মায়া দি
শুভাশিস দাশ
বয়স টা ঠিক আন্দাজ করা মুশকিল হয়েছিল মায়া দি র । একবার বিধানসভা নির্বাচন এ ভোট নিতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল মায়া দি র সাথে । পরে জেনেছিলাম উনি আমার হারিয়ে যাওয়া দিদি । ভোট কেন্দ্র ছিলো কোচবিহার জেলার মাথাভাঙা মহকুমার কালীগঞ্জ অঞ্চল । একেবারেই ইণ্টিরিয়র প্লেস । যাকে বলে গন্ডগ্রাম । আমি ফাস্ট পোলিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলাম ।
ভোটের পি মাইনাস ওয়ান ডে তে পৌঁছে যে স্কুল ঘরে আমাদের থাকবার এবং ভোট কেন্দ্র হয়েছিল তার পাশেই ছিলো মায়া দির বাড়ি ।
একটা সেলফহেল্প গ্রুপের সদস্যা । তাঁর উপর দায়িত্ব ছিলো আমাদের তিনবেলা খাবারের ।
ভোটের গাড়ি যখন পৌঁছল ঠিক তার আধ ঘণ্টা পরেই একজন পাতলা ছিপছিপে গড়নের মহিলা এসে আমার প্রিসাইডিং অফিসার অনিমেষ দেব কে বললেন ' আমরা আমাদের গ্রুপ থেকে আপনাদের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করবো । অনিমেষ বাবুকে অবশ্য ট্রেনিং এর সময়ই দেখেছি খুব কম কথা বলেন।
মায়া দি র কথা গুলো শুনে তিনি আমাকে বললেন দেখুন তো উনি কী বলছেন । বুঝলাম আমাকেই এদিকটা দেখতে হবে ।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে মায়া দির সাথে স্কুলের বারান্দার এক কোণে কথা বলে নিলাম । খুব গুছিয়ে কথা বলে গেলো মায়া দি ।
মায়া দি কথা বলে চলে গেলে আমি সবার সাথে ভোটের কাগজপত্র গুছিয়ে নেবার কাজে যোগ দিলাম ।
এই স্কুল বাড়িটায় এখনও ইলেকট্রিক আসেনি । মে মাসের গরমে প্রায় সেদ্ধ হয়ে যাবার যোগাড় । আমাদের টিমের সেকেন্ড পোলিং অফিসার বললেন অনিমেষ বাবু একটু হাওয়ার ব্যাবস্থা না হলে তো খুবই অসুবিধা হবে । তারউপর আশপাশে কোন বড় গাছও নেই যে একটু বাতাস আসবে । একটা ছোট্ট জেনারেটর অবশ্য আছে কিন্তু তাতে ঘরের দুটো বাল্ব জ্বলছে । ফ্যানের কোন ব্যাবস্থা নেই ।
আমাদের সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে মায়া দি একটা কেটলির মধ্যে চা নিয়ে এলো । সাথে নোনতা বিস্কুট আর ওয়ান টাইম কাপ ।
বারান্দায় উঠে হাঁক দিলেন ' বাবু আপনাদের চা ' বাইরে প্রহরায় যে রক্ষী ছিলেন তিনি বললেন যাও ভিতরে দিয়ে এসো । '
মায়া দি ভিতরে এসে একটা থালার মধ্যে কাপ সাজিয়ে চা ঢেলে পাশে বিস্কুটের প্যাকেট রেখে বলে গেলেন রাতে ন টায় ভাত আনব ।
আমাদের রাত সাড়ে আটটার মধ্যেই সব কমপ্লিট হয়ে গেলো সাথে ভোট কক্ষও ।
স্কুলের চাপা কলের জলে একটু ফ্রেশ হয়ে সবাই বসতেই রাতের খাবার চলে এলো ।
এবার মায়া দির সাথে আরও দুজন মহিলা এসেছেন ।
রাতের খাবার একেবারেই হালকা বলেছিলাম । কেননা যে গরম পড়েছে । মেনুতে মুসুর ডাল , আলু ভাজা , একটা নিরামিষ তরকারি সাথে কাঁচা পেঁয়াজ আর লংকা ।
সবাই একসাথেই খেতে বসলাম ।
মায়া দি পরিবেশন করলেন । মনেই হলো না আমরা বাড়ির বাইরে আছি । আসলে মায়ের জাত তো । কত যত্ন !
খেতে খেতেই অনিমেষ বাবু বললেন - এই সব নিয়ে একটা গল্প হবে না ? আপনি তো আবার লেখক মানুষ ।
বললাম --সে আর বলতে !
খাওয়া দাওয়া শেষ করে মায়া দি রাতের মিলের হিসাব টা দিয়ে বললেন আসুন না এই তো পাশেই বাড়ি একটু দেখে যান । কাল তো সময়ই পাবেন না । তা ছাড়া রাতও তো তেমন হয়নি ।
সেকেন্ড পোলিং বাবুর আবার পানের নেশা আছে । বললেন এখন তো সব বন্ধ হয়ে গেছে । ব্যাগ খুঁজেও পানের ডিব্বা টা পেলাম না । আপনি যদি যান তাহলে দিদির ঘর থেকে একটা পান নিয়ে আসবেন । একটা ছুঁতো পেলাম । আমার আবার বাইরে গেলে সেখানের মানুষজন নিয়ে একটু কৌতুহল জাগে । আর বিন্দু মাত্র অপেক্ষা না করে মায়া দিকে বললাম চলুন ।
ভোট কেন্দ্র থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে মায়া দির বাড়ি । স্কুল থেকে স্পষ্ট দেখা যায় ।
মোবাইল ফোনের আলো জ্বেলে মায়া দিকে অনুসরণ করলাম । স্কুল বাউন্ডারি শেষ হতেই আঙুল উঁচিয়ে মায়া দি বললো -ওই তো ওই বাড়িটাই আমার ।
গরমের রাত বলে ইতি উতি মানুষজনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে , না হলে এতক্ষণ ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যেতো এই কথাগুলো বলতে বলতে মায়া দি একটা টিনের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আমাকে ভিতরে আসতে ইশারা করলেন ।
ওঁর পিছন পিছন ঢুকে পড়লাম । ঘরে একটা লন্ঠন জ্বলছে । টিনের ঘেরা বাড়ি ।
ঘরের ভিতরে একটা টেবিল , দুটো চেয়ার , কাঠের একটা আলমারি আর একটা চৌকি তে বিছানা পাতা ।
আমাকে চেয়ারে বসতে বলে তিনি বাইরে গেলেন । মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এসে তিনি বিছানায় বসেই বললেন জানেন আপনি আমার ঠিক ভাইয়ের মত দেখতে । অবিকল আমার ছোট ভাই । বাংলদেশের যুদ্ধের সময় এপারে এসে কোথায় যে হারিয়ে গেলো আর খুঁজে পাইনি ।
বাংলা দেশ ? আমি বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম ।
সে অনেক কথা গো দাদা বাবু ।
মনে মনে ভাবলাম একটু শুনেই নিই না । অন্তত একটা গল্পের প্লট তো হবে । বললাম কী কথা গো ? একটু বলো না শুনি ।
মায়াদি বলতে শুরু করলেন ।
তখন কতই আর বয়স হবে ছয় কি সাত । ভাইটিও খুব ছোট ।বাংলাদেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধ বাধলে মার হাত ধরে আমরা এপারে চলে এলাম । আমি আর সেই ভাই টা । বাবার কথা মনেও নেই । শরণার্থী ক্যাম্পে ভাইটি হারিয়ে গেলো আর খুঁজে পেলাম না আমরা ।
অসহায় মা এপারে এসে কিছুদিন শরণার্থী শিবিরে আমাদের নিয়ে থাকলো তারপর আমরা একটা বাড়িতে আশ্রয় পেলাম । এই যে স্কুল টায় আপনারা ভোট করতে এসেছেন এই স্কুলের জমিদাতা ছিলেন নরেশ দাস । তিনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন ।
পরে অবশ্য বুঝেছিলাম কেন আশ্রয় দিয়েছিলেন কিন্তু সে ছাড়া তখন আর কোন উপায়ও ছিলো না ।
এতটুকু শুনে বললাম ঠিক বুঝলাম না তিনি কেন আশ্রয় দিয়েছিলেন ।
নরেশ বাবুর স্ত্রী সেসময় গত হয়েছিলেন একটি সন্তান রেখে । নরেশ বাবুর তিনকূলে কেউ ছিলো না । জমি জমা নিয়ে প্রচুর সম্পত্তি ।
এসব দেখতেও তো লোকের দরকার । একেবারেই যুবক ছিলেন তিনি । বুঝতেই পারছেন ? মা' রও বয়স অল্প ।
তবে মা স্বীকৃতি পাননি তাঁর কাছে আর সেজন্যই একদিন ভাইটি কোথায় চলে গেলো আর তাকে পেলাম না ।
এই যে এই জায়গায় বসে আছেন ? এটাও তাঁর দেয়া । আমারও কপাল খারাপ তাই বিয়ের বছরই স্বামীকে হারিয়েছি ।
বললাম আর বিয়ে করেন নি ?
না । পাশের গ্রামেই বিয়ে হয়েছিল । স্বামী মারা যাবার পর মায়ের ভিটা তেই চলে এলাম । মাও একা ।
কেন নরেশ বাবুরা ?
নরেশ বাবুর ছেলেটা বড় হলো তারপর এখান থেকে সব বেঁচে দিয়ে শিলিগুড়ি চলে গেছে মার জন্য শুধু এই জায়গা টা রেখে গেছে ।
এরপর মাও একদিন আমাকে ছেড়ে চলে গেলো । এই স্কুলের এক দিদিমনি আমাকে পরামর্শ দিলেন একটা সেলফহেল্প গ্রুপের সাথে যুক্ত হতে । সেই থেকে আমি এই কাজ নিয়েই আছি ।
হাতের মোবাইল ফোন টা বেজে উঠলো । অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো প্রিসাইডিং অফিসারের গলা ' কী ব্যাপার দাশ বাবু ? রাত বেড়ে যাচ্ছে যে ! সকালে তো উঠতে হবে । '
বললাম এই তো আসছি ।
গল্পে গল্পে কখন রাত হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি । মায়া দি কে বললাম আজ উঠি ।
সেদিন রাতে আর ঘুমোতে পারিনি । ইনি কি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া মায়া দি । কেউই তো জানে না । আর কেউ বলেও নি ।
যে বাড়িতে আমি মানুষ হয়েছিলাম সে বাড়ির মাসিমা বলেছিল আমার জ্ঞান ফিরলে শুধু মায়া দি মায়া দি বলছিলাম ।
কী জানি হবে হয়তো ।
মনের ভিতর কেমন যেন সব ওলট পালট করতে লাগলো ।
দূরের কোন মসজিদ থেকে ভোরের আজান ভেসে এলো । পাখির কিচিরমিচির শব্দে জানিয়ে দিলো ভোর হলো ।
------------
শুভাশিস দাশ
দিনহাটা
মো 9932966949