দূরসঞ্চার
অনিন্দ্য পাল
--"রোজ ওইখানে যেতে ভালো লাগে না!"
পৃথার গলায় আদুরে অনুযোগ। অঞ্জন কে বগলদাবা করে লেকের পাশে বেঞ্চে বসতে বসতে পৃথা আবার বলল, মা মনে হয় কিছু আন্দাজ করছে বুঝলে! কাল তেমনই মনে হল।
অঞ্জন বাম হাতটা পৃথার পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়ে বলল,
-- তুমি কি করে বুঝলে?
--মা'র ব্যবহারটা একটু অন্যরকম মনে হলো!
পৃথাকে আরেকটু কাছে টেনে নিল অঞ্জন। আর একটু পরেই সন্ধ্যা হবে। এই সময়কার আলোটা খুব মন মাতাল করে। দিনের শেষ থেকে রাতের শুরু। কারো শেষ থেকে অন্যের শুরু, প্রকৃতির সর্বত্র এই নিয়ম খেলা করে। কোথাও স্পষ্ট কোথাও গোপনে।
পৃথা অঞ্জনের বুকের উপর মাথা রেখে বলল,
--মা কোন বিষয়ে আমার ওপর রেগে গেলে তুই থেকে তুমিতে ওঠে। গতকাল রাত্রে যখন ফোনে তোমার সঙ্গে কথা বলছিলাম দরজা লক করা হয়নি। মাও কখনো অত রাত্রে আমার ঘরে আসেনা, কাল হঠাৎ এল খোঁজ নিল- ল্যাপটপ টা সুইচ অফ কিনা। কোথায় নাকি কে বিছানায় ল্যাপটপে আগুন ধরে মারা গেছে। ফোন করতে দেখেও গজ গজ করছিল।
অঞ্জন হেসে ওঠে--
-- এতেই তুমি ভেবে নিলে তোমার মা বুঝতে পেরেছে!
-- সেরকমই মনে হচ্ছে। আজ সকালেও মা ভালো করে কথা বলেনি। আবার আজ দেরী হবে ফিরতে। পৃথার গলায় চিন্তা রেশ।
-- তাহলে বাড়ি যাও তুমি, ভীতুর ডিম কোথাকার!
অঞ্জনের মশকরাটা পৃথার মধ্যে পৌঁছাল কিনা বোঝা গেল না। কারণ সেই মুহূর্তে পৃথার মোবাইলটা জিন্সের পকেটে থেকে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলো। বাবার ফোন। পৃথা অবাক। বাবা তো খুব প্রয়োজন ছাড়া কখনো ফোন করেনা।
--হ্যাঁ, বাপী বল !
পৃথার বাবা ফৌজদারি আদালতের দুঁদে উকিল। বিরাট পসার, বললেন--
-- পৃথু আজ ফিরতে একটু দেরি হবে, বুঝলি ক্লায়েন্টের বাড়ি পার্টি আছে। তোর মাকে ফোনে পেলাম না। মনে হয় বুটিকে আছে।
কেটে দিল বাবা।
তার মনে হলো মা'কে আজকাল ফোনই করে না বাবা। কি জানি কেন দুজনার মধ্যে একটা টাগ-অব-ওয়ার চলছে। একজন ক্লায়েন্ট পার্টি, শেয়ার মার্কেট, বন্ধুবান্ধব, নিয়ে চরম ব্যস্ত আর একজন ইদানিং বুটিক এর মধ্যেই দিনের বেশিরভাগ সময়টা কাটিয়ে দেয়।
পৃথাদের দুতলা বাড়িটা বাঘাযতীন এর ভিতর দিকে, বাড়ির নিচের তলার একটা ঘরে ওর মা দুজন বান্ধবীর সঙ্গে বুটিকটা খুলেছে। চলছে ভালোই।
ফোনটা রিসিভ করে পৃথা বেঞ্চ থেকে উঠে পড়েছিল, এটা ওর মুদ্রাদোষ। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেনা। অঞ্জন ততক্ষণে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো গুলো একে একে জ্বলে উঠেছে। সন্ধ্যা নেমে গেছে। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল, কেউ গল্পে মগ্ন, কেউ চুপচাপ ঠেস দিয়ে বসে আছে।
অঞ্জন বিরক্ত বোধ করে। সপ্তাহান্তে একদিন শনিবার অফিস শেষে দেখা করে দু'জন। বেশির ভাগ দিনই ওর সেন্ট্রাল পার্ক যায়। প্রেম করার মুক্তাঞ্চল। এক সপ্তাহ পর শরীর-মনের আংশিক খিদে মেটে। কিন্তু আজ পৃথা সেন্ট্রাল পার্কে যেতে চায়নি। তার গোঁ'তেই এখানে আসা অঞ্জনের। এই সময়টুকু অঞ্জনের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। মোবাইলে নষ্ট হলে বিরক্ত তো হবেই! নাকি পৃথার আজ ঘন হওয়ার তেমন ইচ্ছা নেই।
অঞ্জন একরাশ বিরক্তি নিয়ে হাত ঘড়ির দিকে তাকায়। প্রায় সাতটা বাজে। ক্লাবে যেতে হবে। ধুত্তোর! আজ সন্ধ্যেটা মোবাইলেই মারা গেল!
২
অফিসের গেটে কার্ড পাঞ্চ করতে করতে ঘড়ি দেখলো সায়ন্তন। হ্যাঁ, আজ আর আটকানো গেল না! লেট হয়েই গেল। গত তিন বছরে সর্বসাকুল্যে দু'দিন তার লেট ছিল। একদিন চাক্কা জ্যাম আর দ্বিতীয়টা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। ওর গাড়ির ঠিক সামনেই একটা মিনিবাস একটা স্কুটার কে পাস থেকে ধাক্কা মারে, ফলে বেসামাল স্কুটার প্রায় সায়ন্তনের গাড়ির তলায়। ড্রাইভার এর বিচক্ষণতায় ভয়ঙ্কর কিছু না হলেও স্কুটার চালকের পাঁজরের হাড় ভেঙে ছিল। উন্মত্ত পাবলিকের বাস পোড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা না করে বুঝিয়ে সুজিয়ে কাছের একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়ে বাড়িতে খবর দিয়ে তবে অফিস। তবে আজ দেরিটা এক অদ্ভুত কারণে। দুদিন হল সায়ন্তনের মা'র দীক্ষাগুরু তাদের বাড়িতে এসে উঠেছেন। বছরে দু'বার তিনি হরিদ্বার থেকে বাংলায় আসেন। একবার ওঠেন তাদের বাড়িতে পরেরবার অন্য এক শিষ্যার বাড়িতে। সায়ন্তন ধর্মে বিশ্বাসী না হলেও বয়স্ক মানুষটাকে শ্রদ্ধা করে। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য আর মিষ্টি স্বভাব সায়ন্তনকে আকর্ষণ করে। সেই ছোটবেলা থেকেই সায়ন্তনের সঙ্গে গুরুদেবের ভাব। বড় হবার পরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সায়ন্তন যেমন তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে, তেমনি কোনো সমস্যা হলে তাঁর পরামর্শ নেয়।
আজ সকালের টেলিপ্যাথির সত্যাসত্য নিয়ে কথা প্রসঙ্গে আলোচনা এত গভীরে চলে যায়, কারো খেয়ালি হয়নি কখন সায়ন্তনের স্নানের সময় পেরিয়ে গেছে। যখন মনে হল ইতিমধ্যে আধঘন্টা অতিবাহিত।
চেয়ারে বসে মনিটরটা অন করে সায়ন্তন, দেখে নেয় আজকের ক্যাপিটাল সিডিউলগুলো। নাহ্, তেমন চাপের কিছু নেই আজ। দুটো ডিল আছে নর্থ ক্যালকাটায়। ও বোস সামলে নেবে। পৃথা বোস। সায়ন্তনের অ্যাসিস্ট্যান্ট। মেয়েটা কাজে-কর্মে অত্যন্ত চৌখস, স্মার্ট, কম বয়সের উচ্ছলতা যেমন আছে দায়িত্ববোধটাও প্রখর। গায়ের রং ফর্সা কিন্তু মুখশ্রী তেমন চোখটানার মতো নয়। তবে এসব নিয়ে সায়ন্তন ভাবেনি কখনো। তার ভাববার কথা ও নয়। পৃথার একটা ব্যাপার তবু সন্তানকে ছুঁয়ে যায়। এখনকার বেশিরভাগ মেয়ে যেখানে ক্ষীণ-কটি তন্বী হতে গিয়ে লিকলিকে সর্পিল হয়ে পড়ছে, পৃথা তেমন নয়। তাই বলে সে ওভারওয়েট বা ওবেসিটির শিকারও নয়। পৃথা নিজে যেমন ভালো খাবার, ভাল রান্না খেতে ভালোবাসে তেমনই অন্যকে খাওয়াতেও ভালোবাসে। বাড়িতে রান্না করা মুখরোচক পদ অনেকবারই সয়ন্তানকে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে এসেছে।
সায়ন্তন এর মাথায় এখন গুরুদেবের কথাগুলো ঘুরছে। মনে মনে কাউকে ছোঁয়া যায়, তার সাথে কথা বলা যায়, এমনকি তার সঙ্গে অনুভূতির আদানপ্রদানও করা যায়। দূরবর্তী কোনো মানুষকে যোগাসনে একাগ্র হয়ে কল্পনা করলে বা একান্তে তাকে বার বার ডাকলে নাকি সেই মানুষটার মনে ওই ডাক পৌঁছায়। তাকে ওই মানুষটার প্রতি মনোযোগী করে তোলে। এমনকি অত্যন্ত কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে নাকি স্পর্শানুভূতিও সঞ্চালন করা সম্ভব। এসব কথা সায়ন্তনের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে দোলায়িত, কারণ বিশ্বাস করার জন্য যেমন প্রামাণ্য তথ্যের প্রয়োজন তেমনি অবিশ্বাস করার জন্য প্রবল বিরুদ্ধে যুক্তি থাকা জরুরি। তবে এ নিয়ে এর বেশি বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ আর পাবে না সে। গুরুদেব আজ দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর নবদ্বীপ যাবেন এবং সেখান থেকে পুনরায় হরিদ্বার। মনে মনে বেশ অস্থির হয়ে ওঠে সায়ন্তন। এই কথা কি সত্যি, নাকি...
আসবো স্যার পৃথার গলা সায়ন্তনী চিন্তাসূত্র ছিড়ে যায়।
এরপর প্রায় একমাস গত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বলতে পৃথার উচ্ছ্বলতা যেন হঠাৎ করে কমে এসেছে। সে এখন প্রায়ই চুপচাপ কাজ করে যায়। প্রয়োজন অনুযায়ী কথা বলে। মুখের ভাবে সেই অকৃত্রিম কমনীয়তা নেই, চোখের তলায় কালি না পড়লেও হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় যেন চোখদুটো জলে ভরা। পৃথার এই পরিবর্তন সায়ন্তনের নজর এড়ায়নি। একদিন অফিসে কাজের ফাঁকে পৃথাকে টেবিলে দেখে সায়ন্তন জিজ্ঞাসা করে,
--কয়েকদিন যাবৎ তোমাকে কেমন যেন ডিপ্রেসড লাগছে। কি ব্যাপার পৃথা?
এ প্রশ্নের উত্তরে পৃথা মুখ নিচু করে চুপ করে থাকে। সায়ন্তন আবার বলে,
--কোনো সমস্যায় পড়েছ না কি ? তোমাকে এমন মনমরা তো দেখিনি কখনো!
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে পৃথা। সায়ন্তন লক্ষ্য করে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরছে। সায়ন্তন ঠিক কি করবে, কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে বসে থাকে। পরিবেশ যেন ভারী হয়ে ওঠে। একটু সময় পর পৃথা নিজেই বলতে শুরু করে,
--স্যার হঠাৎ করে আমার জীবনে একটা মারাত্মক দুর্যোগ এসেছে। এর হাত থেকে রেহাই পাব কিনা জানিনা। আমার পরিবার, আমার সম্পর্ক, সব কেমন যেন দুঃসময়ের ঝড়ে ভেসে যাচ্ছে। কিছুই আটকে রাখতে পারছিনা।
গলা ধরে আসে পৃথার। টেবিলের কাঁচের উপর নখ দিয়ে আঁচড় কাটতে কাটতে নিজেকে সামলে নেবার জন্য একটু সময় নেয়। তারপর আবার বলতে থাকে।
--স্যার আপনি তো জানেন আমার বাবা একজন দুঁদে উকিল। তার নাম যশ প্রতিপত্তি যথেষ্ট। কিন্তু প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেলো, তিনি আর আমাদের সঙ্গে নেই। অন্য এক মহিলার সঙ্গে অন্যত্র সংসার পেতেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে যে ছেলেটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক, সেই মহিলা তারই পিসি। বাবার কোর্টে স্টেনো ছিলেন।
এই পর্যন্ত বলে পৃথা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। টেবিলের উপর মাথা রেখে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। দু'হাতের ফাঁকে মাথাটা রেখে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল। সায়ন্তন এতক্ষণ বজ্রাহতের মত শুনছিল। পৃথার কান্না থামানোর মত ভাষা তার জানা ছিল না। শুধু একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস সায়ন্তনের বুক থেকে উঠে এলো।
৩
গত চারদিন পৃথা অফিসে আসেনি। সেদিনের পর থেকে সায়ন্তন অদ্ভুত এক মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করছে। বহুবার পৃথাকে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করছে, এমনকি বাড়ির ল্যান্ড নম্বরটাও ডায়াল করেছে, কিন্তু কোন লাভ হয়নি। কোনো যোগাযোগ করা যায়নি। এই কদিন পৃথা না থাকায় সমস্ত কাজ সায়ন্তন কেই করতে হয়েছে। ফলে বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেবার ইচ্ছা থাকলেও, কোনো উপায় ছিল না। আজ শনিবার। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সায়ন্তন গাড়ির ড্রাইভারকে বাঘাযতীন এর দিকে যেতে বলল।
ঠিকানা জিজ্ঞেস করে যখন পৌছালো, প্রায় সন্ধ্যা। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে সায়ন্তন আরো বেশি আহত হলো, পুরো বাড়ি অন্ধকার। ঢোকার কলাপসিবিলটাতে দু'দুটো বড় তালা যেন তাকে পরিহাস করছে। আশপাশের দু'একজনকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলল, কয়েকদিন আগে নাকি কি ঝামেলা হয়েছিল। পরদিন থেকেই তো দোকান বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বাইরের কয়েকজন লোক এসে নাকি বাড়ি চড়াও হয়ে যাচ্ছেতাই করে বলেছে। বাবাটা তো আর আসে না। তারি কুকীর্তির ফল মা মেয়েকে ভোগ করতে হচ্ছিল।
সায়ন্তন কথাগুলো শুনে হতবুদ্ধি হয়ে রইল। কোথায় যেতে পারে পৃথা? এই খোজ নেবার মতো লোকই বা কে আছে? এরকম সাত-পাঁচ ভাবছে, এমন সময় এক ভদ্রমহিলা সায়ন্তন এর কাছে বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। একধারে ডাকলেন সায়ন্তনকে। বললেন,
--আমি পৃথার মায়ের বান্ধবী। বুটিকটা আমরাই চালাতাম। পৃথার বাবা যে মেয়েটিকে নিয়ে অন্যত্র থাকছেন, তার ভাইরা সেদিন এসে খুব চেঁচামেচি করেছে। পাড়ার লোক, রাস্তার লোক, জমে গিয়েছিল। আমি তখন দোকানে ছিলাম। মা মেয়েতে খুব কেঁদেছিল আমার কাছে। বাড়ি চড়াও হওয়া লোক গুলো আবার পৃথার চরিত্র নিয়েও খারাপ খারাপ কথা বলেছে। পৃথার বয়ফ্রেন্ড তাদের বাড়ির ছেলে। সেও নাকি পৃথার বাবাকে শাসিয়েছে পৃথাকে মান-সম্মান নিয়ে বাঁচতে দেবে না। ওর বাবার মতই নাকি পৃথারও চরিত্র খারাপ! সেদিনের সেই প্রচন্ড চেঁচামেচি আর অপমান সহ্য করতে পারেনি ওরা, কোথায় চলে গেল কে জানে? বুটিকের সব টাকা-পয়সা আমার কাছেই রয়েছে। তবে শুনেছি ডায়মন্ড হারবারে পৃথার এক দুঃসম্পর্কের মাসি থাকে, খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।
এই পর্যন্ত বলে ভদ্রমহিলা হঠাৎ বললেন, কিন্তু আপনাকে এত কথা বলছি কেন? আপনি কে বলুন তো? পৃথার কথা আপনি জিজ্ঞাসা করছেন কেন? পুলিশ?
সায়ন্তন এতক্ষণ নির্জীবের মতো শুনছিল কথাগুলো। তার চোখে পৃথার সে দিনের ভিজে চোখ দুটোর ছবিই ভেসে উঠছিল বার বার। কি জানি কেন একটা অবদমিত কষ্ট উঠে আসছিল দীর্ঘশ্বাস হয়ে। ভদ্রমহিলার শেষ কথাগুলো শুনে কোনমতে বলল,
-- না না আমি পুলিশের লোক নই। আমি পৃথার সিনিয়র অফিসার আমরা একই অফিসে একই সঙ্গে কাজ করতাম তো।
৪
--সায়ন খাবি না? দশটা বেজে গেছে তো!
মায়ের ডাকে সায়ন্তনের চিন্তাসূত্র ছিড়ে গেল। পৃথার মুখটা প্রায় পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। সায়ন্তনের বন্ধ চোখের পাতায় পৃথার উপস্থিতি অস্পষ্ট হয়ে গেল। যোগসূত্রটা কেটে গেল যেন। প্রায় এক মাস হয়ে গেছে পৃথার খোঁজে ওদের বাড়িতে গিয়েছিল সায়ন্তন। তারপর বহু জায়গায় খোঁজ করেছে, কোনো খবর পায়নি। মাঝে একদিন হঠাৎ কি মনে হতে পৃথার মোবাইলে ঢোকার চেষ্টা করেছিল এবং অদ্ভুতভাবে সেই পরিচিত কলারটিউনটা বেজে উঠেছিল। আবার সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইলটা সুইচ অফ হয়ে গেল! অবাক হয়েছিল সায়ন্তন।
এই ঘটনার পর সায়ন্তন ভেবেছিল, আর পৃথার খোঁজ করবে না। কেনই বা সে এত জড়িয়ে পড়বে? পৃথার সঙ্গে তো তার কেবল অফিশিয়াল অ্যাটাচমেন্ট। তাকে নিয়ে আগেতো সায়ন্তন এত ভাবেনি কখনো! গুটিয়েই নিয়েছিল নিজেকে। কিন্তু পারেনি। কি এক অজানা রোগের মতো পৃথার জীবনটা তার প্রতিটা মুহূর্ত কে সংক্রমিত করে ফেলেছিল? ফলে নিরাময়ের জন্য সায়ন্তন পৃথাকেই খুঁজতে লাগলো।
খাবারটা নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে সায়ন্তন উঠে পড়ল । ওর মা'র আজ একাদশী। লুচি আর আলুর তরকারি করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই সায়ন্তন এইরকম দিনগুলোতে মায়ের সঙ্গে মায়ের খাবার খেতে ভালোবাসতো। সেই সায়ন্তন আজ মাত্র একটা লুচি কোনভাবে খেয়ে উঠে গেল! ওর মা বহুবার জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে কোনমতে সায়ন্তন ঘরে এসে দরজা দিল। ঘরে নিজেকে বন্দী করে পদ্মাসনে ধ্যানস্থ হওয়ার চেষ্টা করে। চোখ বন্ধ করে প্রথমে পৃথার মুখটা বন্ধ চোখের পর্দায় স্পষ্ট ফুটিয়ে তোলে। পৃথার চোখের দিকে চেয়ে মন্ত্রের মতো বলে,
"পৃথা, অনুভব করো আমাকে। আমি সায়ন্তন। তুমি কোথায় আছো? আমাকে জানাও।"
কখনো এভাবে সায়ন্তন স্পর্শ করে পৃথাকে। সর্বাঙ্গে মিশিয়ে নেয়, চেষ্টা করে পৃথার মনের সঙ্গে নিজের মনকে মিশিয়ে দিতে। পৃথাকে বোঝাতে চায় এক অদৃশ্য চিন্তন। এক কাল্পনিক রোমন্থনের মাধ্যমে পৃথাকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, সায়ন্তন তাকে খুঁজছে। সে পৃথাকে আপন করতে চায়। পৃথার সমস্ত দুঃখ অপমান শুষে নিতে চায় নীলকণ্ঠের মত। পৃথার অজ্ঞাতবাস তার কাছে অত্যন্ত বেদনার এবং চিন্তার। এভাবেই রাত প্রায় দুটো আড়াইটা বেজে যায় এক তপস্বীর ভগবান সন্ধান এর মত পৃথাকে খুঁজে চলে সায়ন্তন। এভাবেই কেটে যায় রাত। মোবাইলটা খোলা থাকে পাশে যদি পৃথা ফোন করে! কিন্তু...
তারিখ-৩/৪/২০১০
এই লেখা কেউ পড়বে কিনা জানি না। কারণ আমরা যে নিজেদেরকে বেসমেন্টের এই গোপন কুঠুরিতে বন্দি করেছি তা কেউ জানে না। অঞ্জন দের বাড়ি থেকে সেদিন এসে আমাকে আর মাকে সমস্ত শালীনতার সীমানা পেরিয়ে অপমান করে গেল। সবার সামনে বাবাকে নিয়ে অশ্লীল কথা বলে, খারাপ ইংগিত করে, মান সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে গেল। সেদিন রাত্রে আমরা মানে আমি আর মা নিজেদের গৃহবন্দী করার সিদ্ধান্ত নিই। সেই দিন মাঝরাতে পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাড়ির সামনের গেটের দরজা আর দোকানে তালা দিয়েছি। ফলে আমরা যে এখানে কেউ তা সন্দেহ করতে পারবে না। যে পারত, সে এখন নতুন সংসারে ভোগের আনন্দে মত্ত! আর কি বলতে পারি নিজের বাবার সম্পর্কে! 55 বছর বয়সে যে মানুষটা 25 বছরের মেয়ে আর 32 বছরের বিবাহিত জীবন সঙ্গিনীকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে নতুন সংসার পাততে চলে যায়, তাও আবার নিজের মেয়ের প্রেমিকের আত্মীয়ার সঙ্গে, তাকে বাবা বলতেও ঘৃণা বোধ হয়। আমি ভগবানে বিশ্বাস করি। তার কাছে কী পাপ করেছি সে হিসাব নিই না। এই প্রার্থনা করি যেন, আর বাবা বলে ডাকতে না হয়। আজ দুদিন হয়ে গেল মা মারা গেছে। অনাহার আর প্রচন্ড পিপাসা নিয়ে গত প্রায় এক সপ্তাহ জীবনের সঙ্গে লড়াই করে, গত পরশু চলে গেল। আমিও অশক্ত। মৃত্যু কখন বুকে তুলে নেবে এই ভাবনায় মগ্ন। এই ডাইরিটাতেও মাত্র কয়েকটা পাতা বাকি আছে শেষ হতে। জানিনা কতটা লিখতে পারবো, কতক্ষণ লিখতে পারবো। যে কদিন মা ছিল, স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে পরস্পরকে দোষারোপ করতে করতে কেটে গেছে। লেখার কথা মনে হয়নি। শেষের কদিন মায়ের ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি অসহ্য হয়ে গেছিল। শেষ জলের ফোঁটাটাও মায়ের মুখে দিয়েছি। এখন মা নেই। তার নিষ্প্রাণ দেহ আমার সামনে পড়ে আছে। দুর্গন্ধ অসহ্য হয়ে উঠেছে কিন্তু শরীরে কোনো শক্তি নেই। বেসমেন্টের গোপন দরজা খোলার শক্তিও নেই। দরজাটা দেওয়াল কেটে লোহার পাত দিয়ে করিয়ে দিল বাবা। বাবাকে ছোটবেলা থেকেই খুব ভালোবাসতাম। বাবাও আমাকে স্নেহ ভালোবাসা দিতে কার্পণ্য করেনি কখনো। বাবার কথা বলা, বাবার স্মার্টনেস, আমাকে মুগ্ধ করতো। হয়তো এই মুগ্ধতা থেকেই চেয়েছিলাম আমার মনের মানুষটা ও বাবার মত স্মার্ট চৌখস এবং পরিপাটি হোক। কলেজে কয়েকটা প্রেমপ্রস্তাব যে পাইনি তা নয়। কিন্তু সেই ছেলেগুলোর কেউই আমাকে টানেনি। বন্ধু, সহপাঠি ব্যাস এই পর্যন্ত আর কিছু তাদের সম্পর্কে ভাবিনি কখনো। কলেজ শেষ করেই প্রাইভেট কোম্পানিতে একটা সুযোগ এসে গেল। জয়েন করলাম। আমার বস, সায়ন্তনদা, তিনি দারুণ হ্যান্ডসাম খুব সুন্দর করে কথা বলেন। যথেষ্ট ভদ্র কিন্তু কিছুদিন কাজ করার পর বুঝলাম তিনি নিতান্তই ভদ্রলোক। আমার ভালো লাগলেও, উনি এইসব ব্যাপার গুলো থেকে শত হাত দূরে থাকেন। ঠিক এই রকম সময় আমার জীবনে এলো অঞ্জন। রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা। এমন কিছু বড় ব্যবসা নয়। লোন সংক্রান্ত কাজে আমাদের পরিচয়। কিভাবে যেন সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল। ঝড়ের গতিতে এলো। ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমাকে। আমি ছিলাম সমুদ্র থেকে বহুদূরে, অঞ্জন আমাকে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে গেল। আমার গায়ে এক ফোঁটাও জল ছিলনা। আমাকে ভিজিয়ে ডুবিয়ে একসা করে দিল। আমি আধুনিক শিক্ষা এবং পরিবেশে বড় হয়েছি। যৌনতা নিয়ে রাখঢাক করার চেয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। অঞ্জন আমাকে কতটা ভালোবাসতো জানিনা, আমার জমানো টাকার প্রায় সবটাইওর রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ঢেলেছিল। এ ব্যাপারে কোনো কুন্ঠাবোধ ছিল না। এমনকি ওর ব্যবসার জন্য আমার নামে পার্সোনাল লোন নেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার বলেছিল, যদিও সেটা আমি করিনি। এইসব সত্ত্বেও কিন্তু ওকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতাম। এখনো প্রাণ হাতের মুঠোয় রেখেই ওর কথা লিখছি। খুব অস্বস্তি হচ্ছে শরীরে। আর কতক্ষণ লিখতে পারবো জানিনা। চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। এখানে যে আলোটা জ্বলছে তার আয়ুও খুব কম। অঞ্জনের সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার শারীরিক সম্পর্ক হয়। এই ইন্টারনেট ফেসবুকের যুগে মেয়েরা অনেক কিছু বোঝে, জানে। আমিও বুঝেছিলাম অঞ্জন ব্যবহৃত। তাতে আমার তেমন কোনো দ্বিধা তৈরি হয়নি। হয়তো এটাও আধুনিকতার প্রভাব। কিন্তু সেই অঞ্জনের বাড়ির লোকের কাছে আমাকে শুনতে হল, আমি নাকি "প্রস"। আমারও নাকি বাবার মতো অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক আছে।
এই বেসমেন্টের ঘরে বহু অচেতন সময় কেটে গেছে। মাঝেমধ্যে ঘুমের ঘোরে হঠাৎ যেন মনে হয়েছে, কেউ ডাকছে গায়ে ধাক্কা দিয়ে। বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে, যেন সায়ন্তন এসে আমার মাথার কাছে বসে আছে। ধড়মড় করে উঠে দেখেছি, স্বপ্নটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়েছে। আবার কখনো মনে হয়েছে অঞ্জন, আরো যেন কারো সব হিংস্র জন্তুর মত আমার উপর লাফিয়ে পড়েছে। আঁচড়ে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। অজান্তেই কখন চেঁচিয়ে উঠেছি। সঙ্গে সঙ্গেই নিজের মুখ চেপে ধরেছি হাতের তালুতে।
গত রাত্রে হঠাৎ মনে হল, যেন সায়ন্তন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যেন কানের কাছে বলছে "পৃথা আমাকে ফোন করোনি কেন?" কেন এমন হচ্ছে জানিনা তবে সায়ন্তন বহুবার ফোন করেছে এক দুবার রিসিভ করলেও কথা বলিনি। আর বাকি কলগুলো রিসিভ করিনি। কি হবে এই অপমানে ডোবা জীবনটা অন্য কোথাও জড়িয়ে? সায়ন্তন ভদ্রসন্তান। সে নিজেও খুব ভদ্র। হয়তো আমার মুখ থেকে এই পরিস্থিতির কথা শুনে তার সহানুভূতি হয়েছে। হয়তো তাই সে খোঁজখবর করেছে। আমাকে উদ্ধার করতে চেয়েছে হয়ত সায়ন্তন। কিন্তু কি করে তার সঙ্গে কথা বলব ফোনটা রিসিভ না করায় বোধহয় ভাল হয়েছে। আর এই কলঙ্কের বোঝা বয়ে বেড়াবার ক্ষমতাও আমার নেই। আর এই কলঙ্কিত মুখটাও কাউকে দেখাবো না। মা তো চলেই গেছে। আমারও বেশি বাকি নেই। আত্মহত্যার সাহস নেই। থাকলে ,সেদিন ওইখানে ওদের সামনেই করে ফেলতাম। মায়ের মৃতদেহ আমার সামনে তিন চার হাত দূরে। এত দূরে ছিল না। দুর্গন্ধে সরে এসেছি। প্রথমটায় খুব কেঁদেছি। বোধহয় বেশ কিছুক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। পরে মনে হয়েছে, ভালোই তো হল। আমি আগে গেলে মা'র কষ্ট আরো বাড়তো। কে দেখত, তখন মা-এর শেষ সময়। তবু আমি ছিলাম। কান্নার জল ঠোঁটে ছুঁইয়েছি। খাবার জল তো ছিলনা। মা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। আমি আর পারছি না । চিন্তা অসংলগ্ন হয়ে যাচ্ছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রনা। চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। হাত প্রচন্ড কাঁপছে। কি লিখছি দেখতে পাচ্ছিনা। কিন্তু যে কথাটা আমাকে লিখতেই হবে, জানিনা কার উদ্দেশ্যে লিখছি, ...
ওহ মাগো! অসম্ভব যন্ত্রণা বুকে।
মৃত্যুর আগে মা বলেছে, আমি যাকে মা বলে জানি, সে আমার মাসি, আর আমার মাকেও এই ঘরে গুম করে মেরে ছিল আমার বাবা। আমার সেই মায়ের নাকি অকালে মেনোপজ হয়ে গেছিল এবং রটনা হয়ে গেছিল মস্তিষ্ক বিকৃতির। আর তারপর নিখোঁজ। বাবা রাতের অন্ধকারে মা'র ডেড বডি গাড়িতে করে কোন রেললাইনের উপর রেখে এসেছিল পরদিন ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ বাড়িতে এলো।
জানিনা কেউ এই ডায়েরি পড়বে কিনা যদি পড়ে, আমার অনুরোধ আমার বাবাকে...
৫
-- কতক্ষণ জ্ঞান ছিল না কে জানে? সময়, দিন-রাতের হিসাব তো আর করিনা। মোবাইলটাতে এখনো যেটুকু চার্জ আছে, তাতে দেখলাম সায়ন্তনের অসংখ্য মিসডকল। আর কল করে কি হবে? এখনো কি তুমি বোঝোনি আমি ধরবো না! আর বোঝার সময় নেই আমার। শেষ সময়ে তোমাকে ফোন...
আমি কি সব শুনতে পাচ্ছি মনে হয়! সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। অনেক পায়ের আওয়াজ। যেন অনেক মানুষের কথা বলার আওয়াজ। মাথা আর কাজ করছে না। সারা শরীর কাঁপছে। ডায়রির পাতাটাও শেষ!
ওহ, মা গো...
৬
মা খেতে দাও। নটা প্রায় বাজে। সায়ন্তন মাকে খেতে দেবার জন্য তাড়া দেয়। বিগত প্রায় একমাস যাবৎ সায়ন্তন রুটিনড জীবন অনেকটা পাল্টে গেছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে, প্রতিদিন ঠিক রাত সাড়ে-নটার সময় সায়ন্তন ছাদের উপর খোলা আকাশের নিচে গিয়ে বসে। খোঁজার চেষ্টা করে পৃথাকে। তার সীমা ছাড়িয়ে যায় বহুদূর। চোখ বন্ধ করে খোঁজার চেষ্টা করে পৃথাকে। তার মন কে। দূর থেকেই বোঝানোর চেষ্টা করে, অজ্ঞাতবাসে থাকা পৃথাকে উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করে, সে আছে-- সায়ন্তন তাকে এভাবেই খোঁজে। পৃথার দোমড়ানো মোচড়ানো জীবনটাকে আবার পরিপাটি, চলৎশক্তিময় হবে না কি? সায়ন্তন এখন বিশ্বাস করে, দূর থেকে মন দিয়ে মনকে ছোঁয়া যায়। আর এই বিশ্বাসের উপর ভর করে গত একমাসে রোজ রাত্রে সেই চেষ্টা করে গেছে। কত রাত ঘুমহীন কেটে গেছে। সায়ন্তন এটাও জানে না, সত্যি যদি পৃথাকে সে মন দিয়ে ছুঁতে পারে, তবে সে খবরটা সে নিজেই বা জানবে কি করে? পৃথা কি ফোন করবে? সায়ন্তন জানেনা। কিন্তু আশা ছাড়েনা। তাই মোবাইলটা হাত ছাড়া করে না। এমনকি ওই সময়ে ছাদে তার পাশেই রাখা থাকে ফোনটা।
আজও সায়ন্তন বসেছে। এখন প্রায় সাড়ে নটা বাজে। চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থ হবার আগে গুরুদেবের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে নেয়। হঠাৎ সাইলেন্ট মোডে রাখা ফোনটা কেঁপে উঠল। স্ক্রিনের নীল আলো তার চোখে এসে পড়ল। বিরক্ত হয়ে ফোনটা তুলেই চমকে উঠল সায়ন্তন। এতো পৃথার নম্বর! তার আইডি ভেসে উঠেছে! তবে কি পৃথা সত্যিই ফোন করলো? অস্থির সায়ন্তন ফোনটা রিসিভ করে কানে দিল, কিন্তু বেশ কয়েকবার "হ্যালো পৃথা" বলার পরেও অপরপ্রান্ত থেকে ঘড়ঘড় একটা আওয়াজ একবার হয়ে আর কোন আওয়াজ পাওয়া গেল না। এমনকি ফোনটা চালুই রইল। অপরপ্রান্ত থেকে কোন চেষ্টাও করা হল না। প্রায় পাঁচ মিনিট এভাবে চলার পর সায়ন্তন হতচকিত অবস্থা কাটিয়ে উঠে ফোনটা কেটে দিলো। পরক্ষণেই আবার ডায়াল করল এবং অন্য প্রান্তে রিং হচ্ছে তাও বোঝা গেল। কিন্তু কেউ রিসিভ করল না। বেশ কয়েকবার কল ব্যাক করার পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় এক অজানা আশঙ্কায় সায়ন্তনের বুকটা কেঁপে উঠলো।
৭
রাত তখন প্রায় সাড়ে-বারোটা। মোবাইল টাওয়ার লোকেশন ট্রাকিং করে, বাড়ির গেট ভেঙে বেসমেন্টে পৌঁছে গেছে স্পেশাল টাস্কফোর্স। প্রচন্ড দুর্গন্ধ ভরা অন্ধকার খুপরি থেকে দুটো শরীর টেনে হিঁচড়ে বের করে আনল তারা। সায়ন্তনের ঝাপসা চোখের সামনে দিয়ে পৃথার মায়ের পচাগলা দেহটা বের করে নিয়ে এলো। বমি পেয়ে গেল সায়ন্তনের। পুলিশ কর্মীরাও অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। সবারই কমবেশি শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। পৃথার অন্ধকার শীর্ণ শরীরটা বের করে আনার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সায়ন্তন। একহাতে ডায়েরি আর অন্য হাতে মোবাইলটা ধরা ছিল পৃথার। তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে গলায় হাত দিয়ে, নাকে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল সায়ন্তন, পৃথার পালস আছে কিনা। অজান্তেই তার চিবুক থেকে ফোঁটা ফোঁটা কান্না গড়িয়ে পড়েছে পৃথার চোখের পাতায়, ঠোঁটে। হঠাৎ সায়ন্তনের মনে হল, পৃথা যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু গলা দিয়ে একটা ঘড়ঘড় শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হচ্ছিলো না। অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার এর কাছ থেকে একটু জল নিয়ে পৃথার গলায় ঢেলে দিল সায়ন্তন। বেশ কয়েকবার কষ বেয়ে গড়িয়ে আসার পর একটা ঢোক গিললো পৃথা। প্রায় মৃত মানুষটা যেন হঠাৎ একটা দৈবশক্তি পেল। পৃথা অস্পষ্ট অথচ তীব্র স্বরে বলল, "এত দেরী করলে কেন?" অশক্ত , শীর্ণ হাতদুটো বুকের কাছে জোড় করে কিছু একটা যেন ধরতে চেষ্টা করছিল পৃথা। সায়ন্তন তার হাতটা এগিয়ে দিলো। পৃথা সর্বশক্তি দিয়ে সায়ন্তনীর হাতটা চেপে ধরলো। যেন ডুবন্ত জাহাজের একমাত্র জীবন্ত যাত্রী দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে একমাত্র অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে।
================================
ঠিকানা*
======
অনিন্দ্য পাল
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
Mob: 9163812351
ধন্যবাদ।