ছোটগল্প ।। কর্মবিমুখতা ভিক্ষাবৃত্তির কারণ ।। সমীর কুমার দত্ত
0
ডিসেম্বর ০১, ২০২৪
কর্মবিমুখতা ভিক্ষাবৃত্তির কারণ
সমীর কুমার দত্ত
সঞ্জয় সামন্ত নামের এক ব্যক্তি একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে বিল কালেক্টরের চাকরি করতো। যা মাইনে পেতো তাতে তার সংসার ভালো ভাবে চলতো না। চলবে কি করে সাট্টা খেলার রোগ আছে তো। দান লাগায় আর সব পয়সা ঢুকে যায়। তাই কোম্পানির কাজে মাঝে মধ্যেই বিল আদায়ের টাকার গণ্ডগোল করতো। মাঝে মাঝেই ক্যাসিয়ার গোপাল বাবুর সঙ্গে হিসেব গণ্ডগোল করে বিবাদে জড়িয়ে পড়তো । ধরা পড়ে গেলেই 'সরি' বলে অন্যকে ভুল বুঝিয়ে তার কাছ থেকে টাকা ম্যানেজ করে বিল মিটিয়ে দিতো। অনেক বার সে এরকম করে মালিকের কুনজরে পড়ে। মালিক মিঃ বোস বহুবার ওকে সর্তক করেছেন এবং বলেছেন আর একবার হলে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন। তবুও ওর চেতনা হয় না।
অপরদিকে গোপাল বাবু খুবই সজ্জন ব্যক্তি। দীর্ঘদিন ধরে এই কোম্পানিতে কাজ করছেন সুনামের সঙ্গে। তিনি কোম্পানিকে ভালোবাসেন। কোম্পানির ভালো চান এবং মালিকের সুনজরে আসেন। সেহেতু মালিক গোপাল বাবুকে নানা রকম সুযোগ সুবিধে দেন। কারণ গোপাল বাবুর মতো লোক চলে গেলে তিনি আর গোপাল বাবুর মতো বিশ্বস্ত লোক পাবেন না। গোপাল বাবুর প্রতি মালিকের এই যে বদান্যতা আর ওর প্রতি ঘৃণ্য মনোভাব সঞ্জয়কে মালিক ও গোপালের প্রতি প্রতিশোধ পরায়ন করে তোলে। তাই সে সর্বদা মালিক ও গোপালের ক্ষতির কথা ভাবতে থাকে।
এদিকে দোকানে, বাজারে সঞ্জয়ের অনেক টাকা বাকি পড়ে গেছে। দোকানদাররা জানিয়ে দিয়েছে যে টাকা না পেলে তারা আর মাল দেবে না। কারণ টাকা না পেলে তাদের চলবে কি ভাবে। তাদের মাল কিনে বেচতে হয়। ধারে মাল আর বেচা যাবে না। ধার শোধ করতে পারলে তবে মাল পাবে। তা সে কোথা থেকে দেবে, চুরি করবে কি ডাকাতি করবে তা তাদের বোঝার দরকার নেই।
'চুরি' কথাটি বলতে সঞ্জয় মনে মনে ভাবলো এরা ভালো কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। মনে মনে উচ্চারণ করলো 'চুরি', হ্যাঁ সে চুরিই করবে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো," তোমরা কাল টাকা পেয়ে যাবে। কথা দিচ্ছি।" মনে মনে বললো —ঠিকই তো চুরি তোমরা করবে কেন? তোমরা তো ব্যবসা করে খাও। সব শালা ব্যবসায়ীর একই চরিত্র। তোরা কি চুরি করিস না? হ্যাঁ, চুরি তো করতেই হবে তোদের মুখ বন্ধ করতে।"
পরের দিন একটা মোটা অঙ্কের বিল আদায়ের টাকা পাবে। সেই টাকা দিয়েই সবার মুখ চুপ করিয়ে দেবে। ধার চুকিয়ে না দিলে ওরা মাল দেবে না। তাহলে খাবে কী? যেমন ভাবা, তেমন কাজ। পরের দিন মোটা অঙ্কের বিল কালেকশন করে সঞ্জয় আর অফিস মুখো না হয়ে সোজা বাড়ি চলে আসে। বাকি পড়া সব টাকা মিটিয়ে দেয়। বাকি আরও কিছু পাওনাদারের টাকা মিটিয়ে সে আর অফিস মুখো হয় না। মনে মনে বলে চাকরির নিকুচি করেছে। যে চাকরি করে দুঃখ ঘোচে না, সে চাকরি করে লাভ কি। মাইনে বাড়াবার নাম করে না।মালিকের তার প্রতি কোন সহানুভূতি নেই। যে কোন সময় তাকে বরখাস্ত করে দিতে পারে। এই দাঁওটা মেরে দেনাগুলো সব শোধ করে আবার হাতে কিছু রয়ে গেছে। এতে বেশ কিছুদিন চলে যাবে। দু চার দিন সাট্টায় দান লাগিয়ে দেখতে হবে, যদি টাকা পাওয়া যায় তো ভালো, না হলে সে আর সাট্টাই খেলবে না। তারপর দেখা যাবে কি করা যায়। কিছু তো একটা করতেই হবে। সে যে মালিকের টাকা মেরে কাজে না যাওয়ার মতলব করেছে তা তার বাড়িতে কিছু জানায় নি।
কাজ নিয়ে ভাবতে ভাবতে তার নজরে পড়লো ভিক্ষবৃত্তি করে বেঁচে থাকা এক ভিখারী দম্পতি। অন্ধ লোকের অভিনয় করে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে। ভিখারি দম্পতি কে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সঞ্জয় বলে উঠলো, "ইউরেকা, আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছি। চাকরিতে ঝুঁকি আছে, ভিক্ষেতে নেই। চাকরিতে স্বাধীনতা কোথায়? ভিক্ষা করা স্বাধীন ব্যবসা। যতদিন মানুষের মনে দয়া,মায়া, মমতা আর ধর্ম বিশ্বাস থাকবে ততদিন ভিক্ষাবৃত্তি বহাল তবিয়তে চলবে। তদুপরি ভিক্ষা পেশায় নেই কোন চাঁদা কিংবা ট্যাক্সের জুলুম। দেওয়ার নেই কিছু ,পাওয়া আছে। শুধু বুদ্ধি করে করতে পারলেই হলো। তবে হ্যাঁ পাক্কা অভিনেতা হয়ে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। অন্য কিছুর মতো ভিখারীরও শ্রেণী আছে। ঠিকমতো করতে পারলে উচ্চ শ্রেণীর ভিখারী হওয়াও অসম্ভব নয়। যে দেশে বেকার থাকবে সে দেশে ভিক্ষাও একটা পেশা হয়ে থাকবে। অনুন্নত দেশগুলো হলো ভিখারি তৈরির কারখানা। উন্নত দেশে ভিক্ষুক নেই বললেই চলে।" এইসব যুক্তি মেনে নিয়ে সঞ্জয় ভিক্ষাবৃত্তিকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হলো
পরের দিন সে একটা কালো চশমা পরে মন্দিরের পাশে ভিক্ষা করতে বসে পড়লো। কালো চশমাতে তিনটে সুবিধে হলো। এক, কেউ তাকে চট করে চিনতে পারবে না। দুই, লোকে অন্ধ ভেবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। তিন, পরিশ্রম থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। বেশ কয়েকদিন ভালো আয় হতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো,আহা রে,এতো দিন এই পেশায় কেন সে আত্ম নিয়োগ করে নি! তাহলে তো তাকে মালিকের দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হতো না। আর এতো পরিশ্রম করতে হতো না। এই বেশ ভালো হলো। খুচরো পয়সা বন্ধ হয়ে গিয়ে ভিক্ষার পরিমাণ বেড়েছে। লোকে ঠাকুর দর্শন করতে এসে তাকেও টাকা দিয়ে যায়। এক,দু টাকা তো আছেই, আবার কখনও কখনও পাঁচ,দশ টাকাও বাটিতে পড়ে। বিনা পরিশ্রমে ভালো আয় হবার সুবাদে মনটা ছুঁক ছুঁক করলে সাট্টায় দান লাগায়। হাজার হলেও জুয়াখোর তো। সিনেমা দেখার ইচ্ছে হলে কাকেও অন্ধ সাজিয়ে বসিয়ে দিয়ে চলে যায়।পরে এসে তার পকেট সার্চ করে দেখে নেয় ভিক্ষের পয়সা সরিয়েছে কিনা।তারপর ভিক্ষালব্ধ উপায়ের অর্ধেক দিয়ে ছেড়ে দেয়।একবার হিরু নামের স্থূলবুদ্ধিসম্ন্ন তারই মতো এক অলস ব্যক্তিকে পাকড়াও করে বললো, " হিরু, আমার হয়ে একটা কাজ করে দিবি ভাই?" হিরু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, " কাজটা কেমন? আমি পারবো এমন কাজ বল।"
— খুব পারবি।কাজটা এমন কিছু শক্ত নয়। খালি বসে বাটি নাড়বি।
—ধুস্! শেষে ভিক্ষে! আমার মতো শক্ত পোক্ত লোককে ভিক্ষে দেবে কেন?
— সে উপায়ও আছে। তোকে ভিক্ষে না দিয়ে পারবে না। তুই শুধু একটা কালো চশমা পরে বসে বাটি নাড়বি। দেখবি পটাপট টাকা পড়ছে তোর বাটিতে। তুই শুধু সন্ধ্যে থেকে ঘন্টা তিনেক সময় দিবি।
— ঘন্টা তিনেক! বলিস কি ভাই! আমি পারবো? ঠায় বসে থাকা!
— খুব পারবি। এটুকু আমার জন্যে করতে পারবি না। আমাকে তো দু বেলা বসতে হয়।
সেদিন সন্ধ্যে বেলায় সঞ্জয় সিনেমা দেখতে গেলে হিরু কালো চশমা পরে বাটি নিয়ে বসে গেলো। বাটি নাড়াতে থাকে আর পয়সা পড়তে থাকে বাটিতে। হিরুর মনটাও খুশিতে ভরে ওঠে।এমন সময় একজন পাঁচ টাকার একটা কয়েন দিতে গেলে কয়েনটা বাটিতে লেগে অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়ে গেলো। অন্ধের ভূমিকায় অভিনয় করতে অনভ্যস্ত হিরু জায়গা ছেড়ে উঠে কয়েনটা কুড়িয়ে আনে। তা দেখে ওই ব্যক্তি হিরুকে জিঞ্জাসা করলো, "তুমি চোখে দেখতে পাও তো কালো চশমা পরে অন্ধ সেজেছো কেন ? সেই অন্ধ লোকটি কোথায় যে রোজ এখানে বসে?" হাসি মুখে হিরু উত্তর দেয়, "বাবু, আজ সে অনেক দিন পর সিনেমা দেখতে গেছে। আমি তার হয়ে প্রক্সি দিচ্ছি।"
ব্যক্তিটি চোখ কপালে তুলে বেশি কথা না বলে শুধু বললো, শেষ রক্ষে করতে পারলে না। তোমরা দুজনেই ধরা পড়ে গেলে।" এসময় বেশ কিছু লোক ভিড় করে মজা দেখছিলো। সকলে হাসতে হাসতে চলে গেল। জায়গাটা ফাঁকা হয়ে এলে সিনেমা ফেরৎ আড়ালে লুকিয়ে থাকা সঞ্জয় হিরুর কাছে এসে বলল,
"দিলি তো সব মাটি করে। তোকে পই পই করে বলে গেলুম, অন্ধ সেজে থাকতে। তা না করে তুই পয়সাটা কুড়তে গেলি? ওরে হাঁদারাম তুই তো অন্ধ , চোখে দেখতে পাস না।"
— কে বললো দেখতে পাই না।
দেখতে পাই বলেই তো কুড়তে গেছি।
—চুপ কর, গাধা কোথাকার। মাথায় যদি এতোটুকু বুদ্ধি থাকতো। আমাকে আবার অন্য জায়গা খুঁজতে হবে। তুই আমার সব মাটি করে দিলি। সঞ্জয় হিরুর হাত থেকে বাটি কেড়ে নিয়ে পয়সা গুনতে শুরু করলো। ষাট টাকার মতো হয়েছে। কুড়ি টাকা বাড়িয়ে বললো, " এই নে ধর।" কুড়ি টাকা দেখে হিরু বললো, "মোটে কুড়ি টাকা। এতক্ষণ বসলুম। অন্তত অর্ধেকটা দে। আর দশ টাকা দে।" বিরক্ত হয়ে সঞ্জয় বললো, "ভিখারির জাত, আর একটা পয়সাও দেবো না।"
— আহা এমন বলছিস যেন তুই জমিদার। এ সবই তো ভিক্ষের টাকা।
— হতভাগা, বোকা বেনে আমার কি হালটা করে ছাড়লি তুই! কাল থেকে আর এখানে বসতে পারবো? এখান থেকে মানে মানে সরে পড়। লোকে তোকে দেখেছে। একটা মারও বাইরে পড়বে না।
হিরু কি আর করে কুড়ি টাকা নিয়ে বিড় বিড় করতে করতে চলে যায়।
=============================
Samir Kumar Dutta
23/1/A, Mohanlal Bahalwala Road
P.O. Bally, Dist. Howrah 711201