অন্তঃসত্ত্বা
সোমা মজুমদার
মোনালি সেই ছোট্ট বেলায় বাবাকে হারিয়েছে। মা বাবার আদরের একমাত্র সন্তান ছিলো মোনালি। বাবা একটা ছোট্ট চাকরি করতেন। এক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালেই চলে যান মোনালির বাবা সমীর বাবু। সামান্য পেনশনের টাকায় কোনমতে সংসার চালাতেন মোনালির মা কমলা দেবী। তবে মোনালি কে যথাযথ মানুষ করতে তিনি কোন ভুল করেননি। এদিকে শহরের সম্ভান্ত্র চৌধুরী পরিবারের একমাত্র আদরের সন্তান সায়নের সাথে মোনালির প্রেম মনদেওয়া নেওয়া সব হয়ে যায়। সায়ন নিজের মাকে ভালো করেই জানতো। তার অহঙ্কারি মা বাপ মরা গরিব পরিবারের এই মেয়েকে চৌধুরী বাড়ির বউয়ের মর্যাদা অতন্ত্য দেবেন না।
এদিকে মোনালি সায়নের প্রেম পর্ব চলছে।
ওদিকে একদিন রাত প্রায় দুটো নাগাদ মোনালির মার হঠাৎ পেটে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হলে মোনালি সায়ন কে ফোন করে।
প্রেমিকার ফোন পেয়ে প্রায় তক্ষুনি সায়ন গাড়ি নিয়ে ছুটে চলে আসে মোনালিদের বাড়ি।
তখনও মোনালির মা সায়ন কে চিনতেন না। প্রায় বেহুশ অবস্থা দুজনের কাঁধে ভর করে গাড়িতে উঠলেন কমলা দেবী। শহরের একটি নামী বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলো কমলা দেবী কে। ব্যথা নাশক ইনজেকশন ও সেলাই দেওয়ার পর একটু আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন কমলা দেবী। পাশেই বসে আছে একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকা এক আলোক উজ্জ্বল ভোরের অপেক্ষায়।
ভোরে কমলাদেবীর ঘুম ভাঙলে সায়ন নিজেই নিজের পরিচয় দেয় কমলা দেবীর কাছে।
মোনালির মা মোনালির জন্য এমন ভদ্র মার্জিত একটা ছেলে চাইছিলেন। তিনি আশীর্বাদ করলেন উভয়কেই সাথে এও জানাতে ভুললেন না সায়নকে, যে তিনি চাইছেন তাদের বিয়ে টা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। কারণ তিনি অসুস্থ এই অবস্থায় মেয়ের জন্য সারাক্ষণ চিন্তা যদি সায়নের হাতে মোনালিকে তুলে দিয়ে মরতে পারেন তবেই যেন শান্তি। সায়ন ও খুব শীঘ্রই মোনালিকে তার জীবনসঙ্গী করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলো।
প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কিছু দিনের মধ্যে সায়ন মোনালিকে গোপনে বিয়ে করে নিলো।
তার কিছু কাছের বন্ধু মোনালির কিছু বন্ধু ছাড়া এই বিয়ের খবর কেউ জানলো না। বিয়ের পর মোনালি ও তার মায়ের সব দায়িত্ব সায়ন নিজের কাঁধে তুলে নিলো।
এই যেমন মোনালির অসুস্থ মা'র চিকিৎসা, মোনালিদের ছোট্ট কুঁড়েঘর টি পাকা করে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
এদিকে বিয়ের বছর খানেক হতেই মোনালি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। কিন্তু সায়ন বুঝিয়ে সুঝিয়ে অপারেশন করে নেয়। তার ঠিক পরের বছর আবার মোনালি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে এবার ও সায়ন অপারেশন করাতে চাপ দেয়, কিন্তু প্রথম বার মোনালি রাজি থাকলেও দ্বিতীয় বার সে একদম রাজি ছিলো না। সায়ন একরকম জোরকরেই অপারেশন করিয়ে নিলো। মোনালি চাইছিলো তাদের এই সম্পর্কের সামাজিক সৃকৃতি, চৌধুরী পরিবারে বউ হয়ে পা দেওয়া, নিজের একটা সংসার, সন্তান যে স্বপ্ন প্রতিটি মেয়ে গোপনে লালন করে থাকে।
তারপর দুবছর কেটে গেলো।
প্রেম পরিচয়, বিয়ে সব মিলিয়ে সাতবছরের মাথায় আবার মোনালি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। এবার সে বুদ্ধি করে সায়ন কে কিছুই জানালো না।
প্রায় পাঁচমাস হয়ে যাওয়ার পর মোনালি সায়নকে সব জানায়। সব শুনে তো সায়নের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কি করবে এখন?
মাকে কিছুতেই বুঝতে পারবে না, এমনকি মায়ের সামনে এসব উচ্চারণ ও করতে পারবে না, সে তা ভালো করেই জানে।
আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো, যদি কিছু করা যায় এই আশায়।
কিন্তু না, এ ডাক্তার, ও ডাক্তার করে কোন ডাক্তারেই কাজ হলো না।
এক ডাক্তার তো বলেই দিলো আরে আর মাত্র পাঁচ মাসপরেই তো আপনাকে বাবা বলে ডাকবে।
এদিকে মোনালীর চাপ, অন্য দিকে মায়ের ভয়,
অবশেষে কিছু ভেবে না পেয়ে সায়ন তার মামা বাড়িতে গেলো। বড় মামা নিসন্তান, ছোট বেলা থেকে বড় মামা ও বড় মামী থাকে নিজের ছেলের মতো স্নেহ করতেন।
একবুক আশা নিয়ে তাই সায়ন গেলো বড় মামীর কাছে। যদি মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মোনালী ও তার অনাগত সন্তান কে বাড়িতে জায়গা দেওয়া যায়।
সব শুনে বড় মামা ওবড় মামী সায়নের মা প্রমীলা চৌধুরীকে বুঝানোর জন্য সেদিন সন্ধ্যার পর বোনের বাড়ি রওনা দিলেন।
মা যে খারাপ ভাষায় গালাগাল করবেন সায়ন তা জানতো, কিন্তু মা যে এতটা কঠিন হবে তা সে ভাবতেও পারেনি।
সব শুনে তো প্রমীলা দেবী একসম এও বলে দিলেন, এসব মেয়েদের তো রাত হলে অনেকই থাকে সকালের আলোয় আর কেউ থাকে না। মোনালির গর্ভের সন্তান নিজের ছেলের নয় তাও বলতে তিনি দুবার ভাবলেন না। শেষে প্রমীলা চৌধুরী সায়নকে যে সমাধান শুনাইলেন সেটা হলো _ কতো টাকার দরকার, ঠিক কতো টাকা হলে মোনালি সায়নের উপর থেকে এই বদনাম তুলে নেবে তা যেন সায়ন যেনে আসে।
আর নিজের বড় ভাই ও বৌদি কে এই সুপারিশ করতে আসার জন্য অপমান করতে ও ছাড়লেন না।
সায়ন কি করবে ভাবতে ভাবতে কোন কূলকিনারা পাচ্ছে না। মোনালিও চাপ দিয়ে যাচ্ছে, বৌকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে না তো বিয়ে করেছিলে কেন??
দুদিন পর এই সন্তানের পিতার পরিচয় সমাজে কি দেবো কোন কথা শুনাতে বাকি রাখছে না।
চারদিন হয়ে গেলো, সায়ন ভাবছিলো হয়তো একটু সময় গেলে মায়ের রাগ কমতে পারে
আর মোনালি ও তার সন্তান কে মেনে নিতে পারেন, কিন্তু না, প্রমীলা দেবীর অহঙ্কার কিছুতেই মাটি ছুঁতে চায় না।
তার পাথর হৃদয় গললো না।
একদিন রাতে শুয়ে আছেন মা, সায়ন মায়ের ঘরে প্রবেশ করলো,
মায়ের দুপা জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি ক রলো, কিন্তু সন্তানের এমন কান্নায় মায়া হওয়ার চেয়ে আরও রাগ করলেন।
বললেন এই রাস্তার মেয়ে যদি তার নাজায়েজ সন্তান নিয়ে এ বাড়ির সীমানা মাড়ায় তবে তার মরা মুখ দেখবে ছেলে।
কিছুই হলো না। জীবনের প্রতিটি ধাপে জয়ের মালা পরা এই ছেলেটি এভাবে হেরে যাবে স্বপ্নও ভাবেনি।
কি করবে এখন সায়ন?
না মায়ের কাছে একটু শান্তি পাচ্ছে, না বউয়ের। এই বাড়ি ছেড়ে মায়ের কথার তোয়াক্কা না করে যদি মোনালি কে নিয়ে অন্য বাড়ি উঠে, তবে তার যে মা তিনি নিজেকে শেষ করে দেবেন।
এটা সায়ন ভালো করেই জানে।
আর সে এমনটা কখনও হতে দিতে পারেনা।
পাঁচদিন চিন্তা করে সায়ন শুধু চোখের সামনে বাঁচার একমাত্র পথ দেখলো মৃত্যু।
তার নিজের সম্পত্তির ভাগ থেকে স্ত্রী সন্তান যেন কিছুতেই বঞ্চিত হতে না পারে সেই ব্যবস্তা করে।
একদিন দুপুরে মোনালি কে একটা চিঠি লিখলো।
আমার মোনালি_
আমায় তুমি ক্ষমা করো। আমি তোমায় শুধু কষ্ট ছাড়া কিছুই দিতে পারলাম না।
কিন্তু জানো, আমার ভালবাসা একটুও মিথ্যা ছিলোনা।
মোনালি, বেঁচে থাকার সব রাস্তা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন মৃত্যুর মাঝেই খুঁজে নিতে হয় জীবনের ঠিকানা।
আমিও তাই করতে যাচ্ছি।
তুমি যদি আমায় ভালবেসে থাকো, তবে আমাদের ভালবাসার উপহার আমার নিষ্পাপ সন্তান টাকে যথাযথ মানুষ করো।
এই দায়িত্ব শেষ হলে দেখে নিও ওপারে আমাদের আবার মিলন হবে।
আর মাঝখানের এই কয়কটা দিন তোমায় আমাকে ছাড়া থাকতে হবে।
ভালো থেকো।।
ইতি_
তোমার সায়ন।
চিঠিটা লিখে সায়ন তার খুব কাছের বন্ধু দীপকের হাতে দিলো।
সে জানে দীপক চিঠিটা খুলে দেখবে না।
দীপক চিঠিটা হাতে নিয়ে বাড়ির গেটের সামনে যেতেই বাজার থেকে বাড়ি ফেরত প্রমীলা দেবীর সামনাসামনি হয়ে যায়।
প্রমীলা চৌধুরী দীপকের আসা এবং যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সায়ন যে চিঠিটা মোনালি কে দিয়ে আসার জন্য ডেকেছিলো তা বলে দিলো।
কারণ প্রমীলা চৌধুরীর সামনে দাঁড়িয়ে কি মিথ্যে বলবে তা খুঁজে পায়নি দীপক।
সাথে সাথেই চিঠিটা পড়ে নেন প্রমীলা দেবী।
আর তক্ষুনি প্রমীলা চৌধুরী ও দীপক দৌড়ে চলে আসেন সায়নের রুমে।
হয়তো আর একটু পরে এলে সব শেষ হয়ে যেতো। সায়ন গলায় ফাঁস লাগিয়ে মৃত্যুর মাঝে একটু শান্তি খোজার চেষ্টায়।
দীপক আর প্রমীলা এখন থেকে থাকে উদ্ধার করে হসপিটাল নিলেন।
তখনও জ্ঞান ফিরেনি। এদিকে দীপক ফোন করে মোনালি কে সব জানিয়ে দিলো।
মোনালি প্রায় পাগলের মতো অস্থির হয়ে হাসপাতালে ছুটে চলে আসে।
একদিকে শরীর টা ভালো নয় প্রথম সন্তান আসবে শরীরে অনেক সমস্যা, অন্যদিকে এই সন্তানের কি পরিচয় দেবে সমাজে সব চিন্তায় এমনিতে শরীর টা খুব দুর্বল ছিলো, আর এখন সায়ন গলায় ফাঁস লাগিয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এতো দখল আর তার শরীর নিতে পারলো না। জ্ঞানহারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো মোনালি।
তাড়াতাড়ি এই হাসপাতালেরই অন্য এক কেবিনে ভর্তি করা হলো মোনালি কে।
ওদিকে কিছু সময় পর সায়ন একটু সুস্থ হলো।
জ্ঞান ফিরে পেলো।
কিন্তু পাঁচঘন্টা অজ্ঞান থাকার পর মোনালি আর তার অনাগত সন্তান চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লো।
সায়ন উন্মাদের মতো মোনালির মৃতদেহটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
মরে গেলো মোনালি, মরে গেলো তার সন্তান, সায়ন বেঁচে থেকেও মৃত, পেলনা আগের মতো একটা স্বাভাবিক জীবন। কয়েকটা খেলনা পুতুল বুকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদে।
যেখানে কোন ছোট বাচ্চা দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদে।
বেঁচে রইলো শুধু চৌধুরী বাড়ির দালান বাড়ি, গাড়ি আর প্রমীলা চৌধুরীর একরাশ অহঙ্কার।।
সমাপ্ত।