গল্প।। শ্রুতি বিভ্রাট ।। দেবাংশু সরকার
0
ডিসেম্বর ০১, ২০২৪
শ্রুতি বিভ্রাট
দেবাংশু সরকার
সরকারি হাসপাতালের চাকরীটা পেয়ে আনন্দের পাশাপাশি একটা চিন্তাও মালার মনের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। এতদিন সে বাড়ির কাছাকাছি একটা বেসরকারি নার্সিংহোমে চাকরী করত। গত তিন বছর সে চাকরীটা করছে। বেতন মোটামুটি খারাপ নয়। যাতায়াতেরও খুব একটা অসুবিধা নেই। বাড়িতে থেকেই সে চাকরীটা করতে পারে। সেই তুলনায় নতুন পাওয়া সরকারি চাকরীতে বেতন অনেক বেশি। সেইসঙ্গে আছে অনান্য সুযোগ সুবিধাও। তাছাড়া অবসরের পর পেনশনের অঙ্কটাও যথেষ্ট লোভনীয়। কিন্তু চাকরীটা করতে হলে তাকে শিলিগুড়ি ছেড়ে সুদূর কল্যানীতে গিয়ে থাকতে হবে। একজন অবিবাহিত মেয়ের পক্ষে যেটা খুবই সমস্যার। অবশ্য থাকার জন্য একটা কোয়ার্টার সে পাবে। দোটানায় পড়ে যায় মালা, কি করবে সে? সরকারি চাকরীটা নেবে? নাকি বাড়ির কাছের বেসরকারি নার্সিংহোমের চাকরীটাই করতে থাকবে? কিছুতেই স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। তার বাবা মায়ের সাথে আলোচনা করে। অনেক ভাবনা চিন্তার পর সিদ্ধান্ত নেয় যে সে চাকরীটা নেবে। নার্সেস কোয়ার্টারে থাকবে। তার মা মাসখানেক তার সাথে কল্যানীতে গিয়ে থাকবেন। ততদিনে মালা নিশ্চয়ই নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।
সরকারি চাকরী। একরাশ সুযোগ সুবিধা। উজ্জ্বল ভবিষ্যত। আবার সমস্যাও আছে, ঘরবাড়ি, বাবা মাকে ছেড়ে একাকী থাকতে হবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। আশা আশঙ্কায় দুলতে দুলতে মালা তার মাকে সঙ্গে নিয়ে এসে পৌছায় কল্যাণীতে। ওঠে নার্সেস কোয়ার্টারে। জয়েন করে চাকরীতে। দুদিনের মধ্যেই মালার মা ঘর গুছিয়ে নিলেন। করে নিলেন রান্নার ব্যবস্থা। হাসিখুশি মিশুকে মালার পক্ষে নতুন সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরী করতে বেশি সময় লাগলো না। বিরাট বড় হাসপাতাল। অনেক ডিপার্টমেন্ট। ডাক্তার, নার্স, কেমিষ্ট, প্যাথলজিষ্ট, ফার্মাসিষ্ট, ওটি স্টাফ, ওয়ার্ড স্টাফ, ক্লিনিং স্টাফ সব মিলিয়ে প্রচুর মানুষ কাজ করে এই হাসপাতালে। তাছাড়া ক্লার্ক, স্টোরকিপার, সিকিউরিটি গার্ডদের মত ননমেডিক্যাল স্টাফের সংখ্যাও কম নয়।
মালার শিফটিং ডিউটি। কোনও সপ্তাহে রাতে, কোনও সপ্তাহে বিকালে আবার কোনও সপ্তাহে সকালে তার ডিউটি থাকে। নাইট ডিউটি থাকলে, ডিউটি থেকে ফিরে সকালে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে, বিকালের পর তার মাকে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করতে বের হয়। রাতে ডিউটি থাকলে, রোগীর চাপ না থাকলে কিছুটা ঘুমানোর সুযোগ পায়। কিন্তু গত রাতে, সারারাত রোগীর আনাগোনা থাকায় একটুও বিশ্রামের সুযোগ পায়নি মালা এবং তার সহকর্মীরা। পরের দিন সকালে কোয়ার্টারে ফিরে, নিয়ম মত স্নান খাওয়া সেরে, লম্বা ঘুম দেয় সে। ঘুম থেকে ওঠার পরেও, শরীরে একটা আড়ষ্টভাব অনুভব করতে থাকে, মাথাটাও ধরে আছে, গা গরম। মনে হচ্ছে জ্বর আসছে। বিছানা ছেড়ে কিছুতেই উঠতে ইচ্ছা করছে না মালার। কিন্তু আজ দোকানে যেতেই হবে। ঘরে চাল, আটা, সব্জি, মশলা অনেক কিছুই প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। গতকালও ক্লান্তির জন্য বাজারে যায়নি, আর আজতো উঠতেই পারছে না। কোনও রকমে একবার বিছানা থেকে উঠে, একটা জ্বরের ট্যাবলেট খেয়ে, আবার শুয়ে পড়ে সে। কিন্তু দরকারি জিনিসগুলো না কিনলেই নয়। মালার মা বাজারের ব্যাগ হাতে একাই বেরিয়ে পড়েন। কয়েকদিন মালার সঙ্গে দোকানে বাজারে গিয়ে আশেপাশের এলাকাটা ভালো ভাবেই চিনে নিয়েছেন।
মুদিখানা, সব্জি প্রভৃতি প্রয়েজনীয় জিনিসগুলো কিনে, দুটো ভারি ব্যাগ হাতে মালার মা রাস্তার ধারে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু কোনও ফাঁকা রিকশার দেখা নেই। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এভাবে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়! দুহাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। কিন্তু দুটো ভারি ব্যাগ নিয়ে তার পক্ষে বেশিক্ষণ হাঁটা সম্ভব নয়। আবার দাঁড়িয়ে পড়েন, রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু একটাও ফাঁকা রিকশা চোখে পড়ছে না! সব রিকশাতেই প্যাসেঞ্জার। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হতাশ হয়ে পড়ছেন, ক্রমশ যেন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে তার। ব্যাগগুলোকে মাটিতে রেখে, বারে বারে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছছেন।
"মাসিমা উঠে আসুন।" মালার মা দেখেন একটা রিকশা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রিকশা থেকে একজন অচেনা ছেলে তাকে ডাকছে। রিকশায় উঠে আসতে বলছে। ইতস্তত করতে থাকেন তিনি। অজানা জায়গা, অচেনা লোকজন! রিকশায় ওঠা কি ঠিক হবে? ভাবতে থাকেন মালার মা। আবার ছেলেটা বলে, "চিন্তা করবেন না। আপনাকে মালার কোয়ার্টারে নামিয়ে দেব। আমি এই হাসপাতালেই কাজ করি।" রিকশায় ওঠেন মালার মা।
- "আমার নাম অতনু। আমি চার মাস হল এই হাসপাতালে ফার্মাসিষ্টের চাকরিতে ঢুকেছি। আমার ভাগ্য অবশ্য মালার মত অত ভালো নয়। আমি কোয়ার্টার পাইনি। কাছেই একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকি। আমার বাড়ি যাওয়ার পথেই হাসপাতালের কোয়ার্টার পড়বে। আপনাকে নামিয়ে দেব।"
- "তুমিও মালার মত দুর থেকে এখানে চাকরি করতে এসেছো?"
- "হ্যাঁ, আমার দেশের বাড়ি ক্যানিংয়ে। বাড়িতে বাবা, মা, ছোট বোন আছে।"
- "তার মানে তোমাকেও বাড়ি ছেড়ে, বাবা মাকে ছেড়ে এখানে থাকতে হচ্ছে।"
- "কি আর করা যাবে! কিছুদিন যাক তারপর বাড়ির কাছাকাছি কোনও সরকারি হাসপাতালে ট্রান্সফারের চেষ্টা করবো। ততদিন কষ্ট করি।"
- "তোমারতো খুবই কষ্ট। মেয়েদের একা থাকাতে এক রকমের সমস্যা, আবার ছেলেদের অন্য রকমের। তুমি কি নিজেই রান্না করে খাও?"
- "না না, অত সময় কোথায়! হাসপাতালের ক্যান্টিনে খাই। তাছাড়া দোকান থেকেও মাঝে মাঝে কিনে খাই। দুদিনের জন্য বাড়ি গিয়েছিলাম। আজ ফিরছি। আজ পাঁউরুটি কিনে নিয়ে যাচ্ছি। ঘরে মাখন আছে মাখিয়ে খেয়ে নেব। কাল সকাল থেকে আবার হাসপাতালের ক্যান্টিনে খাব।"
রিকশা এসে দাঁড়ায় মালার কোয়ার্টারের সামনে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে, মালার মাকে রিকশা থেকে নামায় অতনু। তারপর মালার মায়ের ব্যাগ দুটো নিয়ে এগিয়ে যায় মালার কোয়ার্টারের দিকে।
- "তুমি রিকশা ছেড়ে দিলে! বাড়ি যাবে কি করে? সন্ধ্যার পর এদিকে রিকশা পাওয়া খুব মুশকিল!"
- "চিন্তা করবেন না মাসিমা, এখান থেকে আমার বাড়ি হেঁটে মাত্র দশ মিনিটের পথ।"
- "ঠিক আছে তাহলে চিন্তার কিছু নেই। বাড়ি যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করতে হবে না। আজ আর পাঁউরুটি খেতে হবে না। ওটা কাল সকালে খেও। আমি এক্ষুনি গিয়ে রান্না করছি। তুমি খেয়ে যাবে।"
- "না না, আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।"
- "ওসব না না বললে শুনবো না। বাড়িতে ঢুকেই রান্না বসাবো। মালার শরীর খারাপ। জ্বর হয়েছে।"
- "সে কি! কবে থেকে?"
- "আজ নাইট ডিউটি থেকে ফেরার পর ঘুম থেকে উঠে বলছে।"
কলিং বেলের শব্দ শুনে বিছানা থেকে উঠে এসে দরজা খোলে মালা। মায়ের সঙ্গে দু হাতে ব্যাগ ধরা অতনুকে দেখে অবাক হয় সে। অসুস্থ শরীরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে তার। একটা ম্লান হাসি হেসে অতনুকে ঘরে আসতে বলে। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, "মা, তোমাকে বললাম আজ ছেড়ে দাও, কাল বাজারে যাব। শুনলে না। অতনুকে কষ্ট দিলে।"
- "না না, কষ্টের কি আছে? রিকশায় করে ফিরছিলাম, রাস্তায় মাসিমাকে দেখতে পেয়ে তুলে নিলাম। মাসিমার মুখে শুনলাম তোমার শরীর খারাপ। এখন কেমন আছো?"
- "প্যারাসিটামল খেয়েছি। জ্বরটা একটু কমেছে।"
- "দুদিন ছুটি নিয়ে রেষ্ট নাও। একটু ফ্রেশ হয়ে আবার কাজে জয়েন করবে।"
- "শুনলাম তোমার বাবার শরীর খারাপ। এখন কেমন আছেন?"
- "প্রেসারটা বেড়ে গিয়েছিল। এখন ভালো আছে। আমি বাড়ি থাকি না। বোনের মর্নিং কলেজ, খুব সকালে বেরিয়ে যায়। মা বাড়ির কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই বাবার ওষুধ খাওয়ায় মাঝে মাঝে অনিয়ম হয়ে যায়। তখন সমস্যা দেখা দেয়।"
দুজনে কথা বলতে বলতে মালার মায়ের রান্না হয়ে গেছে দেখে অতনু অবাক হয়ে বলে ওঠে, "মাসিমা কি ম্যাজিক জানেন? এর মধ্যেই এতকিছু করে ফেললেন!"
খাওয়া সেরে বাড়ি ফেরার সময়ে অতনু মালাকে বলে যায়, "কোনও অসুবিধা হলে বা জ্বর বাড়লে আমাকে ফোন করবে।"
পরের দিন ভোর হতে না হতেই অতনু মালার খবর নেয়। বলে, ডিউটির পর সে মালার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। মাঝে মাঝে অতনু বিকালের পর ফল বা মিষ্টির প্যাকেট হাতে মালার কোয়ার্টারে আসে, অসুস্থ মালাকে দেখতে। কয়েকদিনের মধ্যেই মালা সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দেয়।
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে যায়। এবার মালার মায়ের বাড়ি ফেরার পালা। মালা তার মাকে ট্রেনে তুলে দিতে যায়। সঙ্গে অতনুও যায়। এই কয়েকদিনে মালার এবং মালার মায়ের সঙ্গে অতনুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
স্টেশন থেকে ফেরার পথে অতনু বলে, "তোমার মায়ের রান্নার স্বাদ অপূর্ব। এখনও মুখে লেগে আছে। পরপর কয়েকদিন বেশ ভালো খাবার জুটলো। কাল থেকে আবার ক্যান্টিনের ভাত খেতে হবে!"
- "এই ক'দিন মাঝে মাঝে আমার মায়ের হাতের রান্না খেয়েছো। এবার না হয় মেয়ের হাতের রান্না খেয়ে দেখবে। মায়ের মত অত ভালো না হলেও, আমিও খুব খারাপ রান্না করি না। আমরা হলাম গ্রাম গঞ্জের মেয়ে, রান্না করাটা আমাদের রক্তে। তোমার দুঃখ আমি দুর করে দেব। কিন্তু আমার দুঃখ কে দুর করবে অতনু?"
- "কি দুঃখ তোমার?"
- "কাল থেকে আমার একটা অন্য জীবন শুরু হবে। এতদিন বাবা, মা, দাদার সঙ্গে এক বাড়িতে, এক ছাদের তলায় থাকতাম। গত একমাস তবুও মায়ের মুখটা দেখতে পেতাম। কাল থেকে একা! একেবারেই একা!"
- "কেন, আমিতো আছি।" কথাটা বলে একটু যেন হকচকিয়ে যায় অতনু। সে ভাবে ভুল কিছু বলে ফেললো না তো! একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না তো!
- "তুমি থাকবে অতনু? আমার কাছে, আমার পাশে!"
- "থাকবো মালা। তোমার মত বন্ধু আমি আর কোথায় পাব?"
- "কেবল বন্ধু! আমি যে মনে মনে আরও অনেক দুর এগিয়ে গিয়েছি। অনেক কিছু ভেবে ফেলেছি অতনু। আমার সেই ভাবনা, সেই অনুভূতির কি কোনও দাম নেই তোমার কাছে?"
- "আছে মালা, আছে। কিন্তু তুমি শিলিগুড়ির মত এক সুন্দর সহরের শিক্ষিত, আধুনিক মনস্কতার মেয়ে। সেখানে আমি ক্যানিং থেকে পনের কিলোমিটার দুরের এক অজ গাঁয়ের ছেলে। একটা গাঁইয়া ছেলেকে পারবে ভালোবাসতে? বলো, পারবে ভালোবাসতে?"
- "পারবো অতনু, পারবো। না পারবো না।" একটু থেমে অতনুর মুখের অভিব্যক্তিটা বোঝার চেষ্টা করে আবার বলতে থাকে, "আমি তোমাকে নতুন করে ভালোবাসতে পারবো না অতনু। কারণ আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি।"
- "আমিও মালা। আমিও তোমাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। হৃদয় দিয়ে ভালোবাসি। কিন্তু গাঁয়ের আনস্মার্ট, বোকাসোকা ছেলেতো আমি। তাই বলতে পারছিলাম না।"
- "কেন, বললে কি আমি বকুনি দিতাম?" হেসে ওঠে মালা।
- "না, বকুনি নয়। বললে যদি কান ধরে নীল ডাউন করে দাও, সেই ভয়ে।"
মালা হাত বাড়িয়ে অতনুর কানের লতি ধরার চেষ্টা করে। অতনু বাঁধা দেয় না। হাঁটতে হাঁটতে কোয়ার্টারের কাছাকাছি চলে আসে তারা। এবার একে অন্যকে ছেড়ে যাওয়ার পালা। দাঁড়িয়ে পড়ে মালা। কোনও কথা না বলে নীরবে, নিঃশব্দে অতনুর আঙুলে আঙুল ছোঁয়ায় সে। সেই নীরব স্পর্শে হয়ত লেখা ছিল অনেক কথা! সেই নীরব স্পর্শে হয়ত আঁকা ছিল অনেক ছবি!
মাসখানেক হল মালা তার বাবা দাদাকে দেখেনি। তার মায়ের ট্রেনও অনেকক্ষণ আগে ছেড়ে দিয়েছে। অতনুও চলে গেছে তার ঠিকানায়। নিঃসঙ্গ একাকী মালা তার কোয়ার্টারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিকষ কালো আকাশের দিকে! ভাবতে থাকে আজকের রাত যেন তার জীবনের দীর্ঘতম রাত! হাত ব্যাগের মধ্যে থাকা মোবাইল ফোনের শব্দে সম্বিত ফেরে মালার। তড়িঘড়ি ফোনটা বের করে দেখে অতনু ফোন করেছে।
- "ঘরে ঢুকে যাও। বেশিক্ষণ বাইরে থেকো না। সিজন চেঞ্জ হচ্ছে। শিশির পড়তে শুরু করেছে। আবার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। সবে জ্বর থেকে উঠেছো।"
- "কি করে জানলে, আমি এখনও ঘরের বাইরে আছি?"
- "টেলিপ্যাথি।"
কাজের অবসরে মালা অতনুকে মাঝে মাঝে দেখা যায় হাসপাতালের ক্যান্টিনে চা খেতে, গল্প করতে। কখনও আবার কল্যাণী সহরের বিভিন্ন রেস্তোরা বা শপিং মলে দেখা যায় তাদের। এভাবেই কেটে যায় কয়েক মাস। অতনুর সান্নিধ্যে দুর হয়েছে মালার একাকিত্বের দুঃখ, যন্ত্রনা।
- "অতনু, একটা ভালো খবর আছে। দাদা এক সপ্তাহের জন্য ছুটি নিয়েছে। সামনের সপ্তাহে বাবা, মা, দাদা আসছে।"
- "ভালোই হয়েছে আমিও ভাবছি কয়েক দিনের জন্য বাড়ি যাবো। চাষবাস কি রকম হচ্ছে দেখে আসবো। আমাদের পাঁচ বিঘে ধান জমি আছে। লোক দিয়ে চাষ করানো হয়। গত বছর ভালো ধান হয়েছিলো। দেখা যাক এবছর কেমন হয়।"
- "তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে ঘুরে এসো। শুনছি নিম্নচাপ হয়েছে। ঝড় বৃষ্টি হতে পারে।"
- "না, সেরকম মারাত্মক ঝড় এদিকে হবে না। বলছেতো ঝড়টা বাংলাদেশের দিকে চলে যাবে। অবশ্য এদিকে ভারি বৃষ্টি হতে পারে। আমি তাহলে শনিবার নয় আগামী সোমবার বাড়ি যাবো। কয়েকদিন বাবা মায়ের সঙ্গে আনন্দে কাটাও।"
- "বাবা মায়ের সঙ্গেতো আনন্দে কাটাবো। তবে আরও একজনের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। যে আমাকে আপন করে নিয়ে, আমার একাকিত্বের দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে।"
- "কে গো সে? ক'দিন আগে যার কান মুলে দিয়েছিলে?"
- "শুধু কান কেন। তার অনেক কিছুই মুলে দিতে ইচ্ছা করে। কবে যে তাকে পুরোপুরি নিজের করে পাবো!"
- "ওরে বাবা! এখন থেকেই ভয় দেখাচ্ছো? বিয়ের পর গাঁইয়া ছেলেটার যে কি হাল হবে কে জানে!"
- "কি আবার হবে। বিয়ের পর ঘোরতর সংসারী হবে। বছর বছর বাচ্চা হবে।" কথা বলতে বলতে খিলখিল করে হেসে ওঠে মালা।
- "বুঝতে পারছি।"
- "কি বুঝতে পারছো?"
- "যেখানে এত প্রেম, সেখানে বাচ্চা হওয়াটা কেবল বিয়ের অপেক্ষা।"
- "ধ্যাৎ।"
খবর এসেছে ঘূর্ণীঝড় বাংলাদেশের দিকে নয়, পশ্চিমবঙ্গের দিকে ধেয়ে আসছে। সুন্দরবনের আসেপাশে কোথাও 'ল্যান্ড ফল' করবে। চারিদিকে হৈচৈ শুরু হয়েছে। সরকার তৎপর হয়ে উঠেছে। রেসকিউ টিম কাজে নেমে পড়েছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরানো হচ্ছে। মানুষদের সচেতন করার জন্য দিকে দিকে মাইকিং চলছে। মৎসজীবিদের সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে।
ভয়ঙ্কর কালো রাত! প্রবল বেগে ঝড় আছড়ে পড়লো সুন্দরবনের উপর। উপড়ে গেল বহু গাছপালা, ইলেকট্রিকের পোষ্ট। ছিঁড়ে গেল তার। দিনের পর দিন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। নষ্ট হল বিঘার পর বিঘার ফসল। ভেঙে, গুঁড়িয়ে গেল শত শত কাঁচা বাড়ি। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পুর্ণ বেহাল। ইন্টারনেট কাজ করছে না। ফোনে নেটওয়ার্ক একেবারেই নেই।
অতনুর কোনও খবর পাচ্ছে না মালা। কেমন আছে অতনু, কেমন আছে তার পরিবারের লোকজন কিছুই জানতে পারছে না সে! খুবই দুশ্চিন্তায় আছে। বারে বারে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। দিনের পর দিন চেষ্টা করার পর অবশেষে একদিন ফোনের লাইনটা পেল। তবে খুব অস্পষ্ট, কেটে কেটে কথা ভেসে আসছে। বেশির ভাগ কথাই বোঝা যাচ্ছে না।
- "অতনু, কেমন আছো?"
- "ঠিক আ...সব বন্ধ...ট্রেন চলছে...খুব লেট...এরমধ্যে মা আমার...বিয়ের ঠিক...পাশের গ্রামে...কাল পাকাদেখা....পরশু ফিরবো...." বারে বারে বিঘ্ন ঘটতে ঘটতে কয়েক সেকেন্ড পরে পুরোপুরি কেটে যায় লাইনটা। তারপর অনেক বার চেষ্টা করেও লাইনটা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফোনটা রেখে দেয় মালা।
এলোমেলোভাবে ভেসে আসা অতনুর অস্পষ্ট কথাগুলো নিজের মনে সাজাতে থাকে মালা। কি বললো অতনু! 'মা আমার বিয়ের ঠিক করেছে পাশের গ্রামে। কাল পাকাদেখা। পরশু ফিরবো।' ফোনে ভেসে আসা অস্পষ্ট কাটা কাটা কথাগুলো তিরের মত বিঁধতে থাকে তার মনে। এই ছিল অতনুর মনে! এই তার ভালোবাসা! এত কথা, এত হাসি, এত স্বপ্ন, মন দেওয়া নেওয়া একে অপরকে আপন করে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা সবই মেকি, সবই মিথ্যে, সবই তাহলে অভিনয়! মালাকে নিয়ে, মালার মনকে নিয়ে অতনু তাহলে এতদিন খেলা করেছে! কেঁদে ওঠে মালা। নিজেকে আর সামলাতে পারে না, চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, "কেন অতনু, কেন? কেন তুমি এমন করলে? কেন আমাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেললে? কেন আমার মনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেললে? কেন আমার মনে ভালোবাসার আগুন জ্বাললে? কেন অতনু, কেন? আমিতো ভালোই ছিলাম। কেন এলে আমার জীবনে? কেন ঝড় তুললে আমার মনে? কেনই বা ফিরে গেলে? কি দোষ ছিল আমার? বলো অতনু, বলো? একবার বলে যাও ......।"
মালার কান্না, মালার হাহাকার চার দেওয়াল ভেদ করে পৌছে যায় তার সহকর্মীদের কানে। ছুটে আসে সোমা, উর্মি, শর্মিলারা। তারা মালাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু কি বোঝাবে? কি ভাষায় সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায় না। পুরো ব্যাপারটা জানতে উর্মিরা বারে বারে অতনুকে ফোন করার চেষ্টা করে। কিন্তু যোগাযোগ করতে পারে না।
না, আর নয়। মালা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আর কল্যানীতে নয়। আগামীকাল রবিবার, বন্ধ থাকবে হাসপাতালের অফিস। সোমবার ইস্তফা দিয়ে সে ফিরে যাবে শিলিগুড়িতে। নার্সিং কাজের শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা যখন আছে, সে ঠিক কোনও না কোনও নার্সিংহোমে কাজ জুটিয়ে নেবে। হয়ত এত বেতন পাবে না। পাবে না এত সুযোগ সুবিধা। সেইসঙ্গে পাবে না এত দুঃখ, যন্ত্রনাও! অতনুকে দেখলে সে নিজেকে সামলে রাখতে পারবে না। একেবারে ভেঙে পড়বে। অতনু কল্যাণীতে আসার আগেই তাকে ফিরে যেতে হবে।
লাগেজ গুছিয়ে নেয় মালা। ইস্তফা পত্রটা হাতে লিখে সে জমা দেয় সুপারের অফিসে। স্টেশনে যাবে বলে একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। চলে যায় রিকশা। পড়ে থাকে একরাশ সুখ স্মৃতি আর কয়েক ফোঁটা চোখের জল। পর মুহূর্তে আরও একটা রিকশা এসে দাঁড়ায় হাসপাতালের গেটে। রিকশা থেকে নামে অতনু। ভাবে হাসপাতালে এক চক্কর ঘুরে তারপর বাড়ি যাবে। গেটের সামনে দেখা শর্মিলার সঙ্গে। অতনুকে দেখে প্রথমে মুখ ঘুরিয়ে নেয় শর্মিলা। তারপর দু চারটে কথা শুনিয়ে দেয়। কিছুই বুঝতে পারে না অতনু। জানতে চায় কি হয়েছে। শর্মিলা মালার সব কথা তাকে খুলে বলে । শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ে অতনু। নিজের কপালে একটা চাপ্পড় মেরে বলে, "কি উল্টো পাল্টা বকছো! পাকা দেখাতো আমার বোনের হয়েছে। আমার নয়।"
- " তার মানে? তাহলে তুমি মালাকে ফোনে কি বলেছো?
একটু ভেবে অতনু বলে, "বুঝতে পেরেছি। ফোনে ভালোভাবে কথা শোনা যাচ্ছিল না। মালা বার বার 'অ্যাঁ, অ্যাঁ' করছিল। 'শুনতে পাচ্ছি না, শুনতে পাচ্ছি না' বলছিল। আমি ফোনে বলেছিলাম, 'আমার বোনের পাকা দেখা।' মনে হয় মালা 'বোনের' শব্দটা শুনতে না পেয়ে ভেবে নিয়েছে 'আমার পাকা দেখা'। তার মানে ও আমার অর্দ্ধেক কথা শুনতে পেয়ে, আমার কথার অন্য মানে করে, আমার উপর অহেতুক রাগ করেছে। খুব সেন্টিমেন্টাল মেয়েতো!"
- "রেজিগনেশন দিয়ে, বাড়ি ফেরার জন্য মালা স্টেশনের দিকে গেছে। তুমি তাড়াতাড়ি যাও অতনু। মালাকে ফিরিয়ে আনো।"
অতনু পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে, মালাকে ফোন করার চেষ্টা করে। কিন্তু সুইচট অফ। এদিকে ওদিকে তাকায় অতনু, আসে পাশে কোনও রিকশা দেখতে না পেয়ে, উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়তে থাকে। ট্রেন ছাড়তে যে আর বেশি দেরি নেই!
।। সমাপ্ত ।।
ঠিকানা - 34/10/A,
M.G.ROAD BUDGE BUDGE
KOLKATA - 700137