বিজ্ঞপ্তি
লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫
নভেম্বর ২১, ২০২৪
মিষ্টার এস. ভট্টাচার্য। মেদিনীপুরের গ্রামের স্কুলে পড়ে। বাবা পুজো করে। মা বাড়িতে মুড়ি ভেজে দোকানে দোকানে ও গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ছেলেমেয়েদের দিয়ে বিক্রি করতে পাঠায়। মাবাবা দুজনে, যা পায় তাতে ছ'জন ভাইবোনের ও তাদের স্বামীস্ত্রীর, রোজ একবেলা খেয়ে চলে। আর একবেলা উপোস। বড় ছেলে এস. লেখাপড়ায় খুব ভালো। ক্লাসে ফার্স্ট হয়। অন্যেরা মোটামুটি। পরের কাছ থেকে বই চেয়ে এনে এরা সবাই পড়ে। খাতা, পেন, পেন্সিল ও চেয়েমেগে পায়। অন্যের পুরোনো পোশাক পড়ে। মাটির একটি ঘর। খড়ের চাল। তবে এই ফ্যামিলি ধার্মিক ও নিষ্ঠার জন্য সকলের শ্রদ্ধা পায়। নিজের ঘরের পাশে বাবা একটি ছোট্ট, মাটি ও ছিটে ব্যারার দেওয়াল দিয়ে, তাল পাতার ছাউনি দিয়ে, সেখানে মা শ্রী কালী দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে শুদ্ধাচারে, নিত্য পুজো ও ভোগ দেয়। অনেকেই এখানে এসে মানত করে, সফল হয়, তাই পুজো দিয়ে যায়। জাগ্রতা দেবী মা, এরকম প্রচার ও বিশ্বাস আছে সকলের।বড় ছেলেটি স্কুলের পড়া সম্পূর্ণ করে, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হল। চেনা একজনের বাড়িতে থাকে। তার একমাত্র সন্তান, অল্প বয়সী মেয়েকে ও টিউশনি পড়ায়। ও হিন্দু স্কুলের ছাত্রী। এর বাবা প্রেসিডেন্সির ইকোনোমিক্সের প্রফেসর। এই প্রফেসরের বাবার আদি নিবাস ছিল ওই এস.-এর গ্রামে। প্রফেসর কলকাতায় চাকরী পাবার পর, এখানেই ফ্ল্যাট ক্রয় করে নিজের পত্নী ও কন্যাকে নিয়ে থাকে। নিজেই মেয়েকে পড়াত। তবে একে বাড়িতে পেয়ে যাওয়ায়, এখন দুজনেই পড়ায়। মা হাউস ওয়াইফ। খুব বড় এক ব্যবসায়ীর একমাত্র সন্তান। এই প্রফেসর ওই মেয়ের টিউশন টীচার ছিল। পরে লাভ ও ছাত্রী থেকে স্ত্রী হয়। এবার ঠিক একইভাবে এস ও এই ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমে জড়িত হল। কলেজ থেকে এ এবার গোল্ড মেডেল পেয়ে পাশ করলো। এরপর মাস্টার্স ডিগ্রীতেও গোল্ড মেডেল পেলো। এবার ও দিল্লীতে চলে এলো। রিসার্চ করে ডক্টরেট পেলো। তারপর ফিন্যান্স মিনিস্টারের এডভাইসারের জব পেলো। তারপর দিল্লী আই. আই. টি.-তে লেকচারার হল। পার্ট টাইম করে এখানে। বেশ কয়েকটি বছর কেটে গেছে। এতদিনে ওই কলকাতার প্রেমিকার সঙ্গে ব্রেক আপ হল। এবার নিউজ পেপার দেখে একটি পাত্রীর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করলো। বিয়ে করতে হবে এবার যে। অনেকটাই তো বয়স হল।ওদিক থেকে ইতিমধ্যে, এক এক করে সব ক'টা ভাইকে দিল্লীতে নিয়ে এসে চাকরীতে ঢুকিয়ে দিল। নিজের সোর্স কাজে লাগিয়ে। তিন ভাইই এখন দিল্লীতে থেকে ইনকাম করছে। একটি বিরাট বাড়ি ভাড়া নিল এবার ওরা, দিল্লীর লক্ষ্মীনগরে। এরপর তিন বোনকেও আনলো। এক এক এক করে ওদের বিয়ে দিল। মা আদৌ এখানে আসে না। বাবা মাঝে মধ্যে আসে। আর তখন বাঙালিরা ওই বৃদ্ধকে ধরে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে নিজেদের বাড়িতে সত্যনারায়নের পুজো করায়। ভালো পাওনাও পায়।কোনও পিছুটান তো আর নেই, তাই এবার বিয়েটা করা যেতেই পারে।তো পাত্রীর বাবার সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। নিজেই করছে। কে আর সেরকম আছে? তাই। তো পাত্রীর বাবা কলকাতার লেক টাউনে একটি বিরাট বাংলোয় ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। রেলের হাড্ডির ডাক্তার। আগে বিহারে থাকতো। বিবাহের বহু বছর পরেও এদের কোনও সন্তান না হওয়ায় এরা পতি পত্নী মিলে বিহারের কোন এক জায়গা থেকে একটি কন্যা দত্তক নেয়। পাত্রী হল সেই মেয়ে। দত্তক নেওয়ার কয়েক বছর পর এই মহিলা প্রথমে একটি নিজের গর্ভজাত কন্যা ও পরে একটি পুত্রের জননী হয়। তো এখন সে তিন সন্তানের জননী। এরা একটু বড় হতেই ওরা বিহার থেকে কলকাতায় চলে আসে। এখানে পড়ালেখা করে। আর কখনও বিহার যায় নি। পাত্রী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. কম. পাস। সবেমাত্র পাস করলো। তো পাত্র কলকাতায় দেখ এলো। মাবাবা, ভাইবোনেরা ও ভগ্নিপতিরা সবাই দেখে পছন্দ করল। অনুষ্ঠান করে বিয়ে হল। বিয়ের পর বৌকে নিয়ে দিল্লীতে এলো।আদুরে মেয়ে। সংসারের কাজটাজ অতো করতে পারে না। স্বামী মেড রেখেছে। সে দুবেলা ঘর ও বর্তন সাফ করে। আর কাচাকাচি করে শুকোতে দেয় রোজ সকালে। আর বিকেলে এসে তুলে এনে দেয়। রান্নার কাজটা বউটিকে করতে হয়। কাঁচা হাতের রান্না। খেতে বাজে একদম! চাও ভালো করে করতে পারে না। একদিন যখন বড় বৌদী সকালে সবাইকে চা দিল তখন, মেজো দেওর গরম চা বড় বৌদীর মুখে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, " এটা চা হয়েছে? চিনিফিনি কিচ্ছু নেই। " আসলে বউটি চিনি দিতে ভুলে গিয়েছিল। এরপর বৌদী নাতা এনে পুঁছতে লাগলো। মেজো দেওর বলল, " এর নাম ঘর মোছা? " বলে সে নাতাটা বৌদীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বৌদীর মুখে ঘষে দিল। বৌদী তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। স্বামী নীরব দর্শক মাত্র। ছোট দেওর বলল, " মেজদা তুই এখনই এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা! '' মেজদা বলল, " ক্যানো তুই বলার কে? " তখন বৌদীর কান্না একটু কোমলো।এরপর এদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম নিল। তবে এখানে নয়। আট মাস হতেই ও বাবার বাড়ি চলে আসে। বাবা তো ডাক্তার। তাই ভালো ভাবেই ডেলিভারি হল। এবার ছেলের বাবা পুত্রের মুখ দেখে এলো। তারপর ওখান থেকে সেই মাসে এখানে আনলো, যে মাসে ওর অন্নপ্রাসন হবে। দিল্লীতে মুখেভাত হল। প্রচুর লোকজন নিমন্ত্রণ পেলো। একদম বাঙালী আয়োজন। প্রচুর উপহার পেলো।এবার মিষ্টার এস. ভট্টাচার্য উত্তর প্রদেশের, গাজিয়াবাদের, শালীমার গার্ডেনে একটি ফ্লোর পুরোটাই কিনে নিল। টোটাল ছ'টি ঘর। বিশাল ব্যালকনি। এই বিল্ডিং - এ মোট তিনটি ফ্লোর। এ মাঝেরটি নিল। এর বন্ধু মিষ্টার সাহা টপ ফ্লোরটি নিল। এ আই. এ. এস. অফিসার। আর গ্রাউন্ড ফ্লোরটি এক পাঞ্জাবি পরিবারের। এদের মালিক আবার টি. ভি.-র ফোটো গ্রাফার। সিরিয়ালের জন্য বাইরে বাইরেই ঘোরে বেশিরভাগ সময়। কম সময়ই বাড়িতে থাকে। বউটি ও দু মেয়ে এখানে থাকে। এখানে এরা তিন ফ্যামিলির দু ফ্যামিলি থাকে। মিষ্টার সাহা কিনেছে তবে তার ওয়াইফ ও দু ছেলে এখানে আসে নি। ওরা কলকাতার স্কুলে পড়ে। তাই কিনে পড়েই রইল। সাহা মাঝে মধ্যে কলকাতা যায়। একাই এই বৃহৎ ফ্ল্যাটে থাকে। গাড়ীও কিনেছে। একাই চড়ে। তবে ভট্টাচার্য এখনও কার কেনে নি। এবার এখানে আসার এক বছর পর এদের একটি মেয়ে জন্ম নিল। এবার আর কলকাতায় যায় নি। কারণ, আগের মাসেই যে ওর বাবা ইহলোক ত্যাগ করেছে। দেখতে দেখতে দেখতে ছেলে ও মেয়ে বড় হল। ওরা ডি. পি. এস. স্কুলে পড়ে। রোজ বাসে করে যায় ও আসে। কয়েক বছর কেটে গেল। ওদিকে ভট্টাচার্য বাবুর বাবা তার গ্রামে দেহ রাখলো। অনেক বয়স হয়েছিল তো। তারওপরে হাঁপানী রোগী ছিল। এবার মিষ্টার ভট্টাচার্য জাপান ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর হয়ে চলে গেল। এদিকে ছোট দেওর লাভ ম্যারেজ করে এখন এখান থেকে চলে গেছে। তার পাঞ্জাবী বউকে নিয়ে সে দিল্লীতে ভাড়া থাকে। মেজো এখনও বিয়ে করে নি। জাপান যাবার আগে বড় ছেলে গ্রাম থেকে মাকে নিয়ে এসে রাখলো। একা একা একা এই বৃদ্ধা বয়সে কী করে কাটবে? তাই। শাশুড়ি ও মেজো দেওর মিলে এর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল। আর ওদিকে বর তো বিদেশে। মানি পাঠায় ব্যাংক মারফত। প্রতি মাসে। বউটি বাঁচার জন্য একটি প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষিকার জব করতে লাগলো। কিন্তু হায়! একী হল? জাপান থেকে সে ফিরে এলো। গলায় থাইরয়েড ক্যান্সার। এক নার্সিং হোমে রইল। মাটি তো শুনে হা হুতাশ করতে লাগলো। পত্নীও। কয়েক সপ্তাহ পরে বড় ছেলের জন্য দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মা অসুখে পড়ল। কয়েক দিন পর সে মারা গেল। শাশুড়ীর শেষ কাজ বড় বউ, মেজো ছেলে ও ছোট ছেলেবউ মিলে করালো। শাশুড়ি তো কোনদিন ছোটর বাড়ি যেতই না। পাঞ্জাবীর হাতের জল খাবে না, তাই। এরপর কয়েকমাস কাটলো। মিষ্টার ভট্টাচার্য পরলোকে গমন করল। বউটির মা, ভাই ও ভায়ের বউ এলো। বোন ও ভগ্নিপতিও এলো। ভাইটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে। বউ হাউস ওয়াইফ। বোন টীচার। ভগ্নিপতি প্রাইভেট ব্যাংকের ম্যানেজার। এরা সবাই মিলে মিসেস ভট্টাচার্য ও তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতায় চলে গেল। সাহা তখন এই ভট্টাচার্যদের ফ্ল্যাটটি ও নিজের ফ্ল্যাটটি রিসেল করে দিল। আর নিচের মহিলার সঙ্গে তার হাসব্যান্ডজীর ডিভোর্স হয়ে গেছে। একাই বাচ্চাদের নিয়ে আছে। ওপরের দু ফ্লোরে আবার নতুন কোনও দু ফ্যামিলি এলো।
------------