বদরুদ্দোজা শেখু
চরের বসত। প্রতি বছর এখানে বন্যার বাজার বসে। হাজার মানুষ ভিটেমাটি উন্মূলিত হয়।বন্যা নেমে গেলে আবার সংসার গজিয়ে উঠে।ঘাসের মতন।
ঘাসের বাগান । লাউমাচার সাথে দরমার ঘরবাড়ি। খাঁড়িতে যখন বসবাস, তখন বাড়িঘর কেন? মাচা দরমার টাটি ফুস মুসকিল আসান।
এখানে রমজান মাছ কাঁকড়া ধরে।ভোর ভোর লুঙ্গি গামছা হাফগেঞ্জি প'রে খ্যাজাল খলাই নিয়ে চরের খাঁড়িতে যায়। বেলা হ'লে ফিরে। যা কিছু কুচো মাছ চিংড়ি কাঁকড়া জুটে তা স্থানীয় চরের বাজারে বিক্রি ক'রে দিনের সওদা করে। ঘরে এসে রেঁধেবেড়ে খায় । বাপ মাকে দুমুঠো খাওয়ায়। দিন গুজরায়। বাপ মা বেঁচে আছে, তবে প্রায় অথর্ব এখন।
রমজানের তেমন রোজগার নাই, ঘরবাড়ি নাই, চোরাকারবার দালালি স্মাগলিং সে জানে না। মানে চরের জগতে সে একজন
অচল পাত্র , তাই তার পাত্রী জুটেনি। কারো সাথে প্রেম ভালবাসা জমাতেও পারেনি।
তাই সে আইবুড়ো ফুটো পয়সা।তবে সে তার বাপমার জন্য যথাসাধ্য করে।
ক'দিন আগে বন্যা ফুঁসে উঠেছিল। চরবস্তি ডুবুডুবু। প্রায় সবাই বস্তি ছেড়ে ত্রাণশিবিরে চ'লে যাচ্ছে। রমজান কী করবে ? তার অথর্ব মা-বাপকে ফেলে তো যেতে পারবে না। তাই মাটি আঁকড়ে' প'ড়ে থাকলো। সারারাত জেগে ব'সে রইলো।শুধু আল্লাকে ডেকে চললো। ভাগ্যের বরাতে সে রাতে চরবস্তি বেঁচে গেল। পানি আর বাড়লো না।
যথারীতি ভোর রাতে সে বেরিয়ে পড়লো জাল খলাই নিয়ে।চরের ন্যাবায় প্রাতঃকৃত্য সেরে পানির ধারে গিয়ে শৌচ করলো।
এবার জাল ফেলবে। হঠাৎ তার মনে হলো, কিছু একটা ভেসে যেতে যেতে বাঁকে আটকে আছে। দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখলো
একটা কিশোরী মেয়ে চরের বাঁকে লেগে আছে , বেহুঁশ। ঝট ক'রে সে নেমে পড়লো খাঁড়ির পানিতে, তাকে কোনো রকমে টেনে তুললো।নাকে মুখে হাত ঠেকিয়ে পরখ করলো তার দম আছে কিনা , শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে কিনা।মনে হলো, আছে, বেঁচে আছে।
সে তাকে উপুড় ক'রে তার পেট থেকে পানি বের করার চেষ্টা করলো।বেশী কিছু করতে না পেরে ঘাড়ে ক'রে তুলে নিয়ে ছুটলো ঘরের পানে। সেখানে চেঁচামেচি ক'রেও কাউকে পেলো না, কারণ কাছাকাছি সবাই ত্রাণশিবিরে চ'লে গেছে। সে আবারো তাকে উপুড় করিয়ে পেটের পানি বের ক'রে দেওয়ার চেষ্টা করলো । কতকটা পানি বের করলো।ঘরের কাঠকুঠো দিয়ে আগুন জ্বেলে সে সেঁকাপোড়া করতে লাগলো। তার বাপ মা ততক্ষণে উঠে এসেছে কষ্টেসৃষ্টে ।তারা বললো , জামাল ডাক্তারকে ডাকো।সেই বলবে , বাঁচবে কিনা। রমজান ছুটলো জামাল ডাক্তারের বাড়ি। জামাল ডাক্তার হাতুড়ে পরোপকারী । তার ডাকাডাকি শুনে সে বেরিয়ে এলো।ঘটনা শুনে সে তার ঝোলা নিয়ে ছুটলো রমজানের সাথে।মেয়েটিকে পরীক্ষা ক'রে সে বললো, সিরিয়াস কেস ,একে তুমি আনলা ক্যামনে ? দুজনে তার পেটের সব পানি বের করার চেষ্টা করলো আর কিছুটা সফলও হলো ।তখনো মেয়েটি আচ্ছন্ন বেহুঁশ। একটা ইন্জেকশন দিলো।কতকগুলো বড়ি আর এক শিশি সিরাপ দিয়ে বললো,এইগুলা খাওয়াও, আল্লা যদি হায়াৎ রাখে তো বেঁচে উঠবে।আর ওর ভিজা জামাকাপড় পাল্টাইয়া দিয়া গরম সেঁকা পোড়া করো। টাকার কথা বললো না। কারণ ডাক্তার জানে , ওদের হাতে কিছুই নাই। তারা তিনজনে মেয়েটির আপ্রাণ সেবাশুশ্রূষা করতে ব্যস্ত হ'য়ে পড়লো।
সেদিন বিকেল নাগাদ মেয়েটির জ্ঞান ফিরলো, চোখ খুললো ।
কিন্তু সে ফ্যালফ্যাল ক'রে তাকিয়েই রইলো । কোনো কথা বলতে পারলো না। জামাল ডাক্তার এসে বললো,চরম মানসিক শক পেয়েছে ; কথা বলতে সময় লাগবে। ধীরে ধীরে সুস্থ হ'য়ে উঠলে কথা বলতে পারলেও পারতে পারে।- - -
সেদিন দুপুর নাগাদ চরের বস্তিতে আবার লোকজন ফিরে আসতে লাগলো । সবাই জেনে গেল, রমজান একটা ভেসে আসা মেয়েকে উদ্ধার করেছে, তার জ্ঞান ফিরেছে।
অনেকেই ভিড় করলো ওর ঘরের ছোট খোলা উঠানে। কেউ গরম পানি আনলো তো কেউ গরম দুধ। কেউ কেউ দু'একটা জামাকাপড় , সবই পুরনো। তবে সবাই নিরাশ হলো, মেয়েটি কথা বলতে না পারায়।
বছর তিনেক হ'য়ে গেল, মেয়েটি আর কথা বলতে পারলো না। রমজানের তেমন সামর্থ্য ও নাই যে শহরে নিয়ে গিয়ে তাকে ডাক্তার দেখাবে। তার নামধাম সবই অজ্ঞাত থেকে গেল।রমজানের দিন তো কেটে যায় সংসারের দুমুখো অন্নসংস্থানের জোগাড় করতে।এর মধ্যেই কেউ একজন মেয়েটার নাম দিয়ে দিলো রজনীগন্ধা। বেশ নাম। মেয়েটির মুখশ্রীর সাথে মানানসই। সেই থেকে সে হ'য়ে গেল রজনী, ভালবাসার আরো সংকোচনে রোজু থেকে রোজি।
রমজানের বাপ মা বললো, যখন ওকে তু বাঁচায়েছিস বাবা ,তখন আল্লার কিছু ইচ্ছা নিশ্চয় আছে। তু ওকে বিয়া কর , নাহলে সমাজে নানা কথা উঠবে।মেয়েটা যুবতী হ'য়ে উঠছে। রমজান ভাবলো, তার তো কোনো পাত্রীই জুটেনি , তো এই সই, রোজুকেই সে কনে ক'রে বিয়া করবে।আকার ইঙ্গিতে তো কথাবার্তা বুঝতে পারছে ।নির্বোধ নয়। স্থানীয় মসজিদের ইমামের সাথে কথা বললো। দ্যাখো বাপু, মাইয়াটার তো জাতধর্ম তো জানা নাই ।তবে এতোদিন
তো তোমাদের সাথে থাকছে। তাই তাকে আর কোথায় ছেড়ে দিবা ? কোনো অসুবিধা নাই। - - ডাক্তার পাত্রীপক্ষ হ'তে রাজী হলো।
একদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় লোকজন ডাকিয়ে তাদের বিয়া পড়িয়ে দেওয়া হলো। দেখা গেলো, মেয়েটি আকার ইঙ্গিতে বুঝতে
পারে। সে কথা বলতে না পারলেও , কবুল করার সময় মাথা নাড়লো সামনের দিকে।
সবাই খুশী হলো। সবাই বললো যা হোক রমজান একটা বউ পেলো। কেউ কেউ নকল গয়না চুড়ি শাড়ি দিয়ে সাহায্য করলো। এই চরের বসতে বিবাদ হিংসা সবই আছে। তবে রমজানের পরিবার নিতান্তই নিরীহ তাই তাদের সামান্যতম সাহায্য করার জন্য অনেকেই এগিয়ে এলো।
রমজানের আয় খুব কম। সে নানান চেষ্টা করে রোজগার বাড়ানোর জন্য। দেখতে দেখতে রোগে অপুষ্টিতে ভুগে বছরখানেকের মধ্যে তার বাপ মা আগে পিছে গত হলো। তারা এখন এই ফুসের ঘরে দুজনে একলা। রমজান কাজে যায়, রোজি ঘরের ছোটখাটো কাজকাম ক'রে ঘরেই থাকে, সে তেমন অন্যের বাড়ির কাজ পারে না, তার জন্য রমজান আদৌ দুঃখিত নয়। কিন্ত শুনছে বেপাড়ার কিছু উঠতি চ্যাঙ্ড়ারা তার ঘরের দিকে নজর দিচ্ছে। তারা কখন কী অঘটন ঘটাবে বলা যায় না। রোজি যুবতী হয়েছে। তাকে আর ঘরে একলা রাখা যায়না। নিজের সাথেও কাজে নিয়ে যাওয়া যায় না। অন্যের বাড়িতে পাঠালেও সেখানেও অনেক বিপদ।
তাই সে আকার ইঙ্গিতে রোজিকে বুঝালো যে তারা এখান থেকে চ'লে যাবে, শহরে হয়তো একটু বেশী আয় করতে পারবে ।
শুনেছে কলকাতায় মানুষ কুকুর শেয়ালের মতো রাস্তায় প'ড়ে থাকে, তাই তারা সেখানে যাবেনা । ধারে কাছে কোনো শহরে যেতে পারলে ভালো হয়।যারা বাইরে যায় তাদের কাছে সে খোঁজখবর নেয়।
----- ---- ---- - - - - -
সেই মতো একদিন ঝুঁকি নিয়ে ভোর রাতে তারা বেরিয়ে পড়লো, সঙ্গে নেওয়ার মতো কিছুই নাই। একটা বাঁশের হাতলওয়ালা চটের পুরনো ব্যাগে নিজেদের কাপড়চোপড় টিনের থালা বাটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
হাঁড়ি কুঁড়ি তো সব মাটির। সব রইলো চরের ঘরে প'ড়ে- - - - -
তারা ঘুরতে ঘুরতে মালদহ ষ্টেশনে হাজির হলো, সারাদিন ষ্টেশনের বাইরে কিছু মালপত্র বওয়ার চেষ্টা ক'রে রমজান কিছু খাবার জুটালো। তারপর প্রায় মাঝরাতে একটা ট্রেন এসে দাঁড়ালো। লোকজন যেদিকে যাচ্ছিলো সেইটি অনুসরণ ক'রে একটা কামরায় কোনমতে উঠে পড়লো। ভিতরে যাওয়ার সাহস হ'লনা। বাথরুমে যাওয়ার প্যাসেজের সামনে দাঁড়িয়ে ব'সে চললো।- - -
পরদিন দুপুর নাগাদ জলপাইগুড়ি পৌঁছালো। ওখানে অনেক লোকজন ওঠা নামা করে। তাই সেখানেই লোকের ভিড়ের সাথে নেমে তারা গেট পেরিয়ে গেল। চেকাররা কেউ দেখলো না। কিন্ত ,কিন্তু বাইরে গিয়ে যাবে কোথায় ? সারাদিনে দু'চারজনের ব্যাগপত্র গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যা কিছু পেলো তা দিয়ে চা পাঁউরুটি কিনে দুজনে খেলো।তার বউকে এক নির্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে রাখলো। খুব দুশ্চিন্তা, রাত নামছে ।রোজিকে নিয়ে ষ্টেশনে কী ক'রে থাকবে ভাবতে পারছে না।কেউ যদি ওর বউকে তুলে নিয়ে যায়? তাই সে তখন মরিয়া সন্ধ্যার মুখে একজোড়া বুড়োবুড়ি ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসছিল। একটু হয়তো হাঁপিয়ে উঠেছিল। তাদের দেখে সে ছুটে গেল আর ব্যাগপত্রগুলো পৌঁছে দিতে চাইলো। কোথায় পৌঁছাবে? হয়তো গাড়িতে বা রিকশায়। সেটুকুর জন্য তারা বইতে দিবে কেন ? সে ইশারায় রোজিকে ডাকলো।
তারপর ওর বৌকে দেখিয়ে বললো, মাইজী আমাগো কোথাও চেনাশুনা নাই, যদি একটু থাকার জায়গা দ্যান তো গোলাম হ'য়ে থাকবো।তার চুপচাপ বৌকে দেখে মহিলা ভাবলো, এ কে? রমজান বলল ,-ঘটনা।----
এই রাতে তাদেরকে একটু আশ্রয় দেওয়ার জন্য সে পায়ে ধরতে গেল, বললো, ও কথা বলতে পারেনা মাইজী , ও আমার স্ত্রী।
পুরুষ লোকটি বললো, ওদের কে প্রশ্রয় দিও না। তবুও মহিলা ওদের নাম জানতে চাইলো। শুনে বললো, তোমরা তো মুসলমান, আমরা হিন্দু। আমাদের ঘরের কাজকর্ম কি আদৌ পারবে ? তারা পরামর্শ করলো, মনে হচ্ছে, ওরা সত্য কথাই বলছে, খুব অসহায় মনে হচ্ছে।তবু বললো, তোমরা তো অন্য জাতের,। আমাদের বাহাদুর অবশ্য চ'লে গেছে। কিন্তু দুজনকে থাকতে দেওয়া খেতে দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নাই।
রমজান অনুনয় বিনয় করলো, তাদেরকে দু-একদিন একটু আশ্রয় দেওয়ার জন্য।
তারা স্বামী-স্ত্রী পরামর্শ ক'রে বললো, ঠিক আছে চলো, মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় থাকবে ! চারদিকে চুল্লু বদমাস, কিছু একটা করে দেওয়া যাবে। তবে একজনের মজুরি পাবে ।তোমাদের দুজনকে খেতে দিতে পারবো না । রমজান মাথা নাড়লো।
----- - - - - -
তারা একটা টোটো গাড়ি ধ'রে চললো শহরের বাইরে কিছুটা দূরে একটা অঞ্চলে। একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। বাড়ির এরিয়া দরমার বেড়া দেওয়া, তবে বাড়িটা ইটের। একটা ফুসের চালাঘর মতো আছে, ওখানে আগে বাহাদুর থাকতো । ওখানেই ওদেরকে থাকতে দিলো। একটা সাধারণ কাঠের চৌকি আছে আর কিছু নাই । ওখানেই ওরা থাকতে লাগলো। প্রথম দিন রাতে দুটো পাঁউরুটি দিলো দুজনকে । ট্যাপের পানি ভ'রে নিতে বললো। পাশের কুয়ো থেকে পানি তুলতে বললো। রমজান বেশ ক'বালতি পানি তুলে কুয়োর পাশের ওদের স্নানের ঘরে ভ'রে দিলো। ওদেরকে বাহাদুরের ব্যবহার্য পায়খানা দেখিয়ে দিলো একটু দূরের লেবুতলায় ।
সেদিন রাতে তারা বেশ ঠান্ডা অনুভব করলো। এদেশে মনে হয় সব সময় ঠান্ডা থাকে। ব্যাগে যা কাপড় ছিল , তাই সম্বল।
কয়েকদিন রমজান ওরা যা যা বললো তেমন তেমন কাজ করলো। মিঃ বড়ুয়া ওকে নিয়ে গেল বাজার কোথায় কি পাওয়া যায় এসব চিনিয়ে দিতে। দেখলো এরা সত্যিই খুব আনকোরা; কতো মাহিনা লাগবে জিজ্ঞাসা করায় রমজান বললো আমরা জানিনা মা, আপনারাই ঠিক ক'রে দ্যান।মিসেস বড়ুয়া বললো, তুমি কতো চাও তা বলবে তো। রমজান হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো।
ওদেরকে রান্নার জন্য একটা চালা ছিলো পাশে ওখানে রান্না করার অনুমতি দিলো। ওখানে বাহাদুরের ছেড়ে যাওয়া মাটির হাঁড়ি কুঁড়ি কলসি আছে ওগুলোই ধুয়ে ব্যবহার করতে বললো। রমজানের স্ত্রীকে দেখলো , সে তেমন কিছুই বলতে পারেনা। কেবল আকার ইঙ্গিতে চলে। রমজান যা দুটো পারে ক'রে খাওয়ায়।ক দিন ধ'রে দেখছিলো একটাই কাপড় পরছে, মিসেস বড়ুয়া জিজ্ঞেস করায় রমজান বললো আর নাই মা, একটা রাতে গায়ে দ্যায় , তাই সেটা ভিজায় না। সেদিন মিসেস বড়ুয়া জানতে চাইলো , ওদের এমন অবস্থা কেন। রমজান বললো ওর স্ত্রী কীভাবে ওর জীবনে এসেছে।শুনে মিসেস বড়ুয়া তো অবাক । এমন মানুষও দুনিয়ায় আছে যে কুড়িয়ে পাওয়া মানুষকে সেবা যত্ন ক'রে বাঁচিয়ে তোলে, যে কথা বলতে পারে না তাকে স্ত্রী ক'রে তার সব দায়িত্ব কাঁধে নেয় যার কিছুমাত্র সহায় সম্বল নাই।মিসেস বড়ুয়ার করুণা হলো।- - তাহলে তুমি তো জানো না ও কোন জাতের ।রমজান বললো, না সে জানে না। কোথায় তাকে ছাড়বে !
তাই ওদের চরবস্তির ইমাম মুসলমান মতে আমার মা-বাপের হাজিরায় ওদের বিয়া দেছে। তাই ওরা স্বামী স্ত্রী। তা ছাড়া তো দুজনে এক ঘরে থাকা যায় না। আর ও তো তেমন কিছু পারেও না।আমাগো চরের বসতে অতোকিছু বিচার হয়না মা।কে কোথা থেকে এসেছে , কোথায় বসবাস করছে, কবে উঠে যাছে কোথাও কেউ খোঁজ রাখে না।আমরাও এসেছি ওকে যাতে একটু ভালো রাখতে পারি তাই শহরের সন্ধানে। আমাগো এহানে থাকতে খেতে দিছো মা,যদি তাড়ায়ে দাও তো অকূল পাতারে পড়বো।কোথায় যাবো মা ? আমাগো তাড়ায়ে দিও না।রমজান কাঁদো কাঁদো।মিসেস বড়ুয়া কোনো কিছুই বললো না। উঠে গেল। কিছুক্ষণ পরে কয়েকটা পুরনো নাইটি জামা ও দুটো শাড়ি ওকে দিয়ে গেল। রোজিকে ডেকে কথা বলার চেষ্টা করলো।রোজির আকার ইঙ্গিতে কী বললো এক বর্ণও বুঝলো না। রমজানকে শুধালো।রমজান বললো, ওর আনন্দ হইছে।
রমজান তো মূলতঃ মাছ কাঁকড়া ধরতো, চরের বাজারে বিক্রি করতো।এখন মিসেস বড়ুয়ার ঘরবাড়ি উঠান চাতাল পরিষ্কার করে, জল তোলে, বাজার ক'রে দ্যায়, ফাইফরমাস খাটে আর ওর স্ত্রীর যত্ন নেয়।ওর স্ত্রী, ও না নিয়ে গেলে কোথাও যায় না।
উঠান ঝাঁট দ্যায়, হাঁড়িকুঁড়ি মাজে, ঝাঁটা দিয়ে পানি দিয়ে আঙিনায় নিকায়। এটা হয়তো ওর জানা কাজ।মিসেস বড়ুয়ার খোলা আঙিনায় একপাশে রমজান কতোগুলো গেঁদা গাছ লাগিয়েছে। রোজি সেগুলোতে পানি দ্যায় আর বেড়ার ওপার থেকে লোকজন দ্যাখে।
মিসেস বড়ুয়ার এক ছেলে, দুই মেয়ে ।ছেলে গুয়াহাটিতে পড়তে গিয়ে ওখানেই মেয়েকে বিয়ে ক'রে থেকে গিয়েছে।ওখানেই চাকরি করে।বাড়ি তেমন আসে না; খোঁজখবরও খুব একটা রাখে না। ছোট মেয়ে শিলিগুড়িতে পড়ে, ওখানে হোস্টেলে থাকে।খুব প্রয়োজন না হ'লে , টাকার দরকার না হ'লে চিঠি লিখে না। পূজার ছুটির সময়েও দু'একদিন থেকে বলে ভালো লাগছে না , ওখানে কোন বন্ধুর বাড়ি আছে তার সাথে চ'লে যায়, মিসেস বড়ুয়া বিষণ্ণ হ'য়ে পথের দিকে চেয়ে থাকে। বড়ো মেয়ের কুচবিহারে এক বাস কন্ডাক্টরের সাথে বিয়ে হয়েছে,সেও তেমন আসে না।বছরে হয়তো একবার আসে ,দুচারদিন পরেই ওর স্বামী নিতে আসে। মিঃ বড়ুয়া কোথায় যেন কাজ করে, সকালে যায় রাতে আসে।মিসেস বড়ুয়া প্রায় নিঃসঙ্গ । পাড়াপড়শীর সাথে দিনে দুচারবার কথাবার্তা বলে।শহরের জীবনে এর বেশী আর কি ?
রমজান একদিন বলে, ওর স্ত্রীর জন্য একটা গেঁদা ফুল সে তুলবে কিনা। কী করবে ?
বলে, ওর খোঁপায় গুঁজে দিয়ে ওকে বাইরে নিয়ে যাবে আশপাশগুলো চেনাতে।
মিসেস বড়ুয়া ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।খুব সাধারণ জামাকাপড়ে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে রোজিকে।বিকেল হওয়ার আগেই ফিরে আসে।এসে বাড়ির কাজকর্ম দ্যাখে। রমজানকে ওরা কিছু হাতখরচ দ্যায়, চালডাল , তরিতরকারি দ্যায় , তাই দিয়ে সে সংসার চালায়। ঈদের সময় কিছু বাড়তি বখশিস দ্যায় , নিজের মতো বাড়িতে থাকে।যখন বাড়ির ছোট মেয়ে আসে, তার কতো জামাকাপড় রোদে মেলে দ্যায় , নাইটি প্যান্টি ব্রেসিয়ার লেগিংস ফ্রক চুড়িদার। রোজির তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে। কী যেন ভাবে আর ছোট খাটো কাজগুলো করে।
একদিন রাতে খুব মেঘ উঠলো; সারা আকাশ অন্ধকার।তুমুল মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের ঝলকানি, যেন সমগ্র পৃথিবীটাকে গ্রাস করবে।তুমুল বর্ষণের মধ্যে চোখে ধাঁ ধাঁ লাগানো বিদ্যুৎ চমকানিতে রোজি আতঙ্কে একসময় রমজানকে ভয়ে জড়িয়ে ধরলো ; রমজান দেখলো, রোজি অজ্ঞান হ'য়ে গেছে। সে চীৎকার ক'রে কাঁদতে লাগলো।বৃষ্টি কমলে তার কান্না শুনতে পেয়ে মিঃ ও মিসেস বড়ুয়া ছুটে এলো, কি হয়েছে দেখতে। তারা রমজানকে বললো ওর চোখে মুখে ভালো ক'রে পানির ঝাপটা দিতে। ঝাপটা দিতে দিতে একসময় সে চোখ খুললো আর কেঁদে উঠলো চীৎকার ক'রে, ওমাগো বাবাগো বাঁচাও বাঁচাও বাঁ--চা--ও ,
মুই ভাসি যাছি গো ,কে আছো বাঁ--চা--ও !
তখনো তার চোখে মুখে ঘোর আতঙ্ক-- --
আবারো সে জ্ঞান হারালো। রমজান চেঁচিয়ে উঠলো , রোজি কথা বলেছে মা রোজি কথা বলেছে। রোজিকে পানি খাইয়ে গরম দুধ খাইয়ে মিসেস বড়ুয়া ধাতস্থ করলো। দেখলো, চালা ঘরটা বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে। রোজির মাথায় কিছুই ঢুকলো না সে ফ্যাল ফ্যাল ক'রে কুপির আলোয় চারিদিক দেখতে লাগলো ।হতভম্ব ।সমস্তই যেন তার অচেনা পৃথিবী।
মিসেস বড়ুয়া সেই রাতেই তাদেরকে একটা ঘর দিলো, রান্না ঘরের পাশের যে ঘরটা যেটায় তার ছোট মেয়ে এলে থাকে। সে যখন আসবে তখন এই ঘরটা নাহয় খালি করতে বলবে, এখন তো ওরা থাক। দু-একটা গরম কাপড়চোপড়ও দিলো যাতে মেয়েটার গরম ধরে।
পরদিন থেকে রোজি কথা বলতে পারলো কিছুটা রাজসাহী অঞ্চলের ভাষার মতো। কিন্তু সে তার নামধাম বাপ-মার নাম কিছুই মনে করতে পারলো না। শুধু সে নদীর ধারের বাড়ির কথা বললো । হয়তো সেও রমজানর মতোই কোনো চরবস্তির বাসিন্দা ছিলো। বা রমজানদের বাড়ির কথাই বলতো। নদীর বানে ভেসে আসার আগের জীবনের কথা সে একেবারে ভুলে গেছে। রমজানের সাথে আসার ঘটনা ব'লে মিসেস বড়ুয়া অনেক ভাবে তাকে মনে করানোর চেষ্টা করলো , তার কী জাত ,দেবতা কে মন্দির না মসজিদ , বাড়িতে কজন ছিলো। রমজানও অনেক চেষ্টা করলো তার ইতিহাস জানার। কিন্তু সে শুধুই ফ্যালফ্যাল ক'রে তাকিয়ে রইলো রমজানের পানে। কিছুই বলতে পারলো না। তবে কথা ফুটলো তার মুখে ।সবটা বুঝা না গেলেও রমজান এতেই আনন্দিত হলো।মিঃ বড়ুয়া ওর মনে অতিরিক্ত চাপ দিতে বারণ করলো।
মিসেস বড়ুয়া তার স্বামীর সাথে পরামর্শ ক'রে বারকয়েক একটা ভালো ডাক্তারও দেখালো জলপাইগুড়িতে, ডাক্তার পরীক্ষানিরীক্ষা ক'রে শেষে কয়েকটা বড়ি ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিলো। ধারাবাহিকভাবে ওষুধগুলো খাওয়াতে বললো। আর বললো, ট্রমাজনিত আঘাতে ওর স্মৃতি লোপ পেয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি পরিবেশ বুঝিয়ে দিলে সে সাধারণ জীবনযাপন চলাফেরা কাজকর্ম চালাতে পারবে।
মিসেস বড়ুয়া কিছুদিন ভাবলো, তারপর সিদ্ধান্ত নিলো, ঘরের ছেলেমেয়েরা সবাই তো ছেড়ে চ'লে যাচ্ছে। ছোটটাও তো শহরের দিকে পা বাড়িয়ে আছে।যে কোনো দিন বিয়ে ক'রে বসবে আর বলবে চললাম। ভবিষ্যতে কেউ হয়তো তাদের দেখাশুনা করবে না। তারা বয়সের ভারে পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। বরং এই ছেলেমেয়ে দুটোকে তারা বাড়িতে রেখে দিতে পারে। এরাই হয়তো তাদের অন্তিমকালে সেবা যত্ন করবে, শেষ কৃত্য করবে। হলোই- বা অন্য জাতের। ওদের আচার আচরণে তো কোনো ফারাক নাই । শুধু জীবন ধারণই তাদের মূলকথা। পরদিন থেকে মিসেস বড়ুয়া ওদের কে পরিবারের অংশ করতে তৎপর হলো। মিঃ বড়ুয়াও এতে সায় দিলো।
সামনের লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষ্যে মিসেস বড়ুয়া রোজিকে একটা লাল -কালো ডুরে কাটা শাড়ি ও লাল ব্লাউজ দিলো। রমজানকে জামা পায়জামা ও একটা ভালো লুঙ্গী দিলো। তারা আনন্দে কেঁদে ফেললো। মিসেস বড়ুয়া বললো, এবার তোমরা স্বামী স্ত্রী আমার সন্তানের মতো। তোমরা এখানেই বরাবর থাকবে।
ছোট মেয়ে পূজোয় এসে বললো, তোমরা রোজুকে আমার ঘরটায় থাকতে দিয়েছো ? ভালোই করেছো। আমার আর এখানে থাকার দরকার নাই। আমি বিয়ে করবো ওখানে মিসেস বড়ুয়া মনে মনে দেখলো, রমজান আর রোজি সেজেগুজে ঘুরতে যাচ্ছে , রোজির ডুরে শাড়ি আর লাল ব্লাউজ , খোঁপায় গোঁজা হলুদ গেঁদা ---- আরো ভাবলো, ওদের নামে বাড়ির একটা ঘরসহ কিছুটা অংশ লিখে দিতে হবে- - -
-------------------------------
© বদরুদ্দোজা শেখু , বহরমপুর
ঠিকানা-- 18 নিরুপমা দেবী রোড , বাইলেন 12 ,
শহর+পোঃ- বহরমপুর , জেলা--মুর্শিদাবাদ,
PIN -742101
পঃ বঙ্গ , ভারত ।
হো• অ্যাপ নং 9609882748