গন্তব্য
নির্মলেন্দু কুণ্ডু
আঃ, আজই সেই শুভক্ষণ, এতদিনকার পরিকল্পনা আজ বোধহয় সফল হবে ৷
উত্তেজনায় ঘেমে উঠছেন সঙ্গীতা, সঙ্গীতা চক্রবর্তী ৷ নামী স্পোর্টস মেডিসিন স্পেশালিস্ট হিসেবে তাঁর খ্যাতি আছে ৷ আসলে খেলাধূলার প্রতি ভালোবাসাটা ছোট থেকেই ৷ বাবা রাজ্য স্তরের ভলিবল প্লেয়ার, আর মা কাবাডিতে জাতীয় স্তরে খেলেছিলেন ৷ তবে দুজনের ক্ষেত্রেই সাফল্য সেভাবে আসেনি ৷ স্পোর্টস কোটায় চাকরিটা পেয়েছিলেন বলে সংসারটা ঠিকঠাক চালাতে পেরেছিলেন ৷ তাছাড়া ক্রিকেট বাদে অন্যান্য স্পোর্টসের প্রতি সরকার বা জনতা কারুরই তো খুব একটা আগ্রহ ছিল না সেসময় ৷ কাজেই মেয়ে পড়াশোনা করে অর্থকরী পেশায় যাক, এটাই চেয়েছিলেন দুজনে ৷ কিন্তু জিন বলেও তো একটা জিনিস আছে ৷ তাই ছোট থেকে বিভিন্ন রকম স্পোর্টসে আগ্রহ বাড়তে থাকে সঙ্গীতার ৷ তবে বাবা-মা-র মনে কষ্ট দেওয়ার কোন ইচ্ছেই ছিল না তাঁর ৷ তাই তো সিরিয়াস পড়াশোনা আর খেলাধূলার প্রতি আগ্রহকে মিশিয়ে তৈরি এই স্পোর্টস মেডিসিন স্ট্রিমকেই বেছে নিয়েছিলেন সঙ্গীতা ৷ দেশের খেলাধূলার জগতের খোলনলচে বদলের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতার বা সঙ্গীতাদের কদরও বাড়তে থাকে ৷
সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল ৷ অনির্বাণের সঙ্গে বিয়েটাও ঠিক হয়ে গেছিল ৷ কিন্তু হঠাৎ এক দুর্ঘটনা সব কিছু পাল্টে দিল ৷ কোমায় কিছুদিন থাকার সৌভাগ্যবশতঃ জ্ঞান ফিরে এলেও নিম্নাঙ্গ হয়ে পড়ে প্যারালাইজড্ ৷ প্রথমদিকে মানুষের আনাগোনা থাকলেও আস্তে আস্তে তাও কমতে থাকে ৷ এখন শুধু বাবা-মার ডেলি ভিজিট ৷ মানুষ দুটোও যে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে, তা ওঁদের চোখমুখ দেখেই বোঝা যায় ৷ যদিও ওঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন মুখে হাসি ফোটাবার ৷ বাবা ভূদেববাবু নানা মজার গল্প করে হাসানোর চেষ্টা করেন, তো মা শুরু করেন সাংসারিক কূটকচালি, সেই নিয়ে বাবা শুরু করেন গোঁসা ৷ যেন মেয়েকে প্রাণবন্ত করে রাখার এক অক্লান্ত প্রচেষ্টা ৷ কিন্তু সঙ্গীতাও তো বোঝে, কী ঝড়টা বইছে দুজনের ওপর দিয়ে ৷ চোখের তলার কালি, কন্ঠির হাড়, ভাঙা গলা অনেক উপসর্গের কথা মনে করায় ৷ তারওপর খরচখরচা তো আছেই ৷ একজন মেডিসিন স্পেশালিস্ট হিসেবে সে-ও বোঝে কিছু ব্যাপার ৷ আর জানে এ থেকে উদ্ধারের রাস্তাও !
দীর্ঘদিন ধরে সেই পরিকল্পনাই ছকে আসছিল ৷ বাবা-মাকে জানিয়েছিল একদিন ৷ ছিটকে গিয়েছিলেন দুজনেই ৷ মায়ের কান্নাকাটি কমলে বাবা-মাকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল সঙ্গীতা—
"আমি জীবনভর দৌড়ঝাঁপ করে কাটিয়েছি, বাবা ৷ এই জীবন আমার জন্য নয় ৷ আমি জানি, শত চিকিৎসাতেও আমার কিছু হবার নয় ৷ প্লিজ, আমার কষ্ট মেটানোর চেষ্টা করো ৷ তোমরা ছাড়া কারুর ওপর ভরসা করতে পারছি না ৷ আমার ব্যাপারটাও ভেবে দেখো, মা ৷"
বেশ কিছুদিন বোঝানোর পর বুঝেছিলেন দুজনে ৷ কিন্তু কিভাবে করবেন মেয়ের ইচ্ছেপূরণ ! মেয়েই বাতলেছিল পথ ৷ রেগুলার ভিজিট করতে করতে এখন আর বাবা-মা-কে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ কিছু জিজ্ঞেস করেন না ৷ কিছুক্ষণ ওঁদের একসাথে কাটাতে দেওয়ার পর ডাক্তার আসেন রুটিন চেকআপে ৷এই সময়টুকুই বেছে নিয়েছিল সঙ্গীতা ৷ বাবার হাত কাঁপলেও শক্ত করে বাবার হাতটা চেপে ধরে সজল চোখে বাবার দিকে তাকিয়েছিল ৷ বাবা আর পারেননি, ইঞ্জেকশনটা পুশ করতে কিছু মুহূর্তমাত্র সময় লেগেছিল ৷ মা আজ আসেননি ৷ সঙ্গীতা বুঝতে পারছে তার ধমনীতে যেন নতুন কিছুর উপস্থিতি ৷ তার অভিজ্ঞতা বলছে তার কাঙ্খিত মুহূর্ত আসতে আর বেশি দেরি নেই ৷ চোখ বোজে সঙ্গীতা ৷ তখন সে দৌড়ে চলেছে এক অনন্ত-প্রসারী রানওয়ে দিয়ে ৷ একে একে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে এতদিনকার চেনা মুখগুলোকে ৷ ঐ শেষ প্রান্তের কাছে পৌঁছে গেছেন বাবা-মা ৷ কিন্তু সঙ্গীতাকে তো ওঁদের আগেই পৌঁছতে হবে গন্তব্যে ৷ তেমনটাই তো সে চেয়েছে ৷ এই তো.. আর একটু পরেই... ঐ তো দেখা যাচ্ছে রিবনটা...হাত বাড়িয়ে দেয় সঙ্গীতা...
নির্মলেন্দু কুণ্ডু
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
৮০১৬০৮৩০১৩