শেষ ইচ্ছা
বদরুদ্দোজা শেখু
ভজহরি মন্ডল জজ কোর্টের এক উকীলের
টাইপিস্ট ছিল । তার টাইপরাইটার মেসিনটি পোর্টেবল রেমিংটন ।ছোট। ব্রিটিশ আমলের ।
উকীল বাবুর খসড়াগুলো খুব দ্রুততার সাথে ভজহরি নিখুঁতভাবে টাইপ ক'রে দিত।
মক্কেলও আসতো অনেক। তাই তার সাথে
আরো দু'তিনজন তার সাথে ঐ কাজ করতো।কিন্তু ভজহরি ছিল ঝানু টাইপকার।
কোর্টের কাজ ছাড়াও সে আরো বাইরের অনেক চিঠিপত্র , দরখাস্ত , ফর্ম ইত্যাদি কাজ অবসরে ক'রে যেত।বাড়তি আয়ও হতো। এভাবেই সে তার দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে বড়ো ক 'রে তুলেছে। তাদের বিয়েশাদি দিয়েছে। তারপর তারা যে যার মতো আলাদা সংসার পাতার আকর্ষণে
আরো ভালো থাকার আকর্ষণে বাপমাকে ছেড়ে চ'লে গেছে। এখন কালেভদ্রে খোঁজ নেয় ফোনে।আসার সময় পায় না।
দিন গড়িয়ে গেছে।ধীরে ধীরে যুগের হাওয়ায় এলো কম্পিউটার , জেরক্স,
প্রিন্টার, ল্যাপটপ, স্মার্ট ফোন, নেট
যা আরো দ্রুত নমনীয়ভাবে কাজকে সরল ও সহজসাধ্য ক'রে দিল।ঝকঝকে ছাপা, মূহুর্ত্তে সংশোধন করা যায় , কার্বন কপির মতো ঝাপসা হয় না , তারপর একসাথে যতো খুশী কপি বের করবে করো।এতো সুফল ওই কম্পিউটার ম্যাজিক মেশিনের।
তার কাছে টাইপরাইটার পরাস্ত হ'য়ে ধীরে ধীরে বছর কয়েকের মধ্যেই কার্যত বাতিল
বস্তুতে পর্যবসিত হলো। সহকারী যেসব বন্ধুরা ছিল তাদের বয়স কমবেশী অল্প ছিল, তারা এখান ওখান থেকে কম্পিউটার শিখে কাজে নেমে পড়লো। ভজহরি কিন্তু যুগের হাওয়ার সাথে তাল মেলাতে পারলো না। কম্পিউটারকে তার একটা আজব মেশিন মনে হ'তে লাগলো।তার ঘাইঘোই বোঝার কম্মো তার নয়। তবু এখনো সে একটা ছোট টেবিল নিয়ে কোর্টের রাস্তার এককোণে তার গুমটীঘরে ব'সে থাকে।
যদি কোনো ছাত্রছাত্রী বা পুরনো চেনা লোক আসে।দরখাস্ত লিখে নেওয়ার জন্য।সে তাই ক 'রে দ্যায় হাতে লিখে।তারপর তারা অন্য কোথাও কম্পিউটার থেকে সেগুলো টাইপ কপি ইত্যাদি ক'রে নেয়। কাজেই ভজহরির আর আগের মতো আয় হয় না।
তবু সে টাইপরাইটার মেশিনটাকে বিক্রি ক'রার কথা ভাবতে চায় না, সেটা তার কাছে সন্তানের মতো।ওটা তাকে সারা জীবন জীবিকার জোগান দিয়েছে।তার সব সময়ের সহায়।তাকে সে বিক্রি ক'রে দিতে চায় না।বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত অনেকের পরামর্শ ফিরিয়ে দ্যায়।
কিন্তু বাড়ির অভাবের তাগাদা দিয়ে তার স্ত্রীও তাকে মেশিনটা বেচে দিয়ে একটা ছোটখাটো স্টেশনারী দোকান দেওয়ার পরামর্শ দ্যায় ওই গুমটিতে , কাগজ খাতা খাম পেন তবু তো কিছু বিক্রি হবে ।মন না চাইলেও স্ত্রীর পরামর্শ মেনে সহচর মেশিনটাকে সে বেচেই ফেলবে ব'লে ঠিক করলো।
* * *
রাতে ঘুম আসছিলো না তার চোখে।শূণ্য ঘরে বুড়োবুড়ি দুজন, তবু গভীর রাতে তার মনে হলো , কেউ যেন ফিসফিস ক'রে তার কানে কানে কথা বলছে।সংশয়বশতঃ ভজহরি উঠে বসলো আর দেখলো, দিব্যি তার টাইপরাইটার টার জায়গায় যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে আর তার দিকে অপলক চেয়ে চেয়ে দেখছে; সে আশ্বাস দিলো , কি গো বাবু, ভয় কোরো না , আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না ; তোমার সাথে দু'টো কথা বলতে এসেছি মাত্র।
ভজহরি স্পষ্ট শুনতে পেলো, আমাকে দিয়ে আর তোমাদের দরকার নাই তাই তো। তাই আমাকে লোহালক্কড়ের মতো বেচে দিতে চাইছো গো বাবু , তা আমারও তো শেষ ইচ্ছা আছে তো নাকি? সেটা পূরণ করবে না ? আমাকে যারাই কিনুক , তারা তো আর ফেলে রাখবে না।পুরানো লোহালক্কড়ের দোকানে নিশ্চয় ঠিকাদরে বা ওজন দরে বিক্রি ক'রে দিবে।তারা আমাকে ভেঙে চুরে পার্ট্স খুলে খুলে গলিয়ে একাকার করবে, অন্য কাজের জিনিস বানাবে। এটা তো আমার মৃত্যুঘন্টাই হলো কি না ? তা বাবু, মরার আগে আমার একটা শেষ ইচ্ছা আছে তোমার কাছে বলার।- - -
ঘোরের মধ্যে ভজহরি শুধায়, কী সাধ আবার তোমার ? - - - ঠিক আছে - - বলো, বলো। তোমাকে যখন আর রাখতেই পারছি না , তখন শুনি তোমার কী শেষ ইচ্ছা। সম্ভব হ'লে পূরণ করবো। তোমাকেই ভর ক'রে এতদিন আমার সংসার চলেছে ,তখন আমারও তো তোমার প্রতি কিছু কর্তব্য আছে বইকি!
টাইপপুরুষটার মুখ যেন কিছুটা উজ্জ্বল হ'য়ে উঠলো। বললো, আমাকে ঠিকাদরে বিক্রি না ক'রে যদি পুরনো জিনিস যে সমস্ত দোকান সংরক্ষণ করে সেখানে বিক্রি ক'রে দাও তো বড়ো উপকার হয়, তাহলে আমাকে আর কষ্টের মরণ মরতে হয় না; ওরা নিশ্চয় আমাকে সাফসুতরো ক'রে পুরনো জিনিসের মিউজিয়ামে রাখার ব্যবস্থা করবে। তাতে তুমিও হয়তো ভালো দাম পাবে আর আমার আত্মাও শান্তিতে থাকবে।
ভজহরি বললো, তেমন দোকান তো আমার জানা নাই, এখন কোথায় খুঁজতে যাবো বলো তো ? বুড়ো হয়েছি।এদিক সেদিক বেশী যেতেও পারি না।- -
সেই লোকটা বললো , কেন? রোজ খবরের কাগজে তো এরকম কতো বিজ্ঞাপন বের হয়। দেখতে থাকো। ঠিক পেয়ে যাবে গো বাবু। আমার ইচ্ছেটা রেখো।
ভজহরি এমনিতেই টাইপরাইটার জন্য মনোক্ষুণ্ণ হয়েছিল, এবার সে একটা পথ পেলো ওটাকে কেজি দরে যাতে বিক্রি করতে না হয়। বললো, দেখি তোমার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারি কিনা। ধৈর্য ধরো , তোমাকে আমি ফেলে দিবো না।
---আচ্ছা বাবু , চলি ব'লে টাইপপুরুষ সেলাম ঠুকে উধাও হ'য়ে গেলো।
কিছু এলোমেলো আলোছায়া মায়ামমতায় ভাবতে ভাবতে ভজহরি ঘোরের মধ্যেই আবার ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন সকাল থেকে ভজহরি কাজে নেমে পড়লো।প্রতিদিন কোর্টের চেনা পরিচিত লোকদের কাছে পুরনো টাইপরাইটার কেনার দোকানের খোঁজ করতে লাগলো।পাশাপাশি রোজ চায়ের দোকানে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনেও চোখ রেখে চললো।
বেশ ক'দিন পর একটা বিজ্ঞাপনে তার চোখ ঝলমল ক'রে উঠলো ।লোহাপট্টির একটা দোকানের খোঁজ পেলো যেখানে ওরকম পুরনো জিনিসের কেনাবেচা হয়। ঠিক করলো, আগামীকালই ওখানে একবার যেতে হবে।
সেদিনই বেলা দুপুর নাগাদ একজন ফেরিওয়ালা পুরনো জিনিস বদলে'নতুন জিনিস ফেরি করে হাঁক দিয়ে যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে।পুরনো ব্যাটারী ইনভার্টার মোবাইল টিভি টেলিফোন টাইপরাইটার ইত্যাদি সে বদলে' নতুন শাড়ি বাসনপত্র বিক্রি করে।ডাক শুনে ভজহরির গিন্নী তাকে ডেকে টাইপরাইটারটা দেখালো।আর দরাদরি ক'রে একটা নতুন শাড়ি আর কিছু নতুন চকচকে বাসনপত্র নিয়েই সে আহলাদিত হ'য়ে ওটা ফেরি ওয়ালাকে দিয়ে দিলো। যাক বাবা বাঁচা গেল, ঐ ভজহরিকে দিয়ে কিস্যু হবেনা ! কতো সহজে সে কাজটা মিটিয়ে দিলো ! ভিতরে ভিতরে একটা চাপা ভয়ও লেগে থাকলো। একবার তো খুঁজবে , তখন কি বলবে ?
সেই রাতেই ঘুমের মধ্যে সেই টাইপপুরুষ আবার ভজহরির কাছে উদয় হলো , বললো, কি গো বাবু , খোঁজ পেলে ? আর কতো অকেজো হ'য়ে দিন গুণবো? আমাকে দিয়ে এসো।
ভজহরি বললো ,তুই বেঁচে গেলিরে বুড়ো !
আমিই হেরে গেলাম। তোকে হারাতে হলো।
আমার যে বন্ধু বলতে আর কেউ রইলো না।
কিন্তু সংসারের চাপে আর তোকে ঘরে রাখা গেলো না, বুড়ো ;ক্ষমা করিস বাবা।, তুই আমার এতদিনের অন্নদাতা, ক্ষমা করিস !
পরদিন সকালে যখন বেরুবে , তখন দেখলো সেই টাইপরাইটারটা যথাস্থানে নাই।তার প্রথমেই গিন্নীকে সন্দেহ হলো।সেই তো পুরনো অকেজো জিনিসটার পিছনে প'ড়ে ছিল। তাকে চোটপাট ক'রে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই সে ব'লে বসলো, সে ওটা ফেরিওয়ালাকে বিক্রি ক'রে দিয়ে নতুন শাড়ি আর বাসনপত্র কিনে নিয়েছে।বলেই সে ঝাঁঝিয়ে উঠলো, তোমাকে ব'লে ব'লে তো আর কাজ হলো না ! তাই সে নিজেই সে -কাজ সেরে ফেলেছে। শুনেই ভজহরি অগ্নিশর্মা হ'য়ে উঠলো বটে, কিন্তু এখন সে এক দুর্বল মানুষ , বৌকে বেশী ঘাঁটাতে চায়লো না।অল্পকিছু ঠোকাঠুকি হলো বটে। তবে সে চুপ মেরে গেল। সেদিন সে মনের দুঃখে না খেয়েই কোর্টে চ'লে গেলো। যৎসামান্য আয় হয় , তা তো আর বন্ধ রাখা চলে না! রাগে দুঃখে তার গুমটিতে কাজে মন বসলো না ।এটা কি স্ত্রী? না অর্ধাঙ্গিনী ? যে অবলীলায় স্বামীর অন্তরের ভালবাসার জিনিসকে তার অগোচরে পণ্য ক'রে বেচে দ্যায় ? সে দেরী ক'রে বাড়ি ফিরলো আর সেই রাতে সে ভারাক্রান্ত মন নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।স্ত্রীর সাথে কথা কাটাকাটির চেয়ে এটাই তার শ্রেয় মনে হলো।
ঘুমের মধ্যে সে স্পষ্ট শুনতে পেল , ধন্যবাদ বাবু ! অনেক ধন্যবাদ ! দেখলো, হাতজোড় ক'রে টাইপপুরুষ অম্লান বদনে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
অবাক চোখে ভজহরি জিজ্ঞাসা করলো ,
কিসের জন্য ধন্যবাদ বাবা ? আমি তো তোমার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করতে পারিনি!
তবু কেন আমারে লজ্জা দিতে এসেছো?
টাইপপুরুষ ব'লে উঠলো, না , না বাবু , তুমি তো আমার শেষ ইচ্ছাটা পূর্ণই করেছো গো ! আমি এখন দিব্যি একটা পুরনো অ্যান্টিক দোকানের শোরুমে জায়গা পেয়েছি।তোমার বদান্যতায় আমাকে এক্ষুনি এক্ষুনি মরতে হবে না। আমি বেশ ঘুমিয়ে কাটাচ্ছি।- - -
সেটা কী ক'রে হয় ? তোমাকে তো আমার গিন্নী আমার অনুপস্থিতির সুযোগে ফেরিওয়ালার কাছে বিক্রি ক'রে দিয়েছে।
টাইপপুরুষ স্মিতভাবে বললো, তাই বর হয়েছে গো বাবু , ফেরিওয়ালা আমাকে ঠিক দোকানেই বিক্রি ক'রে দিয়েছে।ওরা খুব যত্ন ক'রে ঝেড়ে মুছে তুলে রেখেছে।হয়তো ওরাও একদিন বিক্রি ক'রে দিবে ভালো দাম পেলে বা নিলামে তুলবে অ্যান্টিক বস্তু হিসেবে, তবু যতদিন তোলা থাকা যায় ততোদিনই জীবন-প্রাপ্তি।স্পষ্ট দেখলো, তার চোখের কোণা দুটো ছলোছলো।
ওদিকে গিন্নী চেঁচিয়ে বলছে , টাইপরাইটারের ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। ও নিয়ে তোমাকে আর ভাবতে হবে না।তুমি পেনখাতাপত্রখামের দোকানে মন দাও। তাহলেই আমার জীবনটা ধন্য হয়ে যাবে !
ভজহরি স্ত্রীর অনধিকার চর্চায় বেশ ক্ষুদ্ধ ও বিষণ্ণ হয়েছিল।এখন তার চোখে জল।
বিচ্ছেদের কান্না? না,আনন্দের ? সে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। ঘোরের মধ্যেই হাতজোড় ক'রে রইলো। টাইপ পুরুষও মনিবের বদান্যতায় হাতজোড় ক'রে উঠলো।কাঁদো কাঁদো। সবাইকেই একদিন চলে যেতে হয়গো বাবু , নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়।তবু আমার ভাগ্য ভালো, আমার দিন ফুরিয়ে গেলেও আমি পৃথিবীর আলো বাতাসে বেঁচে থাকবো আরো কিছুদিন। হয়তো অনেক দিন । চলিগো বাবু।তোমাদের মঙ্গল হোক।
ঘোরের মধ্যেই ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে ভজহরি দ্বিধান্বিত , সে কি তার সহচর সাথীর শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করতে পেরেছে ? ? ?
সে ম'রে গেলেও কি তার সাথী টাইপরাইটার বেঁচে থাকবে ? ? ফেরিওয়ালাকে সে কি ব'লে ধন্যবাদ জানাবে ??
--------------------
বদরুদ্দোজা শেখু
18 নিরুপমা দেবী রোড , বাইলেন 12 ,
শহর+পোঃ- বহরমপুর , জেলা--মুর্শিদাবাদ,
PIN -742101
পঃ বঙ্গ , ভারত ।
হো• অ্যাপ নং 9609882748
----------------------
খুব নিখুঁত সুন্দরভাবে আমার লেখা "শেষ ইচ্ছা" ছোট গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাই।সহৃদয় পাঠক মন্ডলীকে গল্পটি প'ড়ে মতামত দেওয়ার অনুরোধ রইলো।তবেই আমি এগিয়ে যাওয়ার রসদ পাবো ।
উত্তরমুছুন