আতঙ্ক
বদরুদ্দোজা শেখু
ওমর গাজী একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারী শিক্ষক। প্রায় পনেরো বছর আগে তিনি অবসর নিয়েছেন। বাড়ি জয়নগর মজিলপুর এলাকার এক গ্রামে। চাকরিসূত্রে তিনি সোনারপুরে এসে থাকতে শুরু করেন।অল্প বয়সে বিয়ে হওয়াই তাঁর দুটো ছেলে ও তিনটি মেয়ে সন্তান হয়েছিল ।তারা এখন
সবাই প্রায় প্রৌঢ়।পৈতৃক বাড়িতে এখন তাঁর দুই ছেলে থাকে । মেয়েদেরও সবার বিয়ে শাদি দিয়ে দিয়েছেন। এখন সবমিলিয়ে তাঁর বড়ো সংসার। তাদের ছেলেমেয়েরাও জীবনপথের নানান তাগিদে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে গিয়েছে। কেউ মুম্বই তো কেউ চেন্নাই বা দিল্লি।
ছেলেরা সংসারের হাল ধ'রে নেওয়ার পর ওমর তাঁর স্ত্রীকে ও ছোট মেয়েকে সোনারপুরে নিয়ে আসেন। স্থানীয় হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দ্যান যাতে তার লেখাপড়ার দেখাশোনা করতে পারেন ।এখানে স্কুলের থেকে সামান্য দূরে একটা কাঠা দুয়েক জমি তখন অল্প দামে পাওয়া গেছিল, কিছু জমানো টাকা আর কিছু পৈতৃক ডাঙাডহর বিক্রির টাকা দিয়ে ওই জমিটা তিনি কিনে রেখেছিলেন। তখন জমিটা একটা কাঁচা রাস্তাটার ধারে ছিল। এখন সেটা পিচ রাস্তা হয়েছে। এলাকাটা গ্রাম থেকে দিন দিন বেড়ে শহরতলিতে পরিণত হয়েছে। প্রথম বেশ ক'বছর ওমর একটা ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন। সপ্তাহে সপ্তাহে গাঁয়ের বাড়ি যেতেন। অবসর নেওয়ার বছর খানেক আগে থেকে বাড়ি তৈরীর কাজে লাগেন।
মোটামুটি একতলা একটা বাড়ি খাড়া করেন ; দুটো ঘর বারান্দা খাওয়ার চাতাল।
মূলঘর লাগোয়া বাইরে টিনের ছাউনি দেওয়া রান্নাঘর। তার পাশে পানির নলকূপ , স্নানঘর ও পায়খানা। আসলে দুকাঠা জমির বাউন্ডারী প্রথমে বেড়া দিয়ে রেখেছিলেন ,
কিন্তু নানান অত্যাচারে শেষে পাঁচ ইঞ্চি গাঁথুনির ইট দিয়ে দেওয়াল দিতে অনেক টাকা বেরিয়ে যায়। তাই দোতলা করার স্বপ্ন থাকলেও তা আর বাস্তবে হ'য়ে উঠেনি।
তার ওপরে তখনো ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়া বাকি ছিলো।তাই ওপথে আর পা বাড়াননি। মাস গেলে সামান্য কিছু পেনশন পান। এখন তারা দুজন বুড়োবুড়ি , তিনি ও তাঁর স্ত্রী সফুরা বিবি আর সাথে ছোট নাতনি, ছোট মেয়ের মেয়ে।
আঙিনায় পেঁপে লেবু লাউ গাছ সজনে গাছ আছে তা থেকে কিছু শাক- সবজি হয়।
শীতের সময়ে বেগুন টমাটো এগুলোও একটু আধটু লাগান। কখনো সখনো রেললাইনের ধারের বাজার থেকে মাছ ডিম কিনে আনেন।ছোট সংসার চ'লে যায়।
ক'দিন ধ'রে তারা ভাবছিলেন , বহুদিন থেকে ছেলে নাতিপতীনদের সাথে দেখা নাই , মন খারাপ করে। তাই সামনের মাসে একটা দিন দেখে তাঁরা গাঁয়ের বাড়িতে যাবেন।
ইতিমধ্যে কী যে শুরু হলো, চারিদিকে মাইকে মাইকে ঘোষণা শুরু হয়েছে এবং ২২শে মার্চ থেকে সারা দেশে প্রধানমন্ত্রী লকডাউন ঘোষণা করেছেন। ২৪ শে মার্চ থেকে তা আরো বাড়ানো হলো। মারণ ভাইরাস করোণার আক্রমণ শুরু হয়েছে চীনে। সেখান থেকে তা দ্রুত সংক্রমিত হ'য়ে পড়েছে ইউরোপ আমেরিকা ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান ইরান প্রভৃতি দেশে।
এই ভাইরাসের এখনও পর্যন্ত কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। রোগটা খুবই ছোঁয়াচে।
সংক্রমিত মানুষের হাঁচি কাশি জ্বর শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি থেকে এই ভাইরাস বাতাসে ও আশে পাশে ছড়িয়ে পড়ে।মানুষের শরীরে ওরা ঢুকে মূলতঃ মুখ নাক চোখ দিয়ে, তারপর তারা শ্বাসনালীতে বংশ বিস্তার
করতে থাকে ।দিন দশবারো পর থেকে শুরু হয় সর্দি কাশি জ্বর , শেষে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট এইসব উপসর্গ। রোগ ধরা পড়ার পর দিন দশ বারোর মধ্যে দুর্বলরা শেষ।
এই ভাইরাস আতঙ্ক হ'য়ে দাঁড়িয়েছে সারা বিশ্বে।চীন ইরান ফ্রান্স ইটালি স্পেন আমেরিকা প্রভৃতি দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার আক্রান্ত বাড়ছে আর শয়ে শয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে।ভারতে তার আক্রমণ
শুরু হয়েছে।তাই, ভারত সরকার সমগ্র দেশে লকডাউন জারি করেছে। অর্থাৎ মানুষকে তাদের বাড়ীতে থাকতে হবে। কোথাও বেরোনো যাবে না।বাজারহাট দোকানপাট রেল বাস ট্যাক্সি টোটো অটো সব বাধ্যমূলকভাবে বন্ধ ক'রে দেওয়া হয়েছে , যাতে এই মারণ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার তীব্রতাকে রোখা যায়। এখন বাইরের বিমান নৌজাহাজ এইসব ভারতে আসা নিষিদ্ধ ক'রে দেওয়া হয়েছে। সমস্ত বিদেশীর ভিসা বাতিল করা হয়েছে। শুধু প্রশাসনিক অফিস স্বাস্থ্য হাসপাতাল পুলিশ ব্যাঙ্ক ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মচারীরা কাজ ক'রে যাচ্ছে । আর এখন শুধু সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সাবধান থাকতে হবে।মানুষে মানুষে অন্ততঃ এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে,মুখে মাস্ক পরতে হবে। বারবার সাবান দিয়ে ভালো ক'রে হাত ধুতে হবে বা এলকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার হাতে মাখতে হবে ।মুখে চোখে নাকে হাত দেওয়া যাবেনা। যেখান সেখানে থুতু ফেলা যাবেনা।
রাস্তাঘাট বাজারহাট ঘরবাড়ি বিছানাপত্রসব জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।কারো বাড়ি যাওয়া চলবে না, বা কাউকে বাড়িতে আসতে দেওয়া যাবে না।মন্দির মসজিদ স্কুল কলেজ সব বন্ধ। একান্তই জরুরী কাজে বাইরে বেরোলে ঘরে এসে সঙ্গে সঙ্গে কাপড়চোপড় গরম জলে সাবান দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে আর ভালো ক'রে সাবান দিয়ে স্নান সেরে নিতে হবে। এভাবে কী আর আমাদের দেশে বাঁচা যায় না থাকা যায়?
যেখানে রাস্তাঘাটে বাস-ট্রেনে বস্তিতে বাজারে ঘরে ঘরে সব ঘেঁষাঘেঁষি ক'রে চলাফেরা করতে ,বাস করতে বাধ্য হচ্ছে । যেখানে গাঁয়ে গঞ্জে মানুষ পুকুরে শৌচ করে স্নান করে থালাবাসন মাজে ,গরু - মোষকে স্নান করায়, হয়তো গোটা গ্রামে একটাই নলকূপ, সেখানে কী এসব মানা সম্ভব? ওমর গাজী ভাবতে থাকেন।
আর শ্রমিক মজুর মুটে ফেরিওয়ালা ভিখারী এবং ফুটপাথবাসী এরা কী খাবে , কোথায় থাকবে ? এদিকে মাস্ক স্যানিটাইজার ডেটল হঠাৎ বাজার থেকে উধাও।এতো মানুষের চাহিদা , সেই তুলনায় সরবরাহ নাই।
গাজী সাহেব ও তার বউ ভাবতে থাকে , আল্লাহ্ ইয়া কী গজব দিলো মানুষের ওপর ? হায় হায়, তাদের গাঁয়ে তো ভালো পানিই পাওয়া যায় না। ছেলেমেয়েদের কী দুর্গতি হবে ?
ফলে ওমর গাজী ও তার স্ত্রী খুব আতান্তরে পড়লো।সোনারপুরে তাদের আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেউ নাই , তবে জয়নগর মজিলপুর অঞ্চলের অনেকেই এখানে উঠে এসেছে বা ভাড়া নিয়ে থাকে , তাদের সাথে মাঝে মাঝে দেখাসাক্ষাৎ হয় , এখন সেটাও বন্ধ।দুচারজন তাদের দূর-সম্পর্কিত ভাই ও তাদের পরিবারও এখানে থাকে।
শোনা যাচ্ছে যে সব মিস্ত্রি শ্রমিকরা বাংলা থেকে অন্য রাজ্যে কাজ করতে গেছিল,তারা সবাই বাইরের রাজ্যে আটকে পড়েছে।টাকা পয়সাও তাদের ফুরিয়ে আসছে । তাদের অবস্থা কী ভয়ানক তা অকল্পনীয়। আর দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের প্রায় সবাই কাজ হারাতে চলেছে।তাদের সংসার কী ক'রে চলবে ?
বাচ্চাকাচ্চা বয়স্কদের নিয়ে সেইসব পরিবার একেবারে উভয়সংকটে পড়েছে।কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে , তবে তা নিতান্তই অপ্রতুল।
এমনিতেই গাজী সাহেব ও তার স্ত্রী বয়স্ক, তারা তেমন বেরোতো না। এখন একেবারে গৃহবন্দী। ভাগ্যিস একটি টিভি কিনেছিলেন তাই তার সামনে ব'সে বুড়োবুড়ির অনেকটা সময় কাটছে।তাদের যে নাতনী থাকে তাদের সাথে , তার উঠতি বয়স , সে এখানের হাইস্কুলে ক্লাশ নাইনে পড়ে ,তাও অনির্দিষ্টকাল বন্ধ। তার আর ঘরে মন টেকে না।তার ভরসা শুধু ফোন। ফোনের কতো কায়দা সে জানে। বুড়োবুড়ি মনে মনে তারিফ করে, আবার চিন্তিত হয় , দিনকাল খুব সংকটাপন্ন হ'য়ে আসছে। এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ ক'রে বাজারে সবাই ঠিকমতো লকডাউন মানছে না । মারামারি পার্টির দলাদলি ও পুলিশের সাথে নানা গন্ডগোলের খবর আসছে। আর করোনার সংক্রমণ দ্রূত ছড়িয়ে পড়ার আতঙ্ক তাদেরকে গ্রাস করতে চলেছে। বিশেষ ক'রে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার বয়স্ক মানুষদের সবচেয়ে বেশী।
ওমর গাজীর বাড়িটা উপরাস্তার উপরেই। তিনি সকাল থেকেই বারান্দার পাটাতনে বসে থাকেন আর শুনশান রাস্তায় কদাচিৎ যে সব মানুষ যাচ্ছে তাদেরকে অবলোকন করেন।
এই লকডাউনের মধ্যেও রোজ দ্যাখেন দুতিন জন মহিলা সকালে মুখোশ প'রে রাস্তায় গল্পগুজব করতে করতে যাচ্ছে সব সংসারের নানা সমস্যার বারোমাস্যা।ওদের হাতে থাকে ক্যারিব্যাগ, তাতে ওরা যেখানে ফুলগাছ পায় তার থেকে দুটো একটা ক'রে ফুল তুলতে তুলতে ওতে ভ'রে নেয়। বেলা হ'লে কয়েকজন সাইকেলে ঝুড়িবাঁধা ফেরিওয়ালা সব্জি ও ফলের হাঁক দিয়ে যায়,তবে আস্তে আস্তে।আর কতকগুলো সাইকেলে এলুমিনিয়ামের হাঁড়ির মুখে কাপড় জড়িয়ে মাছ বিক্রি ক'রে যায় ।পরিচিত বাড়ির দরজায় টোকা দ্যায় আর জেনে নেয় কিছু লাগবে কিনা। অনেকে নেয় , অনেকে সাড়া দেয় না। কয়েকজন ফেরিওয়ালা দুপুরের দিকে আসে , তারা দই মিষ্টি পনীর ছানা এই সব বাড়িতে বাড়িতে দিয়ে যায়। তবে তারা কেউ পুলিশের ভয়ে
মেন রোড দিয়ে যায় না। সবার মুখেই মাস্ক অথবা গামছা জড়ানো থাকে। চলতে চলতে মিষ্টিওয়ালার স্বগত গান শোনা যায় ---" ও কি ও কা- জল ভোঁমরা রে, ক'ন দিন আসিবেন বন্ধু, কইয়া যাও কইয়া যাও রে !"তার মরমী সুর গাজী সাহেবের মনটাকে যৌবনের দিনগূলোর স্মৃতিতে উদাস ক'রে তোলে।
কেউ আবার সব্জি বিক্রি করার ফাঁকে ফাঁকে গায়----"হরি , দিন তো গেল , সন্ধ্যা হলো , পার করো আমারে।" খালি গলায়
এই গানের সুরে গাজী সাহেব ভাবালু হ'য়ে
বসে থাকেন। - - - তিনি ভাবেন-- তাই তো , কবে যে কখন্ কা'র যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসবে কেউ জানে না। সবাই এক অনিশ্চত পথের যাত্রী । - - এই সব ফেরিওয়ালাদের অনেকেই নতুন। হয়তো দায়ে প'ড়ে সব্জি ফল বিক্রি করতে নেমেছে। রাস্তায় ব্যাটবল নিয়ে যে সব ছেলেরা দুরন্তপনা করতো , ছোট মেয়েরা ছেলেরা ছোট সাইকেল নিয়ে ঘুরতো তারা হঠাৎ সবাই পাড়ায় যেন নাই। দমবন্ধ অবস্থা , শুনশান অল্পরাতেই যেন পাড়াগুলো মৃতপুরী। পুলিশের চোখ এড়িয়ে এই আসমুদ্রহিমাচল লকডাউনের সময়ে কারো কারো আবার নিরিবিলি প্রেম করার আদর্শ সময় জুটে গেছে।রাস্তার কোণটায়
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুপুরে দুটো ছেলে মেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কী-যে সব ফস্টিনস্টি করে দেখা যায় না! সঙ্গে সঙ্গে গাজী সাহেবের মনে তার উঠতি নাতি নাতনিদের কথাও মনে আসে।তারা কে যে কী করছে এখন,আল্লাই জানেন। তিনি মাবুদের কাছে প্রার্থনা করেন , রক্ষা করো মাবুদ। এই দুর্দিনে
খারাপ কিছু ঘটিওনা মাবুদ ।
কখনো কখনো আবার রাস্তায় বচসা
মারামারি ধ্বস্তাধস্তি শুরু হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সাহায্যদান চাল ডাল মূলো
বিতরণের মধ্যে রেষারেষি কথা কাটাকাটি
বিরোধিতা পাল্টা হুমকি শুরু হয়। গাজী সাহেব দ্রুত বারান্দার গ্রীলের পাটাতনে
বসা থেকে উঠে ঘরে ঢুকে যান, বলা যায় না , কী-না কী ঘ'টে যাবে।কেউ ছবি তুলে নিয়ে হয়তো পরে সাক্ষী হিসাবে খাড়া করবে, তখন আর এক বিপদ। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তিনি টিভির সামনে গিয়ে বসেন।
সেখানে নানান মনোরঞ্জনের সিরিয়াল চলছে, ভালো ভালো রান্না , সুন্দরীদের ফ্যাসান শো , নাচগান হাততালি ,তারকাদের ঘরবন্দী জীবনের খুনসুটি, সুখী সুখী মানুষদের নানান মন মজানো বিজ্ঞাপন
চলতেই থাকে।
তার মাঝখানে কয়েক ঝলক সিরিয়ালের অংশগুলো জলপিপির মতো হুস ক'রে উঁকি দিয়ে যায়। সেটুকু দেখার জন্য দর্শক
অপেক্ষায় ব'সে থাকে।আর করোনা নিয়ে
সতর্কতা তর্কবিতর্ক দলাদলি তথ্যের লুকোচুরি বড়ো বিরক্ত ব্যাজার করে মনকে।
এর মধ্যে নাতনী বায়না ধরেছে , সে গরম গরম চপমুড়ি খেতে চায়। গাজী সাহেবের মাথা গরম হ'য়ে যায়। ব'লে ওঠেন, নজুর মা , এই মাইয়াটারে এইবার ওর মায়ের লগে পাঠাই দ্যাও।আমার ছেলে মাইয়াদের
কী ঘটতেছে সেই দুর্ভাবনায় আমাগো জান শুকাইতেছে , আর অর রোজ রোজ নয়া নয়া খাবার বায়না ! বুঝেই না যে এখন মোড়ের দোকানপাট সব বন্ধ , কোনো ভাজাভুজি আইসক্রীম চকলেট দোকান খোলাই নাই ! নাতনী ফোড়ন কাটে , তাইলে আমাকে কী কইরা ফেরৎ পাঠাইবা? ব'লে সে হি হি হাসতে থাকে।
নজুর মা আস্কারা দেওয়ার মতো ব'লে ওঠে, আহা , হা, ওরে খালি খালি বকো ক্যান্? ছোট মাইয়া , একেতো
ঘরবন্দী আসে, তার ওপর খাবারদাবার তো কিছুই তেমন নাই।হেটা কী অর দোষ ?
ওমর গাজী ঠকাস ক'রে হাতের পানির খুরীটা রেখে উঠে যায়; এখন তার মাথায় ওই ফেরিওয়ালাদের গানগুলো ভেসে ওঠে , - - - হরি, দিন তো গেল , সন্ধ্যা হলো , পার করো আমারে-- , মাবুদ পার করো আমারে - । তিনি জায়নামাজটা নিয়ে নামাজ পড়ার জন্য ভিতর বারান্দার দিকে এগিয়ে যান
তিনি বদনাতে পানি ভ'রে নিয়ে উঠানে সফেদা চারাগাছটার কাছে ওজু করতে বসেন। মনটা তখনো যেন বিরক্তিতে ফানাফানা হ'য়ে আছে।আপন মনেই গজগজ করেন , দুনিয়া জ্বলছে , আর আশনাইয়ের শ্যাষ নাই ! তারপর মনে মনে বিচলিত হ'য়ে পড়েন, নাঃ , এ ঠিক হচ্ছে না, সে রাগত অবস্থায় ওজুতে মন দিবে কী ক'রে ? - - মনকে শান্ত করতে উঠে যান ।মুর্গীর দর্বাটা বন্ধ ক'রে এসে আবার ওজুতে বসেন। ওজু শেষ ক'রে হাত মুছে নামাজে দাঁড়িয়েছেন, টিনের দরজায় তখন কেউ ডাক দ্যায়, ও গাজী ভাই আছেন? গাজী
ভা----ই ?
কে ডাকছে? সালামত মিঞার গলা না ?
- - - নামাজ মুলতবি রাখবে না । তাড়াতাড়ি দু রাকাত নামাজ শেষ ক'রে মোনাজাত শেষ করে উঠে পড়েন।তখন নজুর মা এসে
হাজির। বলে, সালামত ভাই আইছেন। কিছু বলবে বুঝি। দ্যাহেন , কোনো বিপদ হলো নাকি ! এমন রাতে তো এধারে তেমন আসে না। আর এই লকডাউনের সময় তো কথাই নাই। দ্যাহেন দ্যাহেন ---
গাজী সাহেব দ্রুত দরজা খুলতে যান, স্ত্রী সফুরা জায়নামাজটা তুলে দেওয়ালে ঝুলিয়ে দ্যায় নির্দিষ্ট স্থানে।
দরজা খুলতেই সালামত বলতে থাকে , ভাই শুনেছেন কথা, করোনায় যারা মারা যাচ্ছে
তাদের সৎকার বা দাফন করার জন্য বাড়ির লোকজনও আতঙ্কে কাছে ঘেঁষছে
না। আর হাসপাতালও লাশগুলোকে পরিবারের হাতে দিছে না।হয় পুড়িয়ে ফেলছে , নাহয় ধাপার এলাকায় কোথাও পুঁতে দিছে । আমেরিকায় ইরানে তো সৎকারের কোনো লোকই পাওয়া যাছে না।
সেখানেও সেনার দ্বারা গণকবর দেওয়া হচ্ছে বা পুড়িয়ে ফেলছে। কোথাও কোথাও তো স্থানীয়রাই নির্দিষ্ট গোরস্থানে নিয়ে যেতে দিচ্ছে না।গোসল করানো বা কাফন পরানোর তো কোনো বালাই -ই নাই। হায় আল্লাহ্, তোমার কী গজব পাঠাইলা দুনিয়ায় ! শেষকালে কিছু হ'লে তো হয়তো আত্মীয়স্বজনের দাফনের দুমুঠো মাটিও জুটবে না কপালে !ওমর গাজী তার মনোবল অটুট রাখার জন্য বললো, আরে ভাই, ওসব গুজব ।। স্রেফ রটনা। ওসবে কান দিও না।আমাদের দেশে তেমন কিছু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। হয়তো বিদেশে হ'তে পারে ।তবে আমাদের দেশে এমন হবে না। আজেবাজে গুজবে একদম কান দিও না । কেউ এসব বললে তাকে বুঝাও যে ওসব গুজব।আর আমাদের দেশের মানুষ আত্মীয়স্বজনের সৎকার নিজেরাই করবে।গণদাহ বা গণকবর এখানে কোথাও হচ্ছে না বা হবে না ।তুমি অমূলকভয় পেও না । তবুও সালামকে আশ্বস্ত করা গেল না। সে হাউহাউ ক'রে কান্নায় ভেঙে পড়লো। সে এতোটাই বিধ্বস্ত ও মনোবলহারা হ'য়ে পড়েছে যে দাঁড়াবার শক্তিও নাই। ধপাস ক'রে দরজায় ব'সে পড়লো।
ওমর গাজী ও তার বউ এইসব দেখে একেবারে বাকরুদ্ধ হ'য়ে দাঁড়িয়ে রইলো !
মনে মনে বললো, সুবহান্ আল্লাহ !
এ কী গজব পাঠাইলো আল্লা , রহম করো খোদা রহম করো , আমরা যেন দাফনের কাফন ও স্বজনের হাতের মাটিটুকু পাই ! আল্লাহ্ তোমার রহমত বরষাও ! করোনা যেন আমাগো না ধরে! - - - আল্লা তুমি দেশ থেকে করোনাকে মুছে দাও , দূর ক'রে দাও - - - -
• ওমর গাজী সালামতকে তুলে ধরতে উদ্যত হলেন। নজুর মা তৎক্ষণাৎ তাঁকে পিছন থেকে টেনে ধরলো,চেঁচিয়ে বললো , নাঃ--!
খবরদার ধরবেন না ! এখন দূরত্বে থাকতে হবে !- - - ওমর দূরত্বে হ'টে এসে সালামতকে ব'লে উঠলো, ওঠো সালামত, ঘরে যাও,
আমার এখানে রাত থাকার ব্যবস্থা নাই, ভাই যাও ! কা'র সাথে করোনা আসবে আমরা কেউ জানিনা। মাফ করো !
সালামত বিস্মিত অবিশ্বাসে বোকার মতো তাদের পানে চেয়ে হাঁ ক'রে রইলো। তার দুচোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে -- -- -
( ২০৫৪ শব্দ )
© বদরুদ্দোজা শেখু ,বহরমপুর।
---------------------------------------------
* * *
**ঘোষণা
-----------------
:: এই গল্পটির রচনার তারিখ—২৬•০৪•২০২০
। গল্পটি মৌলিক ও অপ্রকাশিত । গল্পটির উদ্দেশ্য করোনাকালে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের আবহকে যথাযথ রূপায়িত করা । কারো ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া বা সরকারী নীতিকে বিরোধ করা নয়
--------বদরুদ্দোজা শেখু, লেখক ।
---------------------------------------------------------
কবির নাম-- বদরুদ্দোজা শেখু
ঠিকানা-- 18 নিরুপমা দেবী রোড , বাইলেন 12 ,
শহর+পোঃ- বহরমপুর , জেলা--মুর্শিদাবাদ,
PIN -742101
পঃ বঙ্গ , ভারত ।
হো• অ্যাপ নং 9609882748
----------------------
কবি-পরিচিতি
-------------------
বদরুদ্দোজা শেখু-র জন্ম ১৯৫৫ সালে ফেব্রুয়ারীতে মুর্শিদাবাদ জেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামে ।ক্ষুদ্রচাষী সাইফুদ্দীন সেখ ও গৃহবধূ ফজরেতুন্নেশা বিবির সন্তান। দারিদ্র্যের মধ্যেই গণিতশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ।পেশায় অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। নেশায় কবিতা লেখালেখি। শোভা গোস্বামীকে বিবাহ করেছেন।
এযাবৎ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক আত্মঘাত, দুঃস্বপ্নের নগরে নিভৃত নগ্ন,শব্দ ভেঙে সংলাপ,আরো থোড়া দূর,এবং পরী ও পেয়ালা ।তাঁর কবিতা অদলবদল , সপ্তাহ, দৌড় , কবিতীর্থ ,শব্দনগর, ঋতুযান প্রভৃতি পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত । বিভিন্ন পত্রিকাগোষ্ঠী থেকে একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন।।
তিনি কিছু কিছু ছোটগল্প ও অণুগল্পও লিখেন
-------------------------------------------