গল্প।। ছায়া-বন্ধু ।। চৈতন্য দাশ
ছায়া-বন্ধু
চৈতন্য দাশ
একদিন রাতে গ্রামের মেঠোপথ ধরে সাইকেল চালিয়ে ফিরছিল সায়ম। সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। গ্রীষ্মের ছুটি পড়তেই শহর থেকে গ্রামে নানার বাড়িতে এসেছে। চারদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর দূরের বন থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত একটা গা-ছমছমে শব্দে ভয় লাগলেও, সায়ম সে সবের তোয়াক্কা না করে সাইকেলের গতি বাড়িয়ে দিল।
মাথার ওপরে পেছন দিক থেকে চাঁদের হালকা আলোতে পথে হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো, তার সাইকেলের ছায়া ছাড়াও আরও একটি ছায়া ঠিক তার পাশে পাশে চলেছে। সায়ম থেমে গেল। সাইকেল থামাতেই তার ছায়া থেমে গেল, কিন্তু বাকি ছায়াটা থামল না। ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল!
সায়ম চোখ কচলালো। ভাবলো, হয়তো চোখের ভুল। তার সারা শরীর ভারী হয়ে গেল! গায়ে পশম খাড়া হয়ে গেল। সাইকেলটা জোরে চালানোর শক্তি নেই! সে ধীরে ধীরে সাইকেল চালিয়ে নানার বাড়িতে পৌঁছলো।
পরদিন সন্ধ্যায় সাইকেল চালিয়ে স্থানীয় বাজারে ঢুকেছিল একটা কলম কেনার জন্য। কলম কিনে ফেরার পথে একই ঘটনা ঘটলো। হেলে পড়া চাঁদের হালকা আলোতে দেখতে পেল, নিজের ছায়ার সঙ্গে সেই বাড়টি ছায়াটাও ওর সঙ্গে সঙ্গে একই রকম ভাবে এগিয়ে চলেছে… ছায়াটা ওর থেকে অনেকটাই আগে। ছায়াটা এমন ভাবে ওর আগে আগে ছুটে চলেছে, মনে হচ্ছে ছায়াটা কোনো একটা নির্দিষ্ট দিকে ওকে নিয়ে যেতে চাইছে…
এবার ও সাহস করে ছায়াটিকে অনুসরণ করতে লাগলো। ছায়াটা তাকে গ্রামের পুরনো শ্মশানঘাটের দিকে নিয়ে গেল, যে জায়গাটা সবাই রাতেরবেলা এড়িয়ে চলে।
সেখানে পৌঁছে সে এক অবাক করার মতো আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখল — একটা প্রাচীন, মরা-বাঁচা ঝোপালো বটগাছের নিচে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, একেবারে ওর সমবয়সী। ছেলেটির চোখ যেন আলো ছড়াচ্ছে, আর তার মুখে রহস্যময় হাসি। শুধু এসেই চলেছে…
সায়মের গলা-বুক ভয়ে শুকিয়ে এলেও সাহস করে জিজ্ঞেস করল, "তুমি কে?"
"আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। আমার নাম ছায়ান…" ছেলেটি উত্তর দিল।
সায়ম বললো, "কিন্তু তুমি তো মানুষ না, তাই না?"
ছায়ান একটু কষ্ট পেয়ে বললো, "একসময় ছিলাম। অনেক বছর আগে এক রাতে এই শ্মশানঘাটের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম, কিন্তু একটা ভুল সিদ্ধান্তে আমি আর ফিরতে পারিনি। তারপর থেকে আমি এখানে আটকে রয়েছি। তোমার মতো কাউকে খুঁজছিলাম, যে সাহসী, যে আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে।"
সায়ম বুঝতে পারলো, ছায়ান কারও ক্ষতি করতে চায় না। বরং তার চোখে ছিল বন্ধুত্ব আর মুক্তির আকুতি।
ছায়ান আরও বললো, "তুমি যদি প্রতিদিন রাতে এখানে এসে আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করো, তাহলে আমি ধীরে ধীরে মুক্তি পেতে পারি, কারণ বন্ধুত্বের শক্তি আত্মাকে শান্তি দেয়। মুক্তির পথ দেখায়।"
সায়ম সম্মতি দিল। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ প্রতিদিন রাতের নির্জনে তারা দুজন গল্প করত — ছায়ানের ছোটোবেলার কথা, স্কুল-জীবনের কথা, পড়াশোনার কথা, শহরের গল্প, ভূতের সিনেমা দেখার গল্প, আরো কত কী…!
এক রাতে ছায়ান বলল, "আজ আমার শেষ রাত। তোমার বন্ধুত্ব আমাকে আলোর পথে নিয়ে যাচ্ছে। এবার আমি চলে যাবো। কিন্তু মনে রেখো, সাহস আর হৃদয়ের বন্ধন সব কিছুর চেয়েও শক্তিশালী।"
"কিন্তু…!"
সায়ম কিছু বলার আগেই চোখের সামনে ছায়ান ধীরে ধীরে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। শুধু বাতাসে থেকে গেল একটুকরো মিষ্টি হাসি আর বন্ধুত্বের শীতল স্পর্শ।
পরদিন সকালে সায়ম শ্মশানঘাটের গাছটার নিচে একটা পুরনো খেলনা ট্রেন পেল। হয়তো ছায়ানের প্রিয় খেলনা। সে সেটা নিজের কাছে রেখে দিল, বন্ধুত্বের স্মৃতি হিসেবে।
ছায়ানের সঙ্গে সায়মের সত্যিকারের বন্ধুত্ব হয়েছিল। আর সেই বন্ধুত্বই তাকে যেন আরও সাহসী, আরও মানবিক করে তুলেছে।
বন্ধুত্ব ও সহানুভূতি যে অন্ধকারের মধ্যেও আলোর সূচনা করতে পারে, ছায়ানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াতে সায়ম যার প্রমাণ পেল।
ছবিঋণ - ইন্টারনেট
================
চৈতন্য দাশ, সাহিত্যনীড়,
সম্পাদক, বাংলা-বাক্ সাহিত্যপত্র
ধুবুলিয়া 1/4 নং গ্রুপ, জেলা: নদিয়া,
পোস্টাপিস: টিবি হাসপাতাল,
পিনকোড; 741140,
Chaitanya Das