ভালোবাসার মিষ্টি গন্ধ
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
"জানো তো ভালোবাসার না একটা সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ আছে। আর সেটা পেতে গেলে কিন্তু শুধু নাক থাকলে হয় না; বিরাট, এত্তবড় একটা ভালো মনের ও দরকার। " এই কথাগুলো শুনে রজত হাসিতে ফেটে পড়েছিল। দিনটা ছিল ২৫শে বৈশাখের পরদিন । দলবেঁধে বন্ধুরা সবাই মিলে মিলেনিয়াম পার্ক গিয়েছিল ক্লাসের শেষে । দারুন মজা হয়েছিল সেবার। ততদিনে রজত আর মধুরা একে অপরের কাছাকাছি চলে এসেছে ।যদিও ওদের গল্পটা আর পাঁচটা প্রেমকাহিনীর মত ছিলনা। বিশেষত প্রথম দিকে দুজন দুজনের একেবারে ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যেই ছিলনা। তারপর গঙ্গা পদ্মা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। আর কালের দাবী মেনেই মন দেওয়া নেওয়।তারপর দেখতে দেখতে কেটে গেছে ২২ বছর। রজতের মাস্টার্স করার পরে বছর দশেক দিল্লীতে চাকরির পর মার্কিন মুলুকে পাড়ি । গত ছয় বছর ধরে সেখানেই ঘাঁটি। আর মধুরা একাডেমিশিয়ন থেকে যায়, পড়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে । বরাবর ই তার মাল্টি ন্যাশনাল কম্পানির চাকরি নাপসন্দ। কাজেই কলেজে ছাত্র পড়িয়েই তার দিন চলছে। রজত বারবার বলার পরেও সে এই শহর ছেড়ে কোথাও যাবার কথা একবার ও ভাবতে পারেনি ।
" মা, তোমাকে জবা পিসি ডাকছে'" রিভুর ডাকে ফিরে তাকায় মধুরা। জবাদি ততক্ষণে দরজায় দাড়িয়ে।
"বৌমনি, দুজন লোক এসেছে, তোমাকে ডাকছে। "
মধুরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে দেখল ক্যাটারারের লোক বসে আছে।
সারাদিন ধরে সব কিছু মোটামুটি ঠিক করতেই চলে গেল। প্রায় সারাদিন ই। রাতে ঘরে গিয়ে দেখে রিভু ঘুমিয়ে কাদা। মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। মাকে না পেয়ে একাই কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে ঘুমচ্ছে ।
পোশাক ছেড়ে বিছানায় এসে বসতেই রজতের ফোন।
লক ডাউন এর মধ্যেও ওকে অফিস যেতে হচ্ছে ।যদিও লক ডাউন সেই অর্থে হচ্ছে না মার্কিন মুলুকে। দোকানপাট খোলা । শুধু বয়স্কদের জন্য আলাদা সময়। সমাজিক দুরত্ব বজায় রেখে খুলে রাখা হয়েছে পাব। রেস্তরাঁ গুলো টেক আওয়ে করছে। বলতে গেলে প্রায় সব স্বাভাবিক।
খালি রাস্তায় গাড়ি কম চলছে। আমেরিকানরা ভীষণ অহঙ্কারী। তারা মনে করে দুনিয়ার শ্রেষ্ট জাতি ওরাই। ফেডারেল সরকারের প্রতিও অগাধ বিশ্বাস। ওরা ভাবে দেশ ঠিক কোন ওষুধ না ভ্যাকসিন শিগগিরি বের করে ফেলবে ও সবাইকে
এই মহামারি থেকে বাঁচাবে । তাই ভয়ডর নেহাত ই কম। স্কুল কলেজ অবশ্য বন্ধ আছে। যদিও রজত বলে এদেশের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি পড়ার ধাঁচ আলাদা। বস্তুত চাপ নেই, পুঁথিগত বিদ্যার উপর একেবারেই জোর দেওয়া হয়না। বরং নিজস্ব ক্রিযেটিভ ব্যাপারগুলোকে অনেক বেশি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়।
" সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলেছ? "
" জানিনা ঠিক কিনা, সব ই তো করা হোল। দেখা যাক । শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়ায়। "
" আচ্ছা, বাবার ঐ ছবিটা যেটা পুরী গিয়ে তোলা , ওটা মার ঘরে আলমারিতে আছে"
"হ্যাঁ, জানি ।কল সকালেই রেডি করবো"।
"মা কি করছে? "
"কি আর, ভেঙে পড়েছিল। এ কদিনে তাও কিছুটা সামলেছে"।
" রিভু ঘুমে?
"হুম"।
" সাবধানে থেকো। নিজের খেয়াল রাখবে। "
রজতের ফোন টা রাখার পর, মধুরার মনে পড়ল গতবছরের কথা । ঠিক এক বছর আগেই রজতের সাথে আমেরিকা গিয়েছিল। যাবার ছয় দিন পরেই শ্বশুরের অসুস্থতার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি দেশে ফিরেছিল তিন জন । এয়ারপোর্ট থেকে নেমে বাইপাসের হাসপাতালে গিয়ে আর দেখতে পাবে কিনা, যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় আর ডক্টর সরকারের অক্লান্ত চেষ্টায় সেবার বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন। হয়ত সেটাই শেষের শুরু।
নায়াগরা দেখতে না পওয়ার দুঃখ ছিল রিভুর মনে, কিন্তু দাদান কে সুস্থ দেখার আনন্দের কাছে তা কিছুইনা।
রজত দশ দিন পরে দেশ ছেড়ে গেল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার ধাক্কা ।আর এবার তো তিন দিনেই সব শেষ। প্রায় ৯০% ব্লক ধরা পড়েছিল। তার উপর ডায়াবেটিস । ভিডিয়ো কলে এক কি দুবার রজত কে দেখান গিয়েছিল বাবাকে।কিন্তু করোনা লক ডাউন। চারদিক স্তব্ধ। রজতের অনুপস্থিতে মধুরা শ্বশুর মশাইয়ের শেষ ইচ্ছা পুরণ করেছিল। মুখাগ্নি করতে হাত কেঁপে উঠেছিল মধুরার। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে সেটা করেছিল সে।
আজ থেকে ১৫বছর আগে যখন রজতের হাত ধরে মধুরা এই বাড়িটায় এসে পৌছেছিল, তখন রতনবাবুকে প্রথম নজরেই বাবা মনে হয়েছিল। আর আক্ষরিক অর্থেই রতনবাবু মধুরার বাবা হয়ে উঠেছিলেন । কখনই শ্বশুর হতে চান নি। সময়ে, অসময়ে আর দু:সময়ে মধুরা ছোটবেলায় বাবা না পওয়ার অভাবটা ভুলে যেতে পেরেছিল। রতনবাবু বৌমাকে মেয়ের মত না, মেয়েই মনে করতেন। তাই বরাবর ই ভরসা করতেন মধুরার উপরে। লক ডাউনে যখন রজত দুর দেশে আটকে, তখন হাসপাতাল বাড়ি সব একা হাতে সামলে নিয়েছিল সে।
রিভু আজ বহু দিন বাদে ছবি আঁকতে বসেছে। আর সেদিকে আনমনে তাকিয়ে আছে মধুরা। গত কদিনের ব্যস্ততা ও কাজের চাপ বেশ ক্লান্তি সৃষ্টি করেছে শরীরে । ও অবশ্যই মনে। কিছুক্ষণ আগে সবার পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দিয়েছে মধুরা। শ্বাশুরি পাশের ঘরে শুয়ে আছে।
ছবি আঁকা শেষ করেই রিভু বায়না শুরু করল ছাদে যাবার জন্য। ইচ্ছে না থাকলেও মধুরা হতাশ করল না রিভুকে।
ছাদে গিয়ে হুটোপুটি করছিল রিভু। ছাদের এধার থেকে ওধার ছুটে বেড়চ্ছে লাটিমের মত । আনমনে এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে মধুরা।
হঠাত রিভু দৌড়ে এল।
"মা, মা দেখো, কি সুন্দর গন্ধ এই ফুলটার ।
কি নাম গো মা এটার?"
মধুরা দেখল, তাই তো, বেশ কয়েকটা জুই ফুল ফুটেছে।
সে একটা ফুলের কাছে গিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিল । সত্যি কি মিষ্টি গন্ধ।
মা এর মুখে একটা প্রশান্তির আলো দেখে, কি বুঝল রিভু, কে জানে!
গলা জড়িয়ে মাকে বলল , "আমার মিষ্টি মা, সবচেয়ে ভালো মা। আমি তোমাকে খুউব ভালবাসি।"
# সমাপ্ত #