সোনালী দিনের উপাখ্যান
দেবব্রত ঘোষ মলয়
পূর্ব কথন
অখিলবাবুর মৃত্যুর পরের দিন বাড়িতে মামা, মামী, কাকার উপস্থিতিতে বাড়ির কুলপুরোহিত পারলৌকিক কাজের ফর্দ তৈরি করে দেন। মনন মায়ের কোলে ভেঙে পড়ে কান্নায়।
এদিকে যবনিকা ওঠে ধানসিঁড়ি গ্রামে ...
পর্ব- ৭
ওম জবাকুসুম ...
রাজেন ঠাকুরের উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ ছড়িয়ে যায় গ্রামের আকাশে বাতাসে। পূর্ব দিকের উদীয়মান লাল সূর্যের দিকে জোড়হাত করে দাঁড়িয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন গ্রামের পুরোহিত রাজেনবাবু। তাঁর বাগানের অসংখ্য গাছ থেকে ভেসে আসছে নানা রকম পাখপাখালির কুজন। বাগানের সামনে দিয়ে লাল মোরামের রাস্তা চলে গেছে গ্রাম পেরিয়ে ধান ক্ষেতের দিকে। এখন এই হেমন্তের হাওয়ায় একটা মিষ্টি শিরশির ভাব ভোরের দিকে। এখানে সবাই ভোর ভোর উঠে পড়ে।
ঝিনটি হাতে একটা সাজি নিয়ে ঘুরে ঘুরে ফুল তুলতে থাকে। বাবা নিত্যপুজোয় বসার আগে রোজই ও ফুল তোলে, ঠাকুর ঘর পরিষ্কার করে, বাবাকে সাহায্য করে। আজ রাজেন ঠাকুর লক্ষ করেন মেয়ের মুখ থমথমে। সূর্য নমস্কার সেরে ধীর পায়ে মেয়ের পাশে গিয়ে তিনি জিগ্যেস করেন কোমল স্বরে- ঝিনুক মায়ের আজ মুখে কথা নেই কেন?
এই ঝিনুক নামটি বাবার আদরের নাম। রোজ সকালে এই সময়ে ঝিনুক বাগানে ফুল তোলে আর বক বক করতে থাকে। আজ বাবার প্রশ্নের উত্তরে সে পাল্টা প্রশ্ন করে - আচ্ছা বাবা, মানুষের এত কষ্ট কেন? মানুষ এত অসুখ বিসুখে ভোগে কেন? মারা যায় কেন?
রাজেন ঠাকুর মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত রাখেন। বলেন - জীবনে সুখ এবং দুঃখ পাশাপাশি থাকে। দিনের পরে যেমন রাত হয় তেমনই সুখের অন্তে দুঃখ আর দুঃখের পরে সুখ আসে। কিন্তু মা, আজ হঠাৎ এ কথা কেন?
ঝিনুক বড় বড় দুটি চোখ তুলে তাকায় বাবার দিকে। সে চোখে মুক্ত বিন্দুর দানা ঝিকমিক করে। অস্ফুটে বলে সে - মনদার এখন কত কষ্ট। তার বাবা চিরকালের মত চলে গেল, আমার মায়ের মত। আমাকে একবার কলকাতায় নিয়ে যাবে বাবা, মনদাদার বাড়ি।
অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন প্রাজ্ঞ নিধু ঠাকুর। তিনি মেয়ের চোখে দেখতে পান শ্রী রাধিকার আর্তি। তাঁর মন শঙ্কিত হয়ে ওঠে। কিন্তু সে কথা বুঝতে না দিয়ে তিনি বলেন - মা তুমি তো এখন আর ছোট্টটি নও যে হুট বলতে যেখানে সেখানে যাবে। আমি এখন পুজোয় বসব, তুমি ব্যবস্থা কর।
পুজো শেষ করে বাড়ির প্রশস্ত দালানে বসে চা পান করছেন নিধু ঠাকুর। ঝিনটি নিজেও এককাপ চা হাতে নিয়ে বাবার পাশটিতে চুপ করে বসে তাকিয়ে আছে বাড়ির সামনের বাগানের দিকে, যেখানে ঝাঁকড়া টগর গাছের উপর উড়ছে একঝাঁক প্রজাপতি।
এ সময়েই বাগানের রাংচিত্তর বেড়ার দরজা ঠেলে প্রবেশ করেন মা কালী। মিশমিশে কালো বরণ, চোখের চারপাশে লাল বলয়, লম্বা জিভ বেরিয়ে সামনে, আর পুরুষালি রঙ মাখা চতুর্থ হাতে মস্ত খাঁড়া, যদিও তা লটপট করছে। তার পিছনে একঝাঁক বাচ্ছা।
ঝিনটি কাপ রেখে দৌড়ে গিয়ে মা কালীর হাত ধরে টানতে টানতে সোজা দাওয়ার উপর। নিধু ঠাকুর মৃদু হেসে বলেন - তা কেমন আছো হে শম্ভু? এবার তো অনেক দিন পরে এলে।
শম্ভু বহুরূপী। মাইল পাঁচেক দূরে বেনা গ্রামের বাগদি পাড়ায় তার বাড়ি। সে বহুরূপী। প্রতি বছর পুজোর পরে যখন মাঠের ধান উঠে যায়, চাষের কাজ যায় কমে, তখন গ্রামীন মানুষ মেতে ওঠে নানা মেলা, যাত্রা, তরজা, ছৌ নাচ সহ নানা গ্রামীন বিনোদনে। সে সময়ে এ দিগরের পাঁচ সাতটা গ্রামের মানুষ শম্ভু বহুরূপীকে দেখতে পায়। সে নানা খবরের খনি, সব গ্রামের মানুষই তার স্বজন। কার গাই বাছুর বিয়োলো, কার খড়ের গাদায় আগুন লাগল, কোন পুকুরে বিষ দিয়ে সব মাছ নষ্ট হল, কার মেয়ের বিয়ে হল বা কার বাচ্ছা হল - আনন্দ দুঃখ সব খবর তার ঝুলিতে। গ্রামের মানুষও চালটা, ডালটা, গাছের লাউ, কুমড়ো, পেঁপে, নারকোল সহ নানা সামগ্রীতে তার ঝোলা ভরে দেয়। ছোট থেকে ঝিনটি দেখে আসছে তাকে, এ গ্রামে এলে তাদের বাড়িতে কিছুক্ষন থাকবেই শম্ভুকাকা।
নিধু ঠাকুর বলেন - শম্ভু আজ এখানেই চাড্ডি খেয়ে তারপর যাও।
শম্ভু হাত জোড় করে বলে - আজ তা হবে না ঠাকুরমশাই। কম তো খাই নি এ বাড়িতে। আজ দেউল গ্রামে নিধু মল্লিকের বাড়ি নিমন্ত্রণ। মল্লিক মশাইয়ের নাতি হয়েছে গো।
ঝোলা থেকে চারটি ডাঁসা পেয়ারা বের করে ঝিনটির হাতে দিয়ে বলে শম্ভু বহুরূপী - মা আমার কি মিষ্টি দেখতে হয়েছে। এক্কেবারে লক্ষী পিতিমে। তা মায়ের আমার এবার ঘটকালি করব নাকি?
যাও তো! - লজ্জায় দৌড়ে পালায় ঝিনটি।
সেদিকে তাকিয়ে স্নেহের কণ্ঠে বলেন নিধু ঠাকুর - মা মরা মেয়েটা আমার ছোটটিই থেকে গেল শম্ভু।
তা যাই বলুন ঠাকুরমশাই - শম্ভু উত্তর দেয়, কত মানুষই তো দেখি গ্রামে গ্রামে, আমাদের ঝিনটি মায়ের মত মিষ্টি মেয়ে আমি আর দেখিনি।
বাবা ......
ঝিনটির রিনরিনে গলার তীক্ষ্ণ আর্তনাদে সচকিত হয়ে দুজনেই দৌড়ান রাংচিত্তার বেড়ার পাশে। বেড়ার দরজার ওপারে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে ঝিনটি আর বেড়ার এপারে উদ্যত ফনা তুলে ফোঁস ফোঁস করে আওয়াজ করছে এক বিশালাকৃতি সাপ।
------------
ক্রমশঃ ...