কিশোর গল্প ।। সৈকত মাজী
টুয়েলভথ ম্যান
ক্রিকেট,ফুটবল প্রত্যেক খেলাতেই ১৫ জনের টিম করা হয় সেখান থেকে প্রথম একাদশ বেছে নেওয়া হয় খেলার জন্য। কিন্তু প্রথম একাদশের পরেও একজন দ্বাদশ ব্যক্তি থাকেন যিনি সবসময়ই প্রথম একাদশ কে সাহায্য করে থাকেন, সে খেলার বিরতিতে বা ওভার শেষে লেবু জল দিয়েই হোক বা কোনো ক্লান্ত ফিল্ডারের পরিবর্ত হিসেবে মাঠে নেমে ফিল্ডিং করেই হোক। কিন্তু এই দ্বাদশ ব্যক্তির গুরুত্ব না দর্শক বুঝতে পারে না সেই ব্যক্তি নিজে বুঝতে পারে। আজ আমাদের গল্প সে রকম একজন দ্বাদশ ব্যক্তিকে নিয়েই ।
শীতের শুরু। স্কুলগুলোতে অ্যানুয়াল স্পোর্টস ডে উদযাপন এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে । আর কিছু দিনের মধ্যে Inter School Cricket tournament ও শুরু হয়ে যাবে। সৌরভ এই সব কথা ভাবতে ভাবতে কোচিং থেকে ফিরছিল। সৌরভের বাবার বদলির চাকরির সুবাদে যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন ওরা চলে আসে বাঁকুড়া শহরে। আগে থাকত মালদা শহরে। মালদা শহরে থাকার সময়েই ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগটা জন্মায় সৌরভের। স্কুলের জুনিয়র টিমে বরাবর ওপেন করেছে সে। শেষ দু'বছর তো জুনিয়র টিমের ক্যাপ্টেন ও ছিল। আর সেই দু'বছরই স্কুলকে চ্যাম্পিয়ন করেছিল সৌরভ।কিন্তু সেসব এখন স্বপ্ন, সেই মালদা টাউন হাইস্কুল, সেই ওদের টিম সব এখন স্বপ্নের মতো মনে হয় সৌরভের। সেই যেবার ওরা ফাইনালটা জিতল তখন অমিয় স্যার সৌরভকে একটা সুন্দর ক্রিকেট ব্যাট গিফট করেছিল, সেটা আজও সৌরভ যত্ন করে রেখেছে। অমিয় স্যার সৌরভের বরাবর পছন্দের স্যার, ওনার কাছে শেখা শট গুলো ব্যাট হাতে সবসময়ই সৌরভকে সাহায্য করেছে। হঠাৎ সৌরভের কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো, চোখের সামনে ভেসে উঠল অমিয় স্যারের মুখ টা, মালদা টাউন হাই-এর খেলার মাঠটা, সেমিফাইনালে একাহাতে ম্যাচ জেতানোর পর সৌরভকে কাঁধে তুলে ওর বন্ধুদের নাচটা, নিজের অজান্তেই সৌরভের চোখে জল এসে গেল।
-"কিরে ওপেনার চল্লি কোথায়?" অমিত ব্যঙ্গ করে জিজ্ঞেস করল কথাটা।
অমিতকে দেখেই সৌরভের মনখারাপটা আরো কয়েকটা ঘর বেড়ে গেল। অমিত,অমিত সিংহ, হিন্দু স্কুলের বর্তমান ক্যাপ্টেন, ওর সাথে একই ক্লাসে পড়ে, একদম পছন্দ করেনা সৌরভ সবসময়ই ছোটো করে কথা বলে।
-"বাড়ি ফিরছি"- কোনো রকমে জবাব দিল সৌরভ।
-"কাল থেকে সিলেকশন শুরু এবার সন্তোষ স্যার কে বলে দেখ যদি 1st eleven এ আসতে পারিস" হাসতে থাকে -" তুইতো আবার স্যারের বেস্ট ওপেনার তাও....." হাসতে হাসতে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।
শেষ কথাটাতে সৌরভের চোখে জল চলে আসে। আজ দুটো বছর নরক যন্ত্রণা ভোগ করে আসছে এই ক্রিকেট মরসুম গুলো। বাঁকুড়াতে আসার পর থেকে টুয়েলভথ ম্যান হয়েই থেকে গেছে।
সৌরভের মনে পড়ে গেল ক্লাস নাইনে যখন ট্রান্সফার নিয়ে এখানে এল ওর স্পোর্টস সার্টিফিকেট দেখে ওদের হেড স্যার বলেছিলেন-
" সন্তোষ এ যে দেখছি ক্রিকেট খেলে, আর ওপেনার, একে কাজে লাগিয়ে নিও তুমি"
সেদিন সৌরভের খুব আনন্দ হয়েছিল। সিলেকশনের দিন খেলেছিলও ভালো, সন্তোষ স্যারের মনে ধরেছিল ওর খেলা। স্যার যেদিন পনেরো জনের দল ঘোষণা করল সেদিন ওর নাম দেখে সবার আগে মাকে খবরটা দিয়েছিল সৌরভ।কিন্তু যেদিন প্রথম খেলার জন্য দল ঘোষণা করা হল, সেদিন সৌরভের মাথায় হাত টিমে ওর নাম নেই, ও একজন ব্যাকআপ প্লেয়ার হিসেবে রাখা হয়েছে। আর অমিত যে কিনা ওর থেকে খারাপ ব্যাট করে তাকে রাখা হয়েছে টিমে এমনকি ক্যাপ্টেন করা হয়েছে। ও এর কারন সন্তোষ স্যারকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে অমিতের বাবা তড়িত সিংহ স্কুল বোর্ডের প্রধান ব্যক্তি এবং লোকাল প্রতাপশালী নেতা উনি যা চাইবেন তাই হবে।অমিতকে কোনো রকমে বসানো যাবেনা। আর অচিন্ত্যকে বসানোর প্রশ্নই নেই, যথারীতি ভালো ব্যাটসম্যান এবং হিন্দু স্কুল টিমের ট্রাম কার্ড। সেই মরসুমে আর পরের মরসুমে কোনোটাতেই অমিত ভালো খেলতে পারেনি, এমনকি বাজে ক্যাপ্টেন্সির জন্য ট্রফিও হাত ছাড়া হয়েছে। তাও সৌরভের সুযোগ আসেনি, শুধু লেবুজলই বয়ে গেছে।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে সৌরভ বাড়ি ফিরে মন খারাপ করে শুয়ে থাকে আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে-"ভগবান একটা সুযোগ শুধু একটা সুযোগ......"
এবার সিলেকশনের জন্য মিশন বয়েসের সাথে পাঁচটা কুড়ি ওভারের ফ্রেন্ডলি ম্যাচ রাখা হয়েছে। আমিত খেলবে তিনটাতে আর সৌরভ দুটোতে। সৌরভ দুটো ম্যাচের একটাতে হাফ সেঞ্চুরি আর একটাতে ত্রিশ করেছে কিন্তু অমিত এবারও যাচ্ছে তাই খেলেছে ২৫,১০,০ এই স্কোর। সৌরভ ভেবেছিল এবছর হয়তো সুযোগ পাবে কিন্তু অমিত এবারও ওর বাবার জন্য সুযোগ পেয়েছে। অচিন্ত্য তো সৌরভের জন্য অনেক অনুরোধ করেছিল কোনো ফল হয়নি।
-"কিরে হাফ সেঞ্চুরি করেও টুলেভথ ম্যান"-খোঁচা দেয় অমিত।
সৌরভ কিছু না বলে চোখের জল লুকিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
প্রথম দুটো ম্যাচে সৌরভ মাঠে যায়নি, শুনেছে অমিত কোনোটাতেই রান পায়নি। একটা ম্যাচ অচিন্ত্য বাচাতে পারলেও অন্যটা হেরে গেছে। বাকি দুটো ম্যাচ do or die ম্যাচ।
সন্তোষ স্যার সেদিন সৌরভকে ডেকে মাঠে আসতে বলেছেন। বলেছেন অমিত পরের ম্যাচে রান না পেলে সৌরভকে পরের ম্যাচ গুলোতে খেলাবেন।
সেদিন টাউন স্কুলের সাথে হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচে হিন্দু স্কুল জিতেছে।এই ম্যাচটাতে অমিত রান পেয়েছে, তাই সৌরভের এবারও স্বপ্ন ভঙ্গ। পরের ম্যাচটাতেও অমিত মোটামুটি রান করেছে তাই সৌরভ এখনও রিজার্ভ বেঞ্চেই বসে।
সেমিফাইনালে হিন্দু স্কুলের সামনে পড়ে কেন্দুয়াডিহি হাই। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে হিন্দু স্কুল তোলে ১৫০ রান ৭ উইকেটের বিনিময়ে, অমিত ২৫, অচিন্ত্য ৫০, বাবলু 20 , দয়া ১০ অলরাউন্ডার মনোজ ৩০ এবং চন্দন ১৫। কেন্দুয়াডিহি হাই ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১০ ওভারেই ২ উইকেটর বিনিময়ে তুলে নেয় ৮০ রান। হিন্দু স্কুলের হাত থেকে ম্যাচ বেরিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু পেস বলার কাজলের দুর্দান্ত হ্যাটট্রিকে ম্যাচে সমতা ফেরায় হিন্দু স্কুল। অমিতের হাঁটুতে ছড়ে যাওয়ার জন্য পরির্বত ফিল্ডার হিসেবে সৌরভ মাঠে নামে ১৮.৩ ওভারে। খেলা চরম মুহূর্তে পৌছায় যখন শেষ বলে কেন্দুয়াডিহি হাই কে করতে হবে ৬ রান। মনোজ বল করেছে কেন্দুয়াডিহি হাই এর ব্যাটসম্যান লং ওনের উপর দিয়ে তুলে মেরেছে সবার চোখ বলের দিকে, বাউন্ডারি লাইনে একটা দুর্দান্ত ক্যাচ, প্রায় ছয় হয়ে যাওয়া একটা বল লাফিয়ে ক্যাচটা নিয়েছে সৌরভ। মুহূর্তে কোলাহলে ভরে গেল মাঠটা। একটা দ্বাদশ ব্যক্তি ক্যাচ নিয়ে দলকে ফাইনালে তুলল।
ফাইনালে হিন্দু স্কুলের প্রতিপক্ষ খ্রিস্টান কলেজিয়েট স্কুল। টুর্নামেন্টের সব থেকে শক্তিশালী টিম, একটাও ম্যাচ হারেনি। এর মধ্যেই স্কুলে ওদের বোলিং অ্যাটেক,ফ্লিডিং, ব্যাটিং ডেপ্থ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সৌরভের এসবে কোনো ইন্টারেস্ট নেই, একজন লেবুজল বওয়া প্লেয়ারকে ওসব না ভাবলেও চলে। কোনো রকম একটু প্র্যাকটিস করে সৌরভ একটু দুরে বসে অন্যদের প্র্যাকটিস দেখতে থাকে, অচিন্ত্য ওর দিকে এগিয়ে আসে। অচিন্ত্য সৌরভকে ভাইয়ের মতো দেখে, সৌরভের উপরের ক্লাসে পড়ে অচিন্ত্য। সৌরভ অচিন্ত্যকে খুব পছন্দ করে যেমন ওর ব্যবহার সেরকম ওর ব্যাটিং স্কিল। অচিন্ত্য এগিয়ে এসে সৌরভকে বলে-
-"কি রে হিরো প্রেমিকার জন্য মন খারাপ নাকি রে?" বলে হাসে একটু
সৌরভও হেসে জবাব দেয়-" আরে ধুর ওসব কিছু না"
-"তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে বুঝলি"
-"কি সারপ্রাইজ? " অবাক হয়ে সৌরভ জিজ্ঞেস করে।
-"ঠিক সময়ে জানবি, চল একটু প্র্যাকটিস করি গা"
-"ভালো লাগছেনা অচিন্ত্যদা, শুধু শুধু প্র্যাকটিস করে কি হবে বলো"
-"আমি বলছিতো চল ভালো লাগবে"
অচিন্ত্য সৌরভকে টেনে নিয়ে মাঠে যায়।
ম্যাচের দিন ১:৩০ টা থেকে খেলা শুরু। ১টা বাজতেই মাঠে দর্শকদের ভিড় জমতে শুরু করে। সবাই ওর্য়াম আপ করে ড্রেস পরছে, কিন্তু অমিত এখনও আসেনি, এদিকে এবছরের ক্যাপ্টেন অচিন্ত্য টস করতে গেছে। এসে পর স্যারকে বলে
-"স্যার আমরা টসে জিতে ফ্লিডিং করব"
সন্তোষ স্যার চিন্তিত মুখে বলেন-
-"তড়িত স্যার ফোন করেছিলেন অমিতের এক্সিডেন্ট হয়েছে, হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে"
-"তাহলে স্যার কি হবে? "
-"এক দিকে ভালোই হলো। সৌরভকে নামাতে পারবো ওকে রেডি হতে বলো"
সৌরভ কথাটা শুনে যেন বিশ্বাস করতে পারেনা। যে সুযোগটা চাইছিল এতোদিনে সেটা হাতে পায়। প্রতিজ্ঞা করে আজ নিজেকে প্রমাণ করবেই।
প্রথম ব্যাট করতে নেমে খ্রিস্টান কলেজিয়েট স্কুল ১৮০ রান তুলে নিয়ে সৌরভদের সামনে একটা বিশাল রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয়। দুরু দুরু বুকে মাঠে নামে সৌরভ আর অচিন্ত্য। প্রথম ৫ ওভার সামলে খেলে ওরা জড়ো করে ৪০ রান। যার মধ্যে সৌরভ ১৫ আর ২৫ অচিন্ত্য। কিন্তু ৬নং ওভারের প্রথম বলে বোল্ড হয় অচিন্ত্য। ৮নং ওভারে বাবলু, ১০নং ওভারে দয়া। ১০ ওভার পর ৮০ রানে জড়ো করে ৩ উইকেটের বিনিময়ে। ক্রিজে তখন নতুন ব্যাটসম্যান মনোজ আর সৌরভ ৩৫* , এখনও ১০ ওভারে ১০০ রান দরকার। ১১ নং ওভারে দেওয়া হয় ড্রিঙ্ক ব্রেক। সন্তোষ স্যার সৌরভকে বলেন-
"সৌরভ তুমিই আমার শেষ ভরসা, তুমিই পারো দলকে জেতাতে"
এর পর সৌরভ আর মনোজ দুজনে খেলাটাকে হিন্দু স্কুলের দিকে নিয়ে আসতে থাকে, কিন্তু ১৭নং ওভারে মনোজ ক্যাচ আউট হয়ে যায়। তখনও জেতার জন্য চাই ৩৩ রান। চন্দন আসে ব্যাট করতে, সৌরভ ওর সাথে একটু কথা বলে ব্যাট করতে যায়। ওদের প্রধান বোলার পালিত ওর ৩ নং ওভার করছিল তখন। পালিতের বলে এজ লাগে সৌরভের হতাশ হয়ে বসে পড়ে সৌরভ কিন্তু তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে স্লিপে ক্যাচটা মিশ হয়। আবার প্রাণ ফিরে পায় হিন্দু স্কুল। খেলার শেষ ওভার ৬ বলে চায় ১২ রান। পালিতের হাতে বল ওভার পিচড চন্দন তুলে মারে মিড ফিল্ড এরিয়ার উপর দিয়ে ৬ রান। এখন ৫ বলে ৬ চায়। পরের বল ইর্য়কার, বোল্ড চন্দন। চারিদিকে থমথমে ভাব। নতুন ব্যাটসম্যান ক্রিজে। পালিত লেগ সাইডে ওয়াইড। ৪ বলে ৫ রান চায়। পালিত বল করেছে এজ সৌরভ মরিয়া হয়ে রানটা কমপ্লিট করে। এখন ৩ বলে ৪ রান চায়। পরের বল ইর্য়কার, মরনপন ডিফেন্ড করে সৌরভ কোনো রান নেই। দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা চরমে, হিন্দু স্কুল খ্রিস্টান কলেজিয়েট দু'পক্ষেরই নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। ৫ নং বল বাউন্সার হুক করে সৌরভ, কিন্তু ব্যাটে বলে হয়না, ব্যার্থ হয় সৌরভ। ১বল চার রান। সৌরভ চোখ বন্ধ করে অমিয় স্যারের শেখানো মানসিক চাপ কমানোর কথা গুলো মনে করে নেয়। পালিত দৌড়ে আসছে বলটা হাফভলিতে ড্রপ খেলো আর একটা দৃষ্টিনন্দন কভার ড্রাইভ আর বলটা গোড়াতে গোড়াতে পৌছে গেল বাউন্ডারি লাইনে।চার। আনন্দের কোলাহলে পূর্ণ হয়ে উঠল হিন্দু স্কুলের মাঠ।
অচিন্ত্য সৌরভের সামনে এসে কানে কানে বলল
-"বলেছিলাম না সারপ্রাইজ আছে" বলেই চোখ টিপল।
সৌরভের চোখ গাল বেয়ে নেমে গেল দুফোঁটা জল।
অচিন্ত্য ওর পিঠ চাপড়ে বলল
-"সাব্বাস টুয়েলভথ ম্যান"
:::::::::::::::::::::::