Click the image to explore all Offers

গল্প ।। ন্যায়সঙ্গত ভাবে ।। শ্যামল হুদাতী



 ন্যায়সঙ্গত ভাবে

 শ্যামল হুদাতী 




শৌর্য ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম। বাবা ছিলেন ডাকবিভাগের ছোট অফিসার, মা স্কুলের শিক্ষিকা। সংসারটাকে টানতেন অল্প আয়ের মধ্যেই, কিন্তু ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্নে কোনো খামতি রাখেননি। শৌর্য শান্ত, পড়াশোনায় মনোযোগী, চুপচাপ। উচ্চমাধ্যমিকের পর বি.কম পড়তে কলকাতায় গিয়েছিল। স্নাতক শেষে ব্যাংকের পরীক্ষায় বসে সরকারি চাকরি পেয়ে গেল—একটা স্বপ্নপূরণ যেন!

এই দীর্ঘ পরিশ্রমের পথে শৌর্যর জীবনে একটিই স্থির সঙ্গী ছিল—অনুসূয়া। ছোটবেলার পাড়ার বন্ধু। ক্লাস এইট-নাইন থেকেই তাদের চোখে চোখ পড়ত; কখন যে বন্ধুত্বের আড়াল ভেঙে প্রেম এসে দাঁড়াল, কেউ জানত না।

অনুসূয়া দেখতে সুন্দরী। তার গায়ের রঙ শ্যামল কিন্তু চোখ দুটি ছিল টানা বাদামি, যেন সর্বদা কিছু বলবে। পড়াশোনায় বিশেষ ভালো না হলেও স্কুলের অনুষ্ঠানে কবিতা, গান, নাচে সবার চেনা মুখ ছিল। পাশপাশি সে একটু অলসও—বাড়ির স্বচ্ছলতাই তাকে পড়াশোনার দিকে টানেনি। বাবা বড় ব্যবসায়ী—তেলের পাম্প, জমি কেনাবেচা, প্রমোটিং ইত্যাদি মিলিয়ে পাড়ার মধ্যে যথেষ্ট প্রভাবশালী মানুষ।

বিএ কোনো মতে পাশ করার পরও অনুসূয়া কিছুদিন বাড়িতেই বসেছিল। শৌর্য তখন ব্যাংকের কাজে ব্যস্ত।

একদিন হঠাৎ খবর এল—অনুসূয়া সরকারি স্কুলের শিক্ষক পদে চাকরি পেয়েছে!
সবাই অবাক। কেউ কেউ বলল—

-"বই খুলতই না মেয়েটা, ও আবার মাস্টারমশাই?"    
"ওর বাবার হাত আছে মনে হয়।"

শৌর্যও বিস্মিত হয়েছিল, তবু খুশি হয়েছিল মনে মনে। ভেবেছিল—দু'জনের সংসারের স্বপ্ন এবার সহজ হবে।

কিন্তু এই সুখ স্থায়ী হল না।
বছরখানেক পর আদালতের নির্দেশে জানা গেল, অনেক শিক্ষকই অবৈধভাবে চাকরি পেয়েছেন। নিয়োগ-দুর্নীতির মামলায় চাকরি বাতিল হল একসঙ্গে অনেক শিক্ষকের। যাদের নিয়োগে অসংগতি ধরা পড়েছে, তাদের চাকরি বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে বলা হল—যোগ্যতাদের দলে থাকলে নতুন পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাবে। 

অনুসূয়া সেই অযোগ্যদের দলে পড়ল। তার বিএ ডিগ্রির সঙ্গে প্রয়োজনীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ বা নম্বর ছিল না। ফলে নতুন পরীক্ষাতেও বসার সুযোগ পেল না।

একদিন সকালবেলা সংবাদপত্র হাতে নিয়ে বসেছিল শৌর্য। পত্রিকার প্রথম পাতায় শিক্ষকদের চাকরি বরখাস্তের ব্যাপারে খবরের শিরোনামে ছিল। 


অনুসূয়ার বাবার রাগ তখন আকাশ ছুঁয়েছে।
তিনি বললেন,

-"ওর মতো যোগ্য মেয়েকে অবিচার করল সরকার। এই পরীক্ষার নাটক কিছু না—সব রাজনীতি!"

পাড়ায় আলোচনা, টেলিভিশনে চ্যানেলে বিশিষ্টজনদের মতামত বা বিতর্ক—সব মিলিয়ে পরিবেশ ছিল উত্তপ্ত।

শৌর্য চুপ ছিল। তার ভাবনা ছিল অন্য। সে জানত, সরকারি চাকরি মানে ন্যায্য প্রতিযোগিতায় জেতা। তাই যখন অনুসূয়ার বাবা তার কাছে এসে বললেন,

- "শৌর্য, তুই এখনই বিয়ের কথা পাকাপাকি কর। মেয়ের এই কষ্টে পাশে দাঁড়াও।"

শৌর্য মাথা নাড়ল, ধীরে বলল,

-"আমি চাই অনুসূয়া নিজেকে প্রমাণ করুক। নিয়ম না মানা চাকরির জন্য তো আমি তার জীবনসঙ্গী হতে পারি না।"

এই কথা যেন আগুনে ঘি ঢালল।
 
 
 

অনুসূয়ার চোখে জল। সে ভেবেছিল শৌর্য তার জীবনের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। শৈশবের সেই প্রেমিক আজ এত কঠিন কেন?

-"তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না শৌর্য?"
"ভালোবাসি, কিন্তু অন্যায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ভালোবাসা টেকে না।"
শব্দগুলো অনুসূয়ার মনে খোঁচা মারল।

বাড়ির মানুষজন, আত্মীয়-স্বজন শৌর্যকে ঠিক দোষ দিতে পারল না। বলল,

-"ছেলে তো এখন ব্যাংকের অফিসার। অনুসূয়ার অন্যায়ভাবে চাকরি গ্রহণ করে যোগ্য প্রার্থীদের ঠকিয়েছে। ওর শাস্তি পাওয়া উচিত।"

এরপর যা হল, তা যেন সিনেমার কাহিনি।
এক সন্ধ্যায় শৌর্যকে ডেকে পাঠাল অনুসূয়ার বাবার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন লোক—লোকাল পার্টি অফিসে।

-"কিছু কথা বলতে হবে," বলেছিল তারা।

শৌর্য ভেবেছিল বোঝাপড়ার কথা হবে।
কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখল—গরম চা নয়, গরম গালি আর ঘুষি অপেক্ষা করছে।

কেউ গলা ধরে বলল,

"তোর সাহস হল আমাদের মেয়েকে ছেড়ে যাওয়ার? জানিস না আমরা কারা!"

শৌর্য প্রতিবাদ করতে গিয়ে মার খেল। কপাল ফেটে রক্ত এল। সেদিন রাতেই পাড়ার মানুষ খবর দিল থানায়। পুলিশ এল, কয়েকজনকে আটক করল।

পাড়ার প্রতিবেশীরা শৌর্যের পাশে দাঁড়াল। তারা জানত, শৌর্য সৎ ছেলে। বখাটে নয়।
থানার গেটে ভিড় জমল। সাংবাদিকরা এল। বিষয়টি রাজনৈতিক মোড় নিল।

অনুসূয়ার বাবা তখনও ক্ষিপ্ত। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বললেন,

-"ও ছেলে মেয়েকে প্রতারণা করেছে। ওকে শাস্তি পেতেই হবে।"

কিন্তু সমাজের অনেকেই বলল—

-"চাকরি যদি বেআইনি হয়, শৌর্যর দোষ কোথায়? বিয়ে তো জীবনের বড় সিদ্ধান্ত।"

দিন কেটে গেল। অনুসূয়া ক্রমশ চুপচাপ হয়ে গেল। তার মনে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। সে এখনও শৌর্যকে ভালোবাসে, কিন্তু তার বাবার রাগ, পাড়ার কথাবার্তা—সব মিলিয়ে এক অদৃশ্য প্রাচীর গড়ে উঠল।

একদিন রাতে সে শৌর্যকে ফোন করল।

-"তুমি কি সত্যিই আর আমাকে চাও না?"

শৌর্য দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে বলল,

"তোমার সঙ্গে থাকতে চাই, কিন্তু আমি চাই তুমি সত্যিকারের লড়াই করো। নিজের যোগ্যতায় কিছু করো। কাগজে কলমে শিক্ষক না হয়ে মন দিয়ে শিক্ষক হও।"

অনুসূয়ার চোখ বেয়ে জল গড়াল। তবু মনে মনে সে বুঝল—এই ছেলেটি মিথ্যে সান্ত্বনা দিচ্ছে না, কঠিন সত্য বলছে।

বছর খানেক পরে রাজ্য সরকার নতুন করে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দিল। এবার সব প্রার্থীরা আবেদন করতে পারবে। অনুসূয়ার বাবা প্রথমে চিৎকার করলেন— -"এ সব ফাঁকি, রাজনীতি।"

কিন্তু অনুসূয়া নিজের সিদ্ধান্ত নিল।
সে বলল, - "আমি এবার প্রস্তুতি নেব। দেখব, আমি কি পারি না।"

শুরু হল নতুন সংগ্রাম। কোচিং সেন্টারে ভর্তি হল, পুরনো বই খুলল। শৌর্য দূর থেকে খবর রাখত, কিন্তু ফোনে বিশেষ কথা বলত না। কেবল মাঝে মাঝে বন্ধুদের মাধ্যমে জেনে নিত অনুসূয়ার অগ্রগতি।

বছর ঘুরে পরীক্ষা হল। রেজাল্টের দিন অনুসূয়া মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কাঁপছিল।
কম্পিউটারের স্ক্রিনে নিজের নাম দেখে সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—

- "মা, পেরেছি!"

যোগ্যতার পরীক্ষায় পাশ করেছে সে। এবার সত্যিই সরকারি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপত্র হাতে এল।

খবর শুনে শৌর্য চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সেদিন সন্ধ্যায় পাড়ার মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অনুসূয়া ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার পথে দেখল—শৌর্য সেখানে দাঁড়িয়ে।

দুজনের চোখে চোখ পড়ল।
শৌর্য মৃদু হেসে বলল,

-"এবার তো অভিযোগ করার কিছু নেই। তুমিই প্রমাণ করলে তুমি শিক্ষক হওয়ার যোগ্য।"

অনুসূয়া হেসে ফেলল চোখের জল মুছে।

- "তুমি না থাকলে হয়তো কখনও বুঝতাম না আসল লড়াইটা কোথায়।"

শরতের আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় পাড়ায় আবার উৎসবের সাজ। শৌর্য আর অনুসূয়ার বিয়ে হল শান্তভাবে, তেমন জাঁকজমক ছাড়াই। অনুসূয়ার বাবা শুরুতে গম্ভীর থাকলেও কন্যার হাসি দেখে শেষমেশ চোখ মুছে নিলেন।

বিয়ের রাতেই শৌর্য বলল, -"জীবনের পথে সৎ থেকে হাঁটলে কত ঝড় আসবে কে জানে, কিন্তু আমরা হার মানব না।"

অনুসূয়া মাথা নাড়ল। -"হারব না। কারণ ভালোবাসা মানে শুধু হাত ধরা নয়, কখনও কখনও ঠেলে এগিয়ে দেওয়া।"

শৌর্য আর অনুসূয়ার গল্পটা পাড়ার ছেলেমেয়েদের কাছে এক শিক্ষা হয়ে উঠল— সত্যিকারের ভালোবাসা কখনও আপস নয়, বরং ন্যায়ের পথে চলার সাহস দেয়। ভাঙনের রেখা শেষ পর্যন্ত মিলনের সেতু হয়ে দাঁড়াল।
-------------------------------------------------------------------
শ্যামল হুদাতী 
357/1/13/1, Prince Anwar Shah Road,
P.O. Jodhpur Park,
Kolkata - 700 068

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.