অণুগল্প ।। হিয়ার মাঝে ।। পারমিতা রাহা হালদার (বিজয়া)
হিয়ার মাঝে
পারমিতা রাহা হালদার (বিজয়া)হিয়ার বাইশ বছরের জন্মদিন, বাড়িতে বিশাল আয়োজন। কলকাতার বুকে নাম করা শাড়ির দোকান হিয়াদের। বনেদি ব্যবসায়ী পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারী হিয়া । প্রায় ছয়শ অতিথি আমন্ত্রিত সন্ধ্যের বার্থডে পার্টি তে।
সমস্ত গ্রেস্ট এবার আসতে শুরু করেছে পার্টি তে। হিয়া সেজেগুজে পরী হয়ে বন্ধুদের সাথে এনজয় করছে। এই মূহুর্তে বছর ছাব্বিশের একটি ছেলে পার্টিতে এলো। বেশ অপ্রস্তুত, লাজুক চোখে চারিপাশ দেখছে ছেলেটা। পড়নে খুবই সাধারণ পোষাক, হাতে একটা সামান্য ফুলের তোড়া। একজন ভদ্রলোকের কাছে এসে বললো পরেশ স্যার কোথায় জানেন? ক্যাইন্ডলি যদি একটু ডেকে দেন। ভদ্রলোক হিয়ার বাবা কে ডেকে দিলেন।
আরে অনীক এসেছো বেশ বেশ, চলো বার্থ ডে গার্লের সাথে পরিচয় করিয়ে দি। এই বলে বাবা অনীক কে নিয়ে হিয়ার দিকে আসতেই হিয়ার বন্ধুরা একটু বিদ্রূপের স্বরে বলল এই আইটেম পিস টা কে রে হিয়া? চুপ কর শুনতে পেলে ব্যাপার টা বাজে দেখাবে, বলেই হিয়া বাবার দিকে এগালো।
এই আমার একমাত্র রাজকন্যা হিয়া আজকের বার্থ ডে গার্ল,আর হিয়া ও অনীক আমার ওয়াক শপের নতুন ম্যানেজার, বেশ কাজের ছেলে। আচ্ছা তোমরা এবার কথা বলো আমি অন্য দিকটা দেখে আসি বলে বাবা চলে গেলেন।
ফুলের তোড়া হিয়ার হাতে এগিয়ে বার্থ ডে উইশ করে অনীক বললো আমি চলে যাচ্ছি স্যার কে একটু জানিয়ে দেবেন। সেকি! কিছু না খেয়ে চলে যাবেন কেন কোল্ডড্রিঙ্কস দি, ওয়েটার এদিকে এসো।
আপনি একদম ব্যস্ত হবেন না, আমি আসলে ভীষণ সাধারণ ঘরের ছেলে এই ধরনের পার্টিতে একদমই অভ্যস্ত নই অস্বস্তি বোধ হয়। আপনি বন্ধুদের সাথে এনজয় করছিলেন আমি এসে একটু বিব্রত করলাম বোধহয়। আসলে স্যার এতটাই জোর করলেন না বলতে পারলাম না।
না না এইটা হয়না। আজ আমার জন্মদিন আর আপনি খালি মুখে চলে যাবেন সেটা আমি কিছুতেই হতে দেব না। ওয়েটার এনাকে কিছু স্ন্যাকস দাও। আপাতত কেক কাটা পর্যন্ত থাকূন তারপর ডিনার টা সেরে ফিরে যাবেন।
হিয়ার কথা ফেলতে পারলো না অনীক। বন্ধুদের কাছে হিয়া ফিরতেই বন্ধুরা বললো কি ব্যাপার বল তো হিয়া তুই ওই পিসটার সাথে এতো কি কথা বলছিলি! প্রেমে পড়লি নাকি । আহ্ তোরা কি শুরু করলি বলতো, আমার লেগ পুল করিস না প্লিজ।
হিয়া পরেরদিন সকালে বাবার সাথে ওয়াক শপে গেল। কিন্তু হঠাৎ বিপদ,একটা ভাঙা মেশিনের টুকরো হিয়ার পায়ে পড়লো। অনীক ছুটে এসে হিয়ার পায়ে বরফ লাগিয়ে পরে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার জানালেন ফ্যাকচার বেশ কিছু দিন ভর্তি থেকেই ট্রিটমেন্ট করাতে হবে।
অনীক রোজ একবার করে হাসপাতালে আসতো হিয়া কে দেখতে। এরইমধ্যে কবে যে দুজনের মধ্যে অনুরাগ জন্মেছে কেউ সেটা বুঝতে পারেনি। টনক নড়ল হিয়ার ডিসচার্জের দিন। হিয়া অনুভব করল হসপিটালের দিন গুলোতে অনীক কে ওর ভালো লাগতে শুরু করেছে। অনীক এলে নিজের মনের কথা জানালো হিয়া। "আমি তোমাকে ভীষণ মিস করবো অনীক, এই কয়েক দিনে তুমি আমার অভ্যাস হয়ে গেছো"।
একি কাঁদছ কেন হিয়া, আমি বন্ধু হয়ে সব সময় তোমার পাশে আছি ,থাকবো। ভয় পেওনা তুমি। নিশ্চিন্তে বাসায় ফেরো।
এরপর ফোনেই কথা ম্যাসেজ দিন রাত
একাকার। হিয়া বলল,অনীক তোমাকে খুব ভালবেসে ফেলেছি তুমি আমাকে বিয়ে করবে? না হিয়া এইটা হয়না, আমরা ভালো বন্ধু। তুমি আমার মালিকের মেয়ে, কোন কর্মচারীর সাথে মেয়ের বিয়ে, পরিবার মেনে নেবেনা। তাছাড়া আমার পরিবার,চালচূলো কিছুই নেই। কেউ মানুক বা না মানুক আমি তোমার সাথেই জীবন কাটাতে চাই অনীক ।
অনীক মন থেকে হিয়া কে ভালবাসলেও সামাজিকতার খাতিরে হিয়ার থেকে দূরে সরে গেল। এক পৃথিবী ভালোবাসা তো হিয়ার জন্য কিন্তু "বামুন হয়ে চাঁদে হাত" না সেটা ঠিক কাজ নয়।
বেশ কিছুদিন অনীক ফোন ধরছে না, ভীষণ একা লাগছে হিয়ার। না আর নয়, এবার অনীকের মুখোমুখি হতেই হবে। বাইরে প্রচন্ড দুর্যোগ মাথায় নিয়ে হিয়া ওয়াক শপে পৌঁছালো। একি হিয়া তুমি তো একেবারে ভিজে গেছ, এই সময় এইখানে?
হিয়া কোন কথা না বলে অনীকের হাত ধরে নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে বসলো। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিতে দূজনেই ভিজে গেছে। হিয়া নিজের মাথাটা অনীকের কাঁধে রেখে কেঁদে ফেলল। অনীক জড়িয়ে ধরে বলল আমার অভাবের সংসারে তুমি কষ্ট করে থাকতে পারবে হিয়া?
হিয়ার পরিবার মেনে নিল না এই সম্পর্ক। বাবা অনীকের দিকে আঙূল তুলে বলল, তুমি যা মাইনে পাও তার থেকে দ্বিগুণ হাত খরচ পায় হিয়া তুমি ওর চাহিদা কোন দিনও মেটাতে পারবে?। যদি কোনদিন এই পরিবারের যোগ্য জামাই হয়ে উঠতে পারো তখন এসো হিয়ার হাত চাইতে। তিরস্কার করে বাবা অনীক কে প্রায় খাঁড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিল। অনীক সিংহদুয়ারের সামনে পড়ে গেল, ছুটে এসে হিয়া অনীক কে ধরে তুলে সবাই কে জানাল ও অনীকের সাথে চলে যাচ্ছে। যেদিন এই বাড়ির উপযুক্ত হয়ে উঠবে সেদিন ওরা দুজনে একসাথে ফিরবে তার আগে না।
মন্দিরে বিয়ে সেরে দুধ-আলতায় দুজনে একসাথে পা রেখে গৃহপ্রবেশ করলো নব দম্পতি। পাশের বাড়ির এক মহিলা বলল, একি ছেলেরা আবার দুধ-আলতায় পা রাখে নাকি এতো বাপু জন্মও দেখিনি। হিয়া হেসে বলল এই বাসায় আমরা দুজনে একসাথে জীবনের শ্রেষ্ঠ লড়াই লড়ব তাই একসাথে এই বাসা রাঙালাম।
বিয়ের খবরে হিয়ার কিছু সো-কল্ড বন্ধুরা এসে বলল, অনেক বড় ভুল করলি হিয়া এই আইটেম পিসটাকে বিয়ে করে। যার সামান্য স্মাটনেশ নেই সে কিনা তোর মতো সুন্দরীর হ্যাসবেন্ড। চেহারার সৌন্দর্য কি বড়ো কথা রে অনীকের মনটা যে ঈশ্বরের মতো পবিত্র ও সুন্দর সেটা আমি প্রথম দেখাতেই বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু শিক্ষা,টাকা,পরিবার এইসব তুই দেখতে পারতিস, যা ক্যাবলা এর দ্বারা কিছু হবে বলে তো আমাদের মনে হয়না।
ঠোঁটের কোণায় হাঁসি লাগিয়ে মৃদুস্বরে হিয়া বলল কে বলতে পারে এই অনীকই একদিন বড়ো কিছু হবেনা যে।
অনীক ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভীষণ ভালো। গ্যাজূয়েশনে ফাস্ট ক্লাস পাশ তবে সে কথা অন্যদের মতো জাহির করে বলার ছেলে অনীক নয়। এক্সিডেন্টে মা বাবার একসাথে মৃত্যু হলে পড়াশোনা বন্ধ করে চাকরি করতে হয় অনীক কে। হিয়ার বাবার ওয়াক শপের চাকরি টা চলে গেলে অন্য কম্পানি তে দূজনে একসাথে চাকরি নেয়। বেতন যা পায় তাতে মেরেকেটে দূজনের পেট চলে যায়। কিন্তু বেতনের বেশিরভাগ টাকার অংশ রাখা হয় অনীকের পড়াশোনার খরচ চালাতে।
অনীক কে নিজের যোগ্যতা সবার সামনে প্রমাণ করতেই হবে তাই বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা শুরু হয় নতুন করে। ফ্যাশন ডিজাইনার কোস কমপ্লিট করে অনীক বড়ো একটা কম্পানি জয়েন করে। ডিজাইনার হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে অনীকের। এরপর অনীক নিজের কম্পানি খোলে। সবচেয়ে বড় ব্যান্ডেড কম্পানি এখন অনীকের।
অনীক এবার হিয়ার হাত ধরে শ্বশুর বাড়ি যায়। সবার চোখে চোখ মিলিয়ে নিমন্ত্রণ করে হিয়ার জন্মদিনের। সন্ধ্যায় বার্থডে পার্টি হিয়ার সব বন্ধুরাও এসেছে। এতো বড়ো পার্টি হিয়ার বাবাও হিয়ার জন্য কোনদিন করতে পারেনি অকপটে স্বীকার করল সবাই। হিয়া আর অনীক হাতে হাত ধরে পার্টি তে ঢুকল। হিয়ার বন্ধুদের অনীক কে দেখে চক্ষু ছানাবড়া। সেই আইটেম পিস আজ এক্কেবারে হিরো।
অনীক পার্টিতে নিজেদের সংগ্রামের কথা বলল,কিভাবে ভূখা পেটেও হিয়া তার সাথ দিয়েছে। আজ হিয়ার জেদেই অনীক পরিচিতি লাভ করেছে। হিয়া ছাড়া অনীক অধুরা। হাঁসি মুখে সমস্ত অপমান সহ্য করে তারা আজ সবার কাছে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেই দেখাল। ধৈর্য আর পরিশ্রমের ফলে সফলতা অর্জন অবশেষে অপমান করা প্রতিটি মানুষকে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল অনীক।
-------০০০--------