Click the image to explore all Offers

ছোটোগল্প।। প্রেমের ভগ্নাংশ ।। অঞ্জনা গোড়িয়া

 

প্রেমের ভগ্নাংশ

অঞ্জনা গোড়িয়া

নীচে একটা ঘর তার ওপরে  আর একটা ঘর।সরু বারান্দার একপাশে সিঁড়ি। দুকামরার দোতালা এই বাড়িতে ই ছিল ছোটো একটা  সংসার।সাজানো গোছানো একটা  পরিকল্পিত  পরিবার। সারা গ্রাম এত দিন তাই জানতো। সুখী দম্পতির সুখের সংসার। ভালোবাসার সংসার।  আজ সেই  দুকামরার শুন্য বাড়িটা  নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে।  ভয়ংকর  সেইসব ঘটনাগুলির সাক্ষী হয়ে।
বাড়িটার দিকে তাকিয়ে পথ চলতি মানুষের একটা ই  প্রশ্ন মুখে মুখে। কি এবার হলো   যার জন্য ছেলে মেয়েকে আর  মাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হলো  পুতুলকে? সুখের সংসার টা ভেঙে দিয়ে  এক বুক হতাশা নিয়ে  নিরুদ্দেশ হয়ে গেল পুতুল।দীর্ঘ ২০ বছরের সংসার ভেঙে পাড়ি দিতে হলো অন্য কুলে অন্য কোনো  সুখের সন্ধানে।
সামাজিক মান সম্মানের তোয়াক্কা না করে নতুন করে  বাঁচার আশায়  ঘর বাঁধতে অন্য জনের  সাথে।
মানুষের  গঞ্জনা, অত্যাচার,গুজবের   নীরব সাক্ষী এখন এই বাড়িটা।

বাড়িটা যদি কথা বলতে পারতো, যদি প্রতিবাদ  করতে  পারতো  তাহলে হয়তো সব অত্যাচারের  প্রতিবাদ করতো।  অনেক  আগেই  মিটে যেত সব সমস্যা।
আজ শুন্য বাড়িটা একা। বড়ো  একা।  ক্ষতবিক্ষত  মনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। 

এই বাড়িতেই জন্মেছিল ফুটফুটে একটা  মেয়ে। চোখ দুটো  টানা টানা। ঘনকালো লম্বা চুল। ঠিক যেন পুতুল। তাই নামটা ও রাখা হলো  পুতুল।
পাড়ার সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়াতো।  সেই তখনই  পাড়ার নয়না কাকিমা হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার ছোট ছেলের বউ করে আনব।এ মেয়েকে কোথাও যেতে দেব না।
সব ই  ছিল কথার কথা অবশ্য। 
একদিন সেই কথায়  যে সত্যি হবে,কে তা জানত? ছোট ছেলের  প্রেমে পড়ল পুতুল।  বিয়েটা ও লুকিয়ে  হয়ে গেল।
বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। সেই ছোট্ট মেয়েটা এত কম বয়সেই বউ হয়ে গেল।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো , এই বয়সে লুকিয়ে বিয়ে করায় নয়না কাকিমার চোখের বিষ হয়ে গেল।
অত্যাচার  এমন চরমে উঠলো যে শ্বশুর বাড়িতে  থাকা দুস্কর।
পুতুল ফিরে এসেছে নিজের বাড়িতে। জন্মদার্তী মায়ের কাছে।   স্বামী সুকান্ত ও নিজের  মায়ের সঙ্গে  সব সম্পর্ক  চুকিয়ে  চলে এলো শ্বশুরবাড়িতে।
কথা ছিল নতুন একটা  বাড়ি ঠিক করে  বউকে নিয়ে চলে যাবে।
আপত্তি করল মেয়ের মা। পুতুল ই তাদের একমাত্র  সন্তান। একরত্তি মেয়ে বিয়ে করেছে  বলে কি হাত পুড়িয়ে  খাবে নতুন বাড়িতে? আদরের মেয়ে সেই থেকে  মায়ের কাছেই  থেকে গেল।
শ্বশুর বাড়ি  যাওয়া আর হলো না। এই বাড়িতে ই জন্মেছিল। এই বাড়িতে ই শুরু হলো  নতুন সংসার জীবন। আবার এই বাড়িতে ই জন্ম নিল পুতুলের মেয়ে। আরও  চার বছর পর  একটি  ছেলে। কুড়ি বছরের সংসার জীবন  পরিপূর্ণ  হলো দুই সন্তান নিয়ে।
একসময় মায়ের হাতে হাতে কাজ শিখে পাকা সংসারী  হয়ে উঠলো।
এখন ই তো  সুখের সংসার। সুকান্ত  মাসে একবার ই বাড়ি ফেরে কলকাতা থেকে। কয়েক দিন  থেকে  আবার ফিরে যায় কলকাতায়।  খাওয়াপরার  অভাব ছিল না। পুতুলের ও কোনো  অভিযোগ  ছিল না  প্রেমিক স্বামীর বিরুদ্ধে। দিব্যি ছিল মিলেমিশে।  অন্তত  আমরা মানে পাড়াপ্রতিবেশি  তাই জানত। কি সুখের সংসার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে   এত যে  অশান্তি  কেউ তা জানতো না।
সাজানো সংসার টা ভেঙে গেল।  তাসের ঘরের মতো ।  পুতুল এখন আছে ভাড়া বাড়িতে  মা আর দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে।
বাড়িটা তালাবন্ধ।
কিন্তু কেন এমন হলো? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ভাব করেছিলাম পুতুলের সাথে। তার ই বয়ানে এই সব কারণ আর যুক্তি।

সুকান্ত যখনই  বাড়ি আসে। ব্যাগ ভর্তি  বাজার সঙ্গে  বিদেশি  মদ।  পুতুল সব ই জানতো।
অল্প আদরু মদ সবাই  খায় এখন। এটা তেমন  দোষের নয়।সুকান্ত ও  খেতো। পুতুল মেনে ও নিয়েছিল প্রথমে। কিন্তু  যতই  ইনকাম বাড়ে। ততই বন্ধু -বান্ধব, ক্লাব সেই সঙ্গে  নিজেকে  জড়িয়ে ফেলল।   দাদারাও  এই সুযোগে তার হাত থেকে  যতটা  সম্ভব  অর্থ আদায় করতে  ভাই কে তোয়াজ করে চলল।  একসময় পুতুলের কোনো  কথায়  আর কানে ঢুকলো না। মদের গন্ধে বাড়িটা ম ম করতে থাকে।  নীচের  ঘরে মদের আসর বসালো।  যতসব মাতাল বন্ধুবান্ধব এসে জুটলো  এই বাড়িতে।  ওপরের  ঘরে ছেলে মেয়ে মাকে নিয়ে একপ্রকার  জড়োসড়ো হয়ে পড়ে  থাকতো। অপেক্ষা করতো  কখন আসর ভাঙবে? তাতেও  শান্তি  নেই।  ডাক আসে পুতুলের। সবার  জন্য  মদ পরিবেশন করতে। আপত্তি জানালেই , চুলের মুটি ধরে  টানতে টানতে হাজির। ঠিক ই ধরেছেন মহাভারতের  দুঃশাসন যেমন করে টানতে টানতে এনে ছিল চৌপদীকে  হস্তিনাপুরের রাজসভায়।  তেমন ই । অবশ্য  কেউ শাড়ি ধরে  টানে  নি। শুধু একঘট সুরা পান করতে বলেছিল সবার  সাথে।
শান্তশিষ্ট পুতুল এসব দেখে  পাষাণ হয়ে গেল।
সেদিন ই মদের বোতল  ছুঁড়ে  ফেলে  প্রত্যেকে অপমান করে বাড়ি থেকে   বের করে দেয়।
তারপর  থেকে ই  সুকান্তের অত্যাচার  চরমে ওঠে।  এত বড় সাহস  আমার ই খেয়ে আমার ই বন্ধুদের বাড়ি থেকে  বের করে দেওয়া।  এখান থেকে ওদের নিয়ে  নতুন বাড়ি বাধবে ঠিক করল। পুতুল তাও মেনে নিল। নতুন বাড়িতে নতুনভাবে সাজাবে সংসার। কিন্তু  বাড়ির  দাদারা  জায়গা  জমি থেকে  বঞ্চিত করে দিল। ঘর বাধা আর হলো না। 
প্রতি মাসে কয়েকটা দিন ই  থাকে এই বাড়িতে । তাতেই  ছেলে মেয়ে সুদ্ধ পুতুলের মা ভয়ে তটস্থ  হয়ে থাকতো।
তাও পুতুল মেনে নিয়ে ছিল। স্বামীর সব দোষ  মেনেই  মুখ গুঁজে  পড়ে ছিল বছরের পর বছর।
কিন্তু  তারপর ও সব শেষ হয়ে গেল।
এখন পুতুল আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়  করিয়েছে সুকান্তকে। কেস চলছে অনেক গুলো। 
কতখানি  যন্ত্রণা অত্যাচার  করলে তবেই   স্বামীর বিরুদ্ধে কেস করতে পারে কোনো  প্রেমিকা বউ।
প্রতিশোধের আগুনে পাষাণী হয়ে উঠলো পুতুল।
যে মেয়ের মুখে সাড়া ছিল না  এত গুলো  বছর। স্বামীর সংসারে শান্তিতে ছিল বলে মনে হয়েছিল পথ চলতি মানুষের।  সেই পুতুল ই চরম নির্লজ্জতার কথা স্বীকার করল।
স্বামীর হাতে ধর্ষিত  এক নারীর যন্ত্রনার কথা  সবার সামনে  বলতে  বাধ্য হলো।  সেই সঙ্গে মেয়ের ওপর  বাবার পাশবিক অত্যাচার। আর কিছুতেই মেনে নেবে না সন্দেহবাতিক স্বামীর অত্যাচার।
  বড়ো  ছেলেমেয়ের সামনে ই নিলজ্জের মতো  পুতুলকে জড়িয়ে ধরে  আদর করার নামে  কদর্যতা দিন দিন বাড়তে থাকল।
পুতুলের কোনো  স্বাধীনতা ছিল না  একা কোথাও  যাওয়ার। এমন কি মেয়ে টিউশন পড়তে গেলে ও একটু দেরি  হবার উপায় ছিল না।  বাড়ি ফিরলেই চেঁচামেচি  শুরু করত।
পুতুলের মায়ের সামনেই মেয়ে সম্পর্কে  নোংরা  গালাগালি পুতুলকে ক্ষতবিক্ষত করল। পাড়ার একদল লোকের সামনে থেকে  পাঁজা করে তুলে এনে ছেলে মেয়ের চোখের সামনে ই  শুরু করত যৌন আদরের নামে নৃশংসতা। শেষ পর্যন্ত  নিজের মেয়েকেও ছাড়ল না।
ষোলো বছরের মেয়েকে আদর করার নামে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো।   মেয়ে কিছুতেই মানতে পারে  নি।তীব্র ঘৃণা আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে উঠে ছিল পুতুল ও তার মেয়ে।
এমন কি বাবার হাত থেকে  বাঁচতে মেয়ে  আত্মহত্যা করতে সিলিং ফ্যানে ঝুলে  পড়ে ছিল। সময় মতো  দেখতে  না পেলে শেষ  হয়ে যেত পুতুলের মেয়ে।
পুতুলের ৬ বছরের ছেলে ও  বাবার মুখের ওপর বলেছিল,কেন আসো তুমি এখানে? মাকে দিদিকে  দিদাকে কষ্ট  দিতে? আর আসবে না  কোনো দিন। চাই না তোমার  খাবার? চাই না খেলনা৷ চাই না চকলেট।   আমার মাকে একদম  ভালোবাসো না। আমাকেও  না।শুধু কষ্ট দাও।  ফুঁপিয়ে কেঁদে  লুকিয়ে  পড়ত ঘরের কোণে।

মদ্যপ অবস্থায়  সুকান্ত কি যে বলতো কি করত তা  নিজে ই জানে না।
  সুকান্ত  বড়ো  একা। বন্ধু  বান্ধব  ক্লাব বাড়ির  দাদারা সবাই থেকেও  বড় একা।বাড়ির  লোক ভাবছে, আপদ বিদায়  হয়েছে।  বন্ধুরা ভাবছে,বাঁচা গেল। এবার নিশ্চিন্তে মদ খাওয়া  যাবে। আবার  জমিয়ে মদের আসর  বসবে।সুকান্তর  টাকা কড়ি হাতিয়ে নিয়ে  নিঃস্ব করে দেওয়া  খুব সহজ।
পুতুল আর সুকান্তের সাজানো  বাগান শুকিয়ে গেল এভাবেই।  দুজন এখন দুইপ্রান্তে।
কাঠগড়ায়  আসামি  সুকান্ত। বধূ নির্যাতন, মেয়ের সঙ্গে  দুর্ব্যবহার আইনের চোখে অপরাধী  এক স্বামী।।
যদি এই সমাজের চোখে পুতুলও  ঘেন্নার পাত্র হয়ে গেল।
পরকীয়া নামক উপসংহারে তাজা  নানান তাজা মন্তব্য  মুখে মুখে ঘুরছে এখন সারা পাড়া।
ছি ছি ছি স্বামী যত ই খারাপ হোক তাবলে বড় ছেলে মেয়েকে নিয়ে অন্যের হাত ধরে ঘর ভেঙে  নতুন ঘর গড়া।
এ মেয়ে নির্ঘাত  মরবে। কোনো দিন ই  সুখ পাবে না। এমন ই  কথা লোকের মুখে মুখে।
পুতুলের প্রশ্ন, "কোথায় ছিল এত দিন সমাজ? যখন দিনের পর দিন অত্যাচারিত হচ্ছে তিন অসহায়  মেয়ে। বিচারের দাবি  নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে৷  কেউ সাড়া দেয় নি। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে সামান্য  ঘটনা বলে। নিজেদের মধ্যে  মিটিয়ে  নিতে বলেছিল এই সমাজ ই।   কারন কেউ চটাতে  চায় নি সুকান্ত কে। ওর টাকায় ফুর্তি করা যে তাহলে  বন্ধ  হয়ে যাবে ।
আজ তার ই নির্মম পরিনতি  এই।
কাঠগড়ার আসামি  সুকান্ত।  বিপক্ষে  স্ত্রী সন্তানরা।
এখন শুধু  শেষ  বিচারের  আশায়।

-------------- 

ছোট  গল্প -- প্রেমের ভগ্নাংশ
নাম-অঞ্জনা গোড়িয়া
ভগবান পুর
পোস্ট - দিঘির পাড় বাজার
থানা-ফলতা
জেলা- ২৪ পরগণা (দক্ষিন)
পিন-৭৪৩৫০৩
ফোন-৯৯৩৩১৪৬৭৭৭


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.