অদৃশ্য ভয়
বিকাশ বর
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ড্রয়িংরুমের সোফাটায় ধপ্ করে বসে পড়লেন অবিনাশ। একেবারে কাটা কলাগাছের মত। অবসন্ন, বিপর্যস্ত, নিয়ন্ত্রণহীন শরীরটা নরম সোফার উপর তিনি যেন ছুঁড়ে দিলেন। পরমা সোফাটার এক কোণে বসে টিভি দেখছিলেন। অবিনাশের বাড়ি ফেরার সময় তাঁর ভাল মত জানা। তিনি সিরিয়াল মিলিয়ে সময় বুঝতে পারেন। অবিনাশের বসার ধরণ ও নির্দিষ্ট সময়ের আগে বাড়ি ফেরা তাঁর মনে কেমন ভয় ধরিয়ে দিল। বিদ্যুতবেগে তিনি স্বামীকে জড়িয়ে ধরলেন। --"কী হয়েছে তোমার ? এমন করছো কেন ?" অবিনাশ এক ঝটকায় পরমার আগল থেকে বেরিয়ে এলেন। সোজা ছুটলেন বাথরুমের দিকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলছেন ---"ছোঁবে না, ছোঁবে না আমায়--" বাথরুমে ঢুকে বেশ ক'এক বার হাতে সাবান দিলেন তিনি। সাবান- শ্যাম্পু দিয়ে ভালমত স্নান সারলেন। তারপর নিজের ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি দিলেন। স্বামীর হাবভাব দেখে পরমা হতভম্ব হয়ে গেলেন। কী হল মানুষটার ! এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে কেন ! দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে তিনি চীৎকার করে উঠলেন, ---"কী হয়েছে তোমার-- দরজা বন্ধ করলে কেন---" অবিনাশ ঘরের ভিতর থেকে গোঁয়াতে গোঁয়াতে বললেন, --"মুখে রোমাল বাঁধ। বাবুকে ফোন করে বলে দাও, আসার সময় যেন হাফডজন মাস্ক নিয়ে আসে। মাস্ক ছাড়া এ ঘরে কেউ যেন না ঢোকে।"
কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা একটু বেশিই স্বাস্থ্য সচেতন। শরীর নিয়ে এ়ঁঁরা খুব খুঁতখুঁতে। ঠিক সময়ে খাওয়া, সঠিক সময়ে ঘুমোতে যাওয়া--শরীর চর্চা--এ সব ঘড়ি ধরে পালন করা চাই। অবিনাশ এঁনাদের দলে। শরীর হল এঁনাদের মন্দির। পরমা এতক্ষণে ব্যাপারটা খানিকটা হলেও ধরতে পেরেছেন। --"তোমার কী ঠান্ডা লেগেছে, জ্বর জ্বর ভাব ! নাক দিয়ে জল পড়ছে------গলায় ব্যথা---?" ---"তোমার বা এত দরদ দেখানোর কী ছিল ? একেবারে জড়িয়ে ধরলে !" বন্ধঘর থেকে খেঁচিয়ে উঠলেন অবিনাশ। পরমা এবার বেশ ভয় পয়ে গেলেন। এখন যা সব শুনছেন, দেখছেন, রীতিমত ভয় ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপার। দরজার ওপার থেকে কাশতে কাশতে অবিনাশ বলে চলেছেন---"শোন, এই মুহূর্তে এসব কাউকে জানানোর দরকার নেই। তুমি তৈরি হয়ে নাও। আমাদের বেরুতে হবে। বাবুকে জানিয়ে দাও, আমাদের ফিরতে দেরী হবে।" ভয়ে শরীর অবশ হয়ে আসছিল পরমার। মুহূর্তে তাঁর মনে হল, পৃথিবীর সব আলো নিভে গিয়ে ঘোর অন্ধকারে সবকিছু ডুবে গেছে ! কী করবেন, কোথায় যাবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। বুকে সাহস এনে আর একবার তিনি জীজ্ঞাসা করলেন, -- " -কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে ?" অবিনাশ ভয়ে কাঁটা হয়ে জবুথবু হয়ে ঘরের মধ্যে বসে ছিলেন। মিউ মিউ করে উত্তর দিলেন,---"আরজিকরে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার হয়েছে। ওখানেই চল।" সিঁথি থেকে আরজিকর আধা ঘন্টারও রাস্তা নয়। এ অবস্থায় বাসে যাওয়া ঠিক হবে না। পুলিশ তুলে নিয়ে যেতে পারে---
পরমা সাতপাঁচ ভাবছেন। তিনি একটা ক্যাব বুক করে ফেললেন।
পরমা তৈরি হয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, --"এবার বেরিয়ে এসো। আর দেরী করা ঠিক হবে না।"
গত ক'এক দিন ধরে গলাটা বেশ ব্যথা ব্যথা। খুস খুসে কাশি হচ্ছে। বুকের মধ্যে একটা অজানা ভয় ভারী পাথরের মত ক্রমশ চেপে বসছে। অবিনাশ ভয়টাকে চেপে রেখেছিলেন। কাউকে কিছু বলেননি। আজ নাক থেকে কাঁচা জল গড়িয়ে আসতেই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন। উপসর্গগুলো ঠিকঠাক মিলে যাচ্ছে। --"হাঃ ভগবান ! আমার কপালে এই ছিল !" অবিনাশ যেন ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে গেলেন। দু দুটো রুমাল দু ভাঁজ করে, নাকের উপর এয়ার টাইট করে বেঁধে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। বাড়িতে মাস্ক নেই। মাস্কের দরকারও পড়েনি । এখনোও মাস্ক নিয়ে তেমন কড়াকড়ি নেই। রুমালই মাস্কের কাজ করবে। পরমাও একটা রুমাল নাকের উপর জড়িয়েনিয়েছেন।
আরজিকর এমার্জেন্সী সেলে ডাক্তারবাবুকে সব খুলে বললেন অবিনাশ। --"আমাকে বাঁচান ডাক্তারবাবু।" কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। মুখে মাস্ক বাঁধা এক সুদর্শন নার্সকে সঙ্গে দিয়ে, তাঁকে বিশেষ পরিষেবা কেন্দ্রে পাঠালেন ডাক্তারবাবু।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অনেক রকম ভাবে পরীক্ষা করলেন। মুখের লালা স্যাম্পেল হিসেবে টেস্টের জন্য নিলেন। বললেন, --"ভয়ের কিছুই দেখছি না। ঘন্টা দুই বসুন সব জানা যাবে।"
দু'ঘন্টা যেন দু'যুগ মনে হচ্ছে অবিনাশের। পৃথিবী তলিয়ে গিয়ে আবার যেন আর একটা নতুন যুগ আসছে। অবিনাশ চোখ বন্ধ রেখে মনে মনে প্রার্থনা করছেন, তার যেন অশুভ কিছু না হয়। রিপোর্টটা যেন নেগেটিভ হয়। পরমা কপালে হাত জোড় করে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। হয়তো আরাধ্য দেবতাকে ডেকে চলেছেন। আড়াই ঘন্টা পর ডাক পড়ল। ডাক্তারবাবু হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন। --"নাথিং। এটা একটা সাধারণ ফ্লু। সিজন চেঞ্জ হচ্ছে তো তাই জানান দিচ্ছে। অ্যন্টিবায়োটিক আর প্যারাসিটামল দিলাম। খাওয়ার পর দেখবেন বেশ সুস্থতা বোধ করছেন।"
অবিনাশ পরমার দিকে তাকালেন। এতক্ষণ যে আশঙ্কার কালো মেঘ তাঁর বুকজুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল, নিমিষেই তা উধাও হয়ে গেল ! তিনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন যেন ! পরমার চোখে জল টলটল করছে। ঘোরতর সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার পর , তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে অবিনাশের বুকে মুখ লুকোলেন ।
--------------------
-------
বিকাশ বর
সিঁথি/দমদম
কলকাতা : ৫০
ফোঃ 9038263360