গল্প।। বিবর্ণ কোজাগরী ।। মনোজিৎ চক্রবর্ত্তী
বিবর্ণ কোজাগরী
মনোজিৎ চক্রবর্ত্তী
ঘুমোতে পারছে না বিদিশা,অবসন্ন শরীরটা ঘুম চাইলেও ধর্ম-কর্মে মতি যুক্ত বাঙালি গৃহ বধুর মনটা তাকে ঘুমোতে দিচ্ছেনা কিছুতেই। যতবার চোখ বোজার চেষ্টা করছে,ততবার চোখের সামনে দৃশ্যটা ফুটে উঠছে।ফুটে উঠছে কি,এখন সদর দরজাটা খুলেই আবারও দেখা যাবে সেই দৃশ্য। সামান্য যত্নশীল না হওয়ায় কি অমঙ্গল ডেকে নিয়ে এল এই সংসারের জন্যে, হায় হায়! কি করে এই চিহ্ন মুছে ফেলবে বিদিশা, বাস্তবের দাগ মুছে ফেললেও মনের মধ্যে যে দাগ প্রথিত হয়ে গেলো আজ,তা কি করে মুছে ফেলবে সে, এ জন্মে তা কি কখন ভুলতে পারবে! এই সংসারের মঙ্গলের জন্যে সে তো নিবেদিত প্রাণ। ছিঃ ছিঃ এমন ধারণা কেন করলো সে,কেন তার মনটা এমন ভাবলো! কেন কেন সে একবারও তার মনে এলো না। একটা শিশুকে কেন সে এমন করে, ছিঃ ছিঃ সে নিজেও তো একজন মা। একটা শিশুকে কেন সে এমন পৃথক করে ভাবলো।সে কি কাজের লোকের মেয়ে বলেই? জন্ম সূত্রে সে দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে,দারিদ্র্যের পরিবেশে ক্রমশ বেড়ে উঠছে,তার চলা ফেরা আদব কায়দা সেই পরিবেশের মতই হবে,তাতে ছোট্ট শিশুটার কি দোষ? বিদিশা তো নিজে শিক্ষিত,সচ্ছল ও ভদ্র পরিবার ও পরিবেশে পরিনত হয়েছে, সে কেন এমন আচরণ করলো৷এতটা বয়েষে ভগবান আজ তাকে কি শিক্ষা দিলো!আবার ও প্রথম থেকে পর পর ঘটনা গুলি মনের মধ্যে সাজিয়ে দেখে বিদিশা।
আজ সকাল থেকে বিদিশার নির্জলা উপবাস,একা হাতে পূজোর সমস্ত আয়োজন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারবে না জেনেই, পার্বতী কে বলেছিল,একটু হাতে হাতে পূজার কাজে সাহায্য করতে,শুধু কি পূজোর কাজ? টিঙ্কু আর তার বাবার দুপুরের খাওয়া দাওয়া আছে।ওরা তো আর উপোস করে থাকবে না। কোন রকম একটু ডাল-ভাত একটা যেকোন তরকারি আজকের মত করে দিতে হবে।পূজোর কাজের সাথে এই সব মারাত্মক ঝক্কি ঝামেলার।তাই পার্বতী কে বলেছিল বুদ্ধি করে,এমনিতে কিছু কাজ আগের থেকেই সেড়ে রেখেছিল বিদিশা। নারকেল নাড়ু,তিলের তক্তি,চিনির ছাপা সন্দেস,খই এর উপরা সব। কিন্তু ভোগের রান্না? পায়েস, ভুনা খিচুড়ি, একটু পোলাও সংগে পাঁচ রকমের ভাজা তো করতেই হবে,কোজাগরী লক্ষী পূজো বলে কথা। তাছাড়া এই তিন কামরার ফ্ল্যাট জুড়ে আলপনা দিতে হবে, পাঁচ রকম ফল কেটে,নৈবেদ্য সাজিয়ে……! এত কাজ আছে বুঝেই পার্বতী কে কাজ করবার জন্যে বলেছে।পার্বতী বামুনের ঘরের বউ হওয়াতে নিজেকে লাকি বলেই মনে করেছে,বিদিশা। এই কারণে নিজের বুদ্ধির তারিফ না করে পারেনা সে।
কিন্তু গন্ডগোল টা সেই পার্বতীই বাঁধালো সাত সকালে, সঙ্গে করে সে তার মেয়ে টাকে নিয়ে এসেছে,বয়েসে টিঙ্কুর থেকে ছোটই হবে,ডিগ ডিগে পোকার মত চেহারা মেয়েটার, ওকে দেখেই বিদিশার কেমন নোঙরা মনে হয়! অন্য সময় হলে এক রকম ছিল।এখন এই পূজা অর্চনার মধ্যে, কি দিয়ে কি করে? বিদিশার মন টা বিরক্তি তে ভরে ওঠে।আর শুধু কি তাই, এখন টিঙ্কু আর টিঙ্কুর বাবার সাথে এটার ও দুপুরের খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে।কি যে অস্বস্তি কর ব্যাপার,কি আর বলবে। তারপর ছোট মেয়ে পূজোর আয়োজনে ছোওয়া-ছানির ব্যাপার আছে।বাথরুমে গিয়ে যদি ভালো করে জল না ব্যবহার করে?এদের কি বাথরুমে জল ব্যাবহারের অভ্যাস আছে? বাথরুম থেকে এসেই হয়ত পূজোর কোন জিনিসপত্র ছুঁয়ে দিলো,তখন? এসব সাত-পাঁচ ভেবেই বিদিশার দুই ভ্রু একে ওপরের কাছাকাছি এসে ওর সুন্দর কপালের শ্বেতশুভ্র মাংসে অশান্তির শিল্প কর্ম ফুটে উঠলেও মুখে কিছু বললো না। কিছু একটা আচ্ করে পার্বতী বলল, কি করবো বউদি, পূজা পার্বণের দিন, কোথায় রেখে আসব বলো? কার ঘরে গিয়ে কি করে বসবে,দেখার কেউ থাকবে না।তারপর কথা শুনে মরতে হবে,সেই আমাকেই। তুমি চিন্তা করোনা বউদি,আমার সামনে ওর কোন ট্যান্ডাই-ম্যান্ডাই চলবে না। বিদিশা একটু জোর করেই মুখে হাসি এনে বলল।না না ঠিক আছে,তুই এক কাজ কর পার্বতী। তোর দাদাবাবু টিঙ্কু আর ওর জন্যে একটু ভাত ডাল করে দে,ওরা দুপুরে খাবে তো,পার্বতীর মেয়ে এই কথা শুনে,তার মায়ের কোমর জরিয়ে ধরে মায়ের কানে কানে কিছু বলতে চায়,একটু কৌতুহল বশতঃ বিদিশা পার্বতীর কাছে জানতে চায়,কি বলছে রে তোর মেয়ে? দেখনা বৌদি,আমি উপোষ করবো শুনে,বলছে, ও নাকি উপোষ করবে। পার্বতী উত্তর দেয়। বিদিশা হেসে বলে এত ছোট্ট মেয়ে কি উপোস করে? বড় হয়ে উপোস করিস।কি নাম রে তোর?পার্বতী বলে,ওর নাম চঞ্চলা বৌদি । বিদিশা আর সময় নষ্ট না করে বলে তুই একটু ভাত বসিয়ে দে পার্বতী,খিদে পেলে দুপুরবেলা ঠিকই খাবে।ততক্ষণ উপোষ করুক। বলে মৃদু হাসে বিদিশা।কিন্তু মনের মধ্যে একটা অশান্তি কাঁটার মত বিঁধেই রইল।
এরপর শুধু কাজ কাজ আর কাজ। বিদিশার আর মেয়েটার দিকে আর নজর দেওয়া হয় নি।চঞ্চলা ও বিদিশার ফ্ল্যাটের সাড়ে ছয় ফুট বাই তিন ফুটের ব্যালকনি টা নিজের আপাতত আস্তানা বানিয়ে সেখান থেকে বড় রাস্তার গাড়ি,মানুষ জন দেখতে থাকে। আর সেসব দেখা একঘেয়ে হয়ে গেলে গ্রীল বেয়ে তার সময় কেটে যেতে লাগলো।সে মায়ের কাজে কোন অসুবিধা সৃষ্টি করল না বটে,তবে এই বারান্দা টা তার খুবই ভালো লাগায় তার সাময়িক আস্তানা হিসাবে,এই জায়গা সে মনে মনে অধিকার করে বসল।
দুপুরে টিঙ্কুদের খাওয়ার সময় পার্বতীর বহু অনুরোধ আর আদেশ স্বত্বেও চঞ্চলা মুখে খাবার তুলল না, পার্বতী রাগে গজগজ করতে করতে দু ঘা মেয়ের পিঠে বসিয়ে দিতে গেলে বিদিশা বাধা দিলো বটে,কিন্তু আশ্চর্য হয়ে ভাবে ধন্যি মেয়ের জেদ।এমন জেদ টিঙ্কু তার সাথে দেখালে নিজে কে কতটা সংযত রাখতে পারত ভগবান জানে। সন্ধ্যেবেলা ঠাকুর মশাই এসে পড়বে,এখন খিচুড়ি আর পায়েস টা তৈরি হয় নি।পায়েসের পাক ঘন না হলে বিদিশার মন তাতে সায় দেবে না।তাই সময় লাগবে। সেই কারণ বশতঃ চঞ্চলা কে নিয়ে আর সময় খরচ করা তার আর সম্ভব নয়।বৌদি কাজে চলে যাওয়ায় পার্বতী ও চঞ্চলার পেছনে আর পড়ে রইল না। চঞ্চলা অনেকক্ষণ রাস্তার গাড়ি আর মানুষ জন ও দেখেছে,এখন তার পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ব পরিকল্পিত খেলাটা খেলতে ইচ্ছে করছে, একটু আগে পর্যন্ত কেন জানি সাহস পাচ্ছিল না।তবে সুন্দরী আন্টি আর মা চলে যাওয়া একটা স্বাধীনতার ভাব ফুটে উঠেছে তার মনের মধ্যে। তাই তার রোগা রোগা দুটো ঠ্যাং গ্রীলের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিয়ে,মুখের সামনের গ্রীলের রড দুই হাতে চেপে ধরলো।তারপরেই চঞ্চলার কল্পিত গাড়ি হাওয়ার বেগে ছুটতে আরম্ভ করল। বড় রাস্তার সব গাড়ি পেছনে পড়ে রইল,সব্বার আগে ছুটছে তার গাড়ি। তার এই গাড়িকে আজ থামায় কে?কোথায় গিয়ে এই গাড়ি থামবে, চঞ্চলা নিজেও জানে না।গাছপালা,বাড়িঘর,পথঘাট সব একে একে হাওয়ার বেগে পিছিয়ে যাচ্ছে, উল্টো দিকের গাড়ি গুলি বিপদজনক ভাবে সামনে এসে পড়ছে,আর অসীম দক্ষতায় চঞ্চলা সে সব গাড়ি কে কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে, ষত উল্টো দিকের গাড়ি গুলিকে কাটাচ্ছে তত খুশীতে চঞ্চলার গাড়ি চালানোর উদ্যম যাচ্ছে বেড়ে, এই গাড়ি এই মুহুর্তে অন্তত থামানো প্রায় অসম্ভব। কোন এক তেপান্তরে হয়ত বা থামতে পাড়ে এ গাড়ি। কিন্তু সেই অব্দি আর গাড়ি পৌচাল কোথায়! তার আগেই বারান্দার দরজায় মা আর সুন্দরী আন্টি এসে উপস্থিত। সব সময়ের মত তিরিক্ষি মেজাজে মা বলল,ওমন চিৎকার করছিস কেন?ওলাউঠ।একটা থাপ্পড়ে দাঁত গুলো ফেলে দিতে হয়।মা তো এমন বলেই,কিন্তু মায়ের পেছনে সুন্দরী আন্টির সুন্দর মুখটা এই সময় এত বিশ্রী লাগছে,যে এই কথাতেই চঞ্চলার চোখে জল চলে এল।ওহ আবার ন্যাকামি হচ্ছে,গলা দিয়ে একটা আওয়াজ বেরুলে না, গলা টিপে মেরে দেব! আমার হাড়-মাস এক করে দিল, এই মেয়ে টা।মায়ের বকুনির শেষ অংশটা, চঞ্চলা কে নিয়ে মায়ের দূর্গতি,সুন্দরী আন্টি কে শোনানোর জন্যে। কোন মতে চঞ্চলা নিজের ঠ্যাং দুটো গ্রীলের ফাঁক থেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ায়। মা আবার ও বলে চুপ করে থাকবি, একটা আওয়াজ যদি গলা থেকে যদি বেড় হয়,আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে চঞ্চলা, মনে মনে তার কি অপরাধ সে খুঁজে বেড়ায়।
যথা সময় রান্নার কাজ শেষ করে নৈবেদ্য সাজিয়ে,বিদিশা মা লক্ষীর সামনে গলায় আচঁল জড়িয়ে এসে বসলো,পার্বতী ও বৌদির পথ অনুসরণ করে দরজার সামনে এসে বসলো।তবে তার নজর বৌদির দিকে, বৌদির সামান্য ইশারায় তার বিশ্বস্ত সৈনিক সঙ্গে সঙ্গে হুকুম তামিল করবে,এমনি হলে হয়ত এতটা মনোযোগ পার্বতী র থাকে না বা থাকতো না।এটা তো আর যেমন তেমন কাজ নয়,এ লক্ষী পূজা বলে কথা,এ বাড়ি বৌদিদের হলেও যে টুকু মা লক্ষীর আশীর্বাদ তা এখান থেকেই তাকে অর্জন করতে হবে।তাই এই বিশেষ মনোযোগ। সকাল থেকে যে পূজোর আয়োজন শুরু হয়েছে,যেই পূজো কে কেন্দ্র করে আড়ম্বরের অন্ত নেই৷ সেই পূজো শুরু হচ্ছে দেখে,আর পাঁচ জনের মত চঞ্চলাও তার পছন্দের বারান্দা ছেড়ে পূজোর ঘরে উঁকি দিয়ে ছিলো। ফ্ল্যাট বাড়ির ঘর, পরিসরে ছোট,তায় পূজোর সামগ্রী তে অর্ধেক পূর্ণ হয়ে থাকায়,ঘরটা আরও ছোট মনে হচ্ছে,পূজোর বিভিন্ন সামগ্রী ও ঠাকুর মশাই বসবার পর ভক্তকূলের জন্যে জায়গা সীমিত।তবুও পোশাকের আতিশয্যে, ও বর্ণের ছটায়,চঞ্চলার দরিদ্র বেশ-ভূষা সারাদিনের ধকল সহ্য করেএই পরিবেশে,বড্ড বেমানান।ওকে একদম আলাদা করে চোখে পড়ছে, বিদিশা বিষয় টা নজর করলেও এই মুহুর্তে ওর কিছু করার নেই,সব আয়োজন শেষ করে,একটা অদ্ভুত সুন্দর গরদের শাড়ি পড়ে,সালংকারা হয়ে পূজোর জায়গায় এসে বসেছে।বিদিশাকেই লক্ষী প্রতিমা মনে হচ্ছে, এমন পরিবেশে পার্বতী কে বলে চঞ্চলাকে অন্যত্র পাঠানোর নির্দেশ দিতে তার মন চাইল না। কিন্তু এমন সময় জোয়ার্দার গিন্নী তার বিপুল দেহাড়ম্বোর ও নাক থেকে কান অব্দি টানা এক প্রকান্ড নথ পরে পূজা প্রাঙ্গণে প্রকট হলেন,এ বাড়িতে তার বিশেষ গুরুত্ব। এই বাড়ির গৃহকর্তা, বিদিশার স্বামীর ব্যাবসায়িক সহযোগীর ঘরনী বলে কথা। এই ঘরে তার স্থান সংকুলান করাটা গৃহকর্ত্রী র একান্ত কর্তব্য। মহিলা ঘরে পদার্পণ করা ইস্তক তার বিপুল পশ্চাৎদেশ ঘরের মেঝে স্পর্শ করার অভিলাষী। কিন্তু স্থানাভাব তার অন্তরায়।তাই এই পৃথিবীর নিয়ম মেনেই জোরদার জোয়ার্দার গিন্নীকে বসার জন্যে অতি তুচ্ছ চঞ্চলাকে ঘর ছেড়ে দিতে হবে, এতো বলা বাহুল্য। তাই সুন্দরী বিদিশা আন্টির চোখের ইশারায় আর মায়ের নির্দেশে চঞ্চলা তার শীর্ণ পদ যুগল ভক্তকূলের ফাঁকে ফাঁকে ফেলে অনায়াসেই ফ্ল্যাটের সদর দরজার বাইরে চলে এল, এখানে এসে চঞ্চলাও যেন স্বস্তি পেল। দীপের আলো নিভে যাবে তাই ঘরে ফ্যান বন্ধ, তার মধ্যে ধূপের ধোয়ায় ওর কষ্টই হচ্ছিল। ফ্ল্যাটের বাইরে এসে,তাই ওর ভালোই লাগলো। এই ভক্তিপূর্ণ পরিবেশে তার কথা কারো খেয়াল থাকবে না,কিছু একটা খেলা মনের সুখে খেলতে পারবে,অন্তত যতক্ষণ পূজো চলবে, তবে চঞ্চলা সাড়াদিন উপবাসে থাকায় তার শিশু শরীর টা স্তিমিত হয়ে এসেছে এখন আর সে ব্যালকনির গ্রীল বেয়ে খেলতে পারতো না। বাইরে অন্ধকার নেমে আসায় তেমন ভাবে আর রাস্তার লোকজন তার চোখে পড়ছিল না। এমন একটা পরিবেশে চঞ্চলা আবিস্কার করল,ফ্ল্যাটের সদর দরজার বাইরে চাল গুড়ি দিয়ে গোলা আলপনা দেবার সামগ্রী। চঞ্চলার চোখ চকচক করে ওঠে, এখন তার খেলার বস্তু সে পেয়ে গেছে। সাড়াঘর জুড়ে আলপনা দেওয়া হয়েছে।মা আর সুন্দরী আন্টি মিলে সে আল্পনা একেঁছে,একটুও ফাঁকা জায়গা নেই যেখানে সে একটু আলপনা দিতে পারে।তাই অগত্যা ফ্ল্যাটের চৌকাঠের বাইরে সিড়ির ল্যান্ডিং-এ শিশুর অপটু আঙুলে অতিথি-অভ্যাগতদের চটি জুতো সরিয়ে আকিঁবুকিঁ কাটতে শুরু করল, ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে এই খেলাটায় সে দারুণ মজা পেয়েছে।
পুরোহিত,হাতের তালুতে কিঞ্চিৎ পরিমান জল কোষা থেকে নিয়ে ওঁ শ্রী বিষ্ণু, ওঁ শ্রী বিষ্ণু, ওঁ শ্রী বিষ্ণু তিনবার উচ্চারণ সহযোগে পূজা শুরু করেছেন কিছুক্ষণ। এখন এই
পুরের হীত কামনায় পুরোহিত মশাই উচ্চারণ করে চলেছেন,"ইহা গচ্ছ, ইহা গচ্ছ,ইহা তিষ্ঠ, ইহা তিষ্ঠ, ইহা স্থিরোভব ইত্যাদি! আর কিছু সময় বাদেই পূজা প্রনালী সমাপ্ত হবে।হঠাৎই পার্বতীর চঞ্চলার কথা মনে পড়ে। এই মুহূর্তে আর নতুন কিছু পূজার সামগ্রী আর যোগান দেবার নেই।তাই ফ্ল্যাটের মেঝেতে কপাল ঠুকে উঠে পড়ে পার্বতী।সকল থেকে মেয়েটা কিছু খায়নি,সাড়াটা দিন বারান্দায় খেলা করেছে।তাই প্রথমেই বারান্দায় উঁকি দেয় সে। নাহ সেখানে নেই।আর কোথায় যাবে মেয়েটা। ততক্ষণাৎ তার মনে পড়ে,জোয়ার্দার গিন্নী আসার সময় মেয়েটা আর বারান্দার দিকে যেতে পারেনি,সদর দরজার দিকে চলে গিয়ে ছিল, ফ্ল্যাটের সদর দরজার দিকে নজর পড়তেই,মাথাটা গরম হয়ে যায় পার্বতীর। মাটির মধ্যে থেবড়ে বসে দুই হাতে পিটুলি মেখে মেঝেতে আকিঁবুকিঁ কাটছে মেয়েটা।যে পরিমান মাথাটা তেতেছিল তাতে যে পরিমাণ পার্বতী চিৎকার করত,সেটা যে এত অতিথিদের সামনে করা যাবে না।সেই জ্ঞান ওর আছে তাই,হ্যাঁচকা টানে মেয়েকে তুলে নেয় পার্বতী। ওর ঐ টানে পিটালির বাটি উল্টে সদর দরজার সামনে বাটির সব পিটালি পড়ে যায়।মাথাটা এত গরম হয়ে আছে সে দিকে তার আর খেয়াল রইল না। মায়ের এই হ্যাঁচকা টানে হতচকিত চঞ্চলা হাঁ করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।সবার নজর এড়িয়ে পার্বতী মেয়েকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে হাত পা ভালো করে ধুয়েমুছে সাফ করে দেয়। তারপর তাকে সংগে নিয়ে কোলের মধ্যে জাপটে ধরে পূজোর সামনে আবার ও হাজির হয়।চঞ্চলা মায়ের এই ব্যাবহারে যারপরনাই ভয় পেয়ে চুপ করে মায়ের কোলে বসে থাকে।কিছু একটা অন্যায় সে করেছে,যেটা সে বুঝতে পারছে না।এখন তার কান্নাকাটি করার মত সামর্থ্য নেই।তাই মায়ের বুকে লেগে চুপটি করে বসে থাকতে তার মন্দ লাগছে না। এমন করে আর খনিক বসে থাকলে চঞ্চলা হয়ত ঘুমিয়েই পড়ত।কিন্তু তখনই ঠাকুরমশাই সংকল্পের ঘট নেড়ে দিয়ে মনে মনে দেবনাগরী ভাষায় বললেন, হে লক্ষী দেবী পূজা বিধি অনুসারে আমি তোমার পূজা সমাপন করলাম,আমার ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন!
চঞ্চলা মাকে ভয় করে,তাই এতক্ষণ চুপ করেই যেখানে তাকে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সেখানেই চুপ করে বসে ছিলো, এখন তার শরীর আর চলছে না,দুই চোখ ভেঙে তার ঘুম আসছে।পার্বতী তার হাতে বাটিতে করে কিছু ফল প্রসাদ ধরিয়ে দিয়ে বলল,এইগুলো খেতে থাক ঘুমাবিনা বাড়ি যেতে হবে মনে রাখিস।চঞ্চলার ফলের টুকরো খেতে ইচ্ছে করছে না এখন,তবুও মায়ের কথায় দু-এক টুকরো মুখে দিলো জোর করে।এর মধ্যেই সব লোকজন প্রসাদ খাওয়া শুরু করেছে,বৌদি আর পার্বতী মিলে সব্বাই কে প্রসাদ সাজিয়ে গুছিয়ে বিতরণ করছে। চঞ্চলা কেও থালায় করে খিচুড়ি বেড়ে দেওয়া হয়েছে। খিচুড়ি বার দুই মুখে তোলার পর চঞ্চলার শরীর টা গুলিয়ে ওঠে,তবুও মায়ের ভয়ে আরও খানিকটা জোর করে খেয়ে নেয়,ছোট্ট চঞ্চলার শরীরটা আনচান করতে থাকে। সবার খাওয়া শেষ হলে পার্বতী বলল বৌদি আমার প্রসাদ টা একটা টিফিন বাস্কে নিয়ে নিচ্ছি,দেখছ তো মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ছে, আর দেরী করবো না গো। বিদিশা বলে সে ঠিক আছে,একটু বেশী করেই নিস ঘরে তোর বরও আছে।এখন গিয়ে কি আবার তার জন্যে রান্না করবি নাকি। সব গুছিয়ে নিয়ে মেয়েকে নিয়ে বেড়তে যাবে,ঠিক তখনি চঞ্চলার সহ্যের বাঁধ ভাঙলো।ফ্ল্যাটের দরজার সামনে কাটা ফলমূল সমেত যেটুকু ভোগ প্রসাদ ও খেয়েছিল।সবটা এক সঙ্গে বেড়িয়ে এল।তখন দুই এক জন অতিথি প্রসাদ খাওয়ার পর বসে ছিলো।তাদের সামনেই এই ঘটনা ঘটে যাওয়ায় পার্বতীর আর নিজেকে সামলে রাখতে না পেড়ে মেয়ের ওপর ঝাঁজিয়ে ওঠে, এটা আমার হাড় মাস জ্বালিয়ে খেল।হয়ত কয়েক টা চড় চাপড় ও দিয়ে দিত,একদম সামনেই বিদিশা দাঁড়িয়ে থাকায় সেটা আর পারলো না। হাতের প্রসাদের ব্যাগ নমিয়ে রেখে মেয়ের বমি আর মেয়ে কে পরিস্কার করতে করতে পার্বতীর রাগ বেড়ে গেলেও মুখ বুজে কাজ টা শেষ করেই মেয়েকে একটান দিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে যেতে গিয়ে চঞ্চলার পা গিয়ে পড়লো দরজার সামনে পড়ে থাকা পিটালির ওপর,কোন দিকে আর খেয়াল নেই পার্বতীর, রাগে তার শরীর কাঁপছে, বিদিশা ও এই ঘটনায় বিরক্ত তাই পার্বতী কে তার নিরস্ত্র করবার কথা তার মাথায় আসে নি।
সব ঝক্কিঝামেলা মিটিয়ে সাড়া দিনের শাড়ি ছেড়ে বিদিশা যখন শুতে যাবে তখন সদর দরজা টা ঠিক মত বন্ধ করেছে কিনা দেখতে এসে দৃশ্য টা চোখে পড়ল ওর, সিড়ির ল্যান্ডিং থেকে প্রতিটা সিড়িতে ছোট্ট ছোট্ট পায়ের ছাপ দোতলার দিকে নেমে গেছে।
=================
লেখক-মনোজিৎ চক্রবর্ত্তী
ঠিকানা-দিশা নান্দীমুখ এপার্টমেন্ট
৫ম তল,ফ্ল্যাট নম্বর -৫ই বর্ধমান, বড় নীলপুর রোড।