অভাগী
বিশ্বনাথ প্রামাণিক
আজ ১৭ই আশ্বিন। রূপসার জন্মদিন।
পাকা আট বছর পরে এই প্রথম তার জন্মদিন। ছোট্ট রুপসা দৌড়ে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, মা আজকে পায়েস রাঁধছ মা? তবে তুমি যে বললে, পায়েস হবে না। চাল নেই, দুধ নেই, চিনি নেই... রূপসার মা তার কথার মাঝে বাঁধা দিয়ে বলল, ছিল না তো কিছুই। সব জোগাড় করে তোর কাকা দিয়ে গেল মা। বললে, মেয়েটা এত পায়েস খেতে ভালোবাসে! এবার তার কচি দুটি হাত গালে দিয়ে রুপসা বলে, ও কাকামনি? তাই বল, আমি ভাবি তাইতো এতসব যোগাড় হল কোত্থেকে? এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে চলে, আর থেকে থেকে তাদের মাটির উনানে ওপর বসানো পায়েসের হাঁড়ির দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। উনানের একপাশে কাঠের পিঁড়িতে বসে জ্বাল দিতে দিতে রূপসার মা তার ছোট মেয়েটির মুখের দিকে করুন দৃষ্টিতে চায়। আর মনে মনে ভাবে, ওর বাবা বেঁচে থাকলে কি আজ আমার এই দশা হয়? রুপসা এতসব বোঝেনা। কবে কিভাবে যে বাপটা আকাশের তারা হয়ে গেল, সে জানেনা। জানবে কি করে? রুপসা এবার বলে, মা পায়েসে দুটো তেজপাতা, আর একটা এলাচ দিও। ওবাড়ির মিনুর মা যখন পায়েস রাধে আমি দেখেছি, কি বাস বের হয়! রূপসার মা হাড়ির সরাটা খুলে খন্তির আগায় কটা ভাত তুলে টিপে দেখে বলে, আচ্ছা দেবকন।
আজ রূপসা সাত পার হয়ে আটে পড়েছে। তাদের গাঁয়ের প্রায় সব বাড়িতে এখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্মদিন পালনের ঢল নেমেছে। কত শাঁখ বাজে, কপাল ভর্তি চন্দনের ফোটা লাগিয়ে তারা যখন খেলতে আসে রূপসার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। সে কাউকে কিছু বলতে পারেনা। ফুল-পুষ্প দিয়ে ওদের মা-বাবারা কত আশীর্বাদী করে। তার তো বাবা নেই। মনো, বিজু, রমা, পুষ্প- সবার জন্মদিনে পায়েস হয়, লাল লাল কত মিষ্টি আসে। সে চেয়ে চেয়ে দেখে। কিছু বলে না কোনদিন। এবার এমন করে যে তার জন্মদিন হবে সে ভাবতেই পারেনি। আনন্দে আর উৎসাহে তার কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে। মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে মায়ের দুচোখ জলে ভরে আসে। আর.....
বুকে পাথর বেঁধে ছোট মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে মনটা শক্ত করে রূপসার মা। সকাল সকাল উঠে গরুটা মাঠে বেঁধে দিয়ে আসে। তারপর খাটের নীচ থেকে তার বিয়ের বড় পেতলের থালাটা বের করে বিজুর বাপের দোকানে বাঁধা দিয়ে আতপ চাল, গুঁড়ো দু্ধ, চিনি,- পায়েস রাঁধতে যা যা লাগে, সব কিনে এনেছে। মেয়েকে তো আর সে সব কথা বলা যায় না। খন্তির আগায়ে আবারো কটা ভাত তুলে টিপে দেখে নিয়ে রুপসাকে ডেকে বলে- এই হয়ে পড়ল মা। যা তোর কাকাদের কাছ থেকে দুটো ফুল তুলে নিয়ে আয়। আর দুব্বো ঘাস চিনিস তো? ঐতো মনোদের....., রুপসা আনন্দে লাফাতে লাফাতে বলে খুব চিনি। দুব্বো আবার চিনবোনি? সেবার পুস্পোর জন্মদিনে কত তুলেছি। সে তাড়াতাড়ি ঠাকুর ঘরে ঢুকে ফুল রাখার সাজি নিয়ে আসে। তার মা বলে, তবে যা। বেলা হলে আবার ফুল পাস কিনা দেখ। আর আসার সময় একেবারে তোর কাকিমার কাছ থেকে দুটো ধান চেয়ে আনিস। বলবি, মা চেয়েছে। মনে থাকবে? রুপসা মাথা নাড়ে। তার মা আজ তাদের পূজার রেকাবিতে ধান, দুব্বো, ফুল সাজিয়ে ধূপ জ্বেলে, আসন পেতে তাকে বসাবে। তারপর তাদের ফুলকাটা পেতলের বাটিতে করে এই এক বাটি পায়েস দেবে তাকে। সে ছুটে চলে যেতে গিয়ে আবার একটু দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, মা ওদের ডেকে আনবো? তার মা হেসে বলে, আচ্ছা। আসার সময় একেবারে ডেকে নিয়ে আসিস। আনন্দে তার চোখে জল এসে যায়।
এত বছর হয়ে গেলেও রূপসার মা কোনদিন তার জন্মদিন পালন করেনি। সে জানে এ নিয়ে তার মেয়ের মনে দুঃখের শেষ নেই। যে গেছে তার দুঃখ বুকে বাঁচিয়ে রেখে, যে আছে তাকে কষ্ট দেওয়া কেন বাপু? কথা খানি ঠিকই বলেছিল মনোর মা। এক রত্তি মেয়ে তোর, ও এসবের কি বোঝে? সব বাড়ি শাখ বাজে, ঘটা করে জন্মদিন হয়, ওর ও তো শখ হয় বউ। রূপসার মা জানে কি কপালে নিয়ে জন্মেছে মেয়েটা! সে বারের কথা মনে পড়লে এখনো তার ভয়ে বুক কাঁপে। উনানের ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির সরা খুলে গুঁড়ো দুধ গরম জলে গুলে নিয়ে ঢেলে দেয় সে। একটু দুধের গন্ধ না হলে পায়েস বলে মানাবে কেন? তারপর আবার সরা তুলে হাঁড়ির মুখ চাপা দিয়ে জ্বালটা উনানের মুখে ঠেলে দিয়ে বসে। মেয়েটা ফুল তুলে আনলে তাকে চান করিয়ে কাচা জামাটা পরতে বলবে।
তখনো সাজের বেলা শেষ হয় নি। পশ্চিম আকাশ লাল করে সুয্যি ঠাকুর অস্ত যাচ্ছে। আর একটু পরে নিশ্চুপ অন্ধকার নেমে আসবে ওদের গাঁয়ে। সেবার পেটে প্রথম ব্যথা উঠলো ওর। রূপসার বাবা তখনও বাড়ি ফেরেনি। নয় মাস যেতে না যেতে এমন ব্যথা! প্রথম পোয়াতি, তা দশ মাস পেটে রাখতে পারলো না? রূপসার ঠাকমা গজ গজ করতে করতে ওদের পাড়ার কানা দায়মাকে খবর দিল। বুড়ি এসে হাজারটা ফরমাশ করল, গরম জল বসা, শুকনো কাচা সুতির কাপড় জোগাড় করে আঁতুড়ঘর তয়ের কর , বউয়ের এবার বিয়োবার সময় হয়েছে হারার মা। মালশায় তুষের আগুন দিয়ে রাখ। মিছে কথা কইবনি, তা রূপসার ঠাকমা সব জোগার করে দিয়েছিল। চিন্তায় আর ভয় আমার বুক শুকিয়ে উঠেছিল। মানুষটা কখন ফিরবে কে জানে?
তারপর আর তার কিছু মনে নেই। এখনো চোখ বন্ধ করলে সে দেখতে পায় সব। চোখের সামনে জলের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুধু....
যখন জ্ঞান ফিরল তখন চারিদিক যেন অন্ধকার। ওঘর থেকে একটানা কান্নার আওয়াজ আসছে। সে প্রথমটায় ভাবল তার ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়েছে, তাই শাশুড়ি অমন মরা কান্না কাঁদছে। এমনটা সে কত দেখেছে বিয়ে হয়ে আসা অব্দি এই গ্রামে। তার মানুষটাও যে বড় আশা করেছিল প্রথমবার বউ ছেলে বিয়োবে। তাকে মনের মতো করে মানুষ করবে সে। কিন্তু তার ভুল ভাঙলো দু'পা যেতে না যেতে। মনোদের বাড়ির পিছন দিকে সরদারদের পুকুরের পাড়ে দেখা হয়ে গেল মনোর মায়ের সঙ্গে। কি করবি বাছা! সবি কপাল। এমন ফুটফুটে সোনার বন্ন মেয়ে জন্মালে তোর ঘরে, তা বাপ এসে তার চাঁদমুখ দেখে যেতে পারল না।
কি হয়েছে সানখুড়ি মা? ওর বাপ আসেনি আমায় দেখতে?
সে কথাই তো বলছি। তোর তো তখন এই যায় যায় অবস্থা। তোরে আর কি বলব? তোর শাশুড়ি তো কেঁদে খুন বাছা। অধীর আগ্রহ নিয়ে কথাগুলো শুনে যায় রূপসার মা।
কোমরের ওপর পেট কাপড়টা আরো একটু ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে, ডান হাতে বউয়ের মাথার সামনের ঝুলে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে সান খুড়িমা আবারো বলেছিল -শরীরের কি অবস্থা করেছিস বউ? চোখের কোনে কালি পড়ে... তারপর ডুকরে কেঁদে উঠি থেমে গিয়েছিল আর বলতে পারেনি।
সদ্য আতুর থেকে বেরিয়ে আসা বউটা ভেবে পায়না এতে এত কাঁদার কি হলো? এই বিশ্বসংসারে মেয়ে তো প্রথম তার ঘরে জন্মেছে, এমনটা নয়। অবাক হয়ে চেয়ে থাকে সে মনো ঠাকুরপোর মায়ের দিকে। বিস্ময়ে তার চোখের পাতা পড়ে না। কান্নার ধমক সামলে নিয়ে মনোর মা আবারো বলে, যা এবার ঘাটে গিয়ে একটা ডুব দিয়ে আয়। সব তো লুকিয়ে বসে আছে বাছা, যত দায় এখন এই আমার। কথাটা যে তার শ্বাশুড়ীর উদ্দেশ্যে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না বউয়ের। কিন্তু মনোর মার যে কি দায়! সে তখনও বুঝে উঠতে পারেনি। এনিয়ে বিনিয়ে সান খুড়িমা বলে চলে কি করবি? তোর ওই তো শরীরের অবস্থা। বেঁচে আছিস না মরে গেছিস তার ঠিক নেই কো। তাই আমরা পাঁচজনে বলা-কওয়া করি- এ কি ঠিক কাজ হল হারার মা?
বউকে ধরে ধরে ঘাটে নামিয়ে চান করিয়ে সাদা থান কাপড় খানা পরাতে এলে সে চমকে ওঠে। এ কথার অর্থ কি? নিজের হাতের দিকে চেয়ে তার তখন মনে পড়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কারা যেন জোর করে তার হাতের শাঁখা পলা ভেঙে দিয়েছিল। এখন খুড়িমা তার হাতের নোয়া খুলতে খুলতে বলে, বাছার আমার, মুখে তখনো অক্ত লেগে আছে, আহারে...
ঘাটের পাশে তুলসী তলায় নতুন তৈরি কাদামাটির নিকানো চারকোনা বেদির ওপর মাটির খুড়িতে জল ও কলাপাতায় আতপ চাল রাখতে রাখতে সান খুড়িমা বলে, নে পেন্নাম কর বউ। ক্ষীন শরীরে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে, খুড়িমার গায়ের ওপর মুচছা যায় বউ। তারপর অনেক সাধ্য সাধনা করে, জল খাইয়ে চোখেমুখে জলের ছিটে দিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলে। এরপর সেখানে বসে কোলের ওপর মাথা টেনে হাত বুলাতে বুলাতে পরম স্নেহভরে ধীরে ধীরে যা বলেছিল তা সংক্ষিপ্ত রূপ এইরকম-
প্রতিদিন কাজ থেকে ফেরার পথে আকন্ঠ মদ গিলে আসে হারা। সেদিনও তার অন্যথা হয়নি। পথে যেন কার কাছ থেকে খবর পেয়ে ছিল তার বউ আজ প্রথম বার আতুর ঘরে ঢুকেছে। রূপসার বাবা কলকাতায় রংয়ের কাজে যায়। আর ট্রেন থেকে নেমে সাইকেলে ফেরার পথে মদ গিলে আসে। বিয়ের সাত বছর পর এই প্রথম তাদের বাড়িতে আতুর ঘর সাজানো হয়েছে। ছেলে ছেলে করে হারা একেবারে অস্থির হয়ে উঠেছিল। তাই আনন্দে সেদিন একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিল আর কি। বেনদার মদের দোকানে ঢুকে এই সুখবর খানা কাকে দিয়েছিল তোমার শত্তুর ওই চাঁড়ালের ব্যাটা রেতু। দিন রাত ওদের সঙ্গে তো ওঠাবসা। দাঁত বের করে হেসে বলেছিল কি করে হলো রে হারা? একটা ছাবাল বিওতে পুরো এক যুগ লাগলো তোর? তারপর সবাই হিহি করে হেসে উঠেছিল। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠেছিল হারার। তারই শোকে সেদিন একটু বেশি মদ গিলে ফেলে ছিল সে।
চারিদিক অন্ধকার, নিশুতি রাত। ফেরার পথে হাতের সাইকেল টলমল করে। তবু শক্ত করে ধরে চালিয়ে আসতে গিয়ে ওদের মাটির রাস্তা উত্তর কোণে যে বাঁক আছে, সেই খানে রাজুদের তালগাছের গায়ে ধাক্কা মারে। তারপর গড়িয়ে গিয়ে পড়ে ওই বাগদদের এঁদো পুকুরে। পড়ে গেল তো গেল, তা কেও টের পেলে নে? যখন পেল তখন ফুলে এই একেবারে ঢোল হয়ে গিয়েছিল। এখবর তোকে কেউ দেয়নি। কি করে দেবে? তোর তখন যমে মানুষে টানাটানি বউ। তবুও আমি বলেছিলাম, তা হোক গে, তোরা একবার ওকে শোনা। হাজার হোক কচি বউ তা এই বয়সে..., মনোর মা আর কিছু বলতে পারেনি।
পাকা দুদিন পরে যখন তার জ্ঞান ফিরল সে দেখে তার পাশে ফুটফুটে এক রত্তি মেয়েটা শুয়ে আছে।
----------------