গল্পঃ রমাকান্ত নামা ।। তাপসকিরণ রায়
রমাকান্ত নামা—আকর্ষণ বিকর্ষণ
তাপসকিরণ রায়
রমাকান্তর মাঝে অভিজ্ঞতা যেন গিজগিজ করছে। এটা তার পরিণত বয়েস। পঞ্চাশ পার করে এমত কমবেশি অনেকেরই হয়। জীবনের চাওয়া-পাওয়ার ধর্ম-কর্ম এ সবের মধ্যে দিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হতে থাকে। রমাকান্ত যেন বর্তমানে জ্ঞানের পূর্ণতায় বিরাজমান।
কৈশোর যৌবনের সময়টা বড় কোমল থাকে। এ সময়টা ঠিকঠাক পার করতে না পারলে জীবনের জটিলতা বেড়ে যায় ! রমাকান্তর জীবনে ছুটছাট বৈপরীত্য যে ঘটেনি তা নয়। কিন্তু সেই অবস্থা মনে ও শরীরে তেমন আলোড়ন সৃষ্টি করার আগেই তিনি নিজেকে সামলে নিতে পেরেছেন।
শান্ত শিষ্ট ভদ্র নিষ্ঠ এক রমাকান্ত কৈশোর যৌবন বিনা ফষ্টিনষ্টিতে কাটিয়ে দিয়েছেন--এটা কম কথা নয়।
ভালো মানুষের বিয়ের পর থেকে অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে বিয়ের পর প্রথম কটা বছর তো তুফানি যৌবনের ভেতর দিয়ে চলে। নতুন জীবনের অভিজ্ঞতা মন প্রাণ শরীরে শিহরণ জাগিয়ে যায়। একটা জৈব ভাবনা মনের মাঝে বসে যায়। মানুষের বেঁচে থাকার রসদ আসলে কোথায় ? খাওয়া পরা ছেড়ে দিলাম, তারপর ? নেশা, রং মানসের নেশায় তো মানুষকে হেসে খেলে বাঁচতে হয়। তবে সমাজ সংস্কারের মাঝে সংযম ব্যাপারটা থাকতেই হয়। না হলে যে স্বৈরাচার পশুরাজে পরিণত হত আমাদের এই সভ্য জীবন !
তবে ইচ্ছেগুলিকে সম্পূর্ণ ভাবে কে কবে দমন করতে পেরেছে! ভাবনার জন্যে মানুষের মনে রয়েছে পর্যাপ্ত খালি পৃষ্ঠা যাতে আঁকিবুকি হয়ে যায় সারা জীবনবৃত্তান্ত--নিজের অজান্তে। এই আকাশ, ফুল, বৃক্ষ, পাহাড়-পর্বত, বন-বনানী, প্রকৃতি কেন আমাদের মনকে দোলা দিয়ে যায় ? এর মধ্যেও ওই এক কথা নিহিত--আকর্ষণ বিকর্ষণ। তা না হলে সেই কালো মেয়েটা, যার নাকের সিকনি বাওয়া মলিন এক চেহারা দেখে রমাকান্ত একদিন তাকে ঘৃণায় সরিয়ে দিয়ে ছিলেন, আজ সে বয়সের চাকচিক্যে ঘষে মেজে তার সামলে এলে কেন তিনি আকর্ষিত হয়ে উঠলেন! দীর্ঘ আঠার বছর কেটে যাবার পর যে মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় হল সে আসলে অন্য কেউ নয়, ছোট বেলার সেই কাজল, এ সেই মলিন পোশাকের নাকের পোঁটা ছড়ানো মেয়েটাই !
--তুমি সেই কাজল ?
--হ্যাঁ যাকে আপনি ঘেন্নায় দুরে সরিয়ে দিতেন --
হাসলেন রমাকান্ত। দেখলেন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ধার চকচকে একটি মেয়ে ! প্রসাধন জড়িত এক দেহ নিয়ে একেবারে নায়িকা না হলেও পার্শ্ব নায়িকা তো হতেই পারে !
--কিন্তু আমি তো সে অবহেলা, ঘেন্নার কথা আজও ভুলতে পারিনি। তবে তার বদলা এখন তো আর নেওয়া যায় না! কথা কটা বলে হাসল কাজল, অমায়িক হাসিতে ভরে গেল তার চোখ মুখ গাল ঠোঁট। লাস্যময়ী হয়ে আবার বলে উঠলো, হ্যাঁ, এখন তো বৌদি আছে, আমার পরোয়া কে করে ?
--তা ঠিক, তবে আজ আর তুমি আমার কাছে অবহেলিত নও জেনো!
--আচ্ছা ? তাই ? চোখগুলি কাজলের জ্বলে উঠলো মনে হল নাকি !
ব্যাস মাঝখানের ওই দেখা তারপর আরও কটা বছর বউ ছেলে মেয়ে বাচ্চা নিয়ে হেসে খেলে চলে গেছে। মাঝে কাজলের সাথে দেখা হয়েছে কয়েক বার। তবে কথা বলার মত সুযোগ তেমন একটা ঘটেনি। মাঝে মধ্যে কেন জানি রমাকান্তর কাজলের মুখটা মনে পড়ে যেত। কাজল কথা বলে চটুল, ইচ্ছা অনিচ্ছার মাঝে কতটা সাজানো গোছানো অভ্যাসগত কথা তা তিনি জানেন না। তিনি যেটুকু জানেন, কাজল চাকরি করে, স্বামী কোন কোম্পানিতে আছে। রমাকান্ত আমন্ত্রিত ছিলেন অনেক আগে থেকেই। ছোট বেলার পরিচয়, মনের এক অন্য মাত্রায় ধরা থাকে।
রমাকান্তর বউ তত দিনে শক্ত পোক্ত হয়ে গিয়েছেন। অনেক সময়েই রমাকান্তকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেন না। কিন্তু পুরুষের ছ্যাঁক ছুঁক বাই যায় কোথায় ? শরীর কুটকুটানি তার জাত ধর্ম বলতে হয়। আর বউ তা জানে যে স্বামী দেবতা সুযোগ পেলেই ফুল মোহে ঢলে যাবেন। এমন কি অন্য মধু-কোরক ছুঁয়ে ফেলতেও তিনি দ্বিধাবোধ করবেন না! তাই স্বামী শাসনে এ সময় থেকে স্ত্রীকে বড় তৎপর থাকতে হয়।
এমনি একটা দিনের কথা, রমাকান্ত চুস্কি নিয়ে চা খাচ্ছিলেন কাজলের ঘরে বসে। কাজলের স্বামী ঘরে নেই, প্রাইভেট চাকরি, ফেরে নাকি অনেক রাতে। রমাকান্ত ভাবেন, কাজলের হাতে সময় থাকলেও তাঁর হাতে সময় কোথায় ? মনের দিক থেকে এই আধ ঘণ্টায় স্ত্রীর রশিটান কয়েকবার অনুভব করে নিলেন।
ইচ্ছেগুলির গভীরতা মাপতে চাইলেও বাস্তবে তা কতটুকু কার্যকরী হয় ! প্রেমিক চোর সাজতে হলে সে অভ্যাস উঠতি বয়সেই তৈরি হয়ে যায়। রমাকান্তর মধ্যে একটা সংস্কার হয়ে গেছে। তবু পরিবেশ পরিস্থিতি ভালো মানুষকে পঙ্কে ডুবিয়ে দিতে পারে।এমন অভিজ্ঞতা রমাকান্তর আছে। আজ পর্যন্ত পঙ্কে ডুব দেওয়া তাঁর ঘটেনি বটে কিন্তু ছোঁয়াছুঁয়ি ঘাঁটাঘাঁটির ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতার ঘাটতি নেই।
কাজলের হাত তাঁর হাত ছুঁয়ে গেল কয়েক বার। পুরু চামড়া ভেদ করেও শিহর চিন্তাগুলি খেলে যাচ্ছে।
--নিন চা নিন--চা নিতে গিয়ে হাত ছুঁল। রমাকান্ত পুলকিত হলেন।
কি ভাগ্য, আপনি আমার ঘরে এলেন--বৌদি এলেন না ?
--না, তার সময় কোথায়!
--তা ঠিক, এই দেখুন না--আজ শনিবার, আমার সারা দিন একাই কাটাতে হয়।
--কিন্তু আমি তো আর--হালকা কথাটা রমাকান্তর মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
--জানি, বৌদি আছেন, আপনার আসা সম্ভব নয়।
হাসলেন রমাকান্ত। সেই মেয়েটা, আজ শক্ত সমর্থ এক মায়াবী ছবি, প্রসাধনী সুন্দরী সেজে একেবারে তাঁর সামনে এসে বসে আছে। কাজল আয়ত চোখ, লাল সজ্জার প্রলেপ আবরণের নধর দেহ। গোলাপি লিপস্টিকের ঠোঁট। মৃদু হাসির মুদ্রায় যেন চাওয়া পাওয়ার লুকানো আবেদন। হালকা নেশায়িত এক পারফিউম ম ম ঘ্রাণ ঘরময় ছড়ানো। কিন্তু কেন ? এমনটা কেন ? তবে কি অন্য কারো অপেক্ষায় সময় গুনছিল কাজল ? কিন্তু তা কি করে হবে ! রমাকান্তকে বসতে বলেই তো কাজল স্নান ঘরে গেল। তারপর এই পরিপাটি প্রসাধন সজ্জা !
ভালো, রমাকান্তর পাকা ফল খেতে আপত্তি নেই, পেলে নিষিদ্ধ পাকা ফল খেয়ে দেবদেবীরাও কি কম পস্তাচ্ছেন ? যদিও মাঝখান থেকে একটা মন মাঝে মাঝে বলে ওঠে, খাস না রে, এ ফল বিষগ্রস্ত! তবু চৌর্যবৃত্তি যে সবার মানসেই পুঁতা থাকে ! সময় পরিচর্যায় সে বীজ অঙ্কুরিত হতে তৎপর হয়ে ওঠে।
--খেয়ে যাবে তুমি, কাজল আবেগ ভরে তুমিতে নেমে এসেছে!
কি করবেন রমাকান্ত। ঘণ্টা দুয়েকের দেরি হবার অজুহাত স্ত্রীর কাছ থেকে নেওয়া যেতে পারে বটে, কিন্তু তার বেশী না।
--রমা দা, এসো আমাদের ঘর দেখবে, দু বছর আগেই এ ফ্যাট নেওয়া।
ধীর পায়ে রমাকান্ত কাজলের পিছু নিলেন। ছন্দায়িত দোলে কাজল আগে আগে চলেছে।
--এই যে আমাদের শোবার ঘর—
সব ছেড়ে আগে শোবার ঘর! সুন্দর সাজানো গোছানো। সব চে সুন্দর লাগলো পাশে রাখা ড্রেসিং টেবিলটা। নকশা কাজের ফ্রেমের মাঝে বিরাট এক আয়না, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাজল পেছনের রমাকান্তর দিকে তাকিয়ে আছে। হাসির ছাপ তার চোখ মুখ ছাপিয়ে পড়ছে। আর সহ্য হচ্ছিল না। কাজলের আবেদন নিবেদন যেন অসহ্য ভাবে ধরা পড় ছিল। রমাকান্ত এবার এগিয়ে গেলেন। আয়নার কাঁচ দুটি দেহ ছুঁয়ে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান ইচ্ছেগুলি জেগে উঠছিল। কাজলের চোখে চোখ রাখলেন রমাকান্ত, সে আকর্ষ দৃষ্টি নিয়ে রমাকান্তর দিকেই তাকিয়ে আছে। তিনি আলতো হাত রাখলেন কাজলের কাঁধে। কোন বাধাবন্ধ নেই। এবার ঠোঁটের ছোঁয়া পেতে ঠোঁট এগিয়ে নিলেন রমাকান্ত। চুম্বনপর্ব শেষ হল। আরও এগিয়ে যাবার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে রমাকান্ত জড়িয়ে ধরলেন কাজলকে। কিন্তু কাজল এবার এক ঝটকায় সরে গেল। না রমা দা, আর না, যদি কিছু মনে না করো--আমার পাঁচ শ টাকার খুব দরকার ছিল।
থমকালেন রমাকান্ত,থতমত খেলেন, টাকা !
হ্যাঁ, টাকা, আমায় তো চলতে হবে--আয়েশ আরামের জীবন চালাতে হবে, বিনে পয়সায় আমি ভালবাসা বিলাতে পারি না!
সমস্ত উজান অবস্থা ভাটায় গড়িয়ে যাচ্ছিল। সব ভালো কিন্তু এমনি পয়সার বিনিময়ে ? তার মানে স্পষ্টবাদী কাজল আসলে দেহ পসারিণী ? রমাকান্তর দেহে কোথাও যেন ভাংচুর খেলা চলছে। বর্তমান ভাবনাগুলি তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। তিনি কাজলের ঘর ছেড়ে চুপচাপ রাস্তায় বেরিয়ে এলেন।
সমাপ্ত