বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

সোনালী দিনের উপাখ্যান ।। পর্ব - ৫ ।। দেবব্রত ঘোষ মলয় ।।



পর্ব - ৫


দুম দুম দুম
দুম দুম দুম
দরজায় ক্রমাগত ধাক্কার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় মানদার। ধরমরিয়ে উঠে বসে দু হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে ভাবে মানদা - এখন কি দুপুর না রাত। মনে পড়ে যায় অসময়ে রাগ করে ঘরে খিল দিয়েছিলেন তিনি, মনখারাপ, রাগ, হতাশা ও দুঃখের সংমিশ্রণে এক আগ্রাসী অবসাদ গ্রাস করে তাঁকে - কখন ঘুমিয়ে যান অগাধে। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দেখেন সামনেই উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে বিন্দুর মা।
- মাসীমা তাড়াতাড়ি চল, বাবু কিরকম করতেছে।
মুখ চুন হয়ে যায় মানদার। মনের রাগ পরিণত হয় উদ্বেগে। হাঁফাতে হাঁফাতে পৌঁছে যান অখিলবাবুর ঘরে। ঢুকেই দেখেন আরামকেদারায় কাত হয়ে থাকা অখিলবাবুর ঘাড় একদিকে কাত, মুখে গ্যাজলা আর ডানহাত কেদারার হাতলে ঝুলছে।
মানদার বুক ধড়াস ধড়াস করে ওঠে। অবশ হয়ে যায় হাত পা। কি হল উকিলবাবুর। এই সময়েই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে মনন। সদর দরজায় পুঁটির মার মুখে খবর শুনেই দৌড়ে এ ঘরে এসেছে সে। তাকে দেখেই  ডুকরে কেঁদে ওঠেন মানদা। দ্রুত পরিস্থিতির রাশ হাতে নেয় মনন। টেলিফোনে ডেকে পাঠায় এম্বুলেন্স। কিছুক্ষনের মধ্যেই বাবাকে নিয়ে সোজা হসপিটালে। ইমার্জেন্সিতে ডাক্তারবাবু প্রাথমিক পরীক্ষা করেই জানিয়ে দেন ম্যাসিভ হার্ট এটাক। 
দেখতে দেখতে দু ঘন্টা কেটে যায়। আই সি ইউ এর বাইরে সোফায় বসে ঘামতে থাকে মনন। হসপিটালে আসার জন্য জোরাজুরি করেছিলেন মানদা, কিন্তু মনন রাজী হয়নি। হঠাৎই বাইরে থেকে তীব্র কোলাহলের আওয়াজ ভেসে আসে। এই বিল্ডিং থেকেও অনেকে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। মনন আই সি ইউ এর পাশের করিডোর ধরে সোজা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামে। এই কার্ডিওলজি বিল্ডিংয়ের পাশেই একটি সাততলা ওয়ার্ড, যেটি মূলত প্রসূতি ও শিশু বিভাগ। সেই বিভাগের ছয় তলায় বিধ্বংসী আগুন লেগেছে। মাথার উপর আকাশ কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। বহু মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে ছোটাছুটি করছে। এর মধ্যেই দমকলের কয়েকটি গাড়ি এসে লম্বা লম্বা পাইপ দিয়ে জল ছেটাতে শুরু করে আগুনের উপর। পুলিশ এসে গোটা জায়গাটা কর্ডন করে দেয়। পাশের খালপারের বস্তির ছেলেরা মানব শৃঙ্খল গঠন করে বালতি বালতি জল  ছেটাতে থাকে। বস্তুতঃ দমকল পৌঁছানোর আগে থেকেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মনন ভাবতে থাকে এরা এই বস্তির শ্রমিক, রিকশা বা অটো চালক, আনাজ বা মাছ বিক্রেতা। এরা কখনোই এই কর্পোরেট হসপিটালে ভর্তি হতে পারবে না। 
প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আয়ত্বে আসে আগুন। এখন সাংবাদিকরা ওই বস্তির মানুষগুলির, দমকল কর্তাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। সম্বিৎ ফেরে মননের। দৌড়ে যায় সে কার্ডিওলজি বিল্ডিংয়ের আই সি ইউ এর সামনে। আর তখনই কাচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসেন ডক্টর খাস্তগীর, যিনি এতক্ষন নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অখিলবাবুর অপারেশনের। মনন এগিয়ে যায় তাঁর সামনে। গম্ভীর গলায় তার কাঁধে হাত রেখে বলেন ড. খাস্তগীর - সরি মাই বয়। হি ইজ নো মোর। এতটাই ম্যাসিভ ছিল এটাকটা, আমরা কিছুই করতে পারলাম না। উনি কি কোন বড় রকমের মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন।
মনন দু হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়ে সোফায়। তার বন্ধ চোখে ভেসে ওঠে একরাশ দৃশ্য - বাবার হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে সে, পুরীর সৈকতে বাবার কাঁধে চেপে জলে দাপাদাপি, তার মাথা ফেটে গেলে কঠিন বাবার চোখে জল, ভাল রেজাল্ট এর পর বাবার আলতো আদর আর হাতঘড়ি উপহার ... সব সব মনে পড়ে তার। বাবা নেই, হাজার ডাকলেও আর পাওয়া যাবে না তাকে, এই বোধ তার চোখে জলের বন্যা বইয়ে দেয়।

-------------------
ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.