বড়গল্প ।। তরুণ প্রামাণিক
বর্গী এলো দেশে
এটাই কি ভবিতব্য !
তাহলে আর কোনো পথ খোলা নেই! অবধারিত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেওয়া ছাড়া আর কি কিছুই করার নেই কারোর? চাপা উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নিলেও, সন্ধ্যার আঁধারে চন্ডিমণ্ডপে উপস্থিত প্রত্যেকের চোখে মুখে উদ্বেগের যে ঘনান্ধকারের ছায়া প্রকট হয়ে উঠেছে, তা বেশ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলেন আচার্য গোপালানন্দ।অজয়ের তীরে জানুবাজার থেকে ইলামবাজারের বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকজন তাঁকে গোবিন্দ জ্ঞানে ভক্তি করে ,শ্রদ্ধা আর ভালোবেসে ছোট গোঁসাই বলে ডাকে।তিনিই একমাত্র এই আর্ত পিরীতের তারন কর্তা। খড়ের আটচালার প্রশস্ত চণ্ডীমণ্ডপে মাঝে,পদ্মাসনে বসে,তাকে ঘিরেই এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আবাল বৃদ্ধ বনিতার উৎসুক ভক্তের দল।আগতমান বিপদ থেকে- দেবতা তাদের রক্ষা করবেন-এই আশা বুকে নিয়ে।বাকরুদ্ধ সবাই,উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে তারা।
আটচালার একধারে, মোটা শালের খুঁটিতে বাঁধা মশালের আগুনটা দাউ দাউ করে জ্বলছে।সেই আলোক প্রভার ঔজ্বল্যে কিছু শ্যামা পোকা লাফিয়ে পড়ছে ওই জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে।গোটা চন্ডি মন্ডপ জুড়ে শ্মশান সম নিরবতা।অজয়ের বুক থেকে উড়ে আসা বাতাসের প্রশ্রয়ে মশালের আগুন শিখা শুধু অদ্ভুত একটা আওয়াজ করে চলেছে সেই থেকে।দমকা হওয়ার কাছে কিছুতেই হার মানতে চাইছে না সে। নিভন্তপ্রায় ধুনি থেকে সরু ফিতের মতো ক্ষীণ ধোঁয়া উড়ছে।মাঝে মাঝে দূরের খিরীশ গাছ থেকে ভেসে আসছে শকুন শাবকের কান্না।সেই সাথে সহসা নিকষ অন্ধকার চিরে একসাথে ডেকে উঠছে শিবারা।
মাধবানন্দের কপালে চিন্তার বলিরেখা সুস্পষ্ট। জ্বলন্ত মশালের রক্তিমাভা,তাঁর চাঁদের গড়ন দেহায়বয়বে পড়ে মায়াময় এক দৃশ্যপট রচনা করছে থেকে থেকে। সভা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।করুন চোখের দৃষ্টি গুলোকে খানিক আশ্বস্ত করে, চোয়াল শক্ত করে বললেন,
- তোমরা ভয় পেয়ো না। ভগবান কংসারী আমাদের সবাইকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।দুষ্টের দমন করতে তিনিই একদিন মুরলী ত্যাগ করে হাতে তুলে নিয়ে ছিলেন পাঞ্চজন্য।সুদর্শনে দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন কত পাপাত্মা। তোমরা তাঁর উপর বিশ্বাস রাখো।জগৎ সংসারের উদ্ধার হেতু তিনি আবার প্রকট হবেন।প্রয়োজনে আমাদের ও হাতে অসি তুলে নিতে হবে। মাহেন্দ্র সেই ক্ষণ আগত প্রায়।
জয় রাধা গোবিন্দের জয়। জয় বিপদতারণ কংসারীর জয়।
রাতের নিরবতাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে গর্জে উঠলো চন্ডিমন্ডপ চত্বর।
খড়মে পা গলিয়ে ধীর পায়ে চন্ডিমন্ডপ ছেড়ে,আচার্য মাধবানন্দ যেন মিশে গেলেন শাল বনের জঙ্গলের শুঁড়ি পথে।আষাঢ়ের অমাবস্যার অতল ঘনান্ধকারে ডুবে রইলো জানুবাজারের এই প্রান্তিক চান্ডিমন্ডপ নিঃসঙ্গ,একাকী।
সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলেন না আচার্য গোপালানন্দ।সারাক্ষন সেই একই কথা অনুরণিত হয়ে চলেছে দেহাভ্যন্তরে।কিভাবে রক্ত পিপাসু নিষ্ঠুর লুটেরা বর্গী দস্যুদের হাত থেকে, নিষ্পাপ গ্রামবাসীদের পরিত্রান করে ,ন্যায়ের ধর্ম প্রতিষ্ঠা করবে।কিভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সমূলে এই রক্ত বীজ উৎখাত করবে চিরতরে, সে ভাবনায় কখন যে রাত্রি শেষ হতে চলেছে তা তিনি বুঝতেই পারেননি।গভীর এই বনের অভ্যান্তরে প্রহর ঘোষণা করে পাখি ডেকে উঠলো সমস্বরে।পাতায় পাতায় প্রতিধ্বনিত হলো সে ডাক।গোপালানন্দ ভাঙা দেউল থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে দাঁড়ালেন।
অমাবস্যার নিকষ অন্ধকার ফিকে হতে শুরু করেছে ,পূর্ব কোণে দপদপ করে জ্বলছে শুকতারা। তাঁকে ঘিরে রয়েছে শালের ঘন জঙ্গল।একে ঠিক জঙ্গল বলা চলে না-বন্ বলতে হয়।সে বনের আরো খানিক পূর্বে অজয়ের তটভূমি,শালগাছ খানিক পাতলা হয়ে গেছে ওদিকে।গাছের আধিক্যের জন্য অজয়ের তটভূমি এখান থেকে দেখা যায় না।আরো এক ক্রোশ উত্তর পূর্বে গিয়ে পৌঁছাতে হয় ওখানে।
জানুবাজার থেকে বীরভূম ছেড়ে,বাঁকুড়া জেলা জুড়ে এঁকে বেঁকে সে ঘন শালবন চলে গেছে মানভূম হাজারীবাগের অভিমুখে,অন্যদিকে চলেগেছে মেদিনীপুর হয়ে উড়িষ্যা সীমান্ত ধরে নাগপুরের দিকে।মূল শাল বন মূলত অজয়ের দক্ষিণ ধারেই।অজয়ের ওপারেই বর্ধমান ,বাদশাহী সড়কের ধার থেকে দামোদর পর্যন্ত আবার শুরু হয়েছে ঘন শালবন্।
বাংলা,বিহার ,উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদের বাদশাহী সিংহাসানের পালা বাদলের পর এক রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে গোটা প্রদেশ জুড়ে।নবাব আলীবর্দী খাঁ, সফর রাজ্ খানকে সরিয়ে বাংলার মসনদ দখল করলে, প্রদেশের বিভিন্ন প্রান্তের নায়েব নাজিমরা তাঁর কতৃত্ব মানতে নারাজ হন।সফররাজ খানের জামাতা উড়িষ্যার নাজিম, রুস্তম জং নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে,নবাব তাকে বিতাড়িত করে নিজের ভাইপোকে উপশাসকের পদে বসান।ওদিকে ক্ষুব্ধ রুস্তম জং মারাঠা শাসক প্রথম রঘোজি ভোঁসলের সাহায্য প্রার্থনা করেন।রঘোজি ভোঁসলে, জং-এর ডাকে সারা দিয়ে নাগপুর থেকে অগ্রসর হয়ে গোটা বাংলা জুড়ে আক্রমণ করে।শস্য শ্যামলা এই উর্বর ভূমিতে মারাঠারা ব্যপকাহারে লুটতরাজ শুরু করে।বিশেষত বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী গ্রামাঞ্চল গুলি হয় তাদের প্রধান নিশানা। পঞ্চকোট ধংস করে মারাঠা অশ্বারোহী বর্গী বাহিনী, প্রবল উৎসাহে ঝড়ের গতিতে প্রবল লুঠতরাজ আর রক্ত বন্যার হরি খেলতে খেলতে ঢুকে আসছে প্রদেশের ভিতরের দিকে।
চর মারফত আচার্য গোপালানন্দ খবর পেয়েছেন লুটেরা বর্গী কতৃক রাজধানী মুর্শিদাবাদ আক্রমণের পরিকল্পনার কথা।নবাব এখন কাটোয়ায় অবস্থান রত।ইত্যবসরে রাজধানীর প্রচুর রাজৈশ্বর্যে প্রলুব্ধ হয়ে রক্ত পিপাসু বর্গীর দল আছড়ে পড়বে মুর্শিদাবাদের উপর।আবার রক্ত গঙ্গা বইবে।প্রাণ হানি ঘটবে কত শত!লুঠ হবে রাজৈশ্বর্য!মা বোনেদের ইজ্জত নিয়ে খেলবে ওই পাপিষ্ঠের দল।
শালবনের মাথার উপর দপ্ দপ্ করা শুকতারার দিকে চেয়ে এক মনে ভেবে চলেছেন গোপালানন্দ।বনাভন্তরে থেমে যাওয়া পক্ষীকুল আবার তারস্বরে ডেকে উঠে চিন্তার ছেদ ঘটালো তাঁর।চোখ মেলে চেয়ে দেখলেন ধীরে ধীরে আকাশের গা থেকে অন্ধকার কেটে গিয়ে উজ্বল নীলচে আভা প্রকট হয়ে উঠছে।প্রকৃতির বুকে, সারা রাত জেগে দাঁড়িয়ে থাকা শাল,বহেরা,সেগুন ঋজু গাছের বনাঞ্চল যেন গা ঝাড়া দিয়ে অমাবস্যার ভয়াল অন্ধকার কে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।
এই সময়টাতেই নিত্যদিন অজয়ের জলে অবগাহন করে,সূর্য বন্দনার সমাপ্তি শেষে, দেউলে ফিরে গিয়ে রাধামাধবের নিত্য পূজার্চনা ও গীতা পাঠ করেন। শিষ্যদের সাথে চলে তত্বের সূক্ষাতি সুক্ষ জটিল আলোচনা।দুপুরে রাধা মাধবের ঠিক অন্ন ভোগের আগে অধুনা আরো একটি বিষয় সংযুক্ত হয়েছে ,সেটি হলো শিষ্যদের বিশেষ অস্ত্র প্রশিক্ষণ।দিল্লির মোঘল বাদশা ও বাংলার নবাবের যৌথ ফরমানে ন্যাড়া নেড়ী ,বৈষ্ণব সম্প্রদায়, শৈব্য,তান্ত্রিক ,বাউল ,ফকির সম্প্রদায় কে অবৈধ্য ঘোষণা করে, তাঁদের সাধনস্থল ,আশ্রম ,আখড়া গুলোকে ভেঙে দিয়েছে। অগত্যা তাই জানুবাজারের জমজমাট গঞ্জের আশ্রম ছেড়ে,দক্ষিণের ঘন শালবনের মধ্যে পরিতক্ত্য দেউলে আচার্য তাঁর দল নিয়ে গোপনে ডেরা বেঁধেছেন।ধর্মের উপর অধর্মের শক্তিশেল আছড়ে পড়লে তাঁরা যেন এর প্রতিবাদ করতে পারেন , প্রেমময় শ্রী চৈতন্য মহা প্রভুর প্রেমের বাংলায়, কংসারীর ধর্মের জয় ধ্বজা যেন উন্নত রাখতে পারেন তারই এক প্রবল প্রচেষ্টা।
জমিদার বংশের রাজ্ রক্ত বইছে আচার্য গোপালানন্দ প্রভুর শরীরে।বিষয় ভূ সম্পত্তি ত্যাগ করে,একদিন বেরিয়ে পড়েন, জগতে মায়ার হাতছানিকে উপেক্ষা করে জীবনের অনিত্যতার উৎস সন্ধানে।বহু দেশ ঘুরে কাশীর এক বিখ্যাত পন্ডিতের কাছে তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।তিনি তাঁকে দেন যথার্থ শাস্ত্র শিক্ষা।প্রমময় রাধাবিনোদের বিবিধ লীলারত রূপ ব্যতিরেখে কংসারী রূপ আকৃষ্ট করে তাঁকে।অধর্মের বিনাশ করতে ভগবান একদিন হাতে তুলে নিয়ে ছিলেন সুদর্শন চক্র,আর্ত পীড়িত মানুষের মাঝে প্রকৃত মানব ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে,প্রবল এক সংকটময় পরিস্থিতিতে তিনিও হাতে তুলে নিলেন অসি।তাই একদিন গুরুর সেই মানব ধর্ম প্রচার করতে বেনারসের ঘাট থেকে গেরুয়া ধ্বজা ওড়ালেন , শিঙায় ফুঁ দিয়ে বজরা ভাসালেন জলে।সেই বজরা একদিন এসে ভিড়লো অজয়ের কেন্দুবিল্ব ঘাটে,কবিরাজ জয়দেব গোস্বামীর পাদস্পর্শ পবিত্র বীরভূমের কেন্দুলির মাটিতে।জানুবাজারের জমজমাট গঞ্জের কাছে গড়ে উঠলো আশ্রম।সেখানেশুরু হলো কংসারী গোবিন্দের সাধন,ভজন,আরাধনা।দুই বেলা পাত পেরে অন্ন ভোগ খেলো অভুক্ত শতাধিক ভিখারি ,বৈষ্ণব,গ্রামবাসী।সন্ধ্যা বেলায় গীতাপাঠে, হরি নাম সংকীর্তনে মুখর হল আশ্রম চত্বর। সব ঠিক থাকেই চলছিল কিন্তু গোল বাঁধলো বাদশাহী ফরমানে।তাই গঞ্জের কাছে সে আশ্রম ছেড়ে,লোকচক্ষুর অন্তরালে তাঁদের গোপন সাধনা চালাতে তাঁরা এই শাল বনের অভ্যন্তরে সরে আস্তে বাধ্য হন।একটা ভগ্নপ্রায় দেউল হয়ে ওঠে তাঁদের গোপন আশ্রয়স্থল।
গোপালানন্দ অজয়ের বালুতটে এসে দাঁড়ালেন।ওপারের শালবন থেকে উড়ে আসা হওয়া অজয়ের জলে যেন আল্পনা আঁকছে।রাখাল চূড়ার বাঁধন আলগা করতেই সেই উন্মত্ত হওয়ার দাপটে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে মুখের উপর এসে পড়লো। ভরা আষাঢ় প্রায় শেষ হয়ে আসলেও অজয়ের জল এখনো দুকূল ছাপিয়ে ওঠেনি। মাঝে মাঝেই বিস্তীর্ণ চরা ,কয়েক গোছা শীর্ণ কাশফুল সকালের বাতাসে দুলছে।বৃষ্টিতে ভেজা বালিতটে বয়ে যাওয়া জলের রেখা সুস্পষ্ট।গোপালানন্দ যখন অজয়ের হাঁটু জলে ডুব দিয়ে উঠলেন পুব আকাশে তখন ঈষৎ লাল মিশ্রিত গোলাপি রঙের অনির্বচনীয় দৃশ্যপট।উদীয়মান সূর্য দেব তার সঞ্চিত শেষ রক্তিম আভাটুকু যেন নিঃশব্দে ছড়িয়ে রেখেছেন সুনীল আকাশের ওই দূর প্রান্তর জুড়ে।অজয়ের স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ জলে সে আভা প্রতিবিম্বিত হয়ে রক্তের বর্ণ ধারণ করেছে।সূর্যদেবকে অঞ্জলি থেকে জল নিবেদন করতে গিয়ে চমকে উঠলেন গোপালানন্দ।নিজের খোলা শরীরের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হলো, অজয়ের জল নয়,যেন তরল লাল রক্তে স্নান করেছেন তিনি। দুই হাতের অঞ্জলি থেকে যেন টুপিয়ে পড়ছে তাজা লাল রক্ত!
স্নান সেরে গোপালানন্দ দেউলে ফিরে এলেন।বনস্পতির মাথায় মাথায় তখনো চঞ্চল পাখ পাখালি প্রভাতী সুরমূর্ছনায় রত।দেউলে ঢুকতেই দেখলেন এক মাঝবয়সী যুবা দেউলের শ্যাওলা ধরা চাতালের উপরে বসে আছে।সাথে ইলামবাজারে ঠিক পাশের গঞ্জের বিধবা বৈষ্ণবী হরিদাসী।তাকে চেনে এ তল্লাটের প্রায় সবাই।এক সময়ে সে জানুবাজারের সম্ভ্রান্ত এক ব্যাবসায়ীর সেবাদাসী ছিল।একটি মেয়ে আছে তার। এখন প্রায় ভিক্ষা করেই চলে মা বেটির।কারণে অকারণে প্রায় মাঝে মাঝেই চলে আসে এখানে।গোপালানন্দ একদমই পছন্দ করেন না তাকে।এ নিয়ে তাঁর ক্ষোভের অন্ত নেই।সে-ই যে ওই যুবাকে এই বনাভ্যান্তরে গোপন স্থানে নিয়ে এসেছে এবিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ রইলো না।
গোপালানন্দকে দেউলে ঢুকতে দেখেই শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো তারা।প্রণামের ভঙ্গিতে ওই ভিনদেশি যুবা তাঁর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভারী গলায় বলে উঠলো -নমো !শিব শম্ভু !এই গৃহ ত্যাগী সন্ন্যাসী আজ মহারাজের অতিথি।মানভূম থেকে বহু ক্রোশ পথ পায়ে হেঁটে ক্ষুধার্ত ও পরিশ্রান্ত।কাঠকুড়ানী এই মা-জীই সন্ধান দিয়েছে এই দেউলের।
দেহাতিদের মত ছোট করে পরা ধুতি পরনে তার।গায়ে ধবধবে সাদা ফতুয়া,কপালে সরু করে পেঁচিয়ে রাখা গামছা।কানের কাছে গিট্ মারা সেটা।শক্ত সামর্থ পেশী বহুল হাতে বল্লমের কায়দায় ধরা একটা শাল গাছের লাঠি।সাদা কাপড়ের মধ্যে যে পরিছন্ন বৈরাগ্য থাকে,ওই যুবার পরিধানের আড়ম্বরে তা অধিকতর বিলাসী বলে মনে হলো গোপালানন্দের কাছে।চুলের বিন্যাসের মধ্যেও পরিপাটি যত্নের শাসন ফুটে উঠেছে।
-নমো নারায়ণ।
প্রত্যুত্তর দিয়ে সোজা দেউলে ঢুকে গেলেন গোপালানন্দ।
-মহারাজ আমি আজ আপনার অতিথি।পথ ক্লান্তিতে পরিশ্রান্ত।আজ আমাকে ভগবানের আশ্রয়ে থাকার অনুমতি দিন।
আচার্য ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে তার হাতে তুলে দিলেন কিছু চিরে,জল আর বনের মধু।
-বাসুদেবানন্দ !বাসুদেবানন্দ !
চিৎকার করে ডাকলেন তিনি। গুরুর আদেশের অপেক্ষায় থাকা শিষ্যরা এতক্ষন পর্যন্ত দূর থেকে দেখছিলো কান্ডখানা। গুরুর আহ্বানে ছুটে আসলো যুবক বাসুদেবানন্দ।
-আজ্ঞা করুন প্রভু!
-কি হচ্ছে এখানে?আমি কি এখানে আশ্রম খুলে বসেছি?পত্রপাঠ বিদায় করো এঁদের।আর ওই মা-জি কে যেন আমাদের ত্রি-সীমানায় না দেখি আর।
ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে গেল উপস্থিত সকলে।
সাময়িক নীরবতা ভঙ্গ করে ভিনদেশি ভেকধারী যুবকটি কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো -শিব শম্ভুর আশীর্বাদের ভারতদেশ অতিথি আপ্যায়নে,নিরন্নকে অন্য দানে ,সাধন ভজন পুজনে সর্বাগ্রে অধিষ্ঠান রত।আমি আপনার থেকে এ হেন ব্যবহার পেয়ে যারপর নাই দুঃখিত হলাম।বুঝলাম না আপনি কোন সাধনায় সিদ্ধ!
-আমার সাধনা চরিত্রের,আমার সাধনা সংযমের ,আমার সাধনা সাহস আর চৈতন্যের।মানুষের চোখ খুলে দিয়ে পরম চৈতন্য স্বরূপের মহাপ্রকাশ করে, তাকে বাস্তব জ্ঞানে বাঁধাই আমার সংকল্প।আপনার মতো পুরুষ পবিত্র এ মার্গ এর পরিপন্থী নয়।তাই আপনি অবিলম্বে এ স্থান পরিত্যাগ করুন।
এক টানা কথা গুলো বলে উত্তরের প্রত্যাশা না করে দেউলের অভ্যন্তরের প্রবেশ করলেন গোপালানন্দ। কংসারীর সামনে এসে ধ্যানে বসলেন তিনি ,দেখতে পেলেন কংসারীর মুখে যেন একরাশ বিষণ্ণতার মেঘ এসে জমেছে।চৈতন্যময় পুরুষোত্তমের অপার মহিমা যেন কে গ্রাস করে জ্বালিয়েছে অনন্ত এক দাবানল।তা রোষানল হয়ে যেন চোখ মুখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
অস্থির চিত্তে গোপালানন্দ তাঁর ধ্যানের মধ্যে ভগবানের কংসারীর রূপটি রূপায়িত করে মনে মনে বললেন - হে প্রভু! সর্বলোকের অন্তরেএই রূপেই তুমি প্রকট হয়ে পাপকে নাশ করো।পার্থিব চেতনাকে অতিক্রম করে পূর্ণ চৈতন্যে জাগ্রত হও তুমি !পাঞ্চজন্য শঙ্খে নির্ঘোষ তোলো।মোহাভিভূত মানব জীবনে শক্তি আর সাহসের বীজ বপন করো।
সহসা তাঁর মানসলোকের দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো চলমান অশ্বের পায়ের শব্দ,ধুলায় ধুলায় চতুর্দিক অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।কালো সে অন্ধকার ভেদ করে জ্বলে উঠছে আগুনের গোলা।ঘর বাড়ি সব জ্বলছে। চতুর্দিকে ভয়ার্ত আর্ত চিৎকার।গ্রামের পর গ্রাম লুঠ হচ্ছে।আগুন জড়ানো ঘন মেঘের মতো কালো ধোঁয়া ভেদ করে লাফিয়ে পড়ছে অশ্বরোহীর দল।অজয়ের জলে ভাসছে শত সহস্র মৃতদেহ। মহামারী আর দুর্ভিক্ষে দেশ জ্বলছে। কিসের এক চমকে ধ্যান ভেঙ্গে গেল তাঁর।তীব্রতম উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছেন তিনি।
-বাসুদেবানন্দ !বাসুদেবানন্দ !
চিৎকার করলেন তিনি।সারা শরীর ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। অবসন্ন গোটা দেহ।
-প্রভু!আমায় স্মরণ করেছেন ?আমি আপনার আজ্ঞার প্রতীক্ষায় বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষন।
-এ আমি কি দেখলাম বাসুদেবানন্দ!এর কণা মাত্রও যদি সত্যি হয় তবে তো মহা বিপদ আসন্ন! এতো ঘোর অশনি সংকেত!না না আর দেরি নয় তুমি এখনই যাও ,গ্রামের মানুষদের একত্রিত করে তাদের নিরাপদ স্থানে দূরে সরে থাকতে বলো। শ্যামানন্দ,রামানন্দ ,যাদবানন্দ তোমরা কোথায় !তাড়াতাড়ি যাও!
-আপনি শান্ত হন প্রভু।মুর্শিদাবাদ থেকে আজ চর ফিরেছে। নবাবের অনুপস্থিতিতে গত দুইদিন ধরে প্রবল লুঠতরাজ করেছে ভাস্কর পন্ডিতের বর্গীর লুটেরা দল।ঘর বাড়ি সব পুড়িয়ে ছারখার করে শ্মশানে পরিণত করেছে গোটা মুর্শিদাবাদ।আগুন জ্বলছে নবাবের প্রাসাদে।ভাগীরথির জল রক্তে ঘোলা হয়ে উঠেছে!কেটে ভাসিয়ে দেওয়া মৃতের স্তুপ ভাগীরথী ছাড়িয়ে অজয়ের জলে ভেসে আসছে! মেয়েদের ধরে নিয়ে গেছে তারা জাল পেতে ধরা মাঠ চড়ুইয়ের ঝাঁকের মতো।কুয়ো গুলো লাশে পরিপূর্ণ,তেজস্বিনী মেয়েরা বিষ খেয়ে নতুবা নিজের হাতে গলা কেটে মরেছে শত শত।এদিকে জানুবাজার আর ইলামবাজারের লাক্ষা আর পশম এর আড়ং গুলি ক্রমশ ফাঁকা হতে শুরু করেছে। ব্যাবসায়ী সহ সাধারণ মানুষের মধ্যে লুটেরা বর্গীদের ধংসাত্মক অত্যাচার লীলার আতঙ্ক আগুনের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে গুরু মহারাজ।এমতাবস্থায় আমরা কি করবো আপনি পথ দেখান !
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খানিক শান্ত হয়ে গোপালানন্দ বললেন,-জানো বাসুদেবানন্দ,সকালে ওই হরিদাসী মা-জি, যে যুবা সন্ন্যাসীটিকে নিয়ে এখানে এসেছিলো, তাকে দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল।সে যে সত্যিই বর্গী লুটেরাদের হয়ে চরবৃত্তি করে গোপনে খবর যোগায় এব্যাপারে আমি এখন আরো নিশ্চিত হলাম।
শিউরে উঠে গোপালানন্দ বললে,-চর!আর ওই হরিদাসী মা-জি ও ও ও
-ওর বেপারে আমি নিশ্চিত না হয়ে বলতে পারি না।কিন্তু ওই দেহাতির কথার ধরণ,পোশাক পরিচ্ছদ আমি নাগপুর থাকাকালীন ওদেশের মানুষজনের মধ্যে দেখেছি বাসুদেবানন্দ।বর্গীরা জালের মতো বেতনভুক চর ছড়িয়ে রেখেছেআমাদের চারপাশে।তাই আমাদের সবাইকে সদা সতর্ক থাকার প্রয়োজন।এই সংকটময় অবস্থায় হে যাদবোত্তম,হে পুরুষোত্তম,হে কংসারী আমাদের সকলকে পথ দেখাও।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতং
ধর্ম সংস্থাপনার্থয় সম্ভাবামি যুগে যুগে।
বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো এভাবে।দীর্ঘ রাত্রির অবসানে ভোর হলো।আবার দিনের আলোকমালা মুছে গিয়ে রাত্রি এলো।অজয়ের স্বচ্ছ জলে বয়ে গেল শেষ আষাঢ় ধোয়া বৃষ্টি ধারা।জনমানব শূন্য জানু বাজারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যেন খা খা করছে।ঝড় ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তের মতো অপার এক বহমান নিস্তব্দতা বিরাজ করছে বিস্তীর্ণ অজয়ের গোটা অঞ্চল জুড়ে।
আষাঢ় মাসের ভর দুপুর,আকাশে ঘন মেঘের আচ্ছাদন।প্রকৃতিতে আলো আর আঁধারের লুকোচুরি।মুহূর্তেই বিদ্যুৎতালোকে সমস্ত বনভূমি দীপ্ত হয়ে উঠলো।সাথে সাথেই বজ্রের গর্জনে থরথর করে কেঁপে উঠলো বনাঞ্চল সহ বনাভ্যান্তরের আগাছায় জর্জরিত ভগ্নপ্রায় দেউল।অনেক দূরে,বোধকরি বনভূমির অপরপ্রান্ত থেকে অবিশ্রান্ত চলমান একটা ঝরঝর শব্দ বৃহৎ বনস্পতির মাথার উপর দিয়ে দেউলের দিকেই এগিয়ে আসছে-বর্ষণ নেমেছে। কিন্তু দেউলের কাছে আসতেই থেমে গেল তা। প্রকৃতির ছন্দময় পরিবেশের যেন তালভঙ্গ হয়ে গেল মুহূর্তেই,দূর থেকে করা যেন বাজালো বন শিঙা।ফুলে ফুলে মধু পান রত মৌমাছিরা গুঞ্জন তুলে উড়ে গেল দূরে।ডাহুক ডেকে উঠলো বনাভ্যান্তর থেকে!খানিক অশান্ত চিত্তে দেউলের বাইরে পায়চারি করছিলেন গোপালানন্দ।থমকে দাঁড়ালেন তিনি। বনস্পতির মাথায় মাথায় পাহারা রত গোপন নজরমিনার থেকে ভেসে এলো বিপদসংকেত।দোদুল্যমান চঞ্চল বৃক্ষ শাখার ঘর্ষণে যেন ঝড় উঠেছে বলে মনে হলো।
-শ্যামানন্দ,রামানন্দ ,যাদবানন্দ তোমরা প্রস্তুত হও। লগ্ন এসে গেছে।
সকলে সমস্বরে চিৎকার করে বললো -জয় কংসারী,জয় মুরারি।
গোপালানন্দের নির্দেশে দেউলের পিছন থেকে বেরিয়ে এলো মস্ত বড় মই।সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা ফিরিঙ্গিদের তৈরী বন্দুক ,বারুদ, গুলি।গুরুর নির্দেশ পেয়ে দেউলের কাছেই গাছের মাচায় তীর ধনুক আর গুলি বারুদ নিয়ে উঠে গেল চার পাঁচ জন।উপর থেকে বিস্তীর্ণ অঞ্চলটা বেশ ভালো করেই দেখা যায়। মাথার উপর ঘন কালো মেঘ ছাড়িয়ে দূর দিগন্ত, বৃষ্টিতে ধুয়ে গিয়ে যেন দোয়াত উল্টানো নীল রঙে ঝক ঝক করছে। মাঝে মাঝে তাতে ছড়িয়ে রয়েছে যেন কমলা আর গোলাপি রঙের প্রলেপ। অথচ বনস্পতির মাথার উপর আঁধারের ঘনঘটা।
- কিছু দৃষ্ট গোচর হচ্ছে? সন্দিগ্ধ চিত্তে জানতে চাইলেন গোপালানন্দ।
উপর থেকে শিষ্যরা যা বললো,তার মর্মার্থ হলো এমনরূপ - সব আশঙ্কা সত্যি করে সারি সারি অশ্বারোহী দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে এদিকে,পিছনে গঞ্জের বাজার দাউ দাউ করে জ্বলছে! কি বীভৎস সে আগুন!জ্বলন্ত সে অগ্নিময় কমলা অগ্নিকুন্ডের সর্বগ্রাসী শিখা থেকে ঘন কালো ধোঁয়ার বলয় বাতাসে উত্তাপের সৃষ্টি করছে। জ্বলন্ত সেই টকটকে লাল অগ্নি কুন্ডের ভিতর থেকে সোল্লাসে লাফিয়ে বেরিয়ে আসছে দুরন্ত,ক্রুর লুটেরা বর্গীর দল।কারোর হাতে বন্দুক ,কারোর হাতে রক্তাক্ত বল্লম ,কারোর হাতে বারুদ। বন্দুক দাগছে ঘন ঘন। ভেজা বাতাসে পোড়া বারুদের গন্ধ।আর্ত চিৎকারে ছোটাছুটি করছে ভয়ার্ত গ্রামবাসী।গঞ্জের কাছে তাঁদের আশ্রমটি ও জ্বলছে। বর্গীদের একটি দল অজয়ের ধার বরাবর জঙ্গলের অভ্যান্তরে এই দেউলের দিকেই ছুটে আসছে।অগ্রভাগে নেতৃত্ব দেওয়া দলপতির হাতে একটি কবন্ধ মুক্ত স্ত্রী জাতীয় কারোর একটি কাটা মুণ্ডু।দড়ি দ্বারা গলায় ফাঁস দিয়ে অবাধ্য জানোয়ার ধরার ভঙ্গিতে,দীর্ঘ চুলের প্রান্তদেশ ধরে তা ঘোরাতে ঘোরাতে অজয়ের তীর বরাবর শরবন,কাশবন ও নানান তৃণাচ্ছাদিত চারণভূমি ধরে তারা ছুটে আসছে এই দিকে।
একি! সহসা কোথা থেকে ছুটে এসে,নির্মেদ রিজু শাল বৃক্ষের ন্যায় দুই বাহু প্রসারিত করে পথ আটকে দাঁড়ালো হরিদাসী মা জির মেয়ে অষ্টাদশী রাইদাসী।বাতাসে উড়ছে তার এলোচুল।দুচোখে প্রতিশোধের আগুন।লাগাম টেনে লোলুপ দৃষ্টিতে দাঁড়ালো দলপতি।ছুড়ে দিলো স্কন্ধকাটা রক্তাক্ত মুন্ডুটা তার সাদা থানের উপর।কি নিষ্ঠুর ওটাতো হরিদাসী মা জির কাটা শর !বিলাপ ছেড়ে হিংস্র বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো রাইদাসী ওই দলপতির উপর।
শিষ্যদের মুখে বিবরণ শুনতে শুনতে সর্ব শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল গোপালানন্দের। উত্তেজনায় আগ্নেয়গিরির উত্তাপের মতো বিস্ফোরোন্মুখ হয়ে ছুটে গেলেন দেউলে,কংসারীর হাতের থেকে তুলে নিলেন অসি।
-বাসুদেবানন্দ!চলো আমার সঙ্গে,এই ধর্ম যুদ্ধে অধর্মের বিনাশ করতে রাইদাসীকে সঙ্গ না দিলে অধর্ম হবে। ধর্মের জয় আজ নিশ্চিত।
- কিন্তু প্রভু ওই হরিদাসী মা জি নয়,আসলে ওই পাপাত্মার বিনাশ হয়েছে।এই মুহূর্তে তাই বনের গভীরে লুকিয়ে রাখা গ্রামবাসীদের নিরাপত্তা ব্যতিরেখে ওঁর মেয়ে কে আমাদের সাহায্য করা কি উচিত হবে?
- বিশ্ব সংসারে পাপ ও পুণ্য প্রবৃত্তি দুইই-এক শক্তির দুই বিরোধী রূপ।বাসুদেবানন্দ একথা তুমি ভুলে গেলে কি করে।এই বিরোধের মধ্যে সন্ধির কোনো মধ্যপথ নেই,তাই পাপকে মরতেই হতো। তাই আর কালবিলম্ব করো না চলে এস আমার সঙ্গে।
অজয়ের বালুতটে গোপালানন্দ ছুঁটে এসে দাঁড়ালেন দলপতি আর পদাঘাতে মাটিতে আছড়ে পড়া রাইদাসীর মাঝখানে।মাথার উপরে কাকের গলার মতো আষাঢ়ের কালো মেঘে যেন দিগন্তে ও ছড়িয়ে গেছে।বিদ্যুৎতালোকে তাঁর পেশী বহুল হাতে উদ্যত অসি মুহুর্মুহু ঝলসে উঠলো।ক্ষীণ কটি সিংহের মতো প্রশস্ত শরীর দিয়ে আড়াল করলেন সদ্য মাতৃহারাকে।নাকাড়ায় ঘা পড়লো চারধার থেকে ,বনস্পতির মাথায় মাথায় শিঙার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুললো।দেউলের কাছের মাচা থেকে বন্দুক মুহুর্মুহু গর্জে উঠলো।অজয়ের নদীতে ভাসমান বজরা ,নৌকা ,ছিপে লুকিয়ে থাকা কাঁসারির যোদ্ধারা তীর ধনুক হাতে অজয়ের জলে লাফিয়ে নেমে মুখে হাত থাবড়ে অদ্ভুত এক বাআআআ...বাআআআআ আওয়াজ করে বর্গী লুটেরা দলটিকে চক্রবুহে আবদ্ধ করতে এগিয়ে আসছে।শালবন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে তীর। শুরু হলো প্রচন্ড লড়াই।ঘোড়ার লাগাম টেনে একটা হাচ্ক্য় টান দিতেই ভুলুন্ঠিত হলো দলপতি। গোপালানন্দ এই প্রথম বার খুব কাছ থেকে তাকে দেখে বিস্মিত হলেন।এই তো সেই আগন্তুক দেহাতি।যে কয়েকদিন আগেই তাদের দেউলে এসেছিলো।তাহলে এই আগন্তুক দেহাতিই এই বর্গী লুটেরাদের দলপতি।মুহূর্তের শিথিলতায় বর্গী দলপতি ছুঁটে গেল রাইদাসীর কাছে।উপায়ান্তর না দেখে রাইদাসী তার চোখে মুখে বালি ছিটিয়ে দিল ,ছুঁটে এসে গোপালানন্দের পায়ে নিজেকে নিবেদন করে বললো -বাঁচাও গৌড়।প্রাচীন বট বৃক্ষের জটাধারী শিকড়ের মতো বিদ্যুতের উন্মত্ত আলোক প্রভায় ঝলসে গেল দিকবিদিক।আচার্য গোপালানন্দ তাঁর শক্তি শালী দুই মুষ্টিতে ধরে থাকা,অসি দিয়ে সজোরে বক্ষস্থল বিদ্ধ করলেন দেহাতি ওই বর্গী লুটেরা দলপতির। গগনভেদি চিৎকার করে বললেন জয় কংসারি, জয় মুরারি।উষ্ণ রক্তের তরল ধারা পিচকারীর মুখের মতো ছুটে এসে ছিটকে পড়লো তাঁর গায়ে। তীব্রতম উত্তেজনায় থর থর করে কেঁপে উঠলেন তিনি।ঘটনার আকস্মিকতায় মূর্ছা গেল রাইদাসী।
লুটেরা বর্গী দলটি প্রবল বাঁধার সম্মুখীন হলে পিছু হটতে বাধ্য হলো।মূর্ছা যাওয়া রাই দাসীকে কাঁধে তুলে গোপালানন্দ যখন দেউলে এসে পৌঁছিলেন দূর থেকে তখনো ভেসে আসছে নাকাড়ায় ঘা দেওয়ার শব্দ।যাদবনান্দ,শ্যামানান্দরা অনেক দূর পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়ে এসেছে তাদের।
রাত্রি গভীর হলে একটা নিশাচর পাখি প্রহর ঘোষণা করে ডেকে উঠলো,সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক পাখি তাতে সারা দিল।গভীর রাতের নিঃশব্দ বনভূমির মধ্যেও কেমন একটা চাঞ্চল্য বয়ে গেল। যাদবনান্দ দৌড়ে এসে হাত জড়ো করে দাঁড়ালো ধ্যানমগ্ন গোপালানন্দের পিছনে,গলায় একটা আওয়াজ করে গোপালানন্দের উদেশ্যে বললো,
- প্রভু রাইদাসীর জ্ঞান ফিরেছে।
কংসারীকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।অনুসরণ করলেন যাদবনান্দকে।
শিষ্যদের জন্য নির্মিত অস্থায়ী খড়ের চলার নিচে, খড়েরই বিছানায় চেতনাহীন হয়ে শুয়েছিল রাইদাসী।যেন অবসন্নতা কাটেনি তখনো।থেকে থেকে চমকে উঠছে।চেতনার অন্তরালে তার মানসপটে তখনো ভেসে উঠছে লাল রক্তের হরি খেলা।তার মায়ের কবন্ধ নিয়ে পৈচাশিক উল্লাসে মত্ত নরপিচাশেরা,তাদের অট্টহাসিতে কেঁপে উঠছে দিক- বিদিক।কমলা আকাশ থেকে উড়ে এসে প্রবল শীৎকারে লোলুপ শকুনের দল তার শ্বেত চন্দনের ন্যায় পবিত্র শরীরটাকে ছিন্ন ভিন্ন করতে চাইছে।ভয়ে আড়ষ্ট শরীর কুঁকড়ে যাচ্ছে ,ঠিক তখনি কোথা থেকে মস্তকে ময়ূরপুচ্ছ পরিহিত,মুরলিধর শ্যাম এসে বাঁচালো তাকে। হাত রাখলো অধরে ,কেটে গেল সব ভয়।
ঘরে ঢুকে গোপালানন্দ রাইদাসীর হাত ধরে নাড়ির গতি মাপলেন। অতি সন্তর্পনে হাতটি নামিয়ে রেখে পাথরের বাটিতে কি একটা চূর্ণ মধু দিয়ে মেড়ে তাকে খাইয়ে দিলেন।
দুচোখের পাতা খুলতেই, ছেড়া ছেড়া আলোক আঁধারে,জ্বলন্ত মশালের আলোকোত্তপে দুচোখ যেন ধাঁধিয়ে গেল তার।দুচোখের আলোকভেদী শক্তিতে সে দেখলো এক চৈতন্যময় স্বরূপ তার সামনে দাঁড়িয়ে।প্রেমোময় শ্যাম ,তার গৌড়, স্বয়ং দুই বাহু মেলে আজ তার সামনে।
সদ্যযৌবনা রাইদাসীর শরীর দিয়ে যে কস্তুরী সদৃশ আলোকপ্রভার ঝিম ধরানো সৌরভ দৃপ্ত হচ্ছে তা গোপালানন্দের কাছে অমাবস্যার অন্ধকারে জোনাকির মেকি জ্যোতির ছলনা বলে মনে হলো না।চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি,নির্দেশ দিলেন
- যাদবনান্দ!রাইদাসী এখন অনেকটাই সুস্থ।তাই ওকে ফিরে যেতে বলো।আর বনের গভীরে লুকিয়ে রাখা গ্রামবাসীদের মুক্ত করে তাদের লোকালয়ে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করো।অবিলম্বে আমরা এ স্থান পরিত্যাগ করবো।
গোপালানন্দের মুখে এই স্থান ছাড়তে হবে জেনে, ধড়ফড় করে উঠে বসলো রাইদাসী।জড়িয়ে ধরলো গোপালানন্দের পা।চিৎকার করে কেঁদে বললো,-প্রভু !তুমিই আমার শ্যাম,তুমিই আমার রক্ষা কর্তা।ছেড়েই যদি যাবে তবে কেন বাঁচালে আমাকে?জগৎ সংসারের আমি সব হারিয়েছি,এবার তোমার পায়ে আমাকে একটু ঠাঁই দাও ঠাকুর।
গোপালানন্দ নিরুত্তর রইলো।সদ্য মাতৃহারা অষ্টাদশীর কাতর ক্রন্দন তাঁর হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করলো বটে কিন্তু অভিব্যক্তিতে তা প্রকাশ পেলো না।
মহাবিশ্বে নারীর মধ্যেই আদিম প্রকৃতি প্রছন্ন ভাবে বাস করে।যা প্রথমে পুরুষকে অতি সন্তর্পনে আয়ত্ত করে,পরিশেষে গ্রাস করে।যার কামনা শুধু সৃষ্টির।কিন্তু চৈতন্যময় পুরুষোত্তম সেই বাঁধার আচ্ছন্নতা কাটিয়ে চলে যান।
-হে যাবোত্তম,হে পুরুষোত্তম ,হে কংসারী পথ দেখাও।
অস্ফুটে বললেন গোপালানন্দ।আর দেরি নয়,প্রভাত আসন্ন ,মাথায় তুলেনিলেন রাধাহীন বিনোদ মূর্তি কাঁসারিকে।সোল্লাসে জয়ধনী দিলো সবাই।আচার্যের দেখানো মার্গে বনভূমি ছেড়ে একে একে বেরিয়ে এল প্রত্যেকে।গুরুর নির্দেশে,বনের অভ্যান্তরে তাদের শেষ বসতিরটুকু অগ্নি সংযোগে নিশ্চিহ্ন করে সর্ব শেষে বন ছেড়ে বেরিয়ে এলো যাদবনান্দ।গভীর রাত্রে জতুগৃহে অগ্নি সংযোগ করে পাণ্ডবেরা যেমন নিঃশব্দে বার্ণাবত ত্যাগ করেছিলেন,এ যাত্রাও অনেকটা সেরকমই।
নিকষ অন্ধকারে অজয়ের কালো জলে ভাসমান বজরায় উড়লো ধর্মের ধ্বজা।শিঙায় ফুঁ দিয়ে নদীবুকে থোকায় থোকায় জমে থাকা নীলচে অন্ধকার চিড়ে আপন গতিতে দুলে দুলে সামনের দিকে এগিয়ে চললো বজরা।গোপালানন্দ বজরার উপর থেকে দেখলেন দূরে আগুনের লেলিহান শিখা,কালো রাত্রির কাপড়ে পাড়ের মতো সরু ফিতের ন্যায় দাউদাউ করে জ্বলছে। হওয়ার মতো অতিদ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ছে চারধারে।সর্বগ্রাসী সে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিতে, সেদিকেই বিদ্যুৎবেগে ছুঁটে চলেছে কে এক সুন্দরী অষ্টাদশী!আগুনের দৃপ্ত প্রভা তার মুখের উপর ছিটকে পড়ে যেন মা মহামায়ার মতো লাগছে তাকে!কে ও!তবে কি ও ও ও!বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো।মুহূর্তের উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। অনেক চেষ্টা করেও কণ্ঠ থেকে আওয়াজ বেরোলো না তাঁর।দুই হাতদিয়ে গলা চেপে ধরে প্রানপনে শুধু একটি বার তিনি গগনভেদি চিৎকার করে বলতে চাইলেন
- থামাও যাদবনান্দ! বজরা থামাও!
==== সমাপ্ত ====