সমাজ বসু
--- গাছ কাটাবে নাকি গো?
কথাটা কানে যেতেই চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন ধীরেন বাবু। লুঙ্গিটা কোমরে গুঁজে সোজা বারান্দায়। কাল বিকেল থেকে আমপানের তান্ডবে বাগানসহ বাড়ির চারপাশটা যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আম, পেয়ারা আর কাঁঠালগাছের প্রায় সত্তর শতাংশের ডালপালা ভেঙে তালগোল পাকিয়ে পুরো বাড়িটাকে জড়িয়ে ধরেছে। এই অবস্থায় হাতে চাঁদ পাওয়ার মত,কাটারি সমেত একজন মানুষ নয়,যেন দেবদূতের সন্ধান পেলেন ধীরেন বাবু।
--- এই যে ভাই, তোমার নাম কী? দোতলার বারান্দা থেকে তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন।
--- স্যার আমার নাম শুভ। শুভ সরকার। বছর বাইশ তেইশের ছেলেটা মুখ তুলে ভাঙা ডালের ফাঁক দিয়ে জবাব দিল।
--- কাল আমপান যা তান্ডব চালিয়েছে,বাপরে বাপ! আমার জন্মে এমনটা দেখিনি। দেখছ ত, বাড়ির সামনেটা কী হয়ে আছে। একদিনে তুমি পারবে না। ঠিক আছে,হাত ত লাগাও। সারাদিনে যতটুকু হয় হবে। তা কত দিতে হবে? আসল কথায় এলেন ধীরেন বাবু।
--- যা উচিত মনে হয় দেবেন।
--- তাই বললে কী হয়! ঠিক আছে, তুমি ভেতরে এসো,আমি নামছি। ধীরেন বাবুর আদেশ পাওয়া মাত্রই গেট ঠেলে বাড়িতে প্রবেশ করল ছেলেটা।
ধীরেন বাবুর বড় দয়ার শরীর। তিনি বেশ বুঝতে পেরেছেন,ছেলেটা নিশ্চয়ই কোন অভিজাত পরিবারের। তার হাবভাব আর কথাবার্তায় অন্তত সেটুকু ধরা পড়েছে।তাই তিনি কোনরকমে দরদামের না গিয়ে তিনশ টাকায় ভাঙা ডালপালা পরিষ্কারের ছাড়পত্র দিয়ে দিলেন।
আর অনিচ্ছাসত্ত্বেও ধীরেন বাবুর অনুরোধে জলখাবার খেয়েই শুভকে কাজে নামতে হলো।
লকডাউনের জেরে মাস ছয়েক হলো টিউশনিগুলো সব হাতছাড়া। বড়বাজারে বাবার কর্মস্থলেও তালা। এদিকে সামান্য যেটুকু টাকা ছিল, এই কয়েক মাসে তাও শেষ। চিন্তায় চিন্তায় মায়ের শরীর আর মন দুই-ই ভাঙছে। শুভ আর সাতপাঁচ না ভেবে পাড়ার গনেশ দার দোকান থেকে কাটারিটা ভাড়ায় নিয়ে পথে নেমে পড়েছে। ফেরার পথে কিছু বাজারের সঙ্গে মায়ের গ্যাসের ওষুধটাও নিয়ে যাবে।
ঘন্টাখানেক শুভর পাশে থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ধীরেন বাবু স্নানে ঢুকলেন।
স্নান সেরে ঘরে ঢুকতেই চিৎকারটা তাঁর কানে এল। ছুটে বারান্দায় গিয়ে যা দেখলেন, সেই দৃশ্য তাঁকে হতচকিত করে দিল। তিনি একেবারে হতভম্ব। একি! আমি গাছের ডাল থেকে মাটিতে পড়ে আছে ছেলেটা। দুটো ডালের ফাঁকে আটকে তীব্র যন্ত্রনায় গোঙাচ্ছে সে।
কোনরকমে শার্টপ্যান্ট গলিয়ে নীচে নামতে নামতেই বললেন, ঝিমলি,মা আমাকে এক্ষুনি একবার বেরোতে হবে। গাড়ির চাবিটা নিয়ে আয়।
বাবার আদেশে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বাবার সাথে সিড়ি ভাঙতে থাকে ঝিমলি।
--- একি, শুভ তুই! গাছের ডাল তুই কাটছিলি? কেন? বাবা শুভ আমাদের কলেজে পড়ে। খুব ভাল স্টুডেন্ট। ওকে এই মুহূর্তে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে,বলেই দু মিনিটের ভেতর বাবার মানিব্যাগটা নেমে আসে ঝিমলি।
গাড়ি ছুটে চলে স্থানীয় নার্সিংহোমের দিকে। পেছনের সিটে শুভর রক্তাক্ত মাথাটা ঝিমলি নিজের কোলের ওপর ভিজে তোয়ালেতে ঢেকে রেখেছে। শুভর মুখে শুধুই ব্যথার স্বর।
--- আঙ্কেল,এই ভয়ানক সময়ে অদৃশ্য এক ভয়ের কাটারি যে আমাদের পরিবারকে কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। তাই সত্যিকারের কাটারি নিয়ে মোকাবিলায় নেমেছিলাম,মা বাবাকে ঠিক রাখব বলে। কিন্তু কোত্থেকে কী হয়ে গেল।
--- তুই এখন কোন কথা বলিস না শুভ। ব্যথা বাড়বে। তাছাড়া আমরা তো আছি। ঝিমলি স্বান্ত্বনা দেয়।
এদিকে শুভর এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য ধীরেন বাবু নিজেকেই তাঁর অন্তরের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন। ছেলেটার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তিনিই তো কাটারিটা তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কেউ না জানুক, তিনি জানেন এ তার অমার্জনীয় অপরাধ। আজ এই ক্রান্তিকালে জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে শুধু পরিবারের সদস্যদের সুস্থ স্বাভাবিক রাখার জন্য কী অসম্ভব লড়াই। ছেলেগুলোর এই যুদ্ধকে থামিয়ে দেওয়ার অধিকার তাঁর নেই। একটা অসম্ভব কষ্ট তাঁকে ঘিরে ধরেছে। তবু নিজেকে সামলে ভাবতে থাকেন, যেভাবেই হোক ছেলেটাকে বিপদমুক্ত করতে হবে। পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতেই হবে। যেন সে আবার নতুন করে আত্মবিশ্বাসের কাটারি দিয়ে অভাব অনটনের ডালপালা কেটে সরিয়ে সংসারের জমাট অন্ধকারে স্বস্তি আর খুশির আলো আনতে পারে।
--- শুভ, তুমি ভয় পেও না। তোমার ওই কাটারি শুধু ডালপালাই কাটবে। আড়াল থেকে ওই কাটারি কিছুতেই তোমাদের সংসারে নামমাত্র কোপ ফেলতে পারবে না। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মা বাবার প্রতি তোমার ভালবাসা আর দায়বদ্ধতায় আমি মুগ্ধ। গাড়ি চালাতে চালাতেই কথাগুলো শুভর উদ্দেশে বললেন, ধীরেন বাবু।
----------
সমাজ বসু।।
৫৬এ, মিলন পার্ক।। ডাক--গড়িয়া
কলকাতা--৭০০০৮৪
ফোন--৬২৯১৩৭৭৩৮২.