গাছ মা ছেলে ছড়ালো
প্রিয়ব্রতবাবু তাঁর সুন্দর সবুজ বাগানের সাথে রং মিলিয়ে ছবির মত তাঁর বাংলো বাড়িটারও রং করিয়েছেন সবুজ। মনটাও তাঁর এখনও সবুজ, তাই তো তাঁর বন্ধু যত নবীনের দল। পাড়ার, বেপাড়ার যত কিশোর-কিশোরীদের দল রোজ আসে এই অবসরপ্রাপ্ত জীববিদ্যার শিক্ষকের কাছে। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল কত খেলবার সরঞ্জামই না তিনি কিনে রেখেছেন এই কচি-কাঁচাদের জন্যে। স্ত্রীবিয়োগের পর বেশ ভালই সময় তাঁর কাটে এদের নিয়ে। অনেক বারণ করা সত্ত্বেও ছেলে যখন বিদেশেই বিদেশী স্ত্রী নিয়ে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করল তখনই প্রিয়ব্রত ঠিক করলেন ছেলের পাঠানো অর্থ তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খরচ করবেন- তাদের ভারতবর্ষ চেনাবেন, বাংলাকে ভালবাসতে শেখাবেন। তিনি নিয়মিত বছরে দুটি শিশু-কিশোর পত্রিকা 'রঙিন প্রজাপ্রতি' বার করেন যেখানে কেবলমাত্র শিশু-কিশোররাই নিজের উপযোগী গল্প, কবিতা, ভ্রমণ, ছড়া কত কিছুই লেখে। তাদের কল্পনার আকাশ ডানা মেলে রঙিন প্রজাপতি হয়ে যায়। বছরে দুটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন বেশ ঘটা করে যেখানে পত্রিকাই শুধু প্রকাশ হয় না কিশোর কিশোরীরা নাচ, গান, কবিতা, হাস্যকৌতুক, নাটক কত কিছু করে। মহড়া চলে সারা বছর ধরে প্রিয়ব্রতবাবুর বিশাল হলঘরে।
আজ বিকেলবেলা হঠাৎ এল ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি। ছোট্ট সোনার দল খেলা ছেড়ে চলে এল প্রিয়ব্রতদাদুর হলঘরে, ঘিরে ধরল দাদুকে-তারা জানে বৃষ্টি পড়লেই খেলা বন্ধ আর দাদুর ঝুলি থেকে টুপ টুপ করে ঝরে পড়বে কত বিচিত্র গল্প- কত যে অজানা দুয়ার খুলে যাবে, আর নবীনরা পৌঁছে যাবে সত্যি রূপকথার এক আশ্চর্য জগতে। তবে একটা শর্তে দাদু রাজি হলেন- প্রথমেই বর্ষা-বন্দনা করতে হবে। আসর ভালই জমে উঠল। বাবান আর গুনুর বর্ষার গান, রুমির নাচ আর ঝুমকির স্বরচিত বর্ষার ছড়া দিয়ে বর্ষামঙ্গল একদম জমে গেল। এবার প্রিয়দাদু তাঁর গল্পের ঝুলি খুললেন, বললেন আজকের গল্পের বিষয় কি জানিস, গাছের ভবিষ্যৎ ছেলেমেয়ের ছড়িয়ে পড়া যাকে বিজ্ঞানে বলে বীজের বিস্তার।'' ''সেটা কি দাদু?''- সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল। দাদু বললেন, "বীজের বিস্তার হল আসলে গাছের বীজ পেকে যাবার পর সেটির বিভিন্ন উপায়ে গাছটি থেকে ছড়িয়ে পড়ার নানান কৌশল।"
গুনু বলে ওঠে, ''কেন দাদু, আমরা তো মাকে ছাড়তেই চাই না, মাও তো আমাদের দূরে ছাড়তে চায় না, তবে গাছ কেন তাদের ভবিষ্যৎ সন্তানদের দূরে পাঠাবার ব্যবস্থা করে?''
ঝুমকি বিজ্ঞদের মত বলে ওঠে, ''আরে বাবা বুঝতে পারছিস না, গাছের তলায় বীজগুলো পড়লে সূর্যের আলো পাবে?''
দাদু বলেন, ''ঠিক তাই, তবে শুধু সূর্যালোক নয়, খাদ্য, জল, জায়গা সবকিছুরই ঘাটতি হয়। তাই গাছ মা চায় তার ছেলেপুলেরা দূরে দূরে বেড়ে উঠুক আর তার জন্যে প্রকৃতি তাদের কতরকমের কৌশলেরই না ব্যবস্থা করেছে।''
-''কেমন দাদু কেমন?''– সবাই চেঁচিয়ে ওঠে।
- যেমন দেখ, নারকেল গাছ, বেশির ভাগই সমুদ্রের ধারে হয়, কিন্তু যখন নারকেল পেকে জলে পড়ে, সে কিন্তু ডোবে না।
ঝুমকি বলে, ''হ্যাঁ দাদু ঐ যে ছোবড়াগুলো আছে ঐটাই তো ওকে ভাসিয়ে রাখে- আমি দেখেছি- আমাদের বাগানে অনেক নারকেল গাছ ছিল- এখন তো মোটে দুটো আছে।''
রুমি কটকটি বলে ওঠে, ''তুই তো সবই দেখেছিস, নারকেল ছোবড়া দিয়ে যে গদি হয় তা কি জানিস?''
দাদু ঝগড়া শুরু হবার উপক্রম দেখে বললেন, ''ঠিক আছে, ঠিক আছে, গাছের উপকারিতা নিয়ে অন্য একদিন গল্প হবে- এখন যেটা বলছি শোন, কোন বীজের থাকে কাঁটা, কারুর বা হুক, প্রাণীদের গায়ে আটকে যায় আর নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।''
রুমি বলে, ''দাদু, চোরকাঁটা আমার লংস্কার্টে খুব লেগে যায়, মা খুব বকে-ও, এটা তাহলে বীজের বিস্তারের কৌশল, আমি তো ছাড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলি- এবার থেকে মাঠে ছড়িয়ে দেবো।'' এভাবেই গল্পের মধ্যে দিয়ে গাছের বীজের ছড়িয়ে পড়ার নানান মজার পদ্ধতি খুব সুন্দরভাবে প্রিয়দাদু নাতিনাতনিদের মগজে পুরে দিলেন, যা তারা কখনই ভুলবে না। গল্প শেষে বৃষ্টি থামলে যে যার বাড়ি চলে গেল। ঝুমকিও নানা কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথ ধরল। তার কৌতুহলের যেন শেষ নেই, সীমা নেই।
সন্ধ্যেবেলা পড়াশোনা সেরে গরম গরম খিচুড়ি খেয়ে ঝুমকি ডায়রী লিখতে বসল। এই সুঅভ্যাসটা প্রিয়দাদুই ধরিয়েছেন সবাইকে। কিন্তু সকালবেলা ঝুমকি আম কুড়তে গিয়ে একি বিভ্রাটে পড়ল! আমগাছটা কথা বলছে, ওমা কি কাণ্ড! ঐ তো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, ঝুমকি কান খাড়া করে শুনল, গাছটা বলছে, ''শোন ঝুমকি, আমি এখন থেকে তোমায় আর একটিও আম কুড়ুতে দেব না।''
-কেন দেবে না গো আমমামী?
-কেন দেবো? তোমরা আমার সব বন্ধু আমগাছগুলোকে কেটে ফেলেছো, বহুতল ফ্ল্যাট বানাচ্ছো।
- ঠিক আছে আমমামী, বাবাকে বলবো।
-কাঁঠালদাদাকেও কেটে ফেলবে শুনছি?
-না না, আমি কিছুতেই কাটতে দেবো না, আমি কাঁঠাল খেতে খুব ভালবাসি। দাদাভায়েরও মত নেই। ও আবার এঁচোড়ের ডালনা খেতে খুব ভালবাসে। দাও না আমমামী আমগুলো কুড়োতে।
-না না খবরদার বলছি!
-কেন কুড়োবো না, আমি তো গাছ থেকে নেবো না, মাটিতে যেগুলো পড়ে আছে, তা থেকেই নেবো গো।
যেমনি ঝুমকি আমগুলো কুড়োতে গেছে কি আজব ব্যাপার! ডালপাতা সমেত আমগাছটা ঝুমকির ওপর ঝাঁপিয়ে এলো। প্রায় ছুটতে ছুটতে ঝুমকি কোনরকমে পালিয়ে বাঁচল। সব বন্ধুদের ঝুমকি ঐ ভয়ঙ্কর আমগাছটার কথা বলল। কিন্তু সবাই হো হো করে হেসে উঠল। ঠোঁটকাটা রুমি তো বলেই ফেলল, 'পড়ে পড়ে তোর মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। চল তো গিয়ে দেখি।'
সবাই চলল ঝুমকিদের বাগানে। পাঁচিল ঘেরা মস্ত বাগান ঝুমকিদের। কিন্তু শহর থেকে প্রমোটাররা এসে রাস্তার ধারে বাগানের দিকটায় বেশ কিছু গাছ কেটে মস্ত একটা বহুতল ফ্ল্যাট গড়ে তুলছে। চুপি চুপি পাঁচিল ডিঙিয়ে ছোটোদের দল ঢুকে পড়ল বাগানে। উঃ কত পাকা পাকা আম আমতলাতে পড়ে আছে। আরে একি দেখছে তারা! পাখিগুলো বসলেও গাছটা ডাল ঝাপটিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে। ছোট্ট বাবান তো বলেই ফেলল, ''গাছও কি মানুষের মত হিংসুটে হয়ে গেল?'' তবুও ঝুমকি, গুনু, রুমি, বাবানকে নিয়ে আম কুড়োতে গেল। গাছটা এবার দ্বিগুন বেগে ঝাঁপিয়ে এল! ছুটতে ছুটতে তারা সমস্ত ঘটনা ঝুমকির মা বাবাকে বলল। কিন্তু তাঁরা তো হেসেই কুটোপাটি। একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে ঝুমকির মা ছুটলেন বাগানে। কিন্তু সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। ঝুমকির মা ছুটে পালাতে পারলেন না, তাঁর ডান হাতে একটা আমডাল আঘাত করল- মা যন্ত্রণায় কাতরে উঠলেন। আমগাছটা বলে উঠল, ''গাছ কাটার জন্যে তুমি দায়ী সুলেখা।'' ঝুমকি অবাক হয়ে বলে, ''গাছটা মায়ের নামও জানে। সুলেখার চিৎকারে ঝুমকির বাবাও ছুটে এলেন। সুলেখা তাঁকে আমগাছের তলায় আসতে বারণ করলেন, কিন্তু অমিয়বাবু শুনলেন না, যেমনি তিনি একটা আমে হাত দিয়েছেন অমনি একটা আমের ডাল সপাটে এসে অমিয়বাবুর পিঠে আঘাত করল। গাছটা ছড়া কেটে বলে উঠল,
''দেখ তো কেমন সাজা রে/ গাছ কাটার মজা রে।"
তাড়াতাড়ি সব্বাই মিলে বাড়ির ভেতর চলে এল, আর কেউ ভয়ে আমতলায় যেতে সাহসই পেল না। সবাই ভাবল গাছটাকে বোধহয় গাছভূতে ধরেছে। প্রিয়দাদু কিন্তু বললেন,
''থাম থাম তোরা, দেখ না কি হয়-/ নিজের দোষে সে হবেই হবে ক্ষয়।"
গরম কেটে গেল। নামল বর্ষা। আমের বীজ থেকে অনেক ছোট্ট ছোট্ট চারা বেরল। কিন্তু চারাগুলোর মধ্যে বাধল প্রচণ্ড ঝগড়া। খাবার, জল, রোদ সবকিছুতেই টান পড়তে লাগল, দেখা দিল স্থানাভাব। শেষে তারা ঠেলাঠেলি, এমনকি মারামারি করতে লাগল। গাছগুলো দুর্বল হয়ে পড়তে লাগল রোদের অভাবে- কারণ তারা খাদ্য তৈরী করতে পারছিল না, জায়গার অভাবে বাড়তে পারছিল না। প্রচণ্ড সংগ্রামের পর অবশেষে দু প্রান্তের দুটি চারাগাছ বাঁচল, কারণ তারা কিছুটা সূর্যের আলো আর স্থান পেয়েছিল। গাছমায়ের সেকি কান্না! ঝুমকি কান্নাকাটি শুনে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, ''কি হয়েছে গো আমমামী?'' গাছটা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ''আর বলো না ঝুমকি, তোমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমি নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে এনেছি- আমি কাউকে আম খেতে না দিয়ে কি ভুলই করেছি- আমার কোন বীজই কোথাও ছড়ায়নি- ফলে সবাই আমার তলায় থেকে গেছে- আর তাই জল, রোদ, বাতাস, মাটি, খাবারের অভাবে আমার সন্তানরা সব মরে গেছে- কেবল দুধারে দুটো গাছ মাত্র বেঁচেছে।'' আমমামীর কান্না দেখে ঝুমকিরও খুব কান্না পেয়ে গেল- সেও কাঁদতে লাগল। আমগাছটা বলল, ''আর কাউকে হিংসা করব না- তুমিও কোরো না।''
ঝুমকি বলল, '' না, আমমামী- আর গাছ কাটবো না।''
ঝুমকির কান্না শুনে ছুটে এলেন সুলেখা, বললেন-''এই ঝুমকি, ঘুমের ঘোরে কাঁদছিস কেন? ওঠ, দেখ, কত বেলা হয়ে গেছে- এই জন্যে বলি, অত রাত জেগে পড়িস না।'
===============================