গল্প ।। খালি বাড়ি ।। সোমা মজুমদার
0
ডিসেম্বর ০১, ২০২৪
খালি বাড়ি
সোমা মজুমদার
রাত গভীর হলে মানুষ প্রকৃতির মতো শুদ্ধ হয়ে যায় এই কথা বিশ্বাস করে পারমিতা। যখন কোথাও কেউ নেই, জেগে থাকা নিশাচরের ডানা ঝাপটানো আর অচেনা কিছু একটা ফুলের গন্ধে যেন রাতগুলো অপার্থিব হয়ে যায় তাঁর কাছে। টানা কয়দিন ধরে রাত দুটার পরও দুই পেয়ালা চা শেষ করে দিচ্ছে পারমিতা। কিন্তু কিছুতেই যেন নুতন উপন্যাসের কোন শুরু টাই করতে পারছে না। ওদিকে প্রকাশকের তাড়া, কলকাতা আন্তর্জাতিক বই মেলার জন্য জাস্ট ফাটিয়ে দেওয়ার মতো একটা হরর উপন্যাস নামাতে হবে। এদিকে এতো কম সময়ে হরর লিখে যা নামডাক কুড়িয়েছে পারু, তাতে আবার তাড়াহুড়ায় নড়বড়ে কিছু একটা নামিয়ে দিলে সেই সব জলে যাবে। তাই তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে চাইছে না সে। কিন্তু ওদিকে গভীর রাত অবধি বারান্দায় আলো নিভিয়ে বসে জোর করে ভয় ভয় ফিল করিয়েও তো কাজের কাজ তেমন কিছু হচ্ছে না। পারমিতা এবার ঠিক করে সে-ও একেবারে বিদেশি হরর মুভি, গল্পের মতো বাগান বাড়ি হানাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে একেবারে বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতা যদি নিয়ে আসতে পারে তো দারুণ হয়।
যেই ভাবা সেই কাজ। অনিকেতের চেয়ে ভালো হদিস আর কে-ই বা দিতে পারে। সাথে সাথে অনিকেতের নাম্বার ডায়াল করে পারু। দুবার রিং হয়ে যায়, কিন্তু ওদিক থেকে রিসিভ হয়নি। হয়তো ঘুমিয়ে গেছে, এতো রাতে ফোন করাটাও ঠিক হয়নি। ভবঘুরে এই ছেলে টার বনবাদাড়ে ঘুরে ভেড়ানো নেশা এবং পেশাও। যে কোন রকমের পুরনো পরিত্যক্ত বাড়ি, ভুতুড়ে জায়গার সব হদিস ও-ই দিতে পারে ভালো।
সকালে না-হয় আবার একবার কথা বলে নেওয়া যায়। কিন্তু যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে হাতে সময় খুব কম।
বারান্দার আলো জ্বালিয়ে, ঘরের টা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে পারমিতা।
পারমিতা বছর ৩৪ এর এক মহিলা। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বছর তেইশে। স্বামী আর এক পুত্র কে নিয়ে তাঁর সংসার ভালোই চলছিল। করোনার সময় হার্ট অ্যাটাক এ মারা যান স্বামী। পারু একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা করে নিজের আর ছেলের পড়ার হোস্টেল খরচ চালায়। সাথে লেখালেখি টা চালিয়ে যায় সে। এই লেখালেখি টা পারুর একলা জীবনের সঙ্গী। একটু চাপা স্বভাবের পারমিতা খুব একটা মানুষের সঙ্গ পছন্দ করে না। তুমুল বৃষ্টির দিনে দূরের কোন পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া, কিংবা সিনেমা দেখা, সন্ধ্যার চায়ে সে নিজের সাথেই সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে। তাঁকে নিয়ে কে কি বল্লো, তাতে তাঁর যেমন কিছু যায় আসে না, তেমনই অন্যের জীবন নিয়ে চর্চা ও সে কখনো করে না।
জানালার ফাঁক গলে হিমেল ভোরের প্রথম রোদ্দুর নরম চোখের পাতায় আলতো করে ছুঁয়ে দিতেই ঘুম ভাঙে পারুর। আটটা বেজে গেছে। ৩ মিসড কল। অনিকেত তিনবার ফোন করেছিলো। মোবাইল সাইলেন্ট মুডে ছিলো। তাই বুঝতে পারেনি। সাথে সাথে কলব্যাক করে। - হ্যালো
-বল পারু,
কাল রাতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বুঝতে পারিনি। যা দৌড়ঝাঁপ, রাত হলে মরার মতো ঘুম আসে চোখে।
-পারু- এ-সব ছাড় আর। এবার একটু সংসার ধর্মে মন দে। বলে হিহি করে হেসে উঠে পারমিতা। এই পারমিতাই একসময় অনিকেত কে বলতো 'অনিকেত আমারও খুব ইচ্ছে করে তোর মতো একটা বাউণ্ডুলে জীবন আমারও হোক। তোর এই বনো জীবন অরণ্য পাখি পোকামাকড় এসব নিয়ে করা একটা সংসার যদি আমারও হতো।'অনিকেত বলতো 'হবে হয়তো কোনদিন। ' এমন পারমিতা আজ বলছে এসব ছেড়ে একটু সংসারী হ। কথাটা বলে নিজের কাছেই যেন হাস্যকর লাগছে। তাই নিজের কথায় নিজেই হেসে দিলো।
অনিকে- তুই নিশ্চয় রাত দুটার পর আমাকে সংসারী হওয়ার কথা বলতে ফোন করিস নি। কেন ফোন করেছিলে সেটা বল। কোন প্রবলেম?
পারু- নারে কোন সমস্যা নয়। একটা জিনিস জানতে ফোন করেছিলাম।
অনিকেত - কী?
আমায় একটা পরিত্যক্ত বাড়ি বা এরকম কোন কিছুর হদিস দিতে পারিস? যেখানে ধর কারোর অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে, এখানে দীর্ঘদিন ধরে এখন আর কেউ থেকে না, বা এমন জায়গা যেখানে রাতে কেউ যায় না, অশরীরীর চলা ফেরা দেখা যায়, এমন.... কথাটা শেষ নাকরতেই হাহা করে হেসে উঠে অনিকেত।
অনিকেত - আচ্ছা যাঁর শরীরই নেই তাঁর আবার চলাফেরা দেখবে কিভাবে মানুষ!? (হাসতে হাসতে)
পারু- কিভাবে দেখে না দেখে আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এখন যাচ্ছি না। আমার হাতে সময় খুব কম, আমার একটা প্লট দরকার, তুই এমন একটা জায়গার সন্ধান আমায় দে, এবং আজকের মধ্যে।
অনিকেত - আচ্ছা না-হয় দিলাম, কিন্তু সেখানে গিয়ে কী তুই ভুতপ্রেত কিছু আদোও খুঁজে পাবি।
পারু- আরে না, ভুত দেখবো বলে যাবো না, জায়গায় গেলে দু-একদিন থাকলে ঐ জায়গার পরিবেশ লোকের মুখের নানা কাহিনি আর সবচেয়ে বড় ব্যপার টা জানিস আমি প্লট পাই পরিবেশ থেকে পরিস্থিতি থেকে। একটা গা ছমছম নিরিবিলি ভুতুড়ে পরিবেশ আমায় নুতন প্লট খুঁজতে যথেষ্ট সাহায্য করে জানিস। তাই আমার এই পরিচিত গন্ডির বাইরে বেরুতে হবে। নুতন কিছু খুঁজে পেতে হলে।
অনিকেত তিন-চারটা জায়গার সন্ধান দেয় পারমিতাকে। এর মধ্যে 'খালি বাড়ি' নামের ওই খালি বাড়ি টার গল্প পারমিতার বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে। সে সেখানে গিয়ে ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় পরের দিন। স্থানীয় লোকেরা বলে এই বাড়িতে নাকি একসময় এক মহিলা থাকতেন তাঁর মেয়ে কে নিয়ে একা। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া সেই মেয়ে টার নাকি অন্য গ্রামের একটা ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক হয়, এই সম্পর্কের অছিলায় ছেলেটি মেয়েটার সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলে। একসময় মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। সারা পড়ায় এ নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়। ছেলে টি মেয়ে টিকে বিয়ে করতে অস্বীকার করে, অন্য কোথাও পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে পাঁচমাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে টি নাকি এক ভোর রাতে বাড়ির পুকুর পারের ছাতিম গাছের ডালে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। তখন ছাতিম গাছ টি ছোট ছিল, এখন এর বয়স হয়েছে, বয়সের সাথে সাথে সেও ডালপালা বিস্তার করে বেশ ঝাঁকড়া হয়েছে। মেয়েটির মা নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পরে যতদিন বেঁচেছিলেন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন।
ঐ বাড়ি থেকে নাকি শেষ রাতের দিকে এখনও কারো গোঙ্গানির শব্দ শুনেন মানুষ । হাঁটার শব্দও নাকি শুনা যায়।
মুটামুটি দু'দিনের একটা গোছগাছ করে নেয় পারু। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরের ঐ পাহাড়ি গ্রাম টাতে অনিকেতের পরিচিত একটা ছেলে আছে। অনেকেত তাঁর সাথে ফোনে আলাপ করে তাদের বাড়িরতে পারমিতার থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেয়।
বাসা থেকে প্রথমে টোটো, তারপর অটো ধরে সে। শহুরে কোলাহল পেছনে ফেলে তিনচাকার যানটি ছুটে চলছে কালো পিচের সরু রাস্তা দিয়ে... ধানকাটার পরের বিস্তীর্ণ মাঠের খড়নাড়ায় দুপুর রোদের লুটোপুটি... অঘ্রাণ মাসের এই সময়টা ঘর গৃহস্থালি চলকে পড়ে নতুনের উচ্ছ্বাসে। চাষির ঘর পরিপূর্ণ। এক উৎসব উৎসব আনন্দ ছড়িয়ে দিচ্ছে মেঠো পথের উদাসী হাওয়া...। শূন্য মাঠ আর একফালি খোলা আকাশ দেখতে দেখতে অজানা -অচেনা রহস্যময় কোন গন্তব্যের দিকে যাচ্ছেন স্বনামধন্য লেখিকা পারমিতা চৌধুরী পারু...। একসময় নির্দিষ্ট একটা জায়গায় এসে থামে তাঁর তিনচাকার যানটি। ওইখানেই অপেক্ষায় ছিল অনিকেতের পরিচিত ওই ছেলেটা। গাড়ি থেকে নামতেই সহাস্যে সে নিজের পরিচয় দেয় এবং পারুর পরিচয় টা নিশ্চিত হয়ে পথ দেখিয়ে বাড়ির উদ্দশ্যে রওনা হয় তাঁরা। যাওয়ার সময় স্থানীয় বাজার থেকে কিছু কমলালেবু কিনে নেয় পারু।
এইটুকু পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে ম্যাডাম। সুরু কাঁচা রাস্তা তাই সাইকেল আর বাইক ছাড়া কিছু চলতে পারেনা এই রাস্তা দিয়ে। না না ঠিক আছে। আমার হাঁটতে ভালোই লাগছে...
ছোট্ট একটা নদী, নদীর উপর পাকা সেতু, নদীর কাটাকুটি তে বোনা ফসলের জমি তে হরেক রকম শীতকালীন ফসল চাষ হয়েছে। বিকেলের বাতাসে দোল খাচ্ছে হলুদ শর্ষে খেত...
আহা আহা কী সুন্দর ছিমছাম গ্রাম টি। প্রকৃতি যেন দুহাত ভরে সমস্ত রূপ সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছেন এই গ্রামে। সাবুল মানে অনিকেতের এই বন্ধু টি এই নদীর গল্প, গ্রামের গল্প সব করতে করতে নদীর পারের ছোট রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে পারুকে।
একসময় বাড়িতে এসে পড়ে তাঁরা। বাড়িতে সাবুলের বাবা মা ছোট এক ভাই আর এক বোন। কৃষক পরিবার, খেতের জমিজমা প্রচুর, বড় পুকুর। পুকুরে অনেক জাতের মাছ, পুকুর পার ভর্তি নারকেল গাছ, তাল গাছ, সুগন্ধি লেবু কামরাঙা, আম লিচু জাম কলা কি নেই। পুরো বাড়ি ভর্তি সুপুরি গাছে, প্রায় প্রতিটি গাছে আছে আবার একটা করে পান গাছ। পুকুর ছাড়িয়ে বিশাল জমি জুড়ে শীতকালীন হরেক রকম শাকসব্জী চাষ হয়েছে। এগুলো বিক্রি করে তাদের অর্থ উপার্জন হয়। বেশ পুরনো বাড়ি। আসাম টাইপ ঘর করেছেন, প্রতিটি রুম খুব গোছানো, পরিস্কার। পারুকে পেয়ে রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন সাবুলের মা বোন। শহর থেকে মেহমান এসেছেন, সাবুল বলে দিয়েছে খাতির যত্নের কোন খামতি যেন না হয়। তাঁরা যখন বাড়ি পৌঁছালেন বেলা তখন ডুবুডুবু। সন্ধ্যা নামছে...
সাবুলের মা পারমিতাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।মেয়ে কে বলে দিলেন হাঁস মুরগী গুলো সেই যেন ডেকে নেয়। সন্ধ্যার সুগন্ধি ধানের তৈরি হরেক রকম পিঠেপুলি দিয়ে জলখাবার সাজিয়ে আনলেন। পারু সবকটার নাম জেনে নিলো। বেশ সুস্বাদু। সন্ধ্যায় সাবুলের বাবা রহমান আলী এই গ্রামের ঘটে যাওয়া হরেক ঘটনা বলতে লাগলেন। তাদের যৌথ পরিবার, চাষবাস, জীবনযাপন, হরিণ স্বীকার, তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলো না কুপী জ্বলতো, সন্ধ্যার পর আড্ডা বসতো। একজন খুব ভালো বাঁশি বাজাতো কতো গল্প সব জুড়ে দিলেন পারুর সাথে। পারু মুগ্ধ হয়ে শুনছে... পারু সব ব্যথা, সব মনখারাপির মাঝে যেমন বাবা বাবা একটা গন্ধ পায়, ঠিক তেমনই হঠাৎ কাউকে বা কোন কিছু দেখলে যদি আপন আপন মনে হয় তারমাঝেও বাবা বাবা একটা গন্ধ পায়। আজও এই গ্রাম এই সন্ধ্যাে আর এ-ই মাঝবয়সী মানুষ টার গায়ে জড়ানো শীত চাদর টা থেকেও যেন বাবা বাবা একটা গন্ধ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁকে। পারু আগেই বলে দিয়েছে সব গল্প করা যাবে কিন্তু খালি বাড়ি সম্পর্কে সে যা শুনেছে তার বেশি কিছু সে শুনতে চায়না। ওই বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আসার আগ অবধি।
রহমান আলী প্রশ্ন করলেন - আচ্ছা মা তুমি কী আজ রাতেই ঐ বাড়িতে যেতে চাও?
পারু- হে আজই যাই।
রহমান আলী - ঠিক আছে, তবে তুমি তো এই বাড়ি সম্পর্কে আর কিছু জানতে যখন চাইছোই না, আমি একটা কবজ তোমার বাঁহাতে বেঁধে দেই, আশাকরি তোমার কোন আপত্তি থাকবে না। বলা যায় না তো কিছু। আচ্ছা চাচা দিন বেঁধে আমার কোন আপত্তি নেই।
রহমান আলী আজমির শরিফের কবজে তাবিজ ভরে পারুর বাঁহাতে বেঁধে দিলেন বিসমিল্লাহ বলে।
গৃহিণী রাতের আহারে সুস্বাদু সব রান্নার আয়োজন করলেন। কিন্তু পারু রাতের খাওয়ার খেতে রাজি হলো না। তখন ঘড়িতে পৌঁনে নয়টা। আমি একবার বাড়িটা গিয়ে ঘুরে আসি চাচি, সন্ধ্যায় এতো কিছু খেয়েছি এখন আর খেতে পারবোনা। ফিরে এসে রাত হলে খাবো।
ভালো করে শীত পোষাক গায়ে জড়িয়ে মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে বেরিয়ে পড়ে পারু,তাঁর পেছনে তিন ব্যাটারি একটা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে সাবুল।
পুকুর পার হয়ে ছোট্ট মতো মাঠ, আঘ্রাণের শূন্য মাঠের খড়কুটোয় লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু কুয়াশায় ভিজে যাচ্ছে পায়ের পাতা। অন্ধকারের ভেতর থেকে উঠে আসা শীতল হাওয়ায় রাতের গন্ধ। একটা বাদুড় ডানা ঝাপটে চলে গেলো মাথার উপর দিয়ে। এই ছোট্ট একচিলতে খালি মাঠ পেরিয়ে গেলে দূরে অন্ধকারেও ভালো মতো ঠাহর করা যাচ্ছে ঐ বাড়ি। মাঠের মাঝখান টায়, কতো রকমের গাছগাছালি আগলে রেখেছে বাড়িটাকে। এক-একটা গাছ তার পরিমাণের চেয়েও যথেষ্ট লম্বা। বাড়িতে ঢোকার সেরকম কোন পথ নেই। ঝোপঝাড় সরিয়ে পথ বার করতে হয়। প্রায় কাছাকাছি চলে আসার পর পারু সাবুলকে থামিয়ে দিয়ে বল্লো-
তুমি এইখানটাতে দাঁড়াও, আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে আসছি। কিন্তু সাবুল পারুকে একা ছাড়তে কিছুতেই রাজি নয়। ম্যাম ভুতপ্রেত কিছু না থাকুক, আমি ভুতের ভয় পাচ্ছিও না। কিছু খারাপ ছেলেপেলে মদের আসার জমায় এই বাড়িতে রাত হলে। আপনি একা যাবেন! আমি আলো জ্বালাবো না, বাইরে থেকে আগে দেখার চেষ্টা করবো ভেতরে কেউ আছে কিনা। তারপর ঢুকবো । আর তাছাড়া পনেরো মিনিটের মধ্যে যদি তোমাকে ফোন না করি, ফিরেও না আসি তবে তুমি যাবে। ঠিক আছে ম্যাম।
বিভিন্ন রকমের গাছগাছালি তে ঘেরা ভুতুড়ে বাড়ি টার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সাবুল।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ডালপালা সরিয়ে সরিয়ে পথ বার করে এগিয়ে যাচ্ছে পারু। এতক্ষণে অন্ধকারে চোখ অনেকটা সয়ে গেছে। অন্ধকার যতই গভীর হোক তারও নিজস্ব একটা আলো থাকে, সেই আলোতেই পথ দেখে এগিয়ে যাচ্ছে পারু। অসম্ভব সাহসী মেয়ে পারু।
আর সাহসী না হলে এরকম একটা অজানা অচেনা পাড়াগাঁয়ে এসে এমন একটা ভুতুড়ে
বাড়ি তে রাতবিরেত কেউ একা এসে হানা দিতে পারে!!
ঝোপঝাড় সরিয়ে সরিয়ে ভেতরে এসে ফাঁকা একটা জায়গায় দাঁড়ায় পারু। সামনেই সেই পুকুর চোখে পড়লো। পুকুরের জলে আলো ফেলতেই দেখলো জল অনেকটা লাল। বিশাল উঁচু পুকুরের পাড় গুলো। বিভিন্ন রকমের গাছগাছালি ঘেরা। এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান। সামনে পুকুর ঘাট, জায়গায় জায়গায় ইট খসে পড়ছ
, শেওলা উঠে অনেকটা সেঁতসেঁতে হয়ে আছে। বুঝাই যাচ্ছে একসময় এই শানবাঁধানো ঘাট বেশ সুন্দর চকচকে ছিলো।
আলো নিভিয়ে পায়ে পায়ে সামনের দিকে এগোয় সে ...
বেশ উঁচু বিটের উপর ঘর, মাঠের মাঝখানে বাড়ি করা হয়েছিল, এই এলাকা বন্যার জলে প্লাবিত হতো বছর বছর, প্রতি বর্ষায় ঘন বৃষ্টি আর বন্যর হাত থেকে বাঁচার জন্যেই বোধহয় এতো উঁচু করা হয়েছিলো। পারমিতা পা টিপে টিপে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। বাহ্, কে বলবে এই বাড়িতে গত চল্লিশ বছর ধরে কেউ থাকে না! বাড়ির দেওয়াল গুলো বেশ পুরনো জায়গায় জায়গায় রং খসে পড়ছে, ধূসর হয়ে আছে। কিন্তু বেশ সাফসুতরো। ভেতরে আলো জ্বলছে না, দরজা হাটকরে খোলা। পারমিতা উঠুন থেকে বেশ উঁচু বারান্দায় উঠার সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া সিঁড়ি বেয়ে একপা দুপা করে এগোয়। সব ঘরে মুখ বাড়িয় উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখে, না কোথাও কেউ নেই। এবার নিজের হাতে থাকা মোবাইলের ফ্লাশ লাইট অন করে সে। সব ঘরে আলো ফেলে ফেলে বাইরে থেকে একবার দেখে নেয়। তারপর ঘরের দিকে পা বাড়ায়...
চৌকাঠ পেরিয়ে সবে একপা ভেতরে প্রবেশ করেছে ওমনি শুনলো পাশের ঘরে বাসন পড়ার শব্দ!
পারমিতা আর সামনের দিকে পা না বাড়িয়ে সোজা ঐ ঘরের দিকে যায়...
আলো জ্বলছে... সম্ভবত রান্না ঘর ছিল এটা।
তাঁর মন ভালো হয়ে যায়। আর যাইহোক আলোতে অতন্ত্য প্রেতাত্মা থাকতে পারে না। পারু চুপিচুপি উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করে। একজন বৃদ্ধ লোক, উনুনে আগুন জ্বালিয়ে কিছু একটা রান্না করছেন, পাশে একটা দোতারা মতো কিছু একটা রাখা। আলো আর সুর এই সব পবিত্র জিনিসের মধ্যে কোন অশুভ ছায়া থাকতে পারে না। পারমিতার নিজেকে নিজেই সাহস জুগিয়ে পা বাড়ায় ঘরের দিকে...
বৃদ্ধ পেছন ফিরে থাকান!
তুমি কে মা? রাতে এই বাড়িতে! এখানে তো কেউ আসে না। তুমি কেন এলে এখানে?
পারমিতা- আমারও তো একি প্রশ্ন আপনি কে? আমি যতদূর জানি এই বাড়িতে কেউ থাকে না! তবে আপনি? বৃদ্ধ - আচ্ছা তোমায় সব বলছি। বসো এসে আগুনে একটু হাতপা সেঁকে নাও আগে, যা ঠান্ডা পড়েছে!
পারমিতা- দাঁড়ান আমি আগে একটা ফোন করে নেই। বলে সবুল কে ফোন করে সে।
হ্যলো সাবুল আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যান। আমি কিছুক্ষণ পরই ফিরছি। এখানে কোন সমস্যা কিছু হচ্ছে না। আমি চারিদিক একবার দেখেই চলে আসবো। আচ্ছা ম্যাম।কোন অসুবিধা হলে ফোন করবেন।
আগুনের পাশে বৃদ্ধ মানুষ টা কাঠের একটা বসার টোল এনে দেন, এবং নিজেও বসে পড়েন। হাত-পা সেঁকতে সেঁকতে বলেন বলো কি শুনতে চাও।
পারমিতা- এটা নিশ্চয় আপনার বাড়ি নয়?
বৃদ্ধ - না।
তাহলে এখানে আপনি কেন?
ঐ যে নদী দেখেছো মা, আমি ওই নদীর মাঝি। গান গাই, আর নৌকা নিয়ে মাছ ধরি। এইসবই আমার জীবন ও জীবিকা।
বুঝলাম। কিন্তু এখানে কেন আপনি?
আর বলোনা সব আমার কপাল। কপাল মন্দ না হলে কী আর এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে ভেড়াই বলো!
আমার দুনম্বর ছেলের বউ এরকম এক মাগের শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে গায়ের চাদরে আগুন লেগে পুড়ে মরে যায়। আমি আমার তিন ছেলে মিলে দু'হাতে দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করি, এই দেখো হাতে এখনও পুড়ার ক্ষত। বলে ধুলো জমা চাদরের ভেতর থেকে হাত বের করে পুড়ে যাওয়া হাত দেখান বৃদ্ধ। কিন্তু তবুও বেইমান রা আমার আর আমার তিন ছেলের উপর আগুন লাগিয়ে পুড়ে মারার কেস করে।
কারা করে?
আমার ছেলের বউর ভাইয়েরা।
এখন কী হয়েছে?
এখন আর কি হবে, যে যেখানে পারছি পালিয়ে আছি। কিন্তু আমি আর সহ্য করতে পারছি না এসব। ভাবছি জীবন থেকে মুক্তি নেবো নিজেই।
না না এসব ভাববেন না। সত্যের জয় হয়। ধৈর্য দরুন। সব ঠিক হবে। গরিবের জন্য ওসব নেই রে মা।
আচ্ছা রাত অনেক হলো। তুমি কি কিছু খেয়েছো? না খাইনি। খাবো।
আমি তোমার জন্য খাবার তৈরি করছি। তুমি ঐ ঘরে গিয়ে বসো। পারু বল্লো- আচ্ছা সব ঘরে কি আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা আছে? হে আছে। আমি জ্বালিয়ে দিচ্ছি। তুমি হেঁটে হেঁটে দেখো।
পারু সব ঘর দেখতে লাগলো। বৃদ্ধ রান্না করছেন। এর মধ্যে সাবুল আরো একবার ফোন করলো।
কখন আসবেন ম্যাম? কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো। পারু বৃদ্ধের কথা এতো কিছু আর ফোনে না বলে শুধু এটাই বল্লো আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমি পৌঁছে যাবো। তোমরা চিন্তা করো না।
রাত বারোটার মধ্যে বৃদ্ধ খাবার রেডি করে পারুকে ডাকলেন। তাজা চিতল ফ্রাই করা, কি একটা ডাল চিনতে পারেনি পারু, মচমচে বেগুন ভাজা। আমি সতেরো বছর নিজে রান্না করেছি। রান্নাবান্না সব খুব ভালো করতে পারি। বাচ্চাদের মা ওদের রেখে অকালে চলে যান, আর বিয়েসাদী করিনি। কোনমতে ছেলে লায়েক হতেই তাই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলাম দুটা ভাত রান্না করা পাবো এই আশায় অথচ দেখো আমার কপাল! দুঃখ করবেন না চাচা। সব ঠিক হয়ে যাবে। ও হে ফিস ফ্রাই টা দারুণ হয়েছে। মাছটা নিশ্চয় নদী থেকে নিজে ধরেছেন? হে হে নিজেই ধরলাম।
খাওয়া দাওয়া শেষে,
বৃদ্ধ - তুমি কেন হঠাৎ এই বাড়িতে এলে বললে না তো?
পারু- আমি একজন লেখিকা। ভুতপ্রেত নিয়ে একটা উপন্যাস শুরু করবো। এই বাড়িতে নাকি ভুত দেখা যায়, তাই এলাম। যদি কিছুর দেখা পাই। তবে আমার একটু উপকার হতো। এইজন্যই আশা। বৃদ্ধ জল খাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা হেঁচকি উঠলো আচমকা। কিছুক্ষণ পর থেমে গেলে বললেন ঠিক আছে আমি একটু আসছি, তুমি বসো। যদি এখানে রাতে থাকতে চাও তবে কিছু কাতা কম্বলের দরকার হবে তো আমি দেখি কি করা যায়।এই বলে বেরিয়ে গেলেন বৃদ্ধ। পারমিতা না করবে সেই সময় টুকোও দিলেন না। এতো দ্রুত তিনি বেরিয়ে গেলেন।
পারমিতা বসে ভাবছে, এই অসহায় মানুষ টার জন্য কিছু একটা করতে হবে। শহরে ফিরে গিয়ে ভালো একজন আইনজীবীর সাথে কথা বলতে হবে।
হঠাৎ পুকুর পাড়ের দিকে গাছের ডাল ভাঙ্গার একটা শব্দ শুনে সেদিকে আলো ফেলে পারমিতা।
একি!!
গাছের ডালে এরা কারা!
একটা বছর পনেরো ষোল এর মেয়ের কঙ্কাল, আর একটা বৃদ্ধ লোকের কঙ্কাল গাছের ডালে লটকে কী দানবীয় হট্ট হাসিতে মেতে আছে!!
তারপর আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না পারু। জ্ঞান যখন ফিরছে তখন চারিদিকে গোল হয়ে মানুষজন ঘিরে আছে থাকে, রহমান চাচা অনবরত আয়াতুলকুরসি পড়ে তখনও ফু দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর মুখে কপালে। কোনমতে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে আসার পর রহমান চাচা বললেন ওই মাঝি ফুরমত মিয়া আজ থেকে কম করেও তিরিশ বছর আগে এই মিথ্যে কেস আর নানা অসুখ থেকে মুক্তি পেতে ঐ বাড়িতে গিয়ে সেই ছাতিম গাছের ডালে ফাঁস লেগে জীবন থেকে মুক্তি নেয়। পারু অনিকেত কে ফোন করে সব বলে, সব শুনে অনিকেত বলে, যাহ্, এবারও কলকাতা আন্তর্জাতিক বই মেলায় তাহলে জাস্ট ফাটিয়ে দেওয়ার মতো কিছু একটা আসছে । আমার কিন্তু সই সহ এক কপি চাই। পারু রাগ করে বলে তোর কাছে এসব গল্প মনে হচ্ছে? অনিকেত বলে, আরে না রে আমি গল্প ভাবছি না, বুঝতেই পারছি এসব তোর সাথে সত্যি সত্যি ঘটেছে। আমি কী ভাবছি জানিস! কি ভাবছিস। আমি ভাবছি ওই মাঝি টা তো তোর জন্য কাতা আর কম্বল আনতে গিয়েছিল তাই না। হে তাই তো। কিন্তু দেখ করলো টা কী! তা না এনে উল্টো তোকে ভয় দেখিয়ে সেন্সলেন্স করে দিলো। আসলে জানিস এই সেই কথা না রাখা মাঝি নাদের আলী। শালা সুনীল কে তিনপ্রহরের বিল দেখাবে বলেও দেখায়নি। তোর জন্য কাতা কম্বল আনবে বলেও আনেনি।এই শালা দেখছি কারোরই কথা রাখে না। পারমিতা- শুন অনি সবকিছুতে ইয়াকি মারিস না। ভালো লাগে না।
============================