'দেবযান' সাহিত্য পত্রিকার ৪২তম বর্ষ, ২০২৪, সুচিত্রা মিত্র শতবর্ষ সংখ্যা
অরবিন্দ পুরকাইত
'দেবযান' সাহিত্য পত্রিকার ৪২তম বর্ষ ২০২৪ সংখ্যাটি নিবেদিত হয়েছে কিংবদন্তিপ্রতিম শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের শতবর্ষ সংখ্যা হিসাবে। শ্রীমতী মিত্রের সাক্ষাৎ-শিষ্য— যাঁরা তাঁর কাছে সংগীতশিক্ষা গ্রহণ করে পরবর্তীকালে কেউ কেউ সেই শিক্ষাধারায় শিক্ষাপ্রদানে রত বা আজীবন সেই ধারায় স্নাত— এমন কতিপয় মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ্যসম্পুট এই সংখ্যাটি। এর বাইরে রয়েছে কয়েকটি কবিতা। সম্পাদক উৎপল দত্ত স্বয়ং এই কিংবদন্তিপ্রতিম শিল্পীর সাক্ষাৎ-শিষ্য, শিল্পীর সঙ্গে দীর্ঘ সান্নিধ্যের সৌরভ তাঁর আর বরাবর সেই গীতধারায় স্নাত। সেদিক দিয়ে এই সংখ্যাটি তাঁর গুরুপ্রণাম অবশ্যই। তাঁর এবং তাঁদেরও— রবীন মুখোপাধ্যায়, কাশীনাথ রায়, অনিতা পাল, প্রিয়জিৎ ঘোষ, জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়, ধ্রবজ্যোতি বাগচী এবং উৎপল দত্ত। লেখকদের কলমে শিল্পীর কাছে গান শেখার বিরল অভিজ্ঞতা, তাঁর গান শেখানোর তথা রবীন্দ্রগানের দর্শন শিষ্য-শিষ্যাদের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া প্রতিভাত। একাধারে তাঁর অভিভাবক তথা মাতৃসুলভ ব্যবহার, তাঁর সঙ্গে এঁদের ব্যক্তিগত সান্নিধ্যের সুরভি, তাঁর নিঃসঙ্গতা, তাঁর ব্যক্তিত্ব, বালিকাসুলভ চপলতা, রসিকতাজ্ঞান— স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকা সেসব জীবন্ত হয়ে উঠেছে এঁদের লেখায়।
সম্পাদক মহাশয় লিখেছেন, "গান ছাড়া আর কি কি শিখিয়েছেন? রবীন্দ্রনাথকে শিখিয়েছেন। নিজের প্রাত্যহিক জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে শিখিয়েছেন বেঁচে থাকার শিল্প। এ জীবন কিভাবে ব্যয় করতে হয় তার মন্ত্র শিখিয়েছেন।
"তিনি মা। তিনি দাম্ভিক নন। মায়ের আঁচল পেতে রেখেছিলেন আমাদের সবার জন্য। যে সেই স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছে— সে ধনী। যে পারেনি তার জন্য রইলো শুধুই কৃপা।"
শ্রীমতী মিত্রের ছাত্র রবীন মুখোপাধ্যায়— রবিতীর্থের প্রাক্তন শিক্ষক, যাঁর সঙ্গে গুরুর সান্নিধ্য প্রায় ছয় দশকের এবং যিনি শ্রীমতী মিত্রের ঘরানাতেই অগণিত ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষাদান করে চলেছেন, তিনি শুরুতেই শিল্পীর সংগীত-দর্শন স্মরণ করেছেন, 'আমি আনুষ্ঠানিক পূজা-অর্চনা করি না। গানই আমার কাছে পূজা।' 'রবীন্দ্রগানে সুচিত্রাদি তাঁরই কল্পনার চিত্র তুলে ধরতেন, ভাবের প্রকাশ পেত যেন একটি নিখুঁত ছবির রূপকল্পে।' জামশেদপুরে হোটেলে টিভিতে শ্রী মুখোপাধ্যায় অ্যানিমাল প্ল্যানেট চালিয়ে দিলে ছোট-বড় হাতির সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে চলার দৃশ্য দেখে সুচিত্রা যখন বলেন, 'কী সুন্দর একজোট হয়ে ওরা থাকে। এটাই জীবন। কী বল? না, না, আমি ভালই আছি।'— সে-বলা যে কতখানি অন্তর্ভেদী! শ্রী মুখোপাধ্যায়ের অসুস্থতার সময় ফোনে খবরাখবর নেওয়া তো ছিলই, এক সকালে চোখ মেলেই দেখেন সামনে 'জীবন্ত সরস্বতী'!
শ্রীমতী মিত্রকে চল্লিশ বছর ধরে শিক্ষার্থী বা সহকর্মী হিসাবে পাওয়া কাশীনাথ রায় স্মরণ করেছেন গান শেখানোর আগে বারবার পড়ে তার মর্মার্থ উপলব্ধি করার উপর গুরুত্ব দেওয়াকে। স্বরলিপি অনুধাবনে সীমাবদ্ধ না থেকে তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করাই শিল্পীর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বলে মনে করতেন আর তাই গান শেখানোর সময় স্বরক্ষেপণ ও নাটকীয়তার দিকে সজাগ দৃষ্টি থাকত তাঁর। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও অন্যান্য গীতিকারের গান গাওয়া, তাঁর সময়জ্ঞান ইত্যাদি তুলে ধরেছেন তিনি।
'চিত্রাঙ্গদা'য় 'বঁধু, কোন আলো লাগলো চোখে' শেখানোর সময় অনিতা পালকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, "তুমি কি সেই আলো চেনো?' 'সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল' শ্রীমতী পালের!
জর্জ বিশ্বাস আর তাঁর 'দিদিমণি'কে নিয়ে ছোট্ট সুন্দর একটি লেখা উপহার দিয়েছেন প্রিয়জিৎ ঘোষ। কৃষ্ণকলির সেই সটান আবির্ভাব এবং জর্জের চোখের উপর অচঞ্চল দৃষ্টি রেখে জানিয়ে দেওয়া, "বিশ্বভারতী জর্জের প্রতিভাকে স্বীকার করে নিলেও কোনোভাবেই তাঁর গায়কী অ্যাপ্রুভ করে না এবং তিনিও প্রতিষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে, স্বভাবতই অন্যরকম কিছু ভাবতে পারছেন না।" দোক্তাবিলাসী জর্জকে শ্রী ঘোষ হো হো করে হাসতেই দেখছেন আর মনে হচ্ছে তাঁর যে জর্জ দিদিমণির আসার পথ চেয়ে ছিলেন তো বটেই, নিঃসন্দেহ ছিলেন দিদিমণির বয়ে-আনা বার্তা সম্পর্কেও। বেশ শুনতে পাচ্ছেন শ্রী ঘোষ, "দিদিমণি চলে যাচ্ছেন আর পিছন পিছন ধাওয়া করে আসছে জর্জের হৃদয় তোলপাড় করা কণ্ঠস্বর, '.... তুমি তো দিতেছ, মা, যা কিছু তোমারি/স্বর্ণশস্য তব, জাহ্নবীবারি...' সামনের দাঁতদুটো অননুকরণীয় ভঙ্গিতে নীচের ঠোঁটকে অতিক্রম করে সামান্য বাইরে বেরিয়ে এসে হাসিটাকে আরও মনোরম করে তুলছে।" সে দিদিমণি আর আসবেন না জর্জের কাছে, আসবেন জর্জ যেদিন মরদেহ হয়ে ফিরে আসবেন আর সেদিনের দিতে-না-পারা মালাটি পরিয়ে দেবেন সযত্নে, "আর সরবে না হলেও একাকী ঘরে উদাসী আকাশের দিকে তাকিয়ে একবারের জন্যও কি গাইবেন না, 'আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনই লীলা তব...।'"
১৯৭৬-৭৭ সালের দিক, রবীন্দ্রসদনে সুচিত্রা মিত্রের একক অনুষ্ঠানের হোর্ডিং দেখে জয়ন্ত মুখার্জি ৩৭ পরাশর রোড, কলকাতা-২৯-এ টিকিট সংগ্রহে গিয়ে বুঝলেন সেটাই রবিতীর্থ। সরাসরি গিয়ে বললেন যে তিনি সুচিত্রা মিত্রের কাছে গান শিখতে চান। গান শেখা থেকে একসময় রবিতীর্থর নানা অনুষ্ঠানে গাওয়া। শীতের সন্ধ্যায় সুচিত্রাদির বাড়ি পৌঁছালে খেতে-দেওয়া চা বা স্যুপের খালি পাত্রটা কোথায় রেখে আসবেন জিজ্ঞাসা করায় একটা কথাই বলেছিলেন, "বাড়িতে কি এই কাজগুলো তুমি করো নাকি তোমার মা করেন?" "ওই একটা কথাতেই দিদি আমার কাছে মায়ের রূপে ধরা দিলেন।"— লিখেছেন শ্রী মুখার্জি তাঁর 'মাতৃরূপে সুচিত্রা দি...' লেখায়। একাধিকবার অসুস্থতায় তাঁর মাতৃরূপের পরিচয় এখানে লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী তাঁর 'পরশখানি দিও' শিরোনামের লেখায় রবিতীর্থর প্রতিষ্ঠা থেকে সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গীত শিক্ষাদানের গভীরতা, তাঁর নিকট সান্নিধ্য, পান-জর্দা পাওয়া এবং মাঝে মাঝে তাঁর জন্যে পান নিয়ে যাওয়া, গল্প, বিবিধ প্রশ্নের উত্তরপ্রাপ্তি, প্রয়াণের প্রাক্কালেও তাঁর ক্লাস করতে পারা ইত্যাদি নানান প্রসঙ্গ ছুঁয়েছেন। তাঁর কাছে প্রাপ্ত শিক্ষায় বুঝেছেন, "কী বিপুল আন্তরিক বোধ, মননশীলতা প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথের গানকে আত্মস্থ করবার জন্য।... সুর এবং ভাবের সম্মিলনে যে বাণী-প্রধান রবীন্দ্রসঙ্গীতের আভিজাত্য তা অনুভবের জন্য সূক্ষ্ম বোধ প্রয়োজন।... গান শুরুর পর্বে বারংবার গানটি পাঠ প্রয়োজন, তবেই সম্ভব তার পরিবেশন। 'রবিতীর্থ'র প্রাক্তন ছাত্র হয়ে, অজস্র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে অনুধাবন করতে পেরেছি, রিহার্সাল বা মহড়ার গুরুত্ব।"— লিখেছেন তিনি।
উৎপল দত্তের লেখায় প্রচলিত ছকের বিপরীত পথ পছন্দকারী, জেদি, আত্মবিশ্বাসী, অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, স্নেহশীল জননী সুচিত্রা মিত্রকে দেখতে পাই আমরা। শান্তিনিকেতনে যাবার কথায় বাড়িতে আপত্তি— অত দূরে গিয়ে থাকবে মেয়ে! স্বপ্নপূরণ হল, যাঁর জন্যে যাওয়া সেই রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর। "কিন্তু, তিনি খুঁজে নিলেন সেই আকাশ, বাতাস আর গাছগাছালির মধ্যে তাঁর প্রিয় ঠাকুরকে। মাত্র কুড়ি দিন আগে যিনি চলে গেছেন, তাঁকেই অন্তরে খুঁজে পেলেন।" রয়েছে কালিদাস নাগের দেওয়া নামে দ্বিজেন চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর যৌথভাবে ১৯৪৬ সালে শুরু-হওয়া সঙ্গীতশিক্ষার প্রতিষ্ঠান 'রবিতীর্থ'র কথা। "কেবলমাত্র রবীন্দ্রসংগীত নিয়েই কাটিয়ে দিলেন নিজের জীবন। শান্তিনিকেতনী শিক্ষা, তার রূপ, রসকে বজায় রেখেও তিনি শিল্পী হিসেবে অনন্যা। এক ব্যতিক্রমী সত্তা।" যে কালে বিশেষত মহিলাদের গান-বাজনাকে খুব একটা ভাল চোখে দেখা হত না, তখন পুরুষ সহ-শিল্পীদের সঙ্গে সময়ের দাবি মেনে গণনাট্যের মিছিল, মিটিং, আইপিটিএ অথবা বামপন্থী আন্দোলনে সামিল হওয়া, মাঠে-ঘাটে উদাত্ত কণ্ঠে তাঁর উপস্থিতি! শ্রী দত্ত লিখেছেন যে অনেকেই তাঁকে দাম্ভিক, গম্ভীর বা কেউকেটা মনে করলেও আসলে সেটা ছিল তাঁর বহিরঙ্গ। "তখনকার পুরুষ শাসিত সমাজে একক নারীকে গান গেয়ে লড়াই করে থাকার জন্য এই শামুকের খোলসের প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু, ব্যক্তিজীবনে তিনি তা একেবারেই নন। তিনি পুরুষ শাসন মানতেন না। তিনি অতিমাত্রায় এক অনন্য স্নেহশীল জননী। অতিমাত্রায় একজন মা।" শ্রী দত্ত লিখেছেন যে জীবনে বহু আঘাত এসেছে, এসেছে অবাঞ্ছিত অপবাদ, "কিন্তু তিনি হার মানেননি, রবীন্দ্রগানকে জীবনের ধ্রুবতারা করে জীবনকে সম্মান করে গেছেন।"
শ্রী দত্তের প্রতি ছিল তাঁর এই শিক্ষিকা দিদির অপত্যতুল্য স্নেহ, প্রশ্রয়। পারিবারিক স্তরে সম্পর্ক, বারুইপুরে তাঁদের বাড়িতে আসা, তিরাশি বছর বয়সে অশক্ত শরীরে বারুইপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সার্ধশতবর্ষে উপস্থিত হওয়া এবং সুবীর মিত্রের সঙ্গে মঞ্চে 'কর্ণ-কুন্তী সংবাদ' পাঠ ইত্যাদি মিলিয়ে বছর-বাইশের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক উঠে এসেছে লেখাটিতে।
শিষ্যদের বিপদে-আপদে শ্রীমতী মিত্রের উদ্বিগ্নতা, পারিবারিক স্তরে যোগাযোগ তাঁকে এঁদের কাছের মানুষ, সত্যিকারের শ্রদ্ধেয় মানুষ করে তুলেছিল।
শ্রীমতী মিত্রকে নিয়ে এ সংখ্যায় কবিতা লিখেছেন জয়দীপ চক্রবর্তী, কাশীনাথ ভট্টাচার্য, শান্তিব্রত চট্টোপাধ্যায়, শুক্লা চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাধবী মিত্র। এর বাইরে কবিতা লিখেছেন অসিত গুহঠাকুরতা প্রমুখ।
বানানভুল, ছাপার ভুল চোখে পড়ে। প্রচ্ছদ শোভন।
[উল্লেখ থাকে যে এই লেখার কিছুটা অংশ গৌতম মণ্ডল সম্পাদিত 'সুচেতনা সাহিত্য সংস্কৃতি সংবাদ' পত্রিকার সূচনা সংখ্যায় (১ জানুয়ারি ২০২৪) প্রকাশিত হয়েছে]
পত্রিকার নাম — 'দেবযান' সাহিত্য পত্রিকা
সম্পাদকের নাম — উৎপল দত্ত
প্রকাশ সংখ্যা — ৪২তম বর্ষ, ২০২৪, সুচিত্রা মিত্র শতবর্ষ সংখ্যা
প্রকাশস্থল — বৈদ্যপাড়া রোড, ডাকঘর—বারুইপুর, জেলা—দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, কলকাতা—৭০০ ১৪৪
মূল্য — ত্রিশ টাকা।
========================
অরবিন্দ পুরকাইত
গ্রাম ও ডাক — গোকর্ণী,
থানা — মগরাহাট,
জেলা — দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।
চলভাষ — ৯৪৭৪৭ ০৩৭৭১।