ছোটগল্প ।। প্রমিতিয়া ।। অনিন্দ্য পাল
প্রমিতিয়া
অনিন্দ্য পাল
ওঃ! এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট ট্রেনের জন্য বসে থাকতে হবে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য ট্রেনটা মিস হয়ে গেল। প্ল্যাটফর্মের কংক্রিটের সিটে বসে নিজের মনেই গজ গজ করছিলেন প্রমিতিয়া।
রমেন গড়িয়ার ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে প্রায় এক বছর হল। প্রমিতিয়া এখনো যাননি সেখানে। শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে আসতে মন চায়নি তখন, এখনো পাঁচ শতকের উপরে ভাঙাচোরা শরিকি বাড়ির দুটো ঘর-বারান্দা, একচিলতে বাগান ছেড়ে আসতে চাইছেন তা নয়। একটা বিশেষ দরকারেই যাচ্ছেন, তবে ছেলের কাছে সাহায্য চাইতে নয়, বা সেখানে থাকতেও নয়।
রুণা মাঝে মধ্যে আসে, বুট্টুকে নিয়ে। নাতিকে তখনই দেখতে পান একটু। বছর তিনেকের গোলগাল বুট্টু তার মায়ের মতো হয়েছে। এতে প্রমিতিয়া খুশিই হয়েছেন। রমেন গত এক বছরে একবারো আসেনি, এমনকি খোঁজ টুকুও নেয়নি। কখনো কখনো প্রমিতিয়ার সন্দেহ হয়, রমেন তাঁর নিজের ছেলে তো?
--- চারানা-আটানা পয়সা দাওনা মা, ওমা, আমি হাঁটতে পারিনা, চলতে পারিনা।
বৃদ্ধা ভিখারিনী ভিক্ষা নেবার প্লাস্টিকের হলুদ বাটিটা তার পায়ের পাতার উপর ঠেকিয়ে রেখেছে। উঠে দাঁড়াতে পারেনা বোধহয়, তাই বসে দু'পা এবং হাতের জোরে অদ্ভুত ভাবে শরীরটাকে এগিয়ে নিয়ে আসছে। কোমর থেকে নিতম্ব জড়িয়ে প্লাস্টিকের বস্তা নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা। বোধহয় ময়লা ছেঁড়া শাড়িটা যাতে আরও ময়লা না হয় বা আরো ছিঁড়ে না যায়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। সঙ্গের একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভিতর থেকে কিছু কাপড়, অ্যালুমিনিয়ামের থালা, দেশলাই উঁকি দিচ্ছিল। প্রমিতিয়া ব্লাউজের ভিতর থেকে ছোট্ট বটুয়াটা বের করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই পাশে বসে থাকা ভদ্রলোক বাজখাঁই গলায় ধমকে উঠলেন, ' সামনে যাও '।
প্রমিতিয়া আবার চমকালেন। ভিখারিনী ঘষতে ঘষতে সামনের দিকে এগোল। সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রমিতিয়া যেন দেখতে পেলেন, একটা অস্পষ্ট সংসারের ছবি। এখনকার এই ভিখারিনী ছিলেন সেই সংসারের কর্ত্রী। তার হাত ধরেই বেড়ে উঠেছে ভালোবাসার ফসল। ব্যস্ত সকাল, অলস দুপুর আর সোহাগের রাতগুলো সেই সংসারের রোজ নামচা। একটা সাজানো সুখের রঙ ছড়িয়ে আছে সেই সংসারের সর্বত্র। হঠাৎ একটা তীব্র জান্তব শব্দে সব রঙ কেমন যেন ঘুলিয়ে উঠলো। ট্রেন ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে।
২.
গড়িয়ায় পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাতে চোখে কম দেখেন বলে টর্চটা নিয়েই এসেছিলেন প্রমিতিয়া। কিন্তু স্টেশন থেকে রাস্তায় নেমে টর্চটা বের করতে লজ্জা পেলেন! এত আলো এখানে?
বৌমার দেওয়া ঠিকানাটা মিলিয়ে দু'একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই পৌঁছে গেলেন ফ্ল্যাটের গেটে। সেখানে বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষীর বেড়া টপকে যখন সিঁড়ি ভেঙে পাঁচতলায় উঠলেন, তখন সাতটা বাজে। বুক ভেঙে আসছিল প্রমিতিয়ার। একতলা বাড়িতে কখনো এতটা উঁচুতে উঠতে হয় না তাকে। লিফটের কথাও জানা নেই। হাঁফাতে হাঁফাতে পাঁচশো দুই নম্বর দরজার ডোরবেল বাজালেন। শাড়ির খুঁট দিয়ে মুখটা মুছছিলেন, দরজা খুলে মুখ বাড়ালো, একটা বারো-চোদ্দ বছরের মেয়ে।
-- কাকে চাই?
প্রমিতিয়া থমকালেন!
একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন,
--রমেন, রমেন বসু। আমি রমেনের মা।
-- ওহ! আপনি ঠাকুমা! আসুন, আসুন আমি মাকে ডাকি।
দরজাটা পুরো খুলে দিয়ে মা মা করতে করতে ছুটে চলে গেল মেয়েটা। প্রমিতিয়া অবাক হলেন। এই মেয়েটা কে? রুণাকে মা বলে ডাকছে! খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খানিকটা হতচকিত হয়ে রইলেন প্রমিতিয়া।
--- মা, আসুন। অবশেষে এলেন ছেলের বাড়িতে। আমরা তো ভাবলাম ...
-- মেয়েটা কে বৌমা?
--- ও? ওতো ফুলি। আপনার ছেলে নিয়ে এসেছে। কাজ টাজ করে, আমি পড়াই, এখানের একটা স্কুলে কথা বলা আছে, ওরা পরীক্ষাটা নেয়।
-- তোমাকে মা বলে?
প্রমিতিয়ার কথা শুনে রুণা হেসে ফেললো।
-- ওটা আমার শেখানো। এখন তো জানেন, কাজের মেয়েদের সঙ্গে বাড়ির কর্তাদের কত রকম কেচ্ছা হচ্ছে।
ছেলেকে চিনতেন প্রমিতিয়া, তাই চুপ করে গেলেন। বিয়েটাও তো ক্লাব থেকে ধরে বেঁধে। রুণা তখন মাস তিনেকের পোয়াতি। ঘরটা ভালোই সাজিয়েছে। নিজের সংসার সব মেয়েই চায়। প্রমিতিয়াও চেয়েছিলেন। পাননি। না নিজের সাজানো সংসার, না স্বাধীনতা। কোনোটাই ছিল না। মনে মনে রুণার উপর খুশীই হলেন।
-- মা, আপনার ছেলের আজ ফিরতে একটু দেরি হবে। ওদের কোম্পানী একটা মাল্টিস্টোরিড করছে বজবজে, সেখানে গেছে। আর আপনার নাতি বুট্টুকে সবে মাত্র ঘুম পাড়ালাম। আপনি বরং এখন চা-টা খেয়ে একটু রেস্ট নিন। আমি টিভিটা চালিয়ে দিচ্ছি।
প্রমিতিয়ার চোখে আবার একটা সুখী সংসারের ঝকঝকে ছবি ভেসে উঠলো। স্বামী-সন্তান নিয়ে রুণা বেশ সুখেই আছে তাহলে। রমেনের হয়তো স্বভাবটা বদলেছে। নাঃ! রুণার কপালটা ভালো বলতে হবে। কোথাকার জল কোথায় থিতু হয়েছে।
৩.
ঘুম আসছিল না প্রমিতিয়ার। রুণা তাকে খাইয়ে দিয়ে শোবার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। ওদের বেডরুমের পাশে একটা ছোট ঘর, ফাঁকাই পড়ে থাকে, সেখানেই আজ রাতটা থাকবেন প্রমিতিয়া। এখনও ফেরেনি রমেন। সাড়ে এগারোটা বাজে। সত্যিই কি কাজের জন্য নাকি সেই আগের মতই? বদ্ অভ্যাসটা কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বার সময় থেকেই হয়েছিল। বন্ধুদের সঙ্গে দীঘার হোটেলে রাত কাটানো, মদ-গাঁজা এসব মাঝে মধ্যে চলতো। এই ছেলের জন্য অনেক রাত জেগে কাটিয়েছেন প্রমিতিয়া। মদের ঠেক থেকে থানা, ছেলেকে ঠিক রাস্তায় আনতে বা জামিনে ছাড়িয়ে আনতে তাকেই লজ্জার মাথা খেয়ে যেতে হয়েছে। সৌমেন এসব ব্যাপারে কখনো মাথা দেননি।
রুণাকে নিয়ে ফুর্তি করে ছিল সবাই, কিন্তু হাতে নাতে ধরা পড়ে রমেন। ক্লাবের ছেলেরা মধুচক্র থেকে মারধোর করে পুলিশে দিত। হাতে পায়ে ধরে ছাড়া পায় রমেন। শর্ত, রুণাকে বিয়ে করতে হবে। গরীবের মেয়ে, পেটের জন্য, পরিবারটাকে বাঁচাবার জন্য এই পথে এসেছিল।
ক্লাবের ছেলেরা প্রমিতিয়া বা সৌমেন, কাউকেই জানায়নি। রেজিস্ট্রি বিয়ে দিয়ে বাড়ি বৌ তুলে দিয়ে গেছিল। সৌমেন নিতে পারেননি। দিন দুই একদম চুপচাপ পড়েছিলেন ঘরে। না অফিস, না বাজার, নিজেকে পুরোপুরি গৃহবন্দী করেছিলেন সৌমেন। তৃতীয় দিন রাতেই সম্ভবত স্ট্রোকটা হয়ছিল। আট-ন ঘন্টা পর প্রমিতিয়া যখন ডাকতে গেলেন, সব শেষ। কিছুই গুছিয়ে রেখে যান নি সৌমেন। একা হাতে প্রমিতিয়াই সব সামলে এসেছেন এতদিন।
-- প্লিজ, ওপেন দ্য ডোর।
কলিং বেলের শব্দে চিন্তার সুতোটা ছিঁড়ে গেল। প্রমিতিয়া উঠে বসলেন বিছানায়। রমেন এল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, রাত বারোটা দশ। বিছানা থেকে নেমে দরজাটা খুলতে গেলেন প্রমিতিয়া। কিন্তু থমকে গেলেন। জড়ানো গলায় রমেন, তার ছেলে বলছে ,
--- কেন এসেছে? খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল বলে, শোধ নিতে? নাও এবার সামলাও বাড়তি ঝামেলা। টাকা পয়সা দিতে পারবো না কিন্তু আমি? অত আমার এ নেই, বুঝলে! তোমার বেশী ফাটে তো তুমি করোগে যাও। আমাকে কিছু বলবে না। আর হ্যাঁ, বাবার পেনশনের সব টাকা তো ওনার গ্যাঁটে, সেখান থেকে একটা টুকরোও তো ছুঁড়ে দেয় না, আর দেবে কেন, আমি তো মানুষের বাচ্চা নই, কুত্তার বাচ্চা! জন্ম দিয়ে নর্দামায় ফেলে দেয় নি কেন?
-- মা ওই ঘরে রয়েছে। কেন এরকম করছো? ছেলের বাড়িতে মা কি আসে না? থাকতে তো আসেনি। বলছিল কি একটা ...
-- এই ---- এর বাচ্চা! তুই চুপ কর। আমাকে জ্ঞান দিবি না। খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছি, না হলে এখনো রোজ দশবার শুতে হত হোটেলে, বুঝলি।
একটা লেখার অযোগ্য গালাগাল দিয়ে, ঘরে এসে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো রমেন। তারপর, গজগজ করতে করতে বললো,
-- সব শালা আমার ঘাড়ে চাপার ধান্দা। ও বান্দা আমি নই!
একটা অদ্ভুত নেশাগ্রস্ত হাসিতে ফেটে পড়লো রমেন।
বন্ধ দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রমিতিয়া। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। তারপর ছেলের দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পা থেকে চপ্পলটা খুলে নিয়ে আবার এগিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালেন ছেলের। রমেন মুখ তুলতেই সপাটে একটা চপ্পলের বাড়ি কষিয়ে দিলেন ছেলের গালে।
এই অভিঘাতের জন্য তৈরি ছিল না রমেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে প্রমিতিয়ার জ্বলন্ত চোখের দিকে। সারা জীবনে প্রমিতিয়ার এই রূপ সে কখনো দেখেনি।
-- মা, তুমি মারলে আমাকে?
--- আরো অনেক আগে আমার এই কাজটা করা উচিত ছিলো । তাহলে তুই এরকম জানোয়ার হতিস না।
এক অদ্ভুত দৃঢ় স্বরে কথাগুলো বলে রুণার কাছে গিয়ে বললেন, সব জঙ্গল মানুষের বাঁচার মত হয় না, তাকে কেটে - পুড়িয়ে বাস করার মত করে নিতে হয়, আর না পারলে এই রকম অত্যাচার সহ্য করতে হয়।
প্রমিতিয়া আবার ঘরে ঢুকে এলেন। সমস্ত বাড়ি চুপচাপ। সঙ্গে আনা চটের উপর কারুকাজ করা ব্যাগটা থেকে কয়েক তাড়া কাগজ বের করে হাতে নিয়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন। তারপর বের হয়ে এলেন ঘর থেকে। রুণার সামনে এসে তার হাতে কাগজগুলো দিয়ে বললেন,
-- এগুলো দেবো বলেই এসেছিলাম আজ। এগুলো আমার যা কিছু স্থাবর- অস্থাবর তার দলিল, সব তোমার আর বুট্টুর নামে করে দিয়েছি। ওকে এক টুকরোও কিছু দিই নি। জানোয়ারের সম্পত্তিতে কি কাজ? আজ থেকে তুমি ওর পায়ের তলার জুতো নও। শিরদাঁড়া সোজা করে বাঁচবে। বুট্টুকে মানুষ করবে, ওর মত অমানুষ যেন না হয়।
ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন প্রমিতিয়া। সব দায়িত্ব শেষ হল। এর পরের জীবনটা খুঁজে নিতে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করে জ্বেলে নিলেন, এখন আর কোন দ্বিধাবোধ হচ্ছে না প্রমিতিয়ার।