Click the image to explore all Offers

দেবব্রত ঘোষ মলয়ের ধারাবাহিক উপন্যাস - সোনালী দিনের উপাখ্যান, পর্ব - ৯

 


পূর্বকথন


বাড়ির বেড়ার দরজার সামনে উদ্যত ফনা বিষধর সাপের সামনে অসহায় ঝিনটি কাঁপতে থাকে। বহুরূপী শম্ভু তড়িৎগতিতে শাবলে বিদ্ধ করে সাপটিকে। কিন্তু মেয়েকে বাঁচাতে ছুটে আসেন নিধু ঠাকুর, কাপড়ে জড়িয়ে পড়ে যান বিদ্ধ সাপের সামনে। ক্রুদ্ধ ছোবলে চিরবিদায় নেন ঠাকুরমশাই, সাপটিও ঢলে পড়ে মৃত্যুমুখে।  অচেতন ঝিনটিকে নিজের বাড়ি নিয়ে যান রাজলক্ষী দেবী, বিষণ্ণ শম্ভু গ্রাম ছেড়ে যায় চিরকালের মত। এরপর ...

পর্ব ৯


কালো রাত কেটে ভোর হয়। মলিন সূর্য নিজের কর্তব্য পালনেই বোধহয় আকাশী নদীর উপর ভেসে ওঠে যথারীতি। ধীরে ধীরে জেগে ওঠে ধানসিঁড়ি গ্রাম। আজ কারোর মন নেই কোন কাজে।   রাজেন ঠাকুরমশাই এই গ্রামের সব বাড়ির প্রণম্য। 
গতকাল ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই বিহ্বল থাকলেও সূর্য ডাক্তার বহু চেষ্টায় ঝিনটির দাদা রাজকুমারকে খবর পাঠায়। রাজকুমার রাতেই বাঁকুরা থেকে চলে আসে গ্রামের বাড়িতে। বাবার দাহকাজ সম্পন্ন করে গ্রামের প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে। বোনকে ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসে নিজেদের ভিটেয়। দাদাকে দেখে একটু সামলে ওঠে ঝিনটি।
সকালের নরম রোদে বাড়ির দাওয়ায় বসে একদৃষ্টে বেড়ার দরজার দিকে চেয়ে থাকে রাজকুমার। গতকাল ওইখানেই বাবা সর্পঘাতে প্রাণত্যাগ করেন। তার মনে পড়ে টুকরো টুকরো ঘটনা, বাবার কাঁধে চেপে মেলায় যাওয়া, মাধমিকে ভাল ফল করায় বাবার দেওয়া হাতঘড়ি।  মায়ের অকাল মৃত্যুর পর দু ভাইবোনকে আগলে রাখা। তিল তিল করে জমানো টাকায় তাকে ডাক্তারী পড়ানো। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল সে বড় ডাক্তার হবে, গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়াবে।
চা করে নিয়ে কখন পাশে দাঁড়িয়েছে বোন, সে বুঝতেও পারেনি।
দাদা, চা এনেছি। - দাওয়ার উপর নিজের চা রাখে ঝিনটি। প্লেটের উপর কাপ বসিয়ে দাদাকে দেয়। 
গরম চায়ে চুমুক দেয় রাজকুমার। তারপর বলে - বোন, তোর শরীর ঠিক আছে তো।
ঝিনটি দাদার এ কথায় হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। দু হাতে বোনের মাথা বুকের উপর চেপে ধরে বলে রাজকুমার - আমি তো আছি বোন। তুই নিজেকে শক্ত কর।
বিধাতার বিচার বড় বিচিত্র। এই ছেলে মেয়ে দুটি বড় ভালো মনের মানুষ। গ্রামের সবার প্রিয়। জ্ঞানত কাউকে মনে আঘাত দিয়ে কথা বলে না তারা। নিধু ঠাকুরের ঋজু চেহারার মতোই সৎ শিক্ষা পেয়েছে তারা। অথচ, ছোটবেলায় মাকে হারায় তারা। বাবার কাছে মানুষ হয়েছে, একটা দিনের জন্য অবাধ্য হয়নি, পড়াশোনায় ফাঁকি দেয় নি। অথচ বাবাকেও অকালে হারিয়ে ফেলল দুই ভাইবোন।
এ সময়েই এসে উপস্থিত হন রাজ লক্ষী দেবী আর কিঙ্করবাবু। একরাশ ফল, মিষ্টি, আর হবিশ্যির নানা সামগ্রী ভর্তি ব্যাগ দাওয়ায় রেখে ঝিনটির হাত ধরে নরম স্বরে বলেন রাজলক্ষীদেবী - এগুলো ভিতরে রাখ মা। দাদাকে তো হবিশ্যির সব ব্যবস্থা করে দিতে হবে, আর তুই নিজেও একটু ফল, মিষ্টি খেয়ে শরীর ঠিক রাখবি মা। যিনি যাবার তিনি তো গেলেনই, ভালোয় ভালোয় কাজটা তো করতে হবে। 
ঝিনটি ওঁদের জন্য চা করে আনে কোন বারণ না শুনেই। কিঙ্করবাবু রাজকুমারের সঙ্গে শ্রাদ্ধশান্তির কাজের ব্যাপারে আলোচনা করেন। জানিয়ে দেন, তাঁরা সব রকমভাবে ওদের পাশে আছেন।
দেখতে দেখতে কটা দিন কেটে যায়। পারলৌকিক কাজকর্ম ভালোভাবেই মিটে যায়।
আরও এক সপ্তাহ কেটে গেল। আজ কিঙ্করবাবু দুই ভাইবোনকে বাড়িতে নিমন্ত্রন করেছেন। এই সময়ে খাওয়া দাওয়াটা মূল উদ্দেশ্য নয়, মূল উদ্দেশ্য ঝিনটির ভবিষ্যৎ। বসুবাড়ির প্রশস্ত বৈঠকখানায় মধ্যাহ্নভোজের পর সবাই একজায়গায়। সোফাসেটে কিঙ্করবাবু আর শুভঙ্কর বাবু বসে পান চিবচ্ছেন আর সূর্য শেখর আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়র গল্পটা পড়ছে একমনে। রাজলক্ষী দেবী আর বিনতা নিচু ডিভানে আধশোয়া হয়ে পান চিবুচ্ছেন, রাজলক্ষ্মী দেবীর কোলের কাছে ঝিনটি। রাজকুমার চন্দ্রশেখরের সঙ্গে কিছু একটা আলোচনা করছে।
এ সময়ে ঘরে ঢোকে ছায়া ছবি। তার হাতে একটা বড় থালায় সদ্য কাটা বেশ কিছু মরসুমি ফল। 
নাও তো, ফলগুলো সবাই খেয়ে নাও - বলে ফলের থালাটা ঘরের মাঝখানে রাখা শ্বেতপাথরের সেন্টার টেবিলে রাখে সে।
এ সময়েই রাজলক্ষী দেবী বলে ওঠেন - রাজু তো পরশু বাঁকুড়া চলে যাবে, ওর ফাইনাল ইয়ার। আমার ইচ্ছা ঝিনটি মা এই সময়টা আমার কাছে এ বাড়িতে থাক। 
সবাই সমস্বরে সায় দেয়। ঝিনটির চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে থাকে।
---------- 
ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.