গল্প ।। বাবা লোকনাথ ও এক অন্ধ ভক্তের কথা।। মিঠুন মুখার্জী
0
ডিসেম্বর ০১, ২০২৪
বাবা লোকনাথ ও এক অন্ধ ভক্তের কথা
মিঠুন মুখার্জী
বহু বছর আগের কথা। সন্দেশখালির একটি প্রত্যন্ত গ্ৰামে একজন গরীব তাঁতি বাস করতেন। গরিব তাঁতির দুটো চোখ এক দুর্ঘটনায় চলে যায়। এই কারনে আজ পঞ্চাশ বছর বয়সেও তার বিয়ে হয় নি। কোনো রকমে ভিক্ষা করে দিন অতিবাহিত করত সে। পুরোনো তাঁত পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে যায়। ভালোবাসার যন্ত্রটিকে সে এই অসহায় অবস্থাতেও বিক্রি করে নি। তার বাড়িতে ছোট একটি ঠাকুরঘর ছিল। যেখানে শুধু বাবা লোকনাথের বিগ্ৰহ ছিল। ভিক্ষা করতে যাওয়ার আগে স্নান সেরে বাবা লোকনাথের পুজো দিয়ে যেত, আবার সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি ফিরে পুজো দিত। বাবার সামনে সে কাঁদত আর বলতো -- "হে গরিবের ঠাকুর, এই ভাবে বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া অনেক ভালো। আপনি আমায় এই অন্ধকার জীবন থেকে চিরতরে নিয়ে যান। আমি পাপি। তাইতো আমার কর্মফল আমি ভোগ করছি। আমায় মুক্তি দিন।" একদিন তাঁতি স্বপ্ন দেখে --- তাঁর বাড়ির উত্তর দিকের একটি বটগাছের নীচে একজন ব্যক্তি সাদা বস্ত্রধারী শুভ্রকেশ নিয়ে বসে আছেন। স্বপ্নে তাঁতি অন্ধ নয়। সে সব দেখতে পায়। সেই সন্ন্যাসী ধ্যানে মগ্ন। দূর থেকে দেখে ওই তাঁতির দরিদ্র্যের দেবতা বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী বলে মনে হয়। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখে বাবা লোকনাথের মতোই একজন সন্ন্যাসী, তবে বাবা লোকনাথ নন। তাঁতি তাকে ধ্যানে মগ্ন দেখে কোনো কথা না বলে বাড়ি ফিরে আসতে যায়। তখন ওই সন্ন্যাসীর ধ্যান ভেঙে যায়। তিনি তাকে বলেন--- " দুর্লভ তুই চলে যাচ্ছিস? আমার কাছে তোর কোনো কিছু চাওয়ার নেই? তোর জীবনে খুবই কষ্ট। তুই এই জীবন থেকে মুক্তি চাস কেন? তোর অন্ধত্ব তোর কর্মফল। তবে এই দিনটাও একদিন চলে যাবে। তুই আবার দৃষ্টি ফিরে পাবি। তোর আরাধ্য দেবতার উপর তুই বিশ্বাস রাখ। আমার পুজোর ফুল তুই অসুস্থ মানুষের কাছে পৌঁছে দে। আমার বানি মানুষের কাছে পৌঁছে দে --- "রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়িবে আমাকে স্মরণ করিবে, আমি তোমাদের রক্ষা করিব।" দুর্লভ তাঁতি বুঝতে পারে তার ভুল হয়েছে। তাঁর আরাধ্য বাবা লোকনাথকে সে দেখেও চিনতে পারে নি। তখনি সে দৌঁড়ে গিয়ে বাবা লোকনাথের পা দুটো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বলে--"বাবা, আমি আপনাকে চিনতে পারি নি। জীবন সম্পর্কে আমার কোনো ধারনাই ছিল না। আপনি আমার জ্ঞানের নেত্র খুলে দিলেন। আপনার কথা মতো আজ থেকে আমি চলব। আপনি আমায় পথ দেখান প্রভু।" তাঁতির কথা শুনে বাবা লোকনাথ বলেন-- " পাগল ছেলে আমার। এই পৃথিবীতে সকলেই কোনো না কোনো সমস্যায় আছে। কেউই সম্পূর্ণ সুখী নন। নিজের জীবনের সঙ্গে অন্যের জীবনকে মেলাতে নেই। সকলের জীবন আলাদা। সমস্যাকে সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে, দুঃখ পেয়ে আরও বাড়িয়ে তুললে চলবে না। সুখ-দুঃখ নিয়েই জীবন।" কিছুক্ষণ পর দুর্লভ তাঁতি চোখ তুলে বাবা লোকনাথের দিকে তাকিয়ে দেখে তিনি নেই। তিনি যে জায়গায় বসে ছিলেন সেখানে একটি শিবলিঙ্গ পড়ে ছিল। হঠাৎ দুর্লভের ঘুম ভেঙে যায়। তখন ভোর পাঁচটা বাজে। দুর্লভ পুনরায় আলোর জগত থেকে অন্ধকার জগতে পদার্পণ করে। এবার সে খুব কাঁদতে থাকে। হঠাৎ বাড়ির পাশের একজন বুড়ি দুর্লভের কান্নার শব্দ শুনে ঘরে আসে। বলে --- " ও দুর্লভ তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর? " এরপর একটু থেমে সে ওই প্রতিবেশীকে বলে --- " বিন্দু মাসি আমাকে একটু বাইরে বটগাছ তলায় নিয়ে যাবে? সেখানে যাওয়ার জন্য আমার মন খুব কাঁদছে। আমার বিশ্বাস আমাদের গরিবের দেবতা সেখানে কাল রাতে এসেছিলেন। আমি তাকে স্বপ্নে দেখেছি কাল রাতে। " বিন্দু মাসির কথাটা বিশ্বাস না হলেও অন্ধ দুর্লভের হাত ধরে বুড়ো বটগাছের নীচে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে বিন্দু মাসি অবাক হয়। বটগাছের গোড়ায় বসার জায়গায় একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে। তিনি দুর্লভকে শিব লিঙ্গের কথা জানায়। দুর্লভ বুঝতে পারে স্বয়ং মহাদেব তাকে পরীক্ষা করছিলেন। আর বাবা লোকনাথ তো দেবাদিদেব মহাদেবের অংশ। সে আনন্দে জয় বাবা লোকনাথ ও জয় বাবা ভোলানাথ বলে চিৎকার করে ওঠে এবং আনন্দে কেঁদে দেয়। তারপর বিন্দু মাসি শিবলিঙ্গটি অন্ধ দুর্লভের হাতে দেয়। শিবলিঙ্গ স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে দুর্লভের সারা শরীরে একটা বিদ্যুতপ্রবাহ বয়ে যায়। কিন্তু সে তা অনুভব করে না। শিবলিঙ্গটি এনে দুর্লভ তার ছোট্ট ঠাকুর ঘরে লোকনাথ বাবার বিগ্ৰহের পাশে বসায়। একমুহুর্তের মধ্যে সে অনুভব করে সে সব দেখতে পাচ্ছে। তার বাড়ি, বাবা লোকনাথের বিগ্ৰহ , শিবলিঙ্গ সব। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সেটা তার মনের ভুল মনে হয়। সে খুব কাঁদতে থাকে।
সেই দিন রাত্রে আবার স্বপ্ন দেখে অন্ধ দুর্লভ। সে দেখে তার বাড়িতে একজন সন্ন্যাসী এসেছেন। যে তাকে বলছেন--- " তোমার খারাপ দিন খুব তাড়াতাড়ি কেটে যেতে চলেছে। তুমি তোমার বাড়ির দেবতাকে মনের ভক্তি দিয়ে পুজো করো। তোমার কাছে যারা বিপদে পড়ে আসবেন তাদের তুমি তোমার আরাধ্যের পায়ের ফুল ও স্নানের জল বিনামূল্যে দেবে। আরাধ্যই তাদের সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। যতই মানুষের মঙ্গল হবে ততই তোমার জীবনের অন্ধকার কেটে যাবে।" হঠাৎ সেই সন্ন্যাসী বাবা লোকনাথে পরিণত হন এবং অদৃশ্য হয়ে যান। বাবাকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে দুর্লভের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে দুর্লভ কান্না করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে বাবা লোকনাথের বিগ্ৰহের সামনে গিয়ে বলে --- " আপনার আদেশ যদি এই হয়ে থাকে বাবা, তবে আগামী পূর্ণিমার দিন থেকে প্রত্যেক বৃহস্পতি ও সোমবার আমি মানুষের সেবায় সারাদিন বাড়িতে থাকব। আমার মনপ্রাণ দিয়ে আমি তাদের সেবা করব। আপনার আদেশ আমি মাথা পেতে নিলাম।"
পরের পূর্ণিমার দিন সকাল থেকে দুর্লভ বাড়িতেই ছিল। ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে বাবা লোকনাথ ও শিব লিঙ্গের পুজো করে । ফুল বেলপাতা বিন্দু মাসি রোজ দিয়ে যায়। সেগুলো দিয়ে মনের ভক্তিরসহিত দেবতাদ্বয়কে পুজো করে সে। প্রসাদ হিসাবে দিয়েছিল মিছরি, কলা ও বেল । আশেপাশের ছোট ছোট শিশুরা পাত্র নিয়ে প্রসাদ নিতে এসেছিল। দুর্লভ সকলকে একে একে প্রসাদ বিতরণ করে। সে অন্ধ হলেও তার অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো খুব সতেজ ছিল। গলা শুনে ও ঘ্রাণ শুঁকে কে এসেছে তা সে বলেদিতে পারত। তখন সকাল এগারোটা। একজন মেয়েকে তার বাবা-মা দুর্লভের বাড়িতে নিয়ে আসেন। দুর্লভ তাদের গলার আওয়াজ শুনে বলে -- " কে আপনারা? কোথা থেকে আসছেন? আপনাদের কী হয়েছে?" ভক্ত দুর্লভকে সেই মেয়েটির বাবা বলেন---- " আমার মেয়ের বড় বিপদ। একজন মানুষের কাছে তোমার মন্দিরের জাগ্ৰত দেবতার সন্ধান পেয়ে এসেছি। অনেক ডাক্তার কবিরাজ করেছি, কিন্তু আমার মেয়ে সুস্থ হয় নি। অনেক আশা নিয়ে তোমার কাছে আমরা এসেছি বাবা। তুমি আমার মেয়েকে ভালো করে দাও বাবা।" এরপর ওই ব্যক্তিকে ভক্ত দুর্লভ বলে --- " কি হয়েছে আপনার মেয়ের?" ভক্তের প্রশ্নে ওই মেয়েটির বাবা বলেন ---- " রাত হলে আমার মেয়ে কিছুই দেখতে পায় না। দিনের সবকিছু রাতে ভুলেও যায়। খুব কান্না করে ও। রাতে কিছুই খেতে চায় না, সারারাত ঘুমতেও চায় না। ওর জন্যে আমাদেরও বছরের পর বছর ঠিকঠাক ঘুম হয় না।" এই কথাগুলো বলতে গিয়ে তার কন্ঠ কেঁপে উঠেছিল। তার কথা শুনে ভক্ত দুর্লভ বলেছিল --- "বাবা লোকনাথকে ডাকুন। উনিই পারেন আপনার মেয়েকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে।" তারপর বাবা লোকনাথের পায়ের ফুল ও একটি ছোট বোতলে করে বাবার ও শিব লিঙ্গের স্নানের জল এনে দেয় দুর্লভ। সে তাদের বলে --- " এই ফুল আপনার মেয়ের দুচোখ ও মাথায় দিনে তিনবার ছোঁয়াবেন। আর এই জল একবার সন্ধ্যা বেলায় ও একবার রাত এগারোটার সময় খাওয়াবেন। প্রতি বৃহস্পতিবার ও সোমবার বাবার কাছে আসবেন। বাবার করুণায় আপনার মেয়ে একদিন সুস্থ হবেই।" অসুস্থ মেয়েটির বাবা ভক্ত দুর্লভকে টাকা দিতে গেলে সে বলে--- "আমি কি আপনার কাছে টাকা চেয়েছি? টাকা দিলে ভক্ত-ভগবানের সম্পর্ককে অপমান করা হয়। আমাদের বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ভক্তের কাছে শুধুই ভক্তি আশা করেন। টাকা দিলে আপনাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। এ যেন ভগবানকে ঘুষ দেওয়ার মতো ব্যাপার।" ভক্ত দুর্লভের এই নির্লোভ সত্তা দেখে অসুস্থ মেয়েটির বাবা-মা তাকে প্রণাম করেন এবং মেয়েকে নিয়ে চলে যান। এরপর তারা প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ও সোমবার ভক্ত দুর্লভের বাড়ির মন্দিরে আসেন। এক মাস পর থেকে মেয়েটির সমস্ত সমস্যা দূর হতে থাকে।
এই একমাসের মধ্যে আরও অনেকেই তাদের সমস্যা নিয়ে দুর্লভের মন্দিরে আসেন। ধনী থেকে দরিদ্র সকলের সমস্যাই সমাধান করেন বাবা লোকনাথ। একটি ছেলেকে নিয়ে তার মা এসেছিলেন যে একটি দুর্ঘটনায় তার চোখ দুটো হারিয়েছিল। বাবার মন্দিরে বার বার আসার ফলে ও বাবার পায়ের ফুল ও স্নানের জল নেওয়ার ফলে সে সুস্থ হয়ে ছিল। তিন জন অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর দুর্লভ তার এক চোখের দৃষ্টি ফিরে পেয়ে খুবই আনন্দ পায়। বাবা লোকনাথের বিগ্ৰহের সামনে গড় হয়ে প্রনাম করে। খুবই কাঁদতে থাকে সে। এক চোখ দিয়ে বাবা লোকনাথকে দর্শন করে দুর্লভের মনে হয় তার জীবন ধন্য। প্রভুর উদ্দেশ্যে বলে --- " হে জগতের নাথ লোকনাথ, আপনার কাছে মানুষ এসে খালি হাতে ফেরেন না। তাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়ে আপনি তাদের সমস্ত সমস্যা সমাধান করে দেন। আপনার মাহাত্ম্য এই জগতে প্রচার করার সময় এসে গেছে। রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানেই মানুষ বিপদে পড়বে তিনি যেন আপনাকে স্মরণ করে, তবেই আপনি তাকে সেই বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। এরপর দুর্লভ ভিক্ষা করা ছেড়ে দেয় । ধীরে ধীরে বাড়ি হয়ে ওঠে বিরাট মন্দির। ভক্ত-বৃন্দরা নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে এই মন্দির তৈরি করে দিয়েছিলেন। ভক্ত দুর্লভের কোনো দাবি ছিল না। মন্দিরে দেওয়া ফল ও মিস্টি খেয়ে দুর্লভের দিন অতিবাহিত হয়। ছয় মাসের মধ্যে একশো অসুস্থ ব্যক্তি বাবার কৃপায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। একদিন রাতে বাবা লোকনাথ দুর্লভকে পুনরায় স্বপ্ন দিয়ে বললেন ---- " ভক্ত দুর্লভ, তোমার নিঃস্বার্থ মানুষের সেবা ও আমার প্রতি ভক্তি দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। এই ভাবে মানুষের সেবা করে যাও। তোমার জীবনের যত প্রতিবন্ধকতা সব একদিন সরে যাবে। তোমার কর্মফলে দুচোখ হারিয়েছিলে, আজ তোমার কর্মের দ্বারা এক চোখে তুমি দেখতে পাচ্ছ । এ জগতের কেউই কর্মফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না। এজন্মের কর্মফল তাকে এজন্মেই পেতে হবে। যারা পরজন্মের চিন্তা করে তারা বড় বোকা।" হঠাৎ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী পুনরায় অদৃশ্য হয়ে যান। দুর্লভের ঘুম ভেঙে যায়। সে এবার আর কান্না করে না। সে মনস্থির করে --- " মানুষের মধ্যে সৎ চিন্তা , সৎ জ্ঞান ও সৎ কর্মের প্রসার ঘটাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হলে জীবনে কুকর্মের ইচ্ছা মরে যায়, সব রকম বিপদ থেকে তিনি আমাদের রক্ষা করেন।"
এরপর একদিন বাবা লোকনাথ দুর্লভের গভীর পরীক্ষা নেওয়ার জন্য এক কুষ্ঠরুগীর ছদ্মবেশ ধারণ করে দুর্লভের বাড়িতে আসেন। দুর্লভ তখন পুজোয় বসেছিল। এক চোখ দিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখে সে খুব খুশি হয়। তার আরাধ্য বাবা লোকনাথের বিগ্ৰহের দিকে ভক্তিভরে তাকিয়ে পুজো করে। তার চোখ দিয়ে অশ্রু নির্গত হয়। পুজো শেষ করে বারান্দায় তাকিয়ে প্রথমে ভক্ত দুর্লভ খুব ভয় পেয়ে যায়। তারপর অনেকক্ষণ পরখ করে বুঝতে পারে এই আগন্তুক ব্যক্তি কুষ্ঠ রোগের বাহন। দুর্লভ তখন বলে---- " কে তুমি বাবা? কোথা থেকে আসছ?" প্রথমে তিনি চুপ করে থাকেন। তারপর কাশতে কাশতে বলেন --- "আমি একজন ভিক্ষুক। এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটি আমগাছের নিচে আমার বাস। শরীরটা খুবই খারাপ। তোমার ও তোমার মন্দিরের জলজ্যান্ত ঈশ্বরের কথা আজ সারা দেশের মানুষ জানে। একজন মা জননীর কাছ থেকে খবর পেয়ে আমি তোমার কাছে এসেছি। দাও তো বাবা আমার রোগটাকে যমের বাড়ি পাঠিয়ে। তবে বুঝবো তোমার ঈশ্বর ও তুমি দুজনেই সত্য।" ভিক্ষুকের কথা শুনে ভক্ত দুর্লভ খুবই নম্র ভাবে বলে--- " আমি নগন্য মাত্র , আপনাকে সুস্থ করতে পারেন জগতের নাথ লোকনাথ। যিনি ভোলানাথের অংশ। আপনি বাবা লোকনাথকে ডাকুন, ডাকুন ভোলানাথকে। আজ পর্যন্ত যেই ভক্তিভরে তাকে ডেকেছেন, সেই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন। আপনাকে তার ডাকে কয়েকমাস এখানে আসতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন।" এরপর ভক্ত পুনরায় ভগবানের পুজোয় বসে। বাবা লোকনাথকে সে একটা করে ফুল দেয় আর সেই ভিক্ষুকের কুষ্ঠের ঘা ধীরে ধীরে সেরে যায়। পুজো শেষ করে পঞ্চপ্রদীপ জ্বালানোর জন্য পিছন ঘুরে ভক্ত দুর্লভ দেখে কুষ্ঠরুগী ভিক্ষুকটি পুরো সুস্থ হয়ে গেছেন। সে খুবই অবাক হয়ে যায়। তারপর সামনে বাবা লোকনাথের বিগ্ৰের দিকে তাকিয়ে দেখে ওই ভিক্ষুক বাবার আসনে বসে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। ভক্ত দুর্লভের বুঝতে ভুল হয় না এতক্ষণ বাবা তার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। সে বাবার চরণ দুটি জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে ---- " বাবা, আমায় আপনি ক্ষমা করুন। আমি আপনার লীলা বুঝতে পারিনি। আমি অজ্ঞ অন্ধ মানুষ , তাই আপনাকে চিনতে পারি নি। আপনি আমায় পথ দেখান। " ভক্তের কথা শুনে ভগবান বলেন --- " ধূর পাগল ছেলে। এভাবে কাঁদিস না। সুখ-দুঃখ ভরা এই জীবনে কেবল মানুষ নয় কেউই তার অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট নন। বিপদ আসে আবার সময়ের সাথে সাথে তা চলেও যায়। প্রত্যেককে তার নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হবে।" আমার এই বানি সর্বদা তোরা মাথায় রাখিস -- " রণে বনে জলে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়বি তোরা আমায় স্মরণ করবি, আমি তোদের রক্ষা করব।" বাবা লোকনাথ এই কথাগুলো যখন বলছিলেন তখন ভক্ত দুর্লভ তার সামনে দুচোখ বুজিয়ে মাথানত করে ছিল। যখন সে মাথা তুলে ঠাকুরের দিকে তাকায় তখন দেখে বিগ্ৰহ আসনে বসে আছে। স্বয়ং লোকনাথ চলে যাওয়ায় হাউ হাউ করে সে কাঁদতে থাকে। হঠাৎ তার জ্ঞান হয় সে তার দু-চোখ দিয়েই দেখতে পাচ্ছে। সে অবাক হয়ে দুহাত দিয়ে একবার চোখ ছোঁয়, একবার মুখ । আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় সে। বাবা লোকনাথের বিগ্ৰহের সামনে গড় হয়ে প্রনাম করে চিৎকার করে বলে --- "জয় বাবা লোকনাথের জয়, জয় ভোলানাথের জয়।" এরপর থেকে প্রতি মুহূর্তে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে ভক্ত দুর্লভ। সে না চাইতে মন্দিরে যে প্রনামি পড়ে তাই দিয়ে প্রভুর সেবা ও একার সংসার তার চলে যেতে থাকে।
================
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
পিন-- 743252