দার্জিলিং ভ্রমণঃ লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ
(শেষ পর্ব )
আমাদের দার্জিলিং ভ্রমণ শেষ করে পরদিন আমরা সবাই ব্যাগ পত্র গুছিয়ে চললাম লাভার উদ্দেশ্যে । হোটেলের বিল মিটিয়ে স্নান খাওয়া সেরে গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে বেলা নটা বেজে গেল। দুদিকে বন-জঙ্গল পাহাড়ি রাস্তার বুক চিরে এগিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। আমি উদাস ভাবে চেয়েছিলাম বাইরের দিকে। জনাকীর্ণ দার্জিলিং থেকে বাইরে আসতে পেরে মনটা খুশিতে ভরে উঠেছিল। নির্জন পথে মাঝেমধ্যে কয়েকটা ফিরতি গাড়ি ও মোটরবাইক দেখে বেশ ভালো লাগছিল। এহেন অপরিচিত নির্জন রাস্তা য় সত্যি কথা বলতে কি আমার মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। তিস্তা নদীর পাড়ে এসে আমরা টিফিন করলাম। তখন সম্ভবত বেলা একটা। প্রিয়াংশু (পুষ্পেন্দু কাকুর ছেলে) তিস্তার পারে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল। মা-বাবা দাদু দিদা সহ আমরা সবাই খরস্রোতা তিস্তার সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করলাম। পাহাড়ি খরস্রোতা তিস্তার প্রবাহমানতা আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল। মনে হল অপূর্ব সৌন্দর্যের স্বর্গভূমি রচনা করেছে যেন কেউ।
এখান থেকে লাভা এখনো অনেক দূর। পৌছাতে পৌছাতে প্রায় চারটে বেজে গেল ।দার্জিলিং থেকে লাভা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানকার নির্জনতা আপনাকে মুগ্ধ করবেই করবে। এখানে দুটো হোটেলে আমরা উঠেছিলাম - লাভা ভিউ ও টপ হিল। ওরা সন্ধ্যায় চা ও মম দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করল। রাত্রে পেলাম ফ্রাইড রাইস ও মাটন কষা । তৃপ্তিভরে খেয়ে সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতেআমরা সেদিনের মত শুয়ে পড়লাম।
পরদিন আমরা লোলেগাঁও রওনা হলাম। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। অত্যন্ত খারাপ। ভাঙ্গা চোরা সিমেন্টের রাস্তা , কোথাও বা এবড়োখেবড়ো খোওয়া দেওয়া মাটির রাস্তা। তার ওপর দিয়ে ছির ছির করে শুরু জলের ধারা বয়ে চলেছে । বোধহয় পাশের পাহাড় থেকে নেমে আসছে। দুদিকে পাইন ও ঝাউ গাছের সারি। লাভা থেকে লোলেগাঁও এর দূরত্ব মাত্র ২৭ কিলোমিটার । বাজে রাস্তার জন্য আমাদের সময় লেগে গেল প্রায় দু'ঘন্টা । এখানে পৌঁছে আমরা একটি ভিউ পয়েন্ট এ গেলাম । সেখান থেকে দূরের শহর দেখা যাচ্ছিল। এখানকার একটি ছোট্ট পার্কে বুদ্ধদেবের মূর্তি দর্শন করে আমরা এগিয়ে চললাম ঝুলন্ত দোলনা দর্শনে। এ রাস্তায় গাড়ি যাবে না । তাই আমাদের পায়ে হেঁটে যেতে হলো। বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে কিন্তু বেশ লাগছিল। বিশেষত এতক্ষণ গাড়ি জার্নি করে আসার পর । বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে দেখলাম একেবারেই নির্জন ঘন অরণ্য। আমাদের মত আরেকটি দল কলকাতা থেকে এসেছ। তারাও চলেছে ঝুলন্ত দোলনা দর্শনের প্রত্যাশায়। কিন্তু দোলনাটা বন্ধ। চড়বার উপায় নেই। কাঠের পাটাতন এর সঙ্গে লোহার তার দিয়ে নিচ থেকে ক্রমশ উপরে র গাছের সঙ্গে বাঁধা। নিচে কোন সাপোর্ট নেই। সম্পূর্ণ ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে দোলনা টি। সাধ হল একবার উঠে দেখতে কিন্তু দরজার মুখটা টিন দিয়ে বন্ধ করা । সাইনবোর্ডে লেখা "দোলনায় প্রবেশ নিষেধ ।" হতাশ হয়ে আমি জঙ্গল দেখতে লাগলাম। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দর্শন করে স্থানীয় দোকানে চা ও মম খেয়ে আমরা হোটেলে ফিরলাম বেলা তিনটার সময় ।
পাঁচ টার আগে বাবা ও কাকু বুদ্ধ মন্দির দেখতে যাওয়ার জন্য আমাদের সবাইকে প্রস্তুত হয়ে থাকতে বললেন। কারণ পাঁচটায় গেট বন্ধ হয়ে যায়। আমরা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বুদ্ধ মন্দির দর্শন করতে গেলাম । বাবা মা কাকু কাকিমা দাদু দিদা জেঠু জেঠিমা প্রিয়াংশু- সবাইকে নিয়ে বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে বেশ কিছু ছবি তোলা হলো। এখানে একটি আশ্রমিক বিদ্যালয় আছে। আবাসিক স্কুল হওয়ায় ছেলেরা পড়াশোনা ও প্রার্থনা দুই ই করে । বাবা এদের একজনের সঙ্গে আলাপ জমি য়ে বেশ কয়েকটা ছবিও তুললেন । ওরা বলল এখান থেকে ভালো ভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। কিন্তু তার জন্য ভোর ভোর আসতে হবে। সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মেলেনি। তাই আমরা ঠিক করলাম পরের দিন ভোর বেলায় এসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন করব ।
এখানে এখন বেশ ঠান্ডা। টেম্পারেচার ৬ ডিগ্রীর আশেপাশে। তবু আমি, বাবা ও পুষ্পেন্দু কাকুর সঙ্গে সন্ধ্যায় চাঁদনী রাতে জঙ্গলের শোভা দেখবো বলে ঠিক করেছিলাম । কিন্তু রাতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। তাই আমি আর বের হলাম না। মায়ের সঙ্গে হোটেলের ঘরেই থেকে গেলাম। যদিও বাবা ও কাকু বের হয়েছিলেন।
পরদিন ভোর বেলা আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন করতে গেলাম । এখান থেকে ভালই দেখা যায় । পাহাড়ি কন্যা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। দেখে মনে হয় যেন কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছ।বাবা , কাকু ,জেঠু ক্যামেরা তে বেশ কিছু ছবিও তুলে ফেললেন।
সেদিন কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন করে ঠিক হল এবার এখান থেকে আমরা ছাঙ্গুফলস দর্শন করে রিশপ এর উদ্দেশ্যে রওনা হব। লাভাতে নাকি আর দেখার মত তেমন কিছু নেই।
রিশপ যাওয়ার পথে পাহাড়ি জঙ্গল এর সৌন্দর্য আপনাকে আনমনা করে দেবেই ।অনেকটা পথ ঘুরে ঘুরে বেলা এগারোটার সময় আমরা ছাঙ্গুফলসে পৌছালাম । সমতল ভূমি থেকে অনেকটা নিচে এই ছাঙ্গু -পাহাড়ি ঝরনা। নামার সময় কোন কষ্ট নেই। কিন্তু ফিরতি পথে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে উঠতে হয়।
হাতে একটা লাঠি নিয়ে আমরা সবাই একে একে নেমে পড়লাম। জলপ্রপাত এর ভয়ঙ্কর আওয়াজ চারিদিকে। ঘন কুয়াশার আস্তরন এর সঙ্গে যেন কেউ হঠাৎ বৃষ্টির চাদর বিছিয়ে দিয়েছে । অবাক হয়ে দর্শন করলাম" ঝর ঝর ঝরনা /সুন্দরী ঝরনা"। শ্রবন করলাম তার কলকাকলি।
বিশ্রাম নিতে নিতে উপরে উঠে, টিফিন সেরে আমরা আবার রিশপ এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পাহাড়ি রাস্থা এঁকেবেঁকে চলেছে ক্রমশ ওপরের দিকে। চড়াই উতরাই রাস্তা পার হয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে । জঙ্গলের মাঝে একটি গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল । ফলে বেশ কিছুটা সময় আমাদের দাড়িয়ে থাকতে হল। তারপর দেখলাম পেছনে সারি সারি আরো অনেকগুলো গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে । সেই গাড়িটি কে পাশ করানোর জন্য দাদু কাকু জেঠু বাবা এবং আরো অনেক যাত্রী সবাই মিলে হাত লাগিয়ে ঠেলতে লাগলো। এভাবে গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে সরিয়ে দিয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। অনেক খুঁজতে খুঁজতে প্রায় সন্ধ্যার মুখে আমরা রিশপের গ্রীন ভিউ হোটেল খুঁজে পেলাম।
এটি একটি পাহাড়ি গ্রাম । অপূর্ব সাজানো। অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। প্রত্যেক হোটেলের সামনে ফুলের বাগান এবং নির্জন পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে ই। এখানকার নির্জন সৌন্দর্য মুহূর্তে আমাকে দার্জিলিংয়ের জনো অরণ্য থেকে এক অন্য জগতে নিয়ে গেল । লাভার থেকেই এখানের পরিবেশ অনেক বেশি মনোরম । এখানে আমরা মাত্র এক রাত থাকতে পেরে ছিলাম । ইচ্ছা ছিল আবার এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন করব ।
কিন্তু পরেরদিনই আমাদের ফেরার টিকিট কাটা ছিল। সকাল 9 টায় গাড়ি। তাই আর সময়ের অভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হয়নি। রাতে এরা ভালোই খাওয়ার ব্যবস্থা করে ছিল । আগেই আমাদের ড্রাইভার রাত তিনটের সময় গাড়ি ছাড়ার কথা জানিয়ে দিয়েছিল। অগত্যা ভোর ভোর উঠতে হলো।
ভোরের রিশপ কুয়াশায় ভরা। এখন এখানে টেম্পারেচার নয় ডিগ্রী । আমরা আবারও আমাদের তল্পিতল্পা গুছিয়ে বের হয়ে পড়লাম।সকাল নয় টার ট্রেনে কলকাতা ফিরতে হবে । তাই ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন না করে ই আমরা কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
অন্ধকার রাস্তার বুক চিড়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে নিস্তব্ধে । ঘুম ঘুম চোখে কুয়াশায় ঢাকা পাহাড়ি গ্রাম দেখে মনে হল যেন কে আলোকমালায় সাজিয়ে দিয়েছে। দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট আলোকমালায় সজ্জিত কুঠি গুলোকে অপূর্ব সুন্দর লাগছিল। মনে হচ্ছিল যেন দীপাবলীর আলোকমালায় সজ্জিত।
পাহাড়ি রাস্তা ঘুরে ঘুরে আমাদের গাড়ি যখন সমতল নেমে এলো তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে । সকাল সাড়ে সাতটায় আমরা শিলিগুড়ি স্টেশনে এসে পৌছালাম। ওখান থেকে সকাল নয় টার তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেসে কলকাতা ফিরলাম।
কলকাতা স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল। দার্জিলিংয়ের এই অপূর্ব স্মৃতি আমার মনে চিরকাল সম্মুজ্জ্বল থেকে যাবে।
দেবাঞ্জন প্রামানিক
সোনারপুর