Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।।অন্তু ।। অনিন্দ্য পাল


অন্তু

 অনিন্দ্য পাল


                                 ১.
 
বিছানা ছেড়ে উঠতে গেল অন্তু কিন্তু ধপ করে বিছানার উপরে পড়ে গেল আবার। মাথাটা হঠাৎ যেন ঘুরে গেল আর শরীরটা খুব দুর্বল মনে হচ্ছিল অন্তুর । গতকাল রাতে সে শুয়েছে প্রায় একটার সময়। এই কদিন তার ওপর প্রচুর ধকল যাচ্ছে। সারাদিন শুধু নাচ আর নাচ। দু'বেলা রুপুদি আসছে তাকে নাচের তালিম দেওয়ার জন্য। আর যখন রুপুদি থাকছে না তখন মা তাকে নিয়ে পড়েছে সারাদিন ধরে শুধুই নাচের তালিম। সমস্ত শরীরে তার ব্যথা এমনকি হাতটা উপরে তুলতে গিয়েও একটা যেন অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণা অনুভব করল অন্তু। হঠাৎ তার মনে হলো আজ বৃহস্পতিবার সকাল ছটায় পড়াতে আসবেন স্যার। সুমন স্যার অংক এবং বিজ্ঞানটা দেখেন। অত্যন্ত কড়া ধাঁচের একজন শিক্ষক। ক্লাস এইটে পড়ে অন্তু , শহরের নামী সরকারী স্কুলে। তাই কোনরকম ফাঁকিবাজি একেবারেই পছন্দ নয় তাঁর। 
আবার ধড়মড় করে উঠতে গেল অন্তু। কিন্তু এবারও সে পারলো না। বিছানা যেন তাকে টেনে নিল আবার নিজের কোলে।  
"আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি এখনও বিছানায় পড়ে আছে,ছটা বেজে গেল। এই মেয়েটার দ্বারা না কিচ্ছু হবে না! এই অন্তু উঠে পড়, উঠে পড় এক্ষুনি স্যার আসবে তারপর আবার নাচের প্র্যাকটিস করতে হবে রুপু দিদি চলে আসবে তাড়াতাড়ি ওঠ না হলে সব কমপ্লিট করবি কি করে ?" 
গজ গজ করতে করতে মেয়ের ঘরে ঢুকে তাপসী দেখল তখন অন্তু বিছানায় একেবারে গা এলিয়ে শুয়ে আছে। রেগে গিয়ে এসে অন্তুকে দিল এক ধাক্কা। অন্যদিন হলে হয়তো অন্তু এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে একটু প্রতিবাদ করত কিন্তু আজকে আর কোন সাড়া শব্দ করলো না । তাপসী আবার অন্তুকে ঝাঁকিয়ে দিল। না, কোন সাড়া শব্দই নেই। হঠাৎ করে তাপসীর বুকের ভেতরটা যেন ছ্যাঁত করে উঠলো মেয়ে এখনো কোনো সাড়াশব্দ দিচ্ছে না কেন এরকম তো কখনো হয় না! ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল তাপসী তারপর মেয়ের মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ে সে হতবাক হয়ে গেল। অন্তুর মুখটা যেন শুকিয়ে এই এতোটুকু হয়ে গেছে একটুও যেন প্রাণ নেই মুখে। চিৎকার করে উঠল তাপসী। 
-- কি হল মা? এই তো উঠছি। রুপুদি এসে গেছে? 
-- ওরে মেয়ে! এতক্ষণ আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছিস? দুষ্টুমি হচ্ছে না! চল ওঠ, না হলে কিন্তু বাবা খুব বকবে। 
মেয়েকে একটু আদর করে তাপসী চলে যায়। সৌমেন  অফিসে বেরোবে। রান্না বসাতে হবে। সকাল ন'টা পর্যন্ত তার দম ফেলবার সময় থাকে না। 
                                   ২. 
 
গত বছর ঠিক এই সময় তারা চিড়িয়াখানায় গেছিল। কিন্তু এবছর? এবছর অন্তুর নিজেকেই চিড়িয়াখানায় বন্দী মনে হচ্ছে। খেলা বন্ধ। স্কুল বন্ধ। শুধু বাড়ি বসে মোবাইলে ক্লাস। একটা ভাইরাস তার সব আনন্দ, মজা এমনকি ফুচকা খাওয়াটাও বন্ধ করে দিয়েছে। এর পর আবার টিভি চ্যানেলে রিয়্যালিটি শোতে সুযোগ পাওয়ার জন্য বাবা-মা এর ইচ্ছাটা তার উপর যেন পাহাড়ের মত চেপে বসছে। 
গতকাল রাত্রে রানাঘাট থেকে মামা, মামি আর রঞ্জু এসেছে। রঞ্জু এবার মাধ্যমিক দেবে। গত বছর রঞ্জু একটা সর্বভারতীয় রিয়্যালিটি শোতে ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। অন্তুর বাবা, মা রঞ্জু বলতে একেবারে অজ্ঞান। বকাবকির সময় তাপসী রঞ্জুর উদাহরণই দেয়। যখন অন্তু কোন স্টেপ কয়েক বার ভুল করে, খুব রেগে গিয়ে তাপসী তখন বলে, " রঞ্জুর পা ধুয়ে জল খা, তবে যদি তোর কিছু হয়! " সেদিন যখন রুপুদি তার পারফর্মেন্স গ্রেড "এ" লিখলো, বাবা তো ভয়ানক রেগে গেল। "এ" একটা গ্রেড হল? সঙ্গে সঙ্গে মা কে ডেকে বললো, " একে ওই তোমার কাকুর হোস্টেলে পাঠিয়ে দাও। ওয়র্থলেস একেবারে। " 
         অন্তু কাল থেকে তাই খুব মুষড়ে আছে। রঞ্জুর সামনে যেতেই তার কেমন একটা লজ্জা করছে। নিজেকে খুব বেকার মনে হচ্ছে তার। তবে রঞ্জু তাকে খুব ভালোবাসে। যে কোনো বিষয়ে অন্তুকে সাহায্য করতে তার কখনো "না" নেই। যদিও রঞ্জু গান করে, আর অন্তু নাচে, তবু রঞ্জু তার সাধ্যমত এগিয়ে আসে অন্তুর সমস্যা সমাধানের জন্য। এই যেমন, এখন অন্তু কিছুতেই আলারিপ্পুটা ঠিকঠাক করতেই পারছে না। রঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে ইউটিউবে সার্চ করে সেই নাচের ভিডিওগুলো ওকে দেখাচ্ছে। অন্তু চেষ্টা করছে কিন্তু কেন যেন কিছুতেই করে উঠতে পারছে না। অথচ আগামী কাল অডিশন। বাবা-মা খুব আশা করে আজ সারাটা দিন ওর সঙ্গে থাকবে। মামা-মামি রঞ্জুকে নিয়ে এক বিখ্যাত ওস্তাদের কাছে যাবেন। 
            রঞ্জু থাকলে, অন্তু একটু সাহস পেত, কিন্তু ওর যাবার পর কেমন যেন দমে গেছে। তার মনে হচ্ছে যেন কিছুই পারছে না। যেন সে শেখেনি কিছুই। ভিতরে ভিতরে কেমন একটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে অন্তু। কিছুই ভালো লাগছে না। শরীর যেন কেমন পাথরের মত ভারী হয়ে উঠেছে। পা-দুটো মেঝে থেকে যেন উঠছেই না। হঠাৎ খুব কান্না পেয়ে গেল অন্তুর। মেঝের উপর ধপ করে বসে পড়ে দু'হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগলো। এভাবে কতক্ষণ কেঁদেছে সেটা অন্তু জানে না। কাঁদতে কাঁদতে কখন মার্বেলের মেঝের উপর শুয়ে পড়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে একতাল কাদার মত হয়ে গেছে, অন্তু সেটাও জানে না। 
              হঠাৎ কিছু শব্দ যেন অনেক দূর থেকে তার ঘুমটাকে ছিঁড়ে দিতে লাগলো। কেউ একটা কাঁদছিল। কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কি সব কথা বলছিল। উহ, এভাবে কি ঘুমানো যায়? কত বছরের ঘুম যেন জমে আছে তার চোখে। আরো অনেক ঘুমাতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু এত আওয়াজ তার ঘুমটাকে যেন তাড়া করে চোখের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। 
              অনেক কষ্টে অন্তু চোখের পাতা খুললো। খুলেই সে অবাক হয়ে গেল। বাড়ির সবাই, এমনকি রুপুদিও তার চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা ঠিক তার মুখের উপর, কান্নায় ভিজে আছে, বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে রঞ্জু। মুখটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আছে। 
          তার চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই আনন্দে নেচে উঠলো। মা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। বাবা ও তাই। এরকম আদর অনেক অনেক দিন পায় নি অন্তু। এই কয়েক বছরে তার মনে হত, বাবা-মা হয়তো  তাকে আর ভালোই বাসে না। নাহ আজ তার আর সেই অভিমান নেই। সেও দু'হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মা'কে। 
-- তোকে কিচ্ছু করতে হবে না মা। তুই সুস্থ থাক। আমরাও খুব পাষাণের মত হয়ে গেছিলাম। তুই যেমনটা চাইবি, তোর যেটা ভালো লাগে সেটাই শিখবি, শুধু ভালো ভাবে বেঁচে থাক মা। আর কখননো অমন চাপ দেবো না তোকে। 
অবাক অন্তুকে বুকে জড়িয়ে কথাগুলো বললো তাপসী। তার চোখ বাঁধ মানছে না। কান্নার জলে অন্তুর জামাটাও ভিজে গেছে। 
   হঠাৎ অন্তুর মনে পড়লো, কাল তার অডিশন। সাত সেপ্টেম্বর। ধড়মড় করে উঠতে গিয়ে পারলো না। মা, বাবা দুজনেই তাকে ধরে শুইয়ে দিল। শুয়ে শুয়েই অন্তু বললো, 
-- মা, কালতো আমার অডিশন আছে। প্রাকটিস করবো না? রুপুদি দাঁড়িয়ে আছে তো! 
অন্তুর ক্ষীণ স্বর রুপুর কানে পৌঁছল কিনা বোঝা গেল না। কিন্তু তার কথা শুনে তাপসী বা সৌমেন কেউ কোন কথা বলতে পারল না। একটু খানি পরে, হতবুদ্ধি অবস্থা কেটে গেলে, সৌমেন বলল -- 
---- হ্যাঁ সোনা, আমরা নিশ্চয়ই যাবো, কিন্তু এখনি নয়, তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো, তারপরে। কোন টেনশন করো না এখন, একটু বিশ্রাম নাও। ডাক্তার আঙ্কেল এসে গেছেন, উনি একটু দেখবেন তোমাকে। আমরা একটু বাইরে আছি হ্যাঁ। তুমি কিন্তু এখন ওই সব অডিশন - ফডিশনের ব্যাপারে একদম কিছু ভাববে না। ঠিক আছে। 
      রুপু হাত ঘড়িতে দেখলো, সন্ধ্যা সাতটা পনেরো। তারিখটা দশ সেপ্টেম্বর। 
    --------------              
                



ধন্যবাদান্তে,

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.