছে ক্লাস থেকে। এসেই দেখে সাবিয়ার মায়ের সারা শরীর মোটা মোটা ফোস্কায় ভরে গেছে। লাল দগদগে হয়ে গেছে শরীরের বাকি অংশ। যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে ।

উৎসুক মানুষের দল জড়ো হয়েছে রাস্তায়। টহলদার পুলিশের গাড়ি এসেছে স্কুলে । কি ব্যাপার ,কি ব্যাপার? পুলিশের বড়োবাবু  গ্রামে এসেছিলেন কোনো একটি কেশের তদন্তের জন্য। গন্ডোগোল শুনে গাড়ি নিয়ে আসেন স্কুলে ‌। বড়ো বাবু  হেডমাস্টার  রাধাকান্ত বাবু কে জিজ্ঞেস করলেন কি ব্যাপার মাষ্টারমশাই ? আপনি তো স্কুলে ছিলেন!  রাঁধুনি হরেন সর্দারের তো গলা শুকিয়ে কাঠ। মাস্টার মশাই যদি সব বলে দেন তবে নির্ঘাত তার জেল হবেই হবে। কেউ রক্ষা করতে পারবে না।  হরেন একদিন তাকে  হেনস্থার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল । তার  কৃতজ্ঞতা স্বরূপ  অবলীলায়  উত্তর দিলেন  এসবের আমি কিছুই দেখিনি স্যার —-

 এক অসহায় বৃদ্ধার পর অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো মন্টু মাস্টার। বড়ো বাবু কে বললেন একটা মানুষ কতখানি বর্বর হলে এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে স্যার  দেখুন।  আমরা বাঘ সিংহ কে হিংস্র বলি । তারা কিন্তু এমন কাজ করে কেবল ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য । অন্য কোন উদ্দেশ্য তাদের থাকে না। আর মানুষ আর হিংস্র হয় হীন স্বার্থ  চরিতার্থ করতে। মানুষ কতটা অমানুষ হলে এমন কাজ টি করতে পারে। সদ্য রান্না হওয়া এক ডেকচি গরম খিঁচুড়ি অবলীলাক্রমে একটি বুড়ি মানুষের গায়ে ঢেলে দিতে পারে ।  যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কুঁকড়ে গেছে সারা শরীর।

তাড়াতাড়ি একটা ভ্যান ডেকে নিয়ে চললো সাগরদীঘি হাসপাতালের দিকে।

 সাগরদীঘির দীঘিটি পাল আমলের খনন করা। কতো না স্মৃতি ,কেচ্ছা কাহিনী লোক মুখে   শোনা যায় এই দীঘি কে নিয়ে।  দীঘির মাঝে এখনও বিদ্যমান রয়েছে একটি স্মৃতি স্তম্ভ।   অদ্যাবধি এই স্মৃতি স্তম্ভ জানান দেয় অত্যাচারী  রাজাদের অত্যাচার থেকে নিপীড়িত  মানুষের মুক্তির বিজয় কেতন। দীঘির নাম সাগরদীঘি থেকে বোঝা যায় যে দীঘিটি  আকৃতি কতো বিশাল ছিলো। ইদানিং   নেতা আর জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে দীঘির কলেবর ছোট হতে শুরু করেছে। এখনও যা   আছে তাও বিষ্ময়ে হতবাক হতে হয়। প্রায় একমাইলের ওপর লম্বা। প্রস্থ ও কাছাকাছি একই রকম।

  হেড মাষ্টারমশাই এর বলার অপেক্ষা না করেই মসিউর মাষ্টারমশাই সাবিয়ার  মায়ের চিকিৎসার  সমস্ত খরচ বহন করলেন ।  সেদিনই বেতনের টাকা তুলে এনে স্কুলে এসেছিলো।একটি বার ও ভাবলে না যে ,  আগামী কাল  মিশনে ছেলের  টিউশন ফি দিতে হবে ।অপর একটি  মেয়ের  চিকিৎসার জন্য  বেতনের অর্ধেক টাকা খরচ করে ফেললো। সারা মাস তার কেমন করে চলবে এই সহজ কথা টা তার মনে আসেনি ।ক- টাকায় বা বেতন পায়। একটা প্রাইমারি স্কুলের প্যারাটিচার সে। বুঝতেই তো পারছেন । কোনো আগে পিছে চিন্তা করলো না । এখনও এমন মানুষ গুলো আছে বলে  সূর্য পূর্ব দিকে উঠছে।

  এক অসহায় বৃদ্ধার পর অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো মন্টু মাস্টার। বড়ো বাবু কে বললেন একটা মানুষ কতখানি বর্বর হলে এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে স্যার  দেখুন।  আমরা বাঘ সিংহ কে হিংস্র বলি । তারা কিন্তু এমন কাজ করে কেবল ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য । অন্য কোন উদ্দেশ্য তাদের থাকে না। আর মানুষ আর হিংস্র হয় হীন স্বার্থ  চরিতার্থ করতে। মানুষ কতটা অমানুষ হলে এমন কাজ টি করতে পারে। সদ্য রান্না হওয়া এক ডেকচি গরম খিঁচুড়ি অবলীলাক্রমে একটি বুড়ি মানুষের গায়ে ঢেলে দিতে পারে ।  যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কুঁকড়ে গেছে সারা শরীর।

  মিড ডে মিল রান্না করতে গিয়ে  চুরি করা সামান্য  কিছু   আনাজ পাতির বখরা  চাওয়ার জন্য তার এই শাস্তি। একেই তো হেডমাস্টার  বরাদ্দ অর্থের  সবটুকু খরচ করে না। দোকানদার বাকি তে মাল কিনছে বলে মাল কম দেয়, আমরা রান্না করতে গিয়ে আলু মশলা চাল তেল নুন সরিয়ে রাখছি ।  হবিষান্নের মতো খিঁচুড়ি খেতে ছেলে মেয়েদের বাধ্য করছি। বড়ো লোকের ছেলে মেয়েদের তো দেখছি ছাগল কে খাওয়াবে নিয়ে যায় । একেবারে অভাগা , গরীব, মালপাড়া ,বাগ্দীপাড়া  আর কয়েক ঘর মুসলমান  মানুষের ছেলে মেয়ে মিড ডে মিল খাচ্ছে।হাভাতের দল  দুটি খাবার পাওয়ার আশায় স্কুল আসছে তারাই  বসে খায়।


 এতো দিন সালাম মাষ্টার যখন হেডমাস্টার ছিলো তখন  সব ছেলে মেয়েদের একসাথে বসে যত্ন করে খাওয়াতেন। রুচি করে সবাই খেতো । ছেলে মেয়েদের বলতো দেখ তোদের সাথে আমিও খাচ্ছি। দেখাদেখি সবাই খেতো।

 

    সবাই হেডমাষ্টার, পুলিশ নিয়ে ব্যাস্ত। অন্য দিকে ছটফট করছে সাবিয়ার মা।

 

পাড়ার লোক ,বাজারের লোক মন্টু মাস্টারের প্রশংসাই পঞ্চমুখ। থানার লোক এসে অন্য রাঁধুনিদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে চললো থানার দিকে। হরেন সরদার চেঁচিয়ে  চেঁচিয়ে বলে "ছাড়া পেলে দেখি লুবো রে   ব্যাটা মন্টু মাস্টার। কত দুধ -দহি দিঙ ভাত খেঁঙাছিস  রে ব্যাটা।"

 

আহত বাঘ যেমন প্রতিশোধ স্পৃহা তে গোঁ গোঁ  করে  তেমনি  হরেন সর্দার রাগে ফসফোঁস করে।  ও তো জানছে  পার্টির নেতারা  এসে ছাড়িয়ে  নিয়ে যাবে।

  সুযোগের অপেক্ষায় থাকে । কেমন করে মন্টু মাস্টার কে জব্দ করবে সে ।

বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে সরস্বতী পূজা । ছেলে মেয়েরা অংশগ্রহণ করবে । অভিভাবক অভিভাবিকারা দেখবে তাদের ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণ।  এমন অনুষ্ঠান তো কোনো দিন হয়নি। উৎসাহে সব টগবগ করে ফুটছে যেন । রাধাকান্ত বাবু চাই না এসব ।ওর পরিস্কার করা  এইসব ছোট লোকের বাচ্চাদের মাথায় তোলা ঠিক নয় । কি হবে এসব করে ‌দুবছর পর তো সব চলে যাবে রাজমিস্ত্রির কাজে। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিবে । অযথা ভষ্মে ঘি ঢেলে কি লাভ।

 সরস্বতী পূজা উপলক্ষে মন্টু মাস্টারের নির্দেশনায় অনুষ্ঠিত হলো গান, বাজনা, নাচ।  রাতের বেলায়  হবে নাটক ।নাটক শেষে সবাই মিলে আনন্দ করে হবে খাওয়া দাওয়া। সেই মতো ব্যবস্থাও ছিল ।ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ।প্রাকৃতিক কারণে মাঠের দিকে যেতে হয়েছিল। ওত পেতে বসেছিল হরেন। সেই মতো প্রস্তুতি ছিল তার । অনুষ্ঠান শেষে একবার আক্রমণ কররবেই সে।।

  বিপদ যেন সব সময় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।   স্কুলের কাছেই পুকুর। জলের জন্য  ব্যাটা মন্টু এদিকেই আসছে।  মেঘ না চাইতেই জল। আকাশের চাঁদ যেন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে । কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক লাফে হরেন  মন্টু মাস্টারের গলায় লাগিয়ে দেয় গামছার ফাঁস।   গামছাতে ফাঁস টেনে চাকু ভরে দিলো তার পেটে। গোঁত্তা খেয়ে  পড়ে  গেলো মাটিতে। লুটিয়ে পড়া মাত্র উপুর -যুপুরী  চাকু   মাস্টারের বুকে পিঠে মারতে লাগলো হরেন ।

  রক্তাক্ত দেহ ছেঁড়া বস্তার মত পড়ে রইল গাছ তলায় ।রাত অনেক হয়েছে। খিদেয় ছেলেদের  চোঁ চোঁ করছে পেট । মাষ্টারমশাই এর সঙ্গে খাবে   বলে বসে আছে সবাই। না  মাষ্টারমশাই আসে না । শুরু করতে পারছে না খাওয়া। শুরু হলো খোঁজাখুঁজি।

 হ্যাচাক নিয়ে মাঠের ধারে যেতেই দেখা গেল  পড়ে আছে মাষ্টারমশাই এর রক্তাক্ত অচৈতন্য দেহ ।  যার হাতে মুখে পেটে অজস্র  চাকুর খোঁচা।

 -----------------------

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.