কানুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
কর্ডলাইনে বর্দ্ধমান ফিরছি । গোবরায় ট্রেনে একটা বাচ্ছা ছেলে আর একজন বুড়ো সাপুড়ে উঠেছে।
লোকাল ট্রেনে এরকম কত ফেরিওয়ালা ওঠে ! তাদের পন্য বিক্রির বিচিত্র পদ্ধতি আর হাঁকডাক খুব ঘুমকাতুরে লোকের কানও খাড়া করে দেয়। কিন্তু এই লোকটির বিক্রিত পন্য একটু অন্যরকম। লোকটির মাথায় লাল পাগড়ি , গলায় তিন চারটে সস্তা পুঁতির মালা , ডান হাতেও পুঁতির মালা জড়ানো । সে কামরায় উঠেই চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে দিল , তার হাতের ঝাঁপিতে একটা গোখরো সাপ আছে , চরম বিষধর এবং সদ্য ধরে আনা। মাত্র দশটা টাকা খরচা করলেই গোখরো বাবাজীর আর্শীবাদ পাওয়া যাবে । দু একজন উৎসাহ দেখালো । আর্শীবাদের পদ্ধতিটাও আর্শ্চয রকমের । দশটা টাকা ধরালেই সাপুড়ে ঝাঁপির মুখটা খুলে দিচ্ছে । ভিতরে দেখলাম গুটিসুটি মেরে সত্যিই একটা গোখরো সাপ শুয়ে আছে । এরপর সেই সাপুড়ে হাত ধরে সাপের গায়ে স্পর্শ করাচ্ছে।
দেখতে দেখতে আরো কয়েকজন উৎসাহ দেখালো । আমিও দশ টাকার বিনিময়ে সাপের গায়ে হাত দিলাম। কিরকম পিচ্ছিল আর ঠান্ডা অনুভব । সাপের গায়ের হাল্কা স্পন্দনও অনুভব করলাম ।এছাড়া লোকটা বিভিন্ন রকম শিকড় বাকড় – মাদুলি বিক্রি করছে । মুর্হুতের মধ্যে লোকটার থলি দশটাকা- কুড়িটাকায় ভর্তি হয়ে গেল । সাপুড়ে কামারকুন্ডুতে নেমে গেলো।
আমি বললাম, " মনে হয় জোচ্চুরি । এর পিছনে অন্য গল্প আছে ।"
আমার পাশে বসা ভদ্রলোকটি মন্তব্য করলেন , " সবই কি জোচ্চুরি ? সাপটা তো পুরো জ্যান্তই"।
আমি বললাম ," নিশ্চই বুড়ো হাফ ডেড সাপ , নড়ার ক্ষমতা নেই "।
লোকটি বলল ," সাপ সর্ম্পকে সাধারন মানুষের ধারনা খুব সামান্য। সাপ মানেই ভয়ঙ্কর বা ক্ষতিকর কিছু নয় । নিরীহ সাপও অনেক আছে ।"
আমি হেসে উঠে বললাম ," নিরীহ সাপ ! এরকম কোনোদিন শুনিনি ! "
লোকটি সাপ সম্পর্কে লেকচার দেওয়াই শুরু করে দিল , " সাপ সাধারনত নিরীহই হয়। প্রানের দায়ে ছোবল মারে। ছোবল মারাটা আর কিছুই নয় , বিপদে পড়ে তাৎক্ষনিক রি- অ্যাকশন। ওরা ঝোপঝাড় বনে জঙ্গলে থাকে । ওটাই ওদের ঘর। মানুষ ওদের ঘরে অনাধিকার প্রবেশ করতে চাইলে ওরা তাৎক্ষনিক রি –আ্যকশন দেখায়।"
আমি বললাম " হতে পারে আপনার যুক্তি সত্য। কিন্তু যে সাপটার গায়ে এখনি সবাই হাত দিলাম , সে কেন ছোবল মারল না ? এই ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?"
ভদ্রলোক একটু চুপ করে থেকে বললেন ," আমাদের আশেপাশে কত সাপ আছে যারা ঠিক সাপ নয় অন্যকিছু , সেটা আপনি জানেন কী ?"
"তার মানে আপনি বলছেন নাগিন বা ওই সিনেমা টিভি সিরিয়ালের মতো কেস । আপনি খুব মজার মানুষ কিন্তু"।
ভদ্রলোক অনেকক্ষন কোন কথা বললেন না। আমিও চুপচাপ বাইরের জগতে মন দিলাম।
প্রায় মিনিট কুড়ি পর ভদ্রলোক আমাকে বললেন ," আপনাকে একটা গল্প বলি শুনুন । ঠিক গল্প নয় , আমার নিজের জীবনের কথা। বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার ।"
দেখলাম পথ এখনো অনেকটা । গল্প শোনার প্রস্তাবটা মন্দ না।
লোকটি শুরু করল , " ছোটবেলায় বর্দ্ধমানের গুসকরায় থাকতাম। যখন নাইন টেনে পড়ি ,দুপুর বেলায় একদিন বাড়িতে দুটো সাপুড়ে এসে হাজির। বাবা অফিসে, দাদা কলেজে।বাড়িতে শুধু আমি আর মা । লোকগুলো বলল , 'মা জননী , আপনার বাড়ির পিছনে দুটো গোখরো আছে, দাঁড়ান ধরে আনছি'। তার কিছুক্ষন পর ঝাঁপিতে দুটো সাপ এনে হাজির। ঢাকনা খুলে বলল, 'এই দেখুন একদম টাটকা । বিষ দাঁতও ভাঙ্গা হয়নি'। বলে দাদা আমার হাতে একটা শিকড় ধরিয়ে সটান সাপের গায়ে চেপে ধরলো। হাতের নিচে ভেজা ভেজা পিচ্ছিল জিনিস নড়াচড়া করছে। আমি তো ভয়েই কাত । আমাকে বললো, ' ভয় নেই তোর। তুই তো রাজা হবি। তোর মধ্যে আমাদের নাগরাজকে দেখছি '। তারপর মাকে বলল , ' মা, তোমার এই ছেলে একদিন দেশে দশজনের একজন হবে। কিন্তু এর তো বড়ো ফাঁড়া আছে'।
মফঃস্বলের মা , বুঝতেই পারছেন। সে তো হাউমাউ করে বলে বসল , ' যা করার হয় করুন বাবা, ছেলেটাকে বাঁচান'।
ব্যাস, তারাও মউকা বুঝে হাতে একটা মাদুলি বেঁধে দিয়ে বারোশো টাকা নিয়ে পুনরায় ' এই ছেলে একদিন নাগরাজ হবে। বংশের নাম রাখবে' বলে চলে গেল"।
আমি হাসতে হাসতে বললাম ," আপনার গল্পেই তো প্রমানিত হয় , এরা জোচ্চোর। শুধু পয়সা রোজগারের অজুহাত"।
তিনি বললেন ," আপনাকে আসল কথাটাই বলি নি। ছোটোবেলায় যে সাপুড়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিল , তার মুখটা আমি ভুলি নি। কোনদিন ভুলবও না। ইনিই সেই সাপুড়ে।"
আমি বললাম ," তার মানে আপনি বলছেন, আপনাকে ছোটবেলায় যিনি ঠকিয়ে গিয়েছিলেন আজ পুরো কামরা ঠকিয়ে গেলেন।"
ভদ্রলোক একটু চুপ থেকে বললেন, "পুরোপুরি ঠকান নি, কিছুটা। যে সাপটাকে আপনি ঝুরিতে দেখলেন , সে ঠিক সাপ নয়, একজন মানুষ। যে মানুষগুলো সাপটাকে ছুঁল , তারাও একদিন সাপ হয়ে যাবে। আমি যে এতক্ষন আপনার পাশে বসে গল্প করছি, আপনি কি বুঝতে পেরেছেন আমিও একটা সাপ ?"
আমি হো হো করে হেসে উঠলাম ," তার মানে আপনি বলছেন ওই সাপুড়ে মানুষ থেকে সাপ তৈরি করে। আপনি একজন সাপ। আমি ছুঁয়েছি , তাহলে আমিও একদিন সাপ হয়ে যাব । তা ভারতের জনসঙ্খ্যার কত শতাংশ সাপ?" লোকটা মনে হয় অপমানিত হয়ে অন্য সিটে চলে গেল।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে এল। একের পর এক স্টেশনে কামরা ফাঁকা হয়ে গেল। থাকলাম শুধু আমি আর সেই ভদ্রলোক। ভদ্রলোককে আমার হয় অপ্রকিতস্থ অথবা ধড়িবাজ বলে মনে হচ্ছিল । ওনার সাথে আর কোন কথা বলি নি। উনিও আমার সাথে আর কোন কথা বলেন নি।
গাংপুর পেরোতে ভদ্রলোক সিট থেকে উঠে দরজার কাছে গেলেন । বর্দ্ধমান ঢোকার মুখে বাঁকানালার কাছে ট্রেন একটু থামতেই মনে হল যেন একটা সাপ ঝপাং করে দরজা থেকে নিচে পড়ল। আমি ছুটে দরজার কাছে গেলাম। দেখলাম সত্যিই একটা কালো সাপ হেলতে দুলতে ঝোপের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
আমি অসাড় শরীর নিয়ে ধপ করে সিটে বসে পড়লাম।
মনে হল আমার গায়ের চামড়াটা যেন স্যাঁতস্যেঁতে লাগছে।
দাঁতে জিভ ঠেকিয়ে দেখলাম, জিভটা কেমন চেরা চেরা লাগল। পা গুলো যেন আস্তে আস্তে সরু হতে হতে একসঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে।
আর খুব ইচ্ছা করছিল ট্রেন থেকে পাশের ঝোপে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
==================