সকালের ফুল

বিকাশরঞ্জন হালদার

দোকানটার ঝাঁপ কদিন ধরে বন্ধই ছিলো। যতবারই তাকিয়েছি একটা অদৃশ্য অকাল অবসরের ছায়া যেনো দৃশ্যমান হয়ে লেপ্টে থাকতে দেখেছি ঐ বন্ধ দরজায়! শুনেছি সে নাকি বিশেষ অসুস্থতার হাত ধরে কোথায় গিয়েছে কোন্ ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে! তার অসুস্থতা ক্রমে শক্ত করে ধরেছে তার হাতটা। যে হাত কাজের হাত। যে হাতটা বাড়িয়ে সে ধরে রেখেছে তার দুস্থ সংসারটার ভাঙা হাল! একটা ছোট্ট চায়ের দোকানের সুশান্ত ছেলে সুখরাম। আমাদের সংক্ষিপ্ত ডাকে সুখি। " সুখির কি হলো? " মনে মনে প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম! ঝাঁপের বাইরে সেই মস্ত উনুনটা আছে। নিবে আছে। আঁচ্ নেই! কেমন যেনো বিষণ্ণতার আঁচড়ে ছাই ঝরতে দেখি। যেনো পরিবর্তিত রক্ত! যেনো ঠিক রক্ত নয়, অদৃষ্ট পূর্ব শরীরগত মনোগত কষ্ট। যা এখন অদ্ভুত ভাবে, আশ্চর্যজনকভাবে বাইরে আগত। আমি দেখি! কেনো যে দেখতে পাই তার কোনো কারণ দেখতে পাই না! দিন শুধু পার পেয়ে যায়!

একদিন আচমকা দেখা হয়ে গলো সুখির এক প্রতিবেশীর সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলাম- হ্যাঁ রে সুখির খবর কি? দোকানটোকান আর খুলবেনানা নাকি? তার তো আর দেখাই নেই! কি ব্যপারে বল দেখি? সে কি ছুটি নিয়েছে ? একটু বেশি করে বললাম।

পাড়ার ছেলেটা বলল- " ছুটি নেয় নি এবার নেবে। যা অবস্থা ওর, এবার ছুটিই নিতে হবে।" একটু চুপ করে থেকে বলল- " আমার কথা বুঝতে পারোনি? ওর নাকি কি অসুখ হয়েছে, কোনো ডাক্তার রোগ ধরতে পারেনি। ওর বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। ও হয়তো আর বাঁচবে না। "

সে কি রে- ! কিবলছিস কি- ! কোনো ডাক্তার রোগ ধরতে পারেনি? কোন্ ডাক্তার দেখিয়েছে ? কোনো হাসপাতালে যায়নি? তা ওকে তো ভেলোরে নিয়ে যেতে পারতো? তারপর নিযেই বড়ো লজ্জা পেয়ে গেলাম! কিকরে সম্ভব! সামান্য এই চায়ের দোকানটাই যার বেঁচে থাকার অবলম্বন ..... অতো টাকা পাবে কোথায়! ঝুঁকে পড়া মলীন মেঘের মতো মনটা কুঁচকে গেলো! সুখির সেই মুখটা ফুটে উঠলো! যে মুখে হাসি থাকতো না, যে মুখে কথা ফুটে উঠতো একটা দুটো কখনও সখনও! দোকানে বেকার ছেলেদের পরিচিতি ভিড় জমে উঠতো সকাল - বিকেল- সন্ধে। অকারন কাব্য কচকচা - রাজনীতি - নাটক এক টেবিলে হাঁপিয়ে উঠতো! আর জ্বলত সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে , কাপে কাপে ধোঁয়া উঠতো সুখির গরম চায়ের! ছেলেরা উলসে উঠতো। সুখির কোনো উচ্ছাস কখনও দেখিনি। তার মুখে একটা ছায়ার ঢাকনা থাকতে দেখতাম বরাবর। মুখটা বড়ো দুঃখী দুঃখী, বড়ো করুণ মনে হতো! আর ঐ মুখটাকে ভালোবেসে, আমরা যেতাম বসতাম আড্ডা দিতাম দোকানে বসে।

নাঃ, আমি যেনো বড্ড স্মৃতি মেদুর হয়ে পড়ছি! হ্যাঁ কি যেনো বলছিলাম? - ছেলেটাকে আবার বিরক্ত করি। ও আবার বলতে থাকে - " অনেক ডাক্তার দেখেছে। কতো সব এক্স রে টেক্স রে, করেছিলো কিন্তু কিচ্ছু হয় নি। কোলকাতার কোন্ হাসপাতালে গেলে এবারে নাকি ফিরিয়ে দিয়েছে। বলেছে আর হবে না! শুনছি নাকি ডাক্তার বলেছে - ওর লিভার ক্যান্সার হয়েছে আর বাঁচবে না! "

ছেলেটার থেকে শুনে, মনটা কেমন যেনো হয়ে গেলো! এতো ডাক্তার- এতো হাসপাতাল - নার্সিং হোম। যারা মরার তারা কিন্তু মরছেই! মরেই চলেছে! সুখির কম বয়েস। ওর দুটো নাবালক ছেলে আছে শুনেছি!

পাড়ার ঐ ছেলেটার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর , একটা দুটো দিন কেটে গেছে বোধহয়। সেদিন রাস্তায় বেরিয়েছি , যেমন বেরহই টুক টাক কোনো দরকারে। একদম সকাল বেলা। দেখলাম চারজন লোকের সঙ্গে সুখি! ঝট করে ডাকতে গেলাম- কি রে সুখি কোথায় যাচ্ছিস? তারপর এক গোছা কম দামি ধূপের পোড়া গন্ধ, আর রজনীগন্ধার রহস্যময় সহযাত্রায়, স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! সুখি চলে যাচ্ছে! আশ্বিনের স্নিগ্ধ সকাল! নম্র হৃদয়ে মনে মনে বললাম ---‐‐ যাও সুখি! আন্তরিক প্রীতি রইলো তোমার সঙ্গে !!

============