||জন্মদিন ও নব্বই বছর ||
|| চন্দন চক্রবর্তী ||
মানুষটার নাম হারিয়েছে। অনেকদিন ধরেই কারো ওকে প্রয়োজন হয় না । নিতান্ত কারো দরকার পড়লে অমুকের বাবা হিসাবেই চল ।
তারই আজ জন্মদিন !
নয়ের পিঠে শুন্য দিলে তবে ওর বয়সটা বোঝাবে । দাঁত একটাও নেই,কানে খাটো,চোখে আলো নেই । সারাদিন একা থেকে অভ্যস্ত লোকটার আজ নব্বইতম জন্মদিন পালিত হবে ! যা কোন কালে হয় নি ! হঠাৎ করে নাতি নাতনীরা কোথায় নাকি দেখে এসে বায়না ধরেছে দাদুর নব্বইতম জন্মদিনটা বানাবে !
দুই মেয়ের ঘরের দুই নাতনী আর এক নাতি ওরাই প্রথম প্রস্তাবটা আনে । আজকালতো একটা রেওয়াজ হয়েছে জন্মদিন,বিবাহবার্ষিকী আরো কত কি ! সেইমত দুই মেয়ে,তাদের বরেরা,নাতি নাতনি,নাত জামাই, সবাই এসে জমায়েত হয়েছে এই বাড়িটায় । সঙ্গে ছেলে,ছেলের বউ, ছেলের ঘরের নাতি ।
গ্রাম গ্রাম পাড়াটার রাস্তার ধারে দুটি ঘর,সাথে লাগোয়া বারান্দার একদিক ঘিরে মুলি বাঁশের বেড়ার এক চিলতে একটা ঘেরা জায়গায় কেরোসিন কাঠের সস্তা একটা পুরোনো চৌকি পুরো জায়গাটা জুড়ে,সেখানেই সঙ্গীহীন একা বুড়োটা কুড়িটা বছর কাটিয়ে দিল ।
ছেলে,ছেলের বউ দিনে দুবার দুমুঠো মুড়ি,আর দুপুরে চারটে ভাত দিতে ঘরে ঢোকে । এক কথা চেঁচিয়ে গলা ফাটালেও কানে যায় না । তাই এড়িয়েই চলে । মেয়েদুটো নিজেরাই দেখে শুনে বিয়ে করেছে । দুজনের অবস্থা কোন রকম চলে যায় আরকি । ছেলেটা রোজগেরে তাই বস্তি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে । তবে বুড়ো একটা সুবিধা পেয়েছে । সারাজীবন গতর নাড়াতে হয়েছে তাই রোগ ভোগ নেই । আজ তিরিশ বছর হল এই বাড়িতে এসেছে । বস্তিতে থাকতেই আগে মা পরে বউ মারা গেছে।
সেই কোন ছেলেবেলা,বয়স কত হবে নয় কি দশ, মার হাত ধরে পূর্ববঙ্গ থেকে এপারে এসে উঠেছিল বস্তিতে । আহা সেদিনের কথা মনে পড়লে কেন কে জানে চোখে জল এসে যায় ! নদীর পাড়ে ছোট্ট গ্রামে সেই টিনের ঘর,সামনে উঠান,পেছনে বাগান ফল ফলারীর গাছ । সকালে উঠেই পাখির ডাক শুনে শুনে কোনটা কোন পাখি সব মুখস্ত । গাছে উঠে বুলবুলির ডিম,ঘুঘুর ডিম পাড়া । গ্রামের প্রান্তে ধুধু মাঠ । মাঠের পরে শাপলা,শালুকের দীঘি । সে সব দিনের কথা ভাবলে মনটা উদাস হয়ে যায় । আবার যদি ফিরে পাওয়া যেত সেই নয় বছর বয়সটা ! বিকেলে খেলতে গিয়ে সন্ধ্যা হয়ে অন্ধকার হয়ে যেত,মা এসে চেঁচিয়ে গলা ফাটাবে তবে ফেরা । এখনো চোখে ভাসে,সেই পাখির ডাক কানে বাজে । মায়ের গলাতো রোজ সন্ধ্যা হলেই এখনো শুনতে পায় । একা একা এগুলো নিয়েইতো কাটে । কত আফসোস রয়ে গেল । একবার পদ্ম ফুল তুলতে গিয়ে জলঢোরার গলা মুঠ করে তুলে ফেলেছিল,এখনও ভাবলে গা ঘিন ঘিন করে । এক রাখাল দাদা ওকে একটা ডাক ঘুড়ি দিয়েছিল,আকাশে যখন উড়তো কি ডাক ছাড়তো ! বাঁশ বাগানে একা গেলে বাতাসে বাঁশগুলো দুলে ঘষা খেত আর ক্যাচর ক্যাচর শব্দ তুলতো । ভয়ে বুক কেঁপে উঠতো । ডাহুকের ডিম শত চেষ্টা করেও আজও দেখা হল না । অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেল । সেদিনের দিনগুলো যেন মায়ের আদরের মত মনে হয় ।
না ! তারপরেই পাল্টে গেল জীবনটা । কদিন ধরে শুনছিল দাঙ্গা লেগেছে । কেউ কেউ গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে । একদিন বিকেলে বড়রা বলাবলি করলো ওর বাবাকে নাকি কারা কেটে ফেলেছে । ওইদিনই রাতে ওকে মায়ের হাত ধরে গ্রাম ছাড়তে হল । কলকাতায় উঠেছিল কোন বস্তিতে । তারপর থেকে ওর জীবনে আর রঙ ধরেনি । সবটাই সংগ্রামের ইতিহাস ।
নাতি নাতনীর চেঁচামিচিতে রেশটা কেটে গেল ।
সন্ধ্যায় কেক কাটা হল, মোমবাতি জ্বললো । অনেকদিন পর নিজের দামটা ফিরে পেয়ে ভালোই লাগছিলো । ধকলটা সহ্য হবে কিনা,একটু ভয়ে ভয়েই ছিল । না কোন অসুবিধা হয়নি ।
সেই আনন্দেই বুঝি একটুখানি কেক বুড়ো খেয়ে ফেলল । সন্ধ্যায় মুড়ির বদলে রাতে বুড়ো খেয়ে ফেলল এক টুকরো মাছ,একটু পায়েস । বেশ হইচই করে কাটলো দিনটা ।
রাতেই কিন্তু পেটটা কেমন আইটাই করতে লাগলো । একটু বেশি রাতে সারা বাড়ির সবাই তখন সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত শরীরে ঘুমাচ্ছে,বুড়োর শরীর কেমন করছে,পেটটা ফুলে ফুলে উঠছে !
খেয়ে উঠে,গল্প গুজব করে সেদিন শুতে একটু রাত হয়েছিল,তাই পরের দিন সকালে উঠতে সবারই দেরি হয়েছে ।
বড় মেয়ের ঘরের নাতনী প্রথম বুড়োর ঘরে এসেছিল মুড়ির বাটিটা হাতে নিয়ে । অনেক ডাকাডাকিতেও বুড়ো সাড়া দেয় নি । শেষে তার চিৎকারে একে একে সবাই এসে ডাকাডাকি ধাক্কাধাক্কি করেও বুড়োর ঘুম ভাঙাতে পারলো না !
দাঁতহীন ফোকলা সরল মুখটা হা করে শান্তির ঘুমটা ঘুমিয়েছে,যে ঘুম আর ভাঙে না ।
---------------
----------
| তারিখ : 26.11.2020 ||
|| ঠিকানা :
রোড নাম্বার 2, গ্রাম : প্রীতিনগর, পোস্ট : প্রীতিনগর, থানা : রানাঘাট,
জেলা : নদীয়া , পিন : 741247, মোবাইল : 8641051344 ||