বাবা
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
সেবার পূজোয় বাড়ি আসার সময় এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল অনীশের। আজ ছ'মাস হয়ে গেলে ও ভুলতে পারেনি সে। ডিব্রুগড় রাজধানীর এসি টু টায়ারের যে কামরাটিতে সে আসছিল, তাতে যথারীতি ভিড় ছিল। বেশ কিছু আর এ সি প্যাসেঞ্জার ছিল কামরায়। মোগলসরাই স্টেশনে ট্রেনে উঠেই ক্লান্ত শরীরটা পেতে দেয়। কিন্তু ঘুম আসে না । যদিও সন্ধ্যা রাত। কিন্তু শরীরটা আর পারছিল না। সাইড লোয়ারে লোকের যাতায়াত, চিৎকার, হট্টগোল সবই সহ্য করতে হয়। কিন্তু তাও অনীশের বরাবরের পছন্দ এই সিটটাই। যখন বাবা মায়ের সাথে ট্রেনে করে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেত, এই সিটটার জন্য কি জেদটাই সে করত! মনে পড়লে আজও হাসি পায় । আসলে বাইরের আকাশটা না দেখতে পেলে ভীষণ মন খারাপ লাগে তার। দমবন্ধ লাগে। আকাশ যে তার বড্ড প্রিয় । সেই থেকে তার আকাশে ওড়ার শখ। বাবা মায়ের প্রায় অমতেই বিমানবাহিনীর চাকরীতে আসা। নাহলে উচ্চ মাধ্যমিকে ও অনার্সে ওর যা রেজাল্ট, তাতে অনেক কিছুই করতে হয়ত পারত। কিন্তু সে মনের কথাই শুনেছিল।
"স্যার, আপনার ডিনার"। ভেন্ডার হাঁক পাড়ল। উঠে বসে রাতের খাবার খেয়ে নিল। এত তাড়াতাড়ি তো ঘুম আসেনা । কিছুক্ষণ বসে মোবাইল নাড়াচাড়া করতে করতে বাড়ির কথা ভাবছিল । এবার শুনেছে পূজোয় দিদিরা ও আসবে। পাড়ার পূজো এবার পঞ্চাশ বছর। ভাবতে ভাবতে কানে হেডফোন গুঁজে শুয়ে পড়ল।
ট্রেন আপন নিয়মে গতি নিয়েছে। এক এক করে পাড় হল পাটনা, বেগুসরাই, কাটিহার, মালদা। গোটা ট্রেনে তখন ঝমঝমানি ছাড়া আর কোন শব্দ বিশেষ নেই। হঠাৎ এক অদ্ভুত গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল অনীশের। উঠে বসে বোঝার চেষ্টা করে। মনে হয় শব্দটা পাশের কূপ থেকে আসছে। চটিটা পায়ে গলিয়ে এগোয় সে। দেখে একটা তরুণী একজন প্রৌঢ়ের কাঁধ ঝাঁকাচ্ছেন। আর ভদ্রলোক গা ছেড়ে দিয়ে কেমন গোঙাচ্ছেন। ঐ কূপেরই একজন লোক এরমধ্যেও ঘুমোচ্ছে। আর একজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছেন।
অনীশ সামনে যেতেই মেয়েটি অসহায়ভাবে কাঁদতে লাগল।
" ট্রেন ছাড়ার সময় তো বাবা ভালোই ছিল। বুঝতে পারছি না কি হল! কথা বলছে না! "
অনীশ দেখল, ভদ্রলোকের চোয়ালের ডানদিকে সামান্য বেঁকে আছে। অজ্ঞান হয়ে গেছেন । বুঝতে আর কোন অসুবিধা হোল না। অনীশ দৌড়ে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা সরবিট্রেট ট্যাবলেট বের করে নিয়ে এল। একটু যে হাত কাঁপল না, তা নয়। কিন্তু সাহস করে ভদ্রলোকের মুখে দিয়ে দিল। ডাকাডাকিতে অনেক লোক জমে গেছিল। টিটিই ও এটেন্ড্যান্ট ও হাজির। সামনের স্টপেজ কিষানগঞ্জ । আর মিনিট তিরিশের রাস্তা।
এর মধ্যে কেউ কেউ ফিসফিস করছে, ছেলেটা কি ডাক্তার! অনীশ শুনেও পাত্তা দিলনা। বলা যায় অগ্রাহ্য করল। সে ডাক্তার নয়, তবে এই লক্ষনটা সে বিলক্ষণ জানে!
মেয়েটি অসহায়ভাবে এখনো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে । টিটিই এসে জানাল, ট্রেনে একজন ও ডাক্তার নেই ।
মেয়েটি জানাল যে তারা কিষানগঞ্জে নামবেন । কিন্তু একা এ অবস্থায় বাবাকে নিয়ে কিভাবে নামবেন, কোথায় নিয়ে যাবেন কিছু মাথায় আসছে না।
বেশ কিছু লোক তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে । ইতিমধ্যে কেটে গেছে পনেরো মিনিট। বাবার জ্ঞান ফিরছে না দেখে মেয়েটি ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে। অনীশ পাল্স দেখে বুঝল, এখনো লড়াই থেমে যায় নি। মেয়েটিকে বলল, আপনি কাউকে জানিয়েছেন এই খবরটা? কেউ কি আসবে স্টেশনে !
" ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। জানাতেই পারছিনা! কি করব আমি! বাবা , ও বাবা, ওঠ না!"
অনীশের আর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হোল না ।
তারপর কিছুক্ষণ পরেই ট্রেন দাঁড়াল কিষানগঞ্জ স্টেশনে। সেখান থেকে এক নার্সিংহোম নিয়ে ভর্তি করা হল ভদ্রলোককে। কার্ডিওলজিস্ট ডঃ মালহোত্রা আধঘণ্টা পরে জানালেন ওনার জ্ঞান ফিরেছে । ম্যাসিভ এটাক। " কোন অসুধ দিয়েছেন ওনাকে? "
" সরবিট্রেট " অনীশ বলল।
" ইয়েস, ওটাই ওনার প্রাণ বাঁচিয়েছে । আটচল্লিশ ঘন্টা ওয়াচে রাখতে হবে। তবে স্টেবল! ভয়ের কিছু নেই "।
তখন প্রায় দশটা বাজছে। এরই মধ্যে মেয়েটির বাড়ির কয়েকজন হাজির হয়েছে । মেয়েটি বারবার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিল ।আর সবাইকে বলছিল কিভাবে অনীশ ওদের পাশে দাঁড়িয়েছিল । অনীশ ধীরে ধীরে তার ব্যাগটা পিঠে চাপিয়ে বিদায় নিল।
বাড়ি পৌছতে তার রাত হয়ে যায়। পাড়ার পূজোয় এবার জৌলুস চোখ ধাঁধানো। অষ্টমীর আলো ঝলমলে রাত। বাড়ির সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
রাত প্রায় সাড়ে বারোটা । আজ আর বেরোয় নি। এতক্ষণ মায়ের সাথে গল্প করল । মা শুয়ে পড়েছে । বাকিরাও।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে অনীশ । ঐ দূরে কোন একটা তারা কি ওর বাবা?
তিন বছর আগে বাবা চলে গেছিলেন । কিছু করতে পারেনি অনীশ, পাশে থেকেও। ট্রেনিং এ ছুটিতে বাড়ি এসেছিল সেবার।
আকাশের এক উজ্জ্বল তারা দে'খে অনীশের মনে হল, ওর বাবা যেন হাসছে। আশীর্বাদ করছে বুক ভরে ।
কারো বাবাকে সেদিন বাঁচিয়েছিল অনীশ।
আর ভাবে, বাবা বাবাই হয় । কোনদিন মুখ ফুটে বলা হয়ে ওঠেনি, বাবা, তোমাকে খুব ভালোবাসি । ভালো থেকো বাবা।
------------
(চিকিৎসাজনিত বিষয়টি কাল্পনিক)
🙏🙏🙏
,
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
কোচবিহার
9434169796