
কপালের লিখন কে করে খণ্ডন
সমীর কুমার দত্ত
সেদিন খাবার বেড়েছি টেবিলে লাঞ্চ করবো বলে। খাবার মুখে তুলতে যাবো কি এমন সময় গেটের কাছ থেকে এক বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
" মাগো, দুটো ভাত হবে মা?" পর পর দুবার শুনলাম কথাটা। দ্বিতীয়বারের ডাকে একটা অতিরিক্ত বাক্য যুক্ত হলো, "কতদিন ভালো করে খাইনি মা।"
খেতে গিয়েও খেতে পারলাম না, একজন মায়ের বয়সী মানুষ অভুক্ত আছে ভাবতেই কষ্ট হলো। আমার স্ত্রী কর্মস্থলে যাবার আগে আমার খাবার রেডি করে টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে গেছেন। অন্যদিন তেমন ক্ষিদে থাকে না। আজ ক্ষিদেটা যেন পেয়ে বসেছিলো। এমন আর্তিসুলভ ডাক আমায় থামিয়ে দিলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলাম এক বয়স্কা সধবা মহিলা আমায় দেখতে পেয়ে বললো, "বাবা গো, দুটো ভাত দিতে পারো? আধ পেটা খেয়ে খেয়ে শরীর ভেঙে পড়েছে বাবা।"
গেট খুলে আমি বললাম, "ভেতরে এসে বসো। আমি খাবার দিচ্ছি।"
আমাকে থামিয়ে বৃদ্ধা বললো, "আমি বসে খেতে পারবো না বাবা। আমাকে একটা প্যাকেটে করে দিলে ভালো হয়।"
আমি জিজ্ঞেস করে বললাম," কেন? বসে খেলেই তো হয়।"
—আমার বৃদ্ধ,অসুস্থ স্বামী একটা ভাঙাচোরা বাড়ির নিচে বসে আছে আমার অপেক্ষায়।
—কেউ নেই তোমাদের?
—ছিলো। এখনো যে নেই তা নয়, আছে। আমাদের সঙ্গে নেই।
—বুঝলাম না। একটু পরিস্কার করে বলো।
—আমাদের এক ছেলে আছে। আমার সৎ ছেলে। আমি না হয় তার সৎ মা। কিন্তু বাবা তো নিজের। সে আমাদের দেখে না। উপরন্তু এমন করেছে যে আমরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি।
—একই বাড়িতে থাকে অথচ তোমাদের দেখে না?
—একই বাড়িতে নেই। বাড়ি ছিলো ওর বাবার নামে। নিত্য জ্বালাচ্ছিলো বাড়িটা ওর নামে লিখে দিতে। আমার স্বামী দিতে চাইছিলেন না। একদিন ও আর ওর বৌ জোর করে লিখিয়ে নিয়ে প্রোমোটারকে বিক্রি করে দিয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিলো তা কোথায়, আমরা জানি না। তারপর প্রোমোটার আমাদের ঘর থেকে বের করে দেয়। আজ আমরা পথের ভিখারি। একটা ভাঙা পোড়ো বাড়ির নিচে আমার স্বামীকে নিয়ে পড়ে থাকি। এক এক দিন আমি খাবার জোগাড় করতে পারলে দুজনে ভাগ করে খাই। যেদিন জোগাড় হয় না, সেদিন কলের জল খেয়ে থাকি।
— কোন বৃদ্ধাশ্রমে তো চলে যেতে পারো।
— বৃদ্ধাশ্রমে তো অনেক টাকা পয়সা লাগে। আমরা কোথায় পাবো,বাবা!
—অনেক বৃদ্ধাশ্রম আছে যেখানে টাকা পয়সা লাগে না।
কিন্তু এভাবে তো বেশিদিন চলতে পারে না। ওই বাড়ি যে কোনো দিন ভেঙে পড়তে পারে।
—তা তো পারে বাবা, কিন্তু কোথায় যাবো? আর কোথায় বিনা পয়সার বৃদ্ধাশ্রম আছে আমরা তো জানি না
—তোমাদের কি একটাই ছেলে? তুমি তো বললে ওটা তোমার সৎ ছেলে। তোমার নিজের কোন ছেলে নেই?
—আমার স্বামীর প্রথম পক্ষের স্ত্রী নাকি খুব ভালো ছিলেন। ছেলের জন্ম দিয়ে মারা যান। সদ্যজাত ছেলেকে মানুষ করার জন্য ওনাকে আবার বিবাহ করতে বাধ্য হতে হয়। আমার বাবা আমার ছোট বয়সেই মারা যান। আমি মামার বাড়ি মানুষ হই। মামার অবস্থা ভালো ছিলো না। এরকম একটা সম্বন্ধ আসতে রাজি হয়ে যাই মামার ঘাড় থেকে নামতে। ওই ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের ছেলের কথা ভাবতে পারিনি। আজ সেই ছেলে আমাকে যোগ্য জবাব দিয়েছে। পর কখনো আপন হয় না বলি কি করে ? ওর বাবা তো ওর নিজের। বাবা ওকে জীবনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাবাকে দেখার দায়িত্ব কি ওর নয়? দেখার পরিবর্তে ও ওর বাবার এই প্রতিদান দিলো? আমার স্বামীর অংশীদারি ব্যবসা ছিলো। অংশীদার ওনার ভালো মানুষীর সুযোগ নিয়ে ঠকিয়ে ব্যবসা ওর নামে করে নিয়েছে। পার্টনারকে বিশ্বাস করে,ওর হাতে সব ছেড়ে দিয়েছিলেন । সেও তার প্রতিদান দিয়েছে। কপালের লিখন কে করে খণ্ডন! ছেলে এমন ঘরের মেয়েকে বিয়ে করেছে যে শশুরকে পর করে , পথে বসিয়ে ছেলেকে ভাগিয়ে নিয়ে চলে গেলো। ছেলে এরকম ছিলো না বাবা।
—ও সব মায়েরাই বলে। হঠাৎ একটা মেয়ে এসে আমুল পাল্টে দিলো? কেন নিজের বিবেককে কি বিয়ের পরেই বৌয়ের কাছে বন্ধক দিতে হলো!
সেদিনকার মতো দুটো প্লাস্টিকের কন্টেনারে আমার সব খাবারটা দিয়ে দিলাম। দুজনকে আধপেটা খেয়ে থাকতে হবে। তা থাকুক। পৃথিবীতে কতো মানুষই তো আধপেটা খেয়ে থাকে। নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো।
খাবার দিয়ে বলেদিলাম সন্ধ্যায় এসে রুটি নিয়ে যেতে।আমার স্ত্রী বাড়ি ফিরে সব কথা শুনে বললেন, " তা নয় বেশ করেছো দুটো অভুক্ত বৃদ্ধ মানুষকে খেতে দিয়েছো। কিন্তু তোমার পেটে তো দুটো ভাত পড়লো না। ওষুধ গুলো তো ঠিক মতো খাওয়া হলো না। আমি বরং গরম গরম রুটি করে দি খেয়ে নাও।"
আমি বললাম,"ওকে সন্ধ্যেবেলায় রুটি নিয়ে যেতে বলেছি।"
—তুমি তো রুটির পয়সা দিয়ে দিতে পারতে, কিনে নিতো। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। এভাবে তুমি কদিন ওদের টানতে পারবে?
—না, আমি খোঁজ নিচ্ছি বৃদ্ধাশ্রমের। সেখানেই ব্যবস্থা করে দেবো। আজ এই স্বার্থপরতার যুগে মানুষ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বসেছে।আজকালকার দিনে কে কার কথা ভাবে? কিন্তু চোখ বুজে থাকলে তো চলবে না, সমাজে বাস করতে গেলে। কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে।
এক জায়গায় খোঁজ পেলাম এক বৃদ্ধাশ্রমের। যারা ওই বৃদ্ধাশ্রম চালান, তাঁরা দেশ বিদেশের থেকে আসা অর্থ সাহায্যের ওপর ভিত্তি করে চালান। সমস্ত খবর নিয়ে আমি একটা গাড়ি ভাড়া করে ওদের নিয়ে গিয়ে তুললাম। সবকিছু ফর্মালিটিজ মিটে গেলে আমি ও আমার স্ত্রী ওখান থেকে বিদায় নিলাম। আসার সময় বৃদ্ধ বৃদ্ধা আমাদের মুখের দিকে অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো। ওই সময়ে ওরা আমাদের পুত্র পুত্রবধূ ভেবে স্বপ্নরাজ্যে বিরাজ করতে লাগলো। ভাবখানা যেন তোমরা আমাদের ঠিক জায়গায় রেখে যাচ্ছো তো? কিংবা আবার আসবে তো? ভুলে যাবে না তো? ইত্যাদি প্রশ্নগুলো যেন ছুঁড়ে দিলো আমাদের দিকে।এক দুদিন একটু ভালোবাসার দিলে মানুষ কতটা আপন হয়ে যায়। মানুষ সেই ভালোবাসা টুকুও দিতে কার্পণ্য করে।
কিছুদিন পর ওখান থেকে ফোন এলো বৃদ্ধ মারা গেছেন। আমি অসুস্থ ছিলাম বলে যেতে পারিনি। কিছুদিন পর আবার ফোন এলো বৃদ্ধার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। তার কারণে একদিন কাউকে কিছু না বলে বৃদ্ধাশ্রম ছেড়ে চলে গেছেন। অনেক খোঁজাখুঁজি হয়েছে কিন্তু কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। থানায় একটা এফ. আই. আর করা হয়েছে। বেওয়ারিশ বলে কেউ তার তেমন করে গুরুত্বই দেয় নি। এই হলো বৃদ্ধাশ্রম! আমার মনে প্রশ্ন জাগলো বৃদ্ধা চলে গেলেনই বা কেন? ওরা কি সেখানে নির্যাতিত হয়েছেন কিংবা অত্যাচারিত?
=======================
Samir Kumar Dutta
Bally, Howrah
Mobile no. 9051095623(WhatsApp)