Click the image to explore all Offers

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। মাধব ও মালতি ( পর্ব- আট) ।। সমীরণ সরকার

 

মাধব ও মালতি 

সমীরণ সরকার


(পূর্ব কথা:--রাজনীতিবিদ কনক নারায়ণের একমাত্র সন্তান মানবেন্দ্র নারায়ণ মাত্র 18 বছর বয়সে'চৌধুরী ভিলা'র পুরাতন রাঁধুনি আশালতার বাল বিধবা সুন্দরী কন্যা পূর্ণিমার প্রেমে পড়ল। যদিও তার অনেক আগেই মানবেন্দ্রের ঠাকুরমা বিধুমুখী তাঁর সইয়ের নাতনি ১৪ বছরের হৈমন্তীর সঙ্গে পৌত্রের বিয়ে দিয়েছিলেন।  কিন্তু পূর্ণিমার সঙ্গে মানবেন্দ্রের সম্পর্ক জানার পর বিধুমুখী পৌত্রকে সঙ্গে নিয়ে পিত্রালয় গড়বেতায় গেলেন, পূর্ণিমার কাছ থেকে মানবেন্দ্রকে দূরে রাখার জন্য। বিধুমুখী তাঁর পিত্রালয়ে কাউকে প্রকৃত কারণ জানাতে চাইলেন না । কিন্তু একদিন তাঁর ভাই অম্বিকাপ্রসাদের জিজ্ঞাসার উত্তরে সত্যি কথাটা বলে ফেললেন এবং সেটা কাউকে না জানানোর জন্য মাথার দিব্যি দিলেন। তিনি ভাইকে অনুরোধ করলেন যে, সবাই যেন মানবেন্দ্র নারায়নকে চোখে চোখে রাখে যাতে সে পালিয়ে যেতে না পারে। অম্বিকাপ্রসাদ এর নির্দেশমতো তার দুই ভাইপো অমরেন্দ্র আর অশোক মানবেন্দ্র নারায়ণের সর্বক্ষণের সঙ্গী হল। একদিন বিকেলে ওরা কৃষ্ণপুরের জমিদার বাড়ি শিলাই ভিলা দেখতে গেল।। সেখানে জমিদার কৃষ্ণকমল রায়ের আস্তাবলের চারটি ঘোড়ার মধ্যে 'চেতক' নামে একটি সাদা রঙের ঘোড়া মানবেন্দ্র নারায়ণের  দৃষ্টি আকর্ষণ করল। জমিদার কৃষ্ণকমল রায় মানবেন্দ্রকে একটা চ্যালেঞ্জ  দিলেন। মানবেন্দ্র সেই চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করল এবং কৃষ্ণকমল রায়ের কাছে এই কথা আদায় করল যে, যদি সে চ্যালেঞ্জে জয়লাভ করে তাহলে তাকে ওই সাদা ঘোড়াটি উপহার দিতে হবে।)

                       (আট)

হঠাৎ করে জমিদার বাড়ি 'শিলাই ভিলা'র কর্মচারীদের কাছ থেকে জমিদার বাড়িতে যাওয়ার ডাক পাওয়ায় কৃষ্ণপুর গ্রামের লোকেরা খুব একটা অবাক হলো না। কারণ তারা জানে যে, তাদের গ্রামের জমিদার কৃষ্ণ কমল রায় একটু খামখেয়ালি প্রকৃতির মানুষ। তিনি ছোটখাটো যেকোন উপলক্ষে বা অনুষ্ঠানে অথবা শুধুমাত্র ইচ্ছে হলেই গ্রামের লোকজনদের ডেকে পাঠান এবং তাদের বিভিন্ন রকমের উপহার দেন। আজও সেরকম কিছু হবে ভেবে তারা উল্লসিত‌ হৃদয়ে জমিদার বাড়ির দিকে আসছিল। কিন্তু জমিদার বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়ে তারা একটু বিস্মিত হল। জমিদার বাড়ির গেটের সামনে জমিদারবাবুর আস্তাবলের সহিস বলরাম জমিদারবাবুর প্রিয় সাদা ঘোড়াটার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অনতিদূরে দাঁড়িয়ে আছেন জমিদার কৃষ্ণ কমল রায় আর তিনটি অপরিচিত যুবক।  
গ্রামবাসীরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল। জমিদার কৃষ্ণকমল তাদের হাত তুলে থামিয়ে দিলেন। তারা চুপ করতেই কৃষ্ণ কমল রায় বললেন, একটি বিশেষ কারণে আমি তোমাদের এখানে ডেকে পাঠিয়েছি। তোমরা মন দিয়ে সেটা শোনো। গ্রামবাসীরা জমিদার বাবুর কথা শোনার জন্য মনোযোগী হল। কিন্তু কৃষ্ণ কমল রায় কিছু বলার আগেই হঠাৎ মানবেন্দ্র নারায়ণ বলল, আজ যে কারণে জমিদারবাবু আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছেন, সেই কারণটি আমি আপনাদের জানাবো। আপনারা দয়া করে আমার কথা মন দিয়ে শুনুন।
তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে এভাবে কথা বলায় কৃষ্ণ কমল রায় মনে মনে একটু অসন্তুষ্ট হলেও মুখে সে ভাব প্রকাশ করলেন না। ভাবলেন, শুনিইনা কী বলছে ছোকরা।
মানবেন্দ্র নারায়ণ বললেন, আমার নাম মানবেন্দ্র নারায়ণ । আমি বাঁকুড়া থেকে এসেছি।আমাকে আপনারা না চিনলেও গড়বেতার  সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পুরোহিত তারাপ্রসাদ ভট্টাচার্য মশাইকে নিশ্চয়ই সবাই চেনেন ।গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি বললেন, ওনাকে আবার কে না চেনে। আমাদের গ্রামের অনেকেই তো বছরে এক দু'বার সর্বমঙ্গলা মন্দিরে পুজো দিতে যায়। তারা গ্রামে ফিরে তো তারা প্রসাদ ঠাকুরের নাম করে। আমাদের গ্রামে এক বছর বারোয়ারি কালীপুজোর পুরোহিত ছিলেন উনি। খুব ভালো পুজো করেন তেমনি খুব ভালো মানুষও  উনি। 
------হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। তা উনি সম্পর্কে আমার দাদু হন, আমার ঠাকুরমার বড় দাদা। আমি ওই বাড়িতে ঠাকুরমার সঙ্গে বেড়াতে এসেছি। আমার সঙ্গে এই যে আর দুজন দেখছেন, এদের একজন 
তারাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের ছেলে আর অন্যজন তাঁর ভাইপো। আমরা আপনাদের এখানে এই বিশাল জমিদার বাড়ি দেখতে এসেছিলাম।
ওই বৃদ্ধ ব্যক্তি বেশ গর্ব সহকারে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের গ্রামের জমিদার বাড়ি দেখতে অনেকেই আসে। কাছাকাছির মধ্যে তো এরকম বাড়ি আর নেই। 
-----হ্যাঁ ,ঠিকই বলেছেন। আমরাও তাই বাড়ি দেখতে এসেছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে জমিদার বাবুর আস্তাবলে খুব সুন্দর একটা ঘোড়া দেখতে পেলাম। ধবধবে সাদা রঙের ঘোড়া। 
-----হ্যাঁ ,জানি তো, ওটা জমিদার বাবুর প্রিয় ঘোড়া। ওর নাম 'চেতক'।
-----হ্যাঁ। তা আপনাদের মাননীয় জমিদারবাবুর সঙ্গে আমার একটা বাজি হয়েছে। জমিদার বাড়ির দক্ষিণ দিকে এই  বিশাল  ফাঁকা মাঠের  শেষে একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। 
------হ্যাঁ, জানি তো
----ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, গাছটা এখন ফুলে ফুলে ভর্তি হয়ে আছে। জমিদার বাবু আমায় কথা দিয়েছেন যে, আমি যদি 'চেতকের'  পিঠে চেপে, একবারও নিচে না নেমে, ওই কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে ফুল সমেত একটা ডাল ভেঙ্গে এনে ওনাকে দিতে পারি, তাহলে  শর্তপূরণ করার জন্য উনি আমাকে উপহারস্বরূপ  'চেতক' কে দিয়ে  দেবেন।  
মানবেন্দ্র নারায়ণের কথা শেষ হতে না হতেই উপস্থিত গ্রামবাসীদের মধ্যে হাসির রোল উঠলো। 
মানবেন্দ্র নারায়ণ কিছুক্ষণ সেটা শুনে হাত তুলে গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বললো, থামুন, আপনারা।  হাসছেন কেন? 
সেই বৃদ্ধ গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে হাত তুলে বললেন, থামো তোমরা, আমাকে কথা বলতে দাও। 
গ্রামবাসীরা হাসি থামাতেই  সেই বৃদ্ধ মানবেন্দ্র নারায়ণকে বললেন, দেখুন বাবা, আপনার বয়স অল্প ,তাই হয়তো বুঝতে পারছেন না যে সাদা ঘোড়াটা কী সাংঘাতিক তেজী! ওই ঘোড়ার পিঠে চেপে ফুল আনা দূরে থাক , ওই ঘোড়াটা ওর পিঠে আপনাকে হয়তো বসতেই দেবে না। যদিও এটা হাসির কথা নয়, তবু হয়তো আমার গ্রামের লোকেরা এটা ভেবেই হাসাহাসি করছে। 
মানবেন্দ্র বললো, আমি ঘোড়াটাকে খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করেছি। আমি বুঝতে পেরেছি যে, ও খুব তেজী।। ওকে বশ করা খুব কঠিন কাজ। তবুও আমি স্বেচ্ছায় এই বাজি লড়তে রাজি হয়েছি। কারণ ঘোড়াটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি জমিদার বাবুর শর্ত পূরণ করে এই বাজি জিততে চাই। 
মানবেন্দ্র নারায়ণের কথার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও জেদ প্রকাশ পাচ্ছিল । 
বৃদ্ধ বললেন, আমরা তো আপনাকে বাধা দিতে পারি না, তবে আপনি বয়সে ছোট বলে অনুরোধ করছি, এই বাজি থেকে সরে আসুন। আমরা চাই না যে, আপনি 'চেতকের' পিঠে চেপে কোন দুর্ঘটনায় পড়ুন।
মানবেন্দ্র বললো, সে দায় এবং দায়িত্ব আমার। 
আপনারা দয়া করে শুধু দেখুন যে, আমি বাজির শর্ত পূরণ করে 'চেতক' কে  জিতে নিতে পারি কি না ।
---বেশ , তবে তাই হোক। 
মানবেন্দ্র নারায়ণ এবার  জমিদার কৃষ্ণকমল রায়কে  বলল, এবারে তাহলে আমাকে ঘোড়ায় চাপার অনুমতি দিন। 
কৃষ্ণ কমল বললেন, আমি শেষবারের মতো বলছি, আরেকবার ভেবে দেখো। 
---আমার ভাবা হয়ে গেছে! 
----ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে আমি কিন্তু দায়ী থাকবো না! 
----আমি আপনার প্রজাদের সামনে মুক্ত কন্ঠে জানাচ্ছি যে, ঘোড়ার পিঠে চেপে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার সম্পূর্ণ দায়  শুধুমাত্র আমার। এবার  তবে আপনাকে ও সবার সামনে কথা দিতে হবে যে, আমি আপনার শর্ত পূরণ করলে আপনি এই সাদা ঘোড়া ,অর্থাৎ 'চেতককে' দিয়ে দেবেন আমাকে। কোন রকম আপত্তি করবেন না।
কৃষ্ণ কমল রায় বুঝলেন যে, এই তরুণটি শুধু সাহসী নয়, একরোখাও। কাজেই আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। তিনি গ্রামবাসী প্রজাদের সামনে ঘোষণা করলেন, আমি সবার সামনে কথা দিচ্ছি যে, মানবেন্দ্র নারায়ণ বাজির শর্ত পূরণ করতে পারলে আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তার হাতে তুলে দেবে 'চেতক-কে'। সে তখন থেকেই 'চেতকে'র মালিক হবে।
মানবেন্দ্র বলল, বেশ তাহলে এবার ঘোড়ায় চড়ার অনুমতি দিন।  
কৃষ্ণ কমল ঘোড়ার সহিস‌ বলরামকে বললেন,
মানবেন্দ্র নারায়ণের হাতে ঘোড়া তুলে দাও বলরাম।
বলরাম নিঃশব্দে মানবেন্দ্র নারায়ণের হাতে ঘোড়ার নাগাম তুলে দিল।
তারপর দুহাত জোড়া করে কপালে ঠেকিয়ে জোরে বলল, জয় মা সর্বমঙ্গলা। 

(চলবে)

*********************************** 
From:-Samiran Sarkar
Khelaghar, Lautore,
P.O : Sainthia, Dist : Birbhum.
W.B - 731234

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.