আত্মাহুতি
সুনন্দ মন্ডল
গলির মোড়টা শান্ত। লোকজন চায়ের দোকানে তেমন কই? সবাই বুঝে গেছে মহামারী রোগ থেকে বাঁচতে ঘরে থাকায় শ্রেয়। পরিবারের সবাই অন্তত একসাথে থাকবে! সকলের চোখে কী যেন আতঙ্ক। ভয় আর অসহায়তার দোটানা।
এন.পি রোড ধরে একা ফিরছিল মানালি। সন্ধ্যেবেলা। আসন্ন রাত্রির বুকে ভর করে বাড়িমুখো সে হোঁচট খেল। পড়ে গেল। উঠে দেখল একটা গাছের গুঁড়ি। এদিন অবশ্য বিকেলে একটু বৃষ্টি হয়ে গেছে। তবে ঝড়টা ছিল বেশি। তাতেই হয়তো ভেঙে পড়েছে গাছটা। রোজই একই সময়ে ফেরে সে। কিন্তু আজ কেমন যেন একটু ভয় হল তার।
মেঘলা আকাশ ছিল, তাই সন্ধ্যা প্রদীপেই ঘন অন্ধকার নেমেছে। টর্চ জ্বেলে সামনের দিকে এগিয়ে চলল সে। একটু গিয়ে গলির মোড়ে নামতেই কাদের গলার আওয়াজ শুনতে পেল? কেউ তো নেই! জনশূন্য রাস্তা। চায়ের দোকান বন্ধ। পাশের ওই অপেক্ষাগৃহটাও অন্ধকার। বোঝায় যাচ্ছে বিদ্যুৎবিহীন এলাকা।
হঠাৎ কয়েকজন মানালিকে ঘিরে ফেলল। ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে ছিঁড়ে গেল চুরিদারের হাত। ওড়নাটা আগেই নিয়ে নিয়েছিল একজন। ছুটে পালাতে গিয়েও বাঁচাতে পারল না সেদিন নিজেকে। জনহীন, আলোহীন পথেই ছিঁড়ে খেল ওরা। বিবস্ত্র করে ধর্ষন করল অমানবিক পশুর দল। জ্ঞান হারিয়ে পথেই পড়ে থাকল মানালি।
রাত বাড়তে থাকলে চিন্তায় ভেঙে পড়ে পরিবার। খুঁজতে গিয়ে রাস্তা থেকে মানালির অবশ দেহটাকে বাড়ি নিয়ে এল। তারপর কিছুতেই জ্ঞান ফিরে না এলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। অনেক চিকিৎসার পরে জ্ঞান ফিরল। পুলিশ এল। এফ.আই.আর হল। ধরা পড়ল ধর্ষকদের পান্ডা। সে আবার স্থানীয় দলীয় কর্মী রবিন বাবুর ছেলে। রাজনীতির রঙ মাখা চেহারা তাঁর।
পুলিশি হেফাজত থেকে ছেড়ে দেওয়া হল। নির্বিচারে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল সে। এদিকে 'করোনা' পেশেন্টদের সাথে হাসপাতালের একই বেডে মৃত্যু হল মানালির। রিপোর্ট দেওয়া হল করোনা পজিটিভ। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট মিথ্যে করে প্রচার করে দেওয়া হল, মানালির পরিবারের অভিযোগ ভিত্তিহীন। এমনকি তার দেহটাকেও পরিবারের হাতে দেওয়া হল না। তখন লজ্জায়, অপমানে, শোকে ক্ষত বিক্ষত হতে থাকল মানালির পরিবার।
এই ঘটনার প্রায় পনের দিন পরে লকডাউনের দ্বিতীয় দফায় আরেকটি ঘটনা ঘটল। রবিন বাবু হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। গলা খুসখুস, হালকা কাশির সাথে বুকে টান। ভর্তি হলেন হাসপাতালে। হাই প্রেসার ছিলই অনেকদিন থেকে। প্ৰথমে অন্যান্য করোনা রোগীদের মতোই চিকিৎসা চলছিল। তাঁর রক্ত পরীক্ষার জন্য পাঠানো হল। তিনদিন তো অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু অপেক্ষা করতে পারলেন না রবিন বাবু। বুকের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে অকালেই মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সেই মারা গেলেন। চারঘন্টা পরেই মৃতদেহ তুলে দেওয়া হল পরিবারের হাতে। তিনদিন পরে তাঁর রক্তের রিপোর্ট এল করোনা পজিটিভ। ডাক্তারদের মাথায় হাত। রাজনৈতিক চাপে পড়ে তারা যদিও হার্ট এট্যাক এ মৃত্যু বলেই চালিয়ে দিলেন।
আরও কিছুদিন পর সেই রবিন বাবুর পরিবার থেকে গোটা গ্রামে ছড়িয়ে গেল করোনা ভাইরাস। বেড়ে গেল আক্রান্তের সংখ্যা। এভাবে গোটা রাজ্যে যতই সংখ্যাটা বাড়ুক, আর যতই মারা যাক! না জানি কত মানালি আত্মাহুতি দিতে হয়েছে!
--------------$-------------
সুনন্দ মন্ডল
কাঠিয়া, মুরারই, বীরভূম
8637064029