মনীষা কর বাগচী
মাম্পির মা সুমনার খুব কষ্ট। পাঁচ বছর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে ঈশ্বর তাকে এখনও একটা সন্তান দিলেন না। ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে সেই থেকে নীরবে সারাদিন সংসারের কাজ করে চলেছে। কাজ করতে যতনা কষ্ট হয় তার থেকে বেশি কষ্ট হয় ছেলে মেয়ে হয় না বলে যখন কেউ তাকে খোঁটা দেয়। নীরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলা ছাড়া তার যে আর কোনোকিছু করার থাকে না।
কোন্ মেয়েটা না চায় যে তার কোল জুড়ে ছোট্ট একটা টুকটুকে বাচ্চা আসুক। প্রত্যেকটি মেয়ে বিয়ের পর একটাই স্বপ্ন দেখে তার ভালোবাসার ধন, তার চির আকাঙ্ক্ষিত, তার মানিক রতন কবে আসবে তার কোলে। কিন্তু বাড়ির লোকে কেউ সেটা বোঝে না। বিশেষ করে সুমনার শ্বাশুড়ি উনি তো ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছেন। সুমনার বাবা খুব গরিব। ছোট বেলায় সুমনার মা মারা গেছেন। সে যে বাপের বাড়িতে ফিরে যাবে সে পরিস্থিতিও তার নেই। তার স্বামী যদি দ্বিতীয় বিয়ে করে তখন তার কি হবে এই কথা ভাবলে আতঙ্কে তার হাতে পায়ে বল থাকেনা। তাই দিনরাত সে ভগবানের কাছে কাঁদে "হে প্রভু একটা সন্তান তুমি আমাকে দাও তোমার কাছে আর আমি কিচ্ছু চাইব না কোনোদিন"।
সুমনার কাতর প্রার্থনা হয়ত প্রভু শুনেছিলেন। একদিন সে বুঝতে পারল সে মা হতে চলেছে। তার আর খুশির ঠিকানা রইল না। দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত সুমনার জীবনে সেই চির আকাঙ্ক্ষিত দিনটি এল। চার দিন ধরে সে ভয়ঙ্কর কষ্ট পেল। বারবার সুমনা অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। সবাই বলছিল এ আর বাঁচবে না। গ্রামের ডাক্তার কিছুই করতে পারলেন না। সবাই আশা ছেড়ে দিল। কিন্তু সুমনা আশা ছাড়েনি। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে চলেছে সে। সন্তানের মুখ না দেখে সে যে মরতে পারে না। তাই অদম্য ইচ্ছা শক্তিতে সে জন্মদিল এক কন্যা সন্তানের। জন্মের পর বাচ্চা কাঁদলোনা সবাই বলল মৃত সন্তানের জন্ম হয়েছে। কিন্তু সুমনা বিশ্বাস করেনি সে কথা। ভগবান এতবড় অন্যায় করতে পারে না তার সাথে তার মনে এই বিশ্বাস ছিল। সে আধা অজ্ঞানতার মধ্যেই বাচ্চাটাকে কোলে টেনে নিয়ে আদর করতে লাগল। মায়ের স্পর্শ পেয়ে যেন প্রাণহীন বাচ্চার ভিতরে প্রাণ ফিরে এল। একটু পরে বাচ্চাটা কেঁদে ওঠল। সে যাত্রায় মা মেয়ে দুজনেই বেঁচে গেল । পাড়ার লোকে বলল মেয়ের জাত তো তাই মরা বাচ্চা বেঁচে গেছে ছেলে হলে বাঁচত না।
যে যাই বলুক না কেন মা তো হাতে স্বর্গ পেয়ে গেছে। তার আনন্দ আর ধরে না। কিন্তু সমস্যা হয়েছে মেয়ের বাবাকে নিয়ে এতদিন বলত বাচ্চা কেন হয় না এখন বলছে মেয়ে কেন হল। মেয়ে হয়েছে বলে বাচ্চাটাকে বাবা ছুঁয়েও দেখে না। মায়ের মনে খুব কষ্ট সে অনেক চেষ্টা করেছে যে মেয়েটিকে তার বাবা কোলে তুলে নিক একবার তাকে দেখুক। মেয়ে তো নয় যেন চাঁদের টুকরো পুরো গ্রামময় মেয়ের রূপের চর্চা। তাতে কি হবে তার বাবাই যদি তাকে না দেখে। সুমনার মনের কষ্ট মনেই রইল। তবে একটা দিকে সুমনার খুব আনন্দ তার শ্বাশুড়ি এই নিয়ে কোনোদিন তাকে কিছু বলেনি ছেলে হোক মেয়ে হোক তাতে কি বৌমার একটা বাচ্চা হয়েছে এই তো অনেক। মাম্পিকে কোলে করে তার ঠাম্মা নিজেকে মহারানী মনে করত । মনে মনে ভাবত তার রাজকুমারীর মত সুন্দর বাচ্চা পৃথিবীতে আর নেই। সংসারের সমস্ত কাজ কর্ম ছেড়ে দিয়ে তিনি মাম্পিকে নিয়েই থাকা শুরু করলেন । মাম্পিই তার ধ্যান-জ্ঞান।
এখন মাম্পি একটু বড় হয়েছে। দুপুর বেলা তার মা তাকে বারান্দায় শুইয়ে রেখেছে। বাড়িতে সেদিন কেউ ছিল না । ওর বাবা বাড়ি এসে দেখে বাচ্চাটা একা রয়েছে কেউ কোথাও নেই। উনি একটু দূরে বসে পড়লেন। আর নিজেই বলতে লাগলেন বাচ্চাটাকে একা রেখে সব গেল কোথায়। মা দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখছিল। একটু পরে মাম্পি খেলতে খেলতে বারান্দার কিনারে এসে গেছে পড়ে যাচ্ছে তখন ওর বাবা খুব ডাকাডাকি শুরু করল "আরে কোথায় গেলে সব এ তো পড়ে যাবে"। মা দেখছে কিন্তু সারা দিচ্ছে না। কেউ যখন এলো না তখন বাধ্য হয়ে বাবাই মাম্পিকে কোলে তুলে নিল। মা জয়ী হল। সেই থেকে মাম্পি বাবারও আদরের ধন হল। মাম্পির মা মাম্পিকে এমন ভাবে মানুষ করেছে কি মাম্পির মেয়ে হয়ে জন্মানোতে যারা একদিন দুঃখ করেছিল তারাই এখন মাম্পির জন্য গর্ব বোধ করে। মাম্পির মা দেখাতে চেয়েছিল ছেলে হোক মেয়ে হোক মানুষের মত মানুষ করতে পারলে সব সন্তানই সমান। ছেলের থেকে মেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মাম্পি সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে। মাম্পির আরো ভাই বোন আছে কিন্তু মাম্পিই তার বাবার কাছে সব থেকে বেশি প্রিয়। আজ মাম্পি মা বাবা কাকা কাকিমা ঠাকুমা দাদু মামা মামি সকলেরই নয়নের মনি।
------------
ঋণস্বীকার, ছবি- ইন্টারনেট।